বিয়ের দশদিনের মাথায় সধবা থেকে বিধবা হলো শুভ্রতা। পুরো বাড়ি জুড়ে কান্নার রোল। শুভ্রতার চোখে নেই পানি, শান্ত চাহনিতে সে তাকিয়ে আছে বিয়ের ছবিটির দিকে। হাত রাঙা মেহেদী এখনও যায়নি ভালো করে তার আগেই তার শরীরে লাল শাড়ির বদলে পড়তে হলো সাদা শাড়ি। এখনও চুপ সে। আশের পাশের লোকজন বলাবলি করছে,
-” এই মেয়ের দোষ আছে। আজ ওর জন্যই আকাশের মৃত্যু হলো। অপয়া, অলক্ষ্মী, হতভাগী, শুনেছিলাম জন্মের কয়েক বছর পরেই বাবা মারে খাইছে এই মাইয়া। কেমনে যে তোমরা এই মেয়েকে আকাশের বউ করে আনলে। বিয়ের দশদিন হতে না হতেই তোমাদের ছেলেকে খেয়ে ফেলছে।”
শুভ্রতা চুপচাপ শোনে যাচ্ছে কিন্তু তার চোখে আজ পানি নেই। অন্য সময়ে তো না চাইতেই চোখের পানি চলে আসে কিন্তু আজ আসছে না। কথায় আছে, অল্প শোকে কাতর অধিক শোকে পাথর। আকাশের হাস্যোজ্জ্বল মুখটির দিকে তাকিয়ে আছে শুভ্রতা। যেদিন থেকে তার জীবনে আকাশের ছায়া পড়েছিল সেদিন থেকে তার জীবনের কষ্ট, দুঃখ নিমিষেই উধাও হতে শুরু করেছিল। এত সুখ হয়তো তার কপালে নেই তাইতো জীবন শুরু হবার আগেই সমাপ্তি ঘটে গেলো।
আকাশের মা কান্না করতে করতে দৌড়ে এসে শুভ্রতার চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে রাগী গলায় বললেন,
-” আজ তোর জন্যই আমার আকাশ চলে গিয়েছে আমাদের রেখে। কি যাদু করছিলি তুই আমার ছেলেকে? হাজার বারণ করার পরেও তোকেই বিয়ে করবে বলে সে প্রতিজ্ঞা করেছিল। বাপ মাকে খাইয়ে শান্তি হয়নি তোর এখন আমার ছেলেকে শেষ করলি। আমার ছেলেকে এখন আমার বুকে ফিরিয়ে দে। নাহলে তোকে আর তোর মামা মামীকে পুলিশে দিবো আমি।”
শুভ্রতার চোখে পানির আভাস কিছুটা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পারছে না চেঁচিয়ে কান্না করতে। শাশুড়ি মায়ের কথাগুলো তীরের মত বাঁধছে তার বুকে। হঠাৎ করেই সেন্সলেস হয়ে পরে গেলো ফ্লোরে। আকাশের বোন এসে বলল,
-” সব নাটক এই মেয়ের। শুনছিলাম ওর বাপ মা কি যেন একটা কুকীর্তি করেছিল। বাপ মায়ের সেই নষ্টামির দায় এখন এই মেয়ের উপরে এসে পড়ছে। যে ঘরেই যাবে সব ছারখার করে দিবে।”
শুভ্রতাকে তার রুমে নেওয়া হলো। প্রায় চার পাঁচ ঘণ্টা পর তার সেন্স ফিরে আসাতে চোখ খুলে আবিষ্কার করলো সে নিজের রুমে শুয়ে আছে। গতকাল এই সময়ে সে শুয়ে ছিল আকাশের বুকে কিন্তু আজ,,,,, ভাবতেই তার চোখে চলে আসলো এক সমুদ্র পানি।
কলেজ থেকে ফিরার সময় আকাশের সাথে অস্বাভাবিক ভাবে দেখা হয় শুভ্রতার। প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলে আকাশ। শুভ্রতার সম্পর্কে সব জেনে শুনেই বাবা মায়ের অমতে বিয়ে করে শুভ্রতাকে সে। একমাত্র ছেলে হওয়ায় সব রাগ অভিমান ভুলে গিয়ে মেনে নেয় ছেলে ও ছেলের বউকে। বিয়ের পর শুভ্রতাকে নানান ইঙ্গিতে শায়েস্তা করতে চান আকাশের মা অর্থাৎ আয়েশা বেগম কিন্তু আকাশের ভালোবাসা পেয়ে শাশুড়ির দেওয়া কষ্ট সে মুখ বুজে সহ্য করে নিয়েছে এই কয়দিন। আজ সকালে বালতিতে জামা কাপড় রেখে ছাদে যাচ্ছিল শুকানোর জন্য দরজার কাছে যেতেই আকাশ হেঁচকা টানে বুকের ভিতর মিশিয়ে ঠোঁটে চুমু খেয়ে আদরের সুরে বলেছিল,
-” বিকালে আসবো তোমাকে নেওয়ার জন্য। বিয়ের পর তো আমরা কোথাও ঘুরেনি তাই ভাবছি আজ রাতে আমরা লং ড্রাইভে যাবো। হুটহাট বিয়েতে আমার সম্পর্কে অনেক কিছুই অজানা তোমার আমি চাই তুমি সব জানো। আমার সম্পর্কে জানার পর যদি তুমি আমাকে ভালোবাসো তাহলে সেই ভালোবাসা হবে আমার জীবনের প্রত্যাশিত ভালোবাসা।”
শুভ্রতা মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছিল,
-” আপনার সম্পর্কে যেটুকু জেনেছি তাই আমার জন্য যথেষ্ট। আমার চোখে আপনি একজন ভালো মানুষ। যে লোক সব কিছুকে তোয়াক্কা না করে আমার মত মেয়েকে বিয়ে করতে পারে সেই লোককে আমি চোখ বুজে বিশ্বাস করতে পারি।”☺
-” তবুও আজ তোমাকে আমার সম্পর্কে অজানা কিছু তথ্য দিবো। তাছাড়া আজ তোমার জন্য রয়েছে বিশেষ সারপ্রাইজ। তুমি ভীষণ ভীষণ অবাক হবে শুভ। বিকালে লাল শাড়ি পরে সুন্দর করে সেজে থাকবে আমি এসে একটুও ওয়েট করবো না বলে দিলাম।”
শুভ্রতার চুলে নাক ডুবিয়ে কথাগুলো বলল আকাশ। এমন সময় শাশুড়ি মায়ের চিৎকার শোনে বালতিটা সেখানে রেখেই দৌড়ে ছুটে গেল শাশুড়ি মায়ের কাছে। আকাশ বালতিটা হাতে নিয়ে ছাদের দিকে যেতে যেতে বলেছিল,
–” বড্ড মিস করবো তোমায় শুভ। ভাবছিলাম আজকে একটু আদর করবো কিন্তু ভিলেন মায়ের জন্য পারলাম না।”
আকাশ বেরিয়ে পরলো। শুভ্রতা রান্না ঘরে এসে সকালের আর দুপুরের রান্না করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। আজ সকালে আকাশ না খেয়েই চলে গিয়েছে অফিসে। শুভ্রতা শাড়ির আঁচল টানছে আর ভাবছে কি করে শাশুড়ি মাকে বলবে বিকালে সে ঘুরতে যাবে। তাকে তো উনি দেখতেই পারেন না। মশলা কষানোর জন্য সামান্য পানি দিল পাতিলে। রাজ্যর বিরক্তি নিয়ে আয়েশা বেগম আসলেন। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলেন,
–” আকাশ বলল বিকালে নাকি ঘুরতে বের হবে? রাতে ফিরতে দেরি হবে?
লজ্জা মাখা সুরে বলল শুভ্রতা,
–” জ্বী মা।”
বিরক্তির সুরে বললেন উনি,
–” কি যাদু করেছ তুমি আমার ছেলেকে? আগে যখনি বিয়ের কথা বলেছি ও রাজি হয়নি কিন্তু তোমাকে দেখার পর থেকেই ছেলে আমার দিওয়ানা হয়ে গেল। আমাদের অনুমতি ছাড়াই বিয়ে করে আনলো। যাক সেসব কথা, রাতের জন্য তরকারি কেটে ফ্রীজে রেখে যেও পরে আমি রান্না করে নিবো।”
–” আচ্ছা মা।”
সেদিন বিকালে শুভ্রতা আকাশের পছন্দ অনুযায়ী সেজেছিল। লাল শাড়ি, হাত ভর্তি চুড়ি,টিপ, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, ঝুমকো, চোখে গাঢ় কাজল, বাঁ দিকে সিঁথি করে চুলগুলো খোলা রেখেছিল। আকাশ বলেছে,
–” খোলা চুলে তোমাকে দারুন লাগে। খোলা এলোকেশী চুলের জন্যই তো তোমাকে ভালোবেসেছি আমি।”
আকাশের কথা ভাবছে আর লাজুক হাসছে শুভ্রতা। বিকালে খুব সুন্দর করে সেজে অপেক্ষা করছিল আকাশের জন্য। বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা তবুও আকাশের দেখা নেই। সন্ধ্যার পর আকাশ এসেছিল কিন্তু লাশ হয়ে। রাস্তায় বাইক অ্যাকসিডেন্টে মৃত্যু হয় তার। তারপর থেকেই শুরু হয় শুভ্রতার বিরুদ্ধে বাজে কথা।
সেন্স ফিরে আসার পর দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো রাত সাড়ে একটা। আকাশের জানাজা ছিল রাত দশটায়। তার মানে আকাশের দাফন সম্পন্ন হয়ে গেছে। শেষ বারের মত সে দেখতে পারলো না নিজের স্বামীকে। চিৎকার করে কাঁদতে থাকে সে। শুভ্রতার চিৎকার শোনে আত্মীয়-স্বজন সবাই এসে ভিড় জমালো। আয়েশা বেগম চিৎকার করে বললেন,
–” এতক্ষণ নাটক করে ঘুমিয়ে থেকে এখন আসছে আমার ছেলের জন্য কান্না করতে। এই মেয়েকে যদি এক্ষুনি ঘর থেকে বের করে না দেওয়া হয় তাহলে আমি আত্মহত্যা করবো। এই মেয়ের কারণে আমার ছেলে চলে গেছে কিছুতেই একে আমার সংসারে থাকতে দিবো না। বের হ এক্ষুনি। ওর মামা মামী তো আসেই নাই। আসবেই বা কেন অলক্ষ্মী আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে তারা তো এখন ভেজাল মুক্ত।”
শুভ্রতার চোখের পানিতে কারো মন গলেনি। হাজার মিনুতি সে করেছে শুধু আকাশের স্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য কিন্তু কেউ তাকে আশ্বাস দেয়নি। গভীর রাতে তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে।
পরনে সাদা শাড়ি, নাক,হাত, কান,গলায় থাকা যাবতীয় গয়না সব নিয়ে গিয়েছে আকাশের মা। মামা মামীর বাড়িতে তার জায়গা নেই। এখন একমাত্র রাস্তা হলো মৃত্যু। মেইন রাস্তার মোড়ে এসে চলন্ত গাড়ির নিচে পড়বে বলে ঠিক করেছে শুভ্রতা। রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে। পুরো রাস্তা ফাঁকা। শহর অঞ্চলে এইসময়ে গাড়ি গিজগিজ করে কিন্তু আজ কোনো গাড়িই নেই। হঠাৎ দেখল দূরে একটি গাড়ির লাইট দেখা যাচ্ছে, শুভ্রতা চোখ বুজে মৃত্যুর প্রস্তুতিতে নিয়ে গাড়িটির দিকে এগিয়ে গেলো…..
চলবে,
গল্পঃ প্রেমমোহ পর্বঃ ১
লেখিকাঃ ফারজানা আফরোজ
বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।