তবু মনে রেখো পর্ব-৮

0
5182

তবু মনে রেখো
৮ম পর্ব

আজ প্রায় ২৫ দিন হতে চললো শিমুল এবং ইফতির বিয়ের। এই ২৫ দিনে তাদের সম্পর্কটা যেখানে ছিলো ঠিক সেই জায়গায় রয়ে গেছে। শিমুল অথৈর দেখভালে কোনো ত্রুটি রাখে নি। ইফতি বারবার শিমুলের দিকে পা বাড়াতে যেয়েও আটকে যায়। কোথাও না কোথাও একটা বাধা রয়েই গেছে। ধীরে ধীরে তার মনে যে আলাদা জায়গা তৈরি করে নিচ্ছে শিমুল সেটা খুব ভালো করেই অনুভব করতে পারছে, কিন্তু প্রকাশ করতে চাইছে না। তাই এক কদম শিমুলের দিকে এগিয়েও দু কদম পেছনে সরে যাচ্ছে সে। শিমুলের আজকাল মনটা ভালো নেই, সেদিনের পর থেকে নিহাল তার সাথে একবার যোগাযোগ তো দুরে থাক তার সামনে পর্যন্ত আসে নি। এতো ভালো বন্ধুকে এভাবে হারিয়ে ফেলছে ভাবতেই কেমন জানে নিজেকে অসহায় লাগছে তার। খাওয়ার পর ইফতির রুমে এসে খেয়াল করলো শিমুল রুমে নেই, অথৈ বিছানায় ঘুমাচ্ছে। রুমে আর ওয়াশরুমে না পেয়ে বারান্দার দিকে উঁকি মেরে দেখলো শিমুলের শাড়ির আঁচল দেখা যাচ্ছে। শিমুলের উদাসীনতা আজ যেন খুব চোখে পড়ছে। সাতপাঁচ না ভেবে শিমুলের কাছাকাছি একটু দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো সে। শিমুল ইফতির অস্তিত্ব বুঝতে পেরেও চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। অন্ধকার রাতে সোড়িয়ামের আলোতে শিমুলের মুখটা কোনো নুরের চেয়ে কম লাগছে না। কপালের ছোট ছোট চুল গুলো বারবার চোখ ঢেকে দিচ্ছে। শিমুলের ঠোঁটের নিচের তিলটা আজ ইফতিকে বড্ড আকৃষ্ট করছে। খুব করে ছুয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। নিজের পুরুষত্বকে বহুত কষ্টে সংবরণ করলো। পিনপতন নীরবতা ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করে উঠলো,
– মন কি বেশি খারাপ?
-…..
– যদি খারাপ থাকে তাহলে বলতে পারো। শেয়ার করলে নাকি বোঝ কমে।
– মন খারাপ কিনা সেটাও ঠিক জানি না।
– কেনো বলতো?
– আচ্ছা এমন কি হয়েছে আপনার সাথে যে আপনার প্রিয় বন্ধু আপনার সাথে কথা বলা ছেড়ে দিয়েছে? কোনো কারণে মনোমালিন্য হয়েছে যা চেয়েও আপনি ঠিক করতে পারছেন না?
– হুম, তোমার উপর ও কেউ রাগ করে থাকতে পারে নাকি?
– তাই তো হয়েছে।
– আমাকে কি পুরো ঘটনাটা বলা যাবে?
– বলার তেমন কিছুই নেই। আমার বেস্টফ্রেন্ডকে আমার বিয়ের কথা জানাই নি তাই সে এই ২১ দিন হলো আমার সাথে কোনো রকম যোগাযোগ করছে না।
– ফ্রেন্ডের সাথে দেখা হবার ওয়ে কি?
– হসপিটাল, আমার সাথেই কাজ করে।
– তাইলে তো সল্যুশন খুব সোজা কালকে সকালে হসপিটালে যেয়ে তাকে খুজে বের করবা। তারপর সামনে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করবা প্রবলেম কি? কথা না বললে কোনোদিন কোনোকিছু সলভ হয় না। আর বন্ধুত্ব জিনিসটা এমন যে যত অবহেলা করবা তত জং ধরবে। তুমি তার রাগ পরার অপেক্ষায় আছো, সে হয়তো তোমার রাগ ভাঙ্গানোর অপেক্ষায় আছে। তুমি এক কদম আগালে সে তোমার দিকে তার হাত বাড়িয়ে দিবে। বুঝলেন ডাক্তার সাহেবা?
– হুম, ধন্যবাদ।
– তা আজ তার কি এখানেই থাকবেন নাকি?
– আপনি যান, আমি আসছি।
– বাতাসটা ঠান্ডা, বৃষ্টি হবে। চলো দাঁড়িয়ে থেকো না আর।

ইফতির কথা বলার ধরণ আচারণ আজকাল সব কিছুই যেন শিমুলের ভালো লাগে। তার ভাবনা, চিন্তায় আজকাল যেন এই পুরুষটির আনাগোনা। সম্পর্কটা হয়তো স্বামী স্ত্রীর নয়, তবে বন্ধুত্বটা বেশ হয়েছে। শিমুলের মনে যেন ক্ষীন আশা জন্মাতে লেগেছে, একদিন ঠিক ইফতি তাকে স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবে। তার কোনো ইচ্ছে নেই বকুলের জায়গা দখল করা তবে নিজের জায়গা করে নিতে ক্ষতি কোথায়!!

পরদিন সকাল ১০টা, শিমুল তন্য তন্য করে খুঁজে শেষমেশ ডা. ইশরাত মাহমুদের কেবিনে নিহালকে পেলো। ডা. ইশরাত মাহমুদ গাইনোকোলজিস্ট ডিপার্টমেন্টের হেড। নিহাল উনার আন্ডারেই রয়েছেন। কাল একটি অপারেশনে নিহালে অমনোযোগীতার জন্য একটা বড় বিপদ হতে হতে সামলেছে। তাই খুব বাজে ভাবে বকছেন তিনি নিহালকে।
– যদি এরকম বিহেভিয়ার থাকে, দেন ইউ ক্যান রিজাইন ডা. নিহাল বিন আফরোজ।
– সরি ম্যাম, এরকম আর হবে না।
– হোয়াট সরি? যদি বাই এনি চান্স রোগীর কিছু হতো তুমি এই দায়ভার নিতে? লাইফে সবারই কিছু না কিছু প্রবলেম থাকে৷ পার্সোনাল লাইফের সাথে ডিল না করতে পারলে,ইট উইল হ্যাম্পার ইউর ফিউচার। দিস ইজ ইউর লাস্ট ওয়ার্নিং। মাইন্ড ইট। নাও গো
– ইয়েস ম্যাম।

বের হতেই শিমুলকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে খানিকটা চমকে গেলো নিহাল। তারপর তার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে নিলেই শিমুল তার হাত খপ করে ধরে ফেলে। টানতে টানতে হসপিটালের ট্যারেসে নিয়ে যায় তাকে।
– এখানে নিয়ে এসেছিস কেনো? কি হলো শিমুল কি হয়েছে?
– তোর কি হয়েছে নিহাল? একটু বলবি? বিগত একুশ দিন তুই আমাকে এড়িয়ে গেছিস। কি হয়েছে?
– কি আবার হবে? কিছু না।
– নিহাল আমি আজ থেকে তোকে চিনি না। প্রায় আমাদের বন্ধুত্ব তের বছর হবে। তুই ফাও কথা বললেই তো হবে না। তুই এতই অমনোযোগী ছিলি যে ইশরাত ম্যাম তোকে বকেছে। যেখানে তিনি তোকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসে। ক্যান ইউ টেল মি হোয়াট হ্যাপেন্ড কাইন্ডলি? ফর গড সেক। প্লিজ
– বললাম তো কিছু হয় নি, তারপর কেনো জোর করছিস।
– চিল্লাচ্ছিস কেনো?
– তুই আমাকে এখানে এসব জিজ্ঞেস করতে আনলে আমি বলবো প্লিজ লিভ মি এলোন।
– না পারছি না, একা ছাড়তে পারবো না তোকে। বল না প্লিজ, যদি আমি সলভ করতে পারি
– কি সলভ করবি হ্যা? কি সলভ করবি? ডিভোর্স করবি ইফতিকে? বিয়ে করবি আমায়? আই লাভ ইউ শিমুল। এখন থেকে না বিগত দশ বছর থেকে তোকে ভালোবাসি। সাহস হয় নি বলার। ভেবেছি একটু স্যাটেল হই তারপর বলবো। ইউ নো? আমি পুরো প্রিপারেশন নিয়ে ছিলান তোকে ওই উইকে প্রোপোজ করার। জানবি কিভাবে তুই তো ইফতিকে বিয়ে করার জন্য লাফাচ্ছিলি। এখন বল সলভ করতে পারবি? পারবি না। তুই জানিস ই না এটাকে কিভাবে ডিল করতে হয়। জানলেই না আমাকে বলবি। নিজের ভালোবাসার মানুষটাকে অন্যকারোর কাছে দিতে কতোটা খারাপ লাগে ইউ ডোন্ট নো। ইউ ক্যান্ট ইমাজিন হাউ আই ফিল। সো প্লিজ লিভ মি এলোন।
– আই ক্যান ফিল।

শিমুলের কথায় যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় নিহাল। এতো শান্ত রেসপন্স কখনো আশা করে নি সে। শিমুল শান্তভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন এটা কোনো ইস্যুই না। একটু থেমে আবার বলতে লাগলো,
– আই ক্যান ফিল ইট নিহাল। আই অ্যাম সরি। আমি সত্যি কোনোদিন ভাবি নি, আমার বেস্টফ্রেন্ড আমাকে এতোটা ভালোবাসবে। তবে একটা কথা তুই ভুল বলেছিস আমি কোনো দিন বুঝতে পারবো না ভালোবাসার মানুষটাকে অন্যের কাছে দেয়ার কষ্ট। আমি ছয় বছর ধরে এটা ফিল করে এসেছি।
– মানে?
– ইফতিকে বিয়ে করার কারণ শুধু পুচকু নয়। আরেকটা কারণ ও আছে সেটা হলো আমি ইফতিকে ভালোবাসি। এখন না অনেক আগে থেকে।
– কিহহ?
– হুম মনে আছে ছয় বছর আগে একবার আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। এন্ড আই ওয়াজ ভেরি হ্যাপি। এংগ্যাজমেন্টের দিন বিয়েটা ভেঙ্গে দেয় তারা, কয আই ক্যান্ট বি এ্যা মাদার। কেউ তাদের জানিয়েছে যে আমি কোনোদিন মা হতে পারবো না। সেই ছেলেটা আর কেউ না ইফতি ছিলো।
– তাহলে বকুলের সাথে ওর বিয়ে?
– এক বছর পর বকুল জানায় সে একটা ছেলেকে ভালোবাসে, তারপর দেখা যায় সেই ছেলেটা আর কেউ নয় সেই ছেলেটাও ইফতি। বাবা প্রথমে অনেক আপত্তি করলেও আমি ওদের বিয়ে দেই। আমি ইফতিকে অজান্তেই খুব ভালোবেসে ফেলেছিলাম। কিন্তু বকুলের মুখ চেয়ে নিজের ভালোবাসাকে জ্বলাঞ্জলি দিতে হয়েছে। বেশ কিছুবার জিজ্ঞেস ও করতে ইচ্ছে হয়েছে আমাকে রিজেকশনের কারণ কি আমার অপূর্ণতা নাকি বকুল। বকুল ও যদি আগেই বলে দিতো এই ছেলেকে সে আগের থেকে ভালোবাসে তাহলে আমার ও তখন বিয়ে ভাঙার যন্ত্রণা সহ্য করতে হতো না। পরে জানতে পারি, ইফতি বা বকুল কেউ জানতোই না আমি যে সেই মেয়ে যার সাথে ওর বিয়ে ঠিক হয়েছে। সে আমাকে দেখেও নি, তার বাবা মাই বিয়ে ঠিক করেছে আবার তার বাবা মাই বিয়ে ভেঙেছে। মা-বাবা বকুল আর ইফতির বিয়ের দিন আমার কাছে ক্ষমা চান, তখন বলেন যে আমি যাতে এই কথাটা কাউকে না বলি। ওদের দুজনের সম্পর্কে একটা ফাটল ধরবে। কারণ বকুল আমাকে খুব ভালোবাসে। কিছুদিন আগে যখন তারা বাবার কাছে আমাদের বিয়ের কথা বলেন, বাবা রাজী হতে চান নি। আমিই জোর করে রাজী করিয়েছি। পুচকুর যেমন কাউকে দরকার ছিলো, ইফতির ও ছিলো। আমি ইফতিকে এভাবে অন্ধকারে ডুবে যেতে দিতে পারছিলাম না। আমি এখনো তোর মতোই কষ্ট সহ্য করে যাচ্ছি। তবে এটা তখন সোজা হয়ে যায় যখন ভাবি ওতো আমার বোনকেই ভালোবাসে। নিহাল আমাকে ক্ষমা করে দিস। আমি যদি বিয়েও না করতাম তাহলেও তোকে মেনে নিতে পারতাম না। আমার বেশি বন্ধু নেই, তুই আমার খুব ভালো বন্ধু। এভাবে আমাকে একা করে দিস না। প্লিজ, ভেবে দেখিস।
– আই অ্যাম সরি শিমুল। আমি জানতাম না সরি।
– খিদা লাগছে, খাবো।
– চল।

নিহালের অনুতাপ হচ্ছে, কি বলতে কি বলেছে শিমুলকে। সত্যিই তো শিমুলের যখন এতোদিন বিয়ে ভেঙ্গেছে তখন সে চাইলে মনের কথা বলতে পারতো। অথচ বলে নাই, এখন যখন তার হাত থেকে সুযোগ চলে গেছে তখন সে শিমুলকে কোনঠাসা করছে। শিমুল তাকে বন্ধু হিসেবে কতোটা ভালোবাসে সে তো জানে, তারপর ও এই কাজটা করা তার ঠিক হয় নি। ক্যান্টিনে খাবার খাওয়ার সময় নিহালকে চুপচাপ দেখে শিমুল বলে উঠে,
– তুই কি এখনো আমার উপর রেগে আছিস?
– নারে রেগে থাকবো কেন?
– নিহাল আমি জানি তোর খারাপ লাগছে, অস্বস্তি হচ্ছে কিন্তু এমন কি করা যায় না যে আমরা আজকের দিনটা ভুলে যাই। আমরা এটা ভাবি যে, আমি কখনো জানতাম ই না তুই আমাকে ভালোবাসিস, আর তুই কোনোদিন বলিস ই নি আমাকে। ঠিক যেমন আগে আমাদের বন্ধুত্বটা ছিলো, ঠিক সেভাবে আমাদের বন্ধুত্বটা অটুট রাখতে।
– সরি রে, আমি বুঝি নি যে আমার উদাসীনতা তোকে এতোটা হার্ট করবে। শিওর তো দিতে পারছি না তবে আমি ট্রাই করবো। আর আরেকটা কথা, যদি কোনোদিন ও তোকে ছেড়ে দেয় আমার কাছে তুই চলে আসবি। তখন কিন্তু ছাড় দিবো না।
– সে দেখা যাবে, খা।

বিকেল ৬.৩০ টা, শিমুলের দেরি হয়ে গেছে। একটা ওটি ছিলো। সব শেষ করে বের হতে হতে প্রচুর দেরি হয়ে গেছে। টেনশন হচ্ছে, না জানি অথৈ কি করছে বাসায়। বের হতেই পেছন থেকে ডাক পড়ে,
– শিমুলফুল
– হুম
– সন্ধ্যা হতে চললো, চল আমি বাসায় ড্রপ করে দেই।
– না আমি যেতে পারবো। ইফতি বলেছিলো আসবে, ফোন দিচ্ছি ধরছে না।
– ও হয়তো ব্যস্ত, চলনা। কতোদিন আমার বাইকে উঠিস না।লাস্ট করে ড্রাইভে গেছি মনে আছে?
– ঠিক আছে, মহারাজ যো হুকুম। চল

শিমুল, নিহালের বাইকেই উঠে পড়লো। বাইকে দ্রুত ও হবে। কিন্তু সে জানতো কেউ একজন তার এই দৃশ্যটি নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করবে এবং একটা শুকনো আগুন সেই ব্যাক্তির মনটা একটু একটু করে দগ্ধ করবে।

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here