হুংকার পর্ব-৭

0
4212

#হুংকার
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৭

ইয়ামিন আলমারি থেকে সেই ব্যাগটা বের করলো। সবকিছু ঠিক আছে কি-না চেক করে ঘর থেকে বেরিয়ে ড্রইংরুমে গেল। সোফায় ৪ জন ছেলে বসে আছে৷ জাহিদুর, রওনক, রানা এবং গৌরব। ইয়ামিন ধীরপায়ে হেটে তাদের সামনে গেল। ইয়ামিনকে দেখে তারা চমকে উঠে দাঁড়াল। ইয়ামিন টি টেবিলের উপর ব্যাগ আর মোবাইল রেখে সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“কি ব্যাপার! দাঁড়ালে কেন? বসো তোমরা।”
কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। ইয়ামিন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি জানি তোমরা খুব টেনশনে আছো রাবেয়াকে নিয়ে তাই না? চিন্তা করো না সে একদম ঠিক আছে। তোমরা চেয়েছিলে সে ম*রে যাক। কিন্তু মরে নি।”
সবাই একে অপরের চেহারা দেখছে। জাহিদুর ইয়ামিনের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলল,
“কি..কি বলছেন ভাইয়া? আমরা..আমরা কেন চাইবো রাবেয়া ম..ম*রে যাক। আমরা তো তার জন্য অনেক দোয়া করেছিলাম।”
রানা বলল,
“হ্যাঁ, জাহিদ ঠিক বলছে। রাবেয়া সুস্থ আছে জেনে ভালো লাগলো।”
ইয়ামিন চোখ ছোটো ছোটো করে বলল,
“তোমরা ভালো মতো নাটকও করতে জানো না। কিন্তু আমি জানি। খুব নিখুঁত ভাবে নাটক করে তোমাদের সবাইকে এখানে নিয়ে আসলাম।”
গৌরব ব্যাগের পাশে মোবাইল দেখে বলল,
“তার মানে এতদিন আপনি আমাদের মেসেজ করছিলেন ইলিয়াসের মোবাইল দিয়ে?”
রওনক বলল,
“আমি বলেছিলাম যেতে হবে না। ইলিয়াস কোথায়? উনি আমাদের ফাঁসাবে শুধু। আর নিজের ভাইকে রেহাই দিয়ে দেবে।”
ইয়ামিন কিছু বলবে তার আগেই বাহির থেকে পুলিশ গাড়ির শব্দ ভেসে আসলো। সবার চেহারায় ভয় ফুটে উঠল। বাহিরে তো পুলিশ এখন পালাবে কিভাবে তারা? ইন্সপেক্টর আলী ভেতরে আসলো। ইয়ামিন ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। আলী ভেতরে এসে সবাইকে দেখে ইয়ামিনের দিকে তাকাল।
“হঠাৎ ডাকলে আমায়? সব ঠিক আছে তো?”
ইয়ামিন এক নজর আলীকে দেখে মোবাইলটা হাতে নিয়ে গ্যালারি থেকে একটা ভিডিও অন করে আলীর হাতে দিলো। আলী মোবাইল হাতে নিয়ে চমকে উঠল। ভিডিওটা রাবেয়ার। কিছু নরপি*শাচরা মিলে তাকে শারীরিক অত্যা*চার করছে। আর রাবেয়া নিজেকে বাঁচাতে ব্যস্ত। আকুতি মিনতি করছে কিন্তু কেও তার কথা শুনছে না। ভিডিওর কিছু সিন দেখেই সাথে সাথে নজর সরিয়ে নিল। ইয়ামিন বলল,
“ভিডিওতে যাদের দেখতে পারছেন তারা সামনেই আছে।”
আলী সবাইকে দেখে বলল,
“তাদের ৪ জনকে ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে। তো ভিডিওটা কে করেছে?”
ইয়ামিন আলীর থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে বলল,
“ইলিয়াস”
.
.
ইয়ামিন যা বলেছে রশিদ তাই করলো। আজ রাবেয়াকে ঘুমের ইনজেকশন দেয় নি। আসফিয়া বেগম জায়নামাজে বসে দোয়া করছিলেন। হঠাৎ রাবেয়া নড়েচড়ে উঠল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মা দোয়া করছেন। রাবেয়া তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। মা দোয়া শেষ করে রাবেয়ার দিকে তাকালেন। মেয়েকে তাকিয়ে থাকতে দেখে দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন। দৌড়ে গেলেন রাবেয়ার কাছে। রাবেয়ার মাথায় হাত রেখে কান্নাজড়িত কন্ঠে বললেন,
“মামনি..মামনি তুমি উঠেছো। তুমি ফিরে এসেছো। আমি রশিদকে এখনই ডাকছি।”
মা দৌড়ে কেবিন থেকে বের হলেন। রাবেয়া চুপচাপ শুয়ে আছে। হালকা হালকা ঘুম ভাব আছে তার মধ্যে। শুয়ে থাকতে থাকতে শরীর ব্যাথা হয়ে গিয়েছে তার। কিন্তু উঠতেও পারছে না।

আসফিয়া বেগমকে দৌড়ে রশিদের কাছে যেতে দেখে ইলিয়াস উঠে দাঁড়াল। উনি যে গতিতে দৌড়ালেন জিজ্ঞেস করার সুযোগও পেল না সে। রমজান সাহেবও বসে ছিলেন। স্ত্রীকে এভাবে দৌড়াতে দেখে উনি ভয় পেয়ে গেলেন। মেয়ে ঠিক আছে তো? উনি দ্রুত রাবেয়ার কেবিনে গেলেন। কেও এসেছে বুঝতে পেরে রাবেয়া দরজার দিলে তাকাল। রাবেয়াকে দেখে থমকে গেলেন রমজান সাহেব। রাবেয়া বাবাকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেল। বাবার সম্মুখীন হবে কিভাবে? ভীষণ লজ্জা করছে তার। দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকাল। ইলিয়াস এসে দূর থেকে উঁকি দিয়ে দেখে রাবেয়া নড়ছে। সে ভয় পেয়ে গেল। সে তো জানতো রাবেয়ার কোমা থেকে বের হওয়ার চান্স নেই। রশিদ আর আসফিয়া বেগম দৌড়ে এসে ইলিয়াসের পাশ কাটিয়ে কেবিনে ঢুকলেন। ইলিয়াস কিছু কদম পিছিয়ে গেল। কি করবে এখন সে? ভেতরেও তো যেতে পারবে না। ইয়ামিন নেই। নাহলে তার সাথেই ভেতরে যেত। রাবেয়া পাগলামি করলে সবাই ইয়ামিনকে সন্দেহ করতো। ইলিয়াস এদিক সেদিক থেকে সেখান থেকে চলে গেল।
.
.
মোস্তফা ধীর গতিতে বাইক চালাচ্ছে। সে চায় রাস্তা আজ দেরিতে শেষ হোক। আজ সারাদিন সে উর্মির সাথে প্রেম করে কাটাতে চায়। উর্মি মোস্তফাকে জড়িয়ে ধরে রেখে মোস্তফার পিঠে গাল ঠেকিয়ে রেখেছে। চোখ দুটো তার বন্ধ। তখনই তার মোবাইল বেজে উঠল। চোখ খুলে বিরক্ত হলো। এখন কে ডিস্টার্ব করছে তাদের। উর্মি ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে দেখে “ভাইয়া” নাম ভাসছে। ইচ্ছে করছে না তার ইয়ামিনের সাথে কথা বলতে। মোস্তফা বলল,
“কে কল করছে?”
“ভাইয়া, আমার উনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে না।”
“ও তোমার ভাই হয় উর্মি। রিসিভ করো। এমনও তো হতে পারে কোনো দুঃসংবাদ আছে।”
দুঃসংবাদের কথা শুনতেই উর্মির বুকের বা পাশ মোচড় দিয়ে উঠল। রাবেয়ার কিছু হয়নি তো? দ্রুত রিসিভ করে কানে ধরলো,
“বলুন”
“কোথায় তুমি?”
“মোস্তফার সাথে বাহিরে এসেছি। সব ঠিক আছে তো?”
“মোস্তফাকে নিয়ে বাসায় আসো এখনই।”
“ভাইয়া আমার ভয় করছে সব ঠিক আছে তো? রাবেয়া, রাবেয়া কেমন আছে?”
“আর একটা প্রশ্ন শুনতে চাই না। আসতে বলেছি আসো।”
বলেই ইয়ামিন কল কেটে দিলো। উর্মি থমকে বসে আছে। ভয় করছে তার খুব। মোস্তফা উর্মিকে চুপ থাকতে দেখে ভয় পেয়ে গেল।
“কি হয়েছে উর্মি? সব ঠিক আছে তো?”
“বাসায় চলো, ভাইয়া ডাকছেন আমাদের। জিজ্ঞেস করেছি কি হয়েছে কিন্তু কিছু বলেনি।”
“চিন্তা করো না। ইন শাহ আল্লাহ কিছু হয়নি।”
মোস্তফা বাইকের গতি বাড়িয়ে দিলো।

ইয়ামিন চুপচাপ সোফায় বসে আছে মাথা নিচু করে। আলী সব প্রমাণ দেখে লম্বা নিশ্বাস ফেলল। ইলিয়াসের বন্ধুদের থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আলী ইয়ামিনের দিকে তাকাল। কিছু জিজ্ঞেস করবে? সে বুঝতে পারছে না ইয়ামিনকে কি ভাববে? এতদিন সবাই তার উপর সন্দেহ করছিল। ইয়ামিন মাথা নিচু রেখেই বলল,
“আমি চাই আপনি তাকে হসপিটাল গিয়ে রাবেয়ার সামনে থেকে এরেস্ট করেন।”
আলী নড়েচড়ে বসে বলল,
“এতে তো হসপিটালে ঝামেলা হবে। আপনাদের পরিবারের মানসম্মানের ব্যাপারও আছে।”
“রাবেয়ার ধ*র্ষণের খবর পুরো এলাকায় ছড়িয়ে গিয়েছে। বাজে মানুষরা সব দোষ তার উপর দিচ্ছে৷ রমজান আংকেলের বদনাম হচ্ছে। তো ধ*র্ষকের বদনাম কেন হবে না?”
“সুলতান আংকেল?”
“আমার বাবা সাহসী। উনি সব বিপদের সম্মুখীন হতে জানেন।”
আলী আর কিছু বলল না। দরজা গিয়ে মোস্তফা আর উর্মি প্রবেশ করলো। আলীকে দেখে দুজন আরো চিন্তায় পড়ে গেল। টেবিলের উপর ব্যাগ দেখে উর্মি বলল,
“এটা তো সেই ব্যাগ। আলী ভাইয়া এটার ভেতর রাবেয়ার হিজাব আর মোবাইল দেখেছিলাম আমরা।”
আলী বলল,
“শান্ত হও, বসো তোমরা জরুরি কথা আছে।”
“সব ঠিক আছে তো?”
ইয়ামিন উর্মির দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
“চুপচাপ বসো। আর মনোযোগ দিয়ে শোনো।”
উর্মি তবুও দাঁড়িয়ে আছে। মোস্তফা উর্মিকে সোফায় বসিয়ে নিজেও বসলো। ইয়ামিন কিভাবে কী বলবে বুঝতে পারছে না। খুব এলোমেলো লাগছে তার নিজেকে। লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলা শুরু করলো,
“রাবেয়া হসপিটাল থাকাকালীন আমি বাসায় ফিরে আসি। গাড়ি পার্ক করার সময় ইলিয়াসের গাড়ির দিকে নজর যায়…..

———–

ইয়ামিন ইলিয়াসের গাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়ি লক হলেও কাঁচের ওপাড়ে ড্রাইভিং সিটের নিচে পড়ে থাকা একটা সোনালী রং এর ঘড়ি দেখতে পেল। সে ঘড়িটা চেনে। ঘড়িটা রাবেয়ার। ইয়ামিন দ্রুত ইলিয়াসের ঘরে যায়। তার গাড়ির চাবি নিয়ে এসে গাড়ি খুলে ভেতরে গিয়ে ঘড়িটা হাতে নিলো। চুপচাপ বসে রইল ইয়ামিন। রাবেয়ার ঘড়ি ইলিয়াসের গাড়িতে কী করছে বুঝতে পারছে না। গাড়ির চারপাশে চোখ বুলালো। তার কেন যেন খটকা লাগছে। হঠাৎ চোখ গেল পেছনের সিটের নিচে। একটা গোলাপি রং এর হিজাব দেখা যাচ্ছে। ইয়ামিন পেছনে গিয়ে হাত বাড়াতেই একটা ব্যাগ পেল। ব্যাগের ভেতর রাবেয়ার মোবাইল এবং হিজাব রাখা। ইয়ামিন থমকে বসে রইল। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে তার। দ্রুত ব্যাগটা নিয়ে গাড়ি থেকে বের হলো। ইলিয়াসের উপর তার ভরসা আছে। কিন্তু এসব দেখে তার বুক কাঁপছে। ভাবলো ইলিয়াসের উপর নজর রাখবে। আর এই ব্যাগটা লুকিয়ে রাখবে। ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে ইয়ামিন সেদিন ঘুমিয়ে পরেছিল। পরেরদিন অফিস থেকে ফিরে উর্মি আর মোস্তফাকে বাসায় দেখতে পায়। নিজের ঘরে গিয়েও ব্যাগটা তার চোখে পড়েনি। উর্মি আর মোস্তফা দেখে ফেলে। সে ব্যাগটা নিজের গাড়িতে লুকিয়ে ফেলে৷ তাই আলী বাড়ি সার্চ করেও কিছু পায় না।

সেদিন বাবা আর ইলিয়াস বাসায় আসে। ইলিয়াস ঘুমিয়ে যাওয়ার পর ইয়ামিন তার ঘরে যায়। ইলিয়াস তখন গভীর ঘুমে। ইয়ামিন চুপচাপ পুরো ঘর সার্চ করে কিন্তু কিছু পায় না। ইলিয়াসের মোবাইল চার্জে দেয়া ছিল। মোবাইল হঠাৎ ভাইব্রেট হয়ে উঠল। ইয়ামিনের নজর গেল তার মোবাইলের দিকে। টেবিলের উপর চার্জে রাখা। বার বার ভাইব্রেট হওয়ার কারণে টেবিলের উপর শব্দ হচ্ছে। ইয়ামিন ভাবলো মোবাইল একবার চেক করা যাক। সে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে ইলিয়াসের ওয়াটসঅ্যাপ থেকে বার বার মেসেজ আসছে। তার বন্ধুদের গ্রুপে তারা চ্যাট করছে। কয়েকটা মেসেজ ইয়ামিনের পড়ে চোখে। রাবেয়াকে নিয়ে ছিল মেসেজ গুলো। মোবাইল লক থাকার কারণে ইয়ামিন বুঝতে পারছিলো না তারা কি বলছে রাবেয়ার সম্পর্কে। কয়েকটা মেসেজ তার নজর কেড়ে নিলো। ইলিয়াসের বন্ধু রানার মেসেজ,
“ইলিয়াস রাবেয়ার ভিডিওটা তারাতাড়ি সেন্ড কর৷ আমি তো ভুলতেই পারছি না দিনটার কথা।”
ইয়ামিন ভ্রু কুঁচকালো। কিসের ভিডিওর কথা বলছে রানা? ইয়ামিন ঘুরে ইলিয়াসের দিকে তাকাল। খোটকা লাগছে তার। ইয়ামিন দ্রুত মোবাইল চার্জ থেকে খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। তার এক হ্যা*কার বন্ধুকে কল দিয়ে বলল একটা মোবাইলের পাসওয়ার্ড খুলতে হবে। আর্জেন্ট বাসায় আসতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার বন্ধু এসে হাজির হয় এবং মোবাইলের পাসওয়ার্ড খুলে দেয়৷ বন্ধুর সামনে ইয়ামিন মোবাইল চেক করে না। বন্ধুকে বিদায় দিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে মোবাইল অন করে। বুকের বা পাশ ধুকপুক করছে তার। তার ভাই এই কাজ কিছুতেই করতে পারে না। দোয়া করছে তার সন্দেহ যাতে ভুল হয়।

সন্দেহকে ভুল ভাবাটা ভুল হয়ে গেল। ইয়ামিন ঠাঁই বসে আছে। নিজেকে প্রাণহীন মনে হচ্ছে তার। ওয়াটসঅ্যাপে নানান মেসেজ দেখে তার মাথা হ্যাং হয়ে গিয়েছে। বিশ্বাস হচ্ছে না তার ইলিয়াস এই কাজ করতে পারে। ইয়ামিন একবার ভাবলো কাওকে জানাবে না। ইলিয়াস তার কলিজার টুকরা। নিজের ভাইকে কিছুতেই শা*স্তি পেতে দেবে না। হঠাৎ রাবেয়ার কথা মাথায় আসলো। মেয়েটার সম্পর্কে বাজে বাজে কথা বলছে লোকজন। সেও এক সময় বলেছিল। ইয়ামিন ছোটোবেলা থেকে রাবেয়াকে চেনে। রাবেয়া ভীষণ ভালো মেয়ে। মেয়েটার সাথে এত বড়ো অন্যায় সে করতে পারবে না। ইয়ামিন মোবাইল নিজের কাছে রেখে দিলো। মোবাইলে সব প্রমাণ আছে। কয়েকটা মেসেজ দেখে জানতে পারলো রাবেয়ার মোবাইল জামা ইলিয়াস সময় পেলে জ্বালিয়ে ফেলবে বলে প্ল্যান করেছে। ইয়ামিন ভাবলো ইলিয়াসের বিরুদ্ধে প্রমাণ তো পেয়েছে কিন্তু তার বন্ধুদের ফাঁসাতে হলে আপাতত বিষয়টা গোপনে রাখতে হবে। তাই সে ইলিয়াস হয়ে তাদের মেসেজ করতো।

———-

উর্মির হাত পা কাঁপছে। তার হাতে ইলিয়াসের মোবাইল। মোবাইলে রাবেয়ার ভিডিও চলছে। মোস্তফা কপালে হাত দিয়ে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটুখানি ভিডিও দেখেই তার মাথা ঘুরছে। আলী উর্মির হাত থেকে মোবাইল নিয়ে রেখে দিলো। ইয়ামিন তাকিয়ে আছে বোনের দিকে। উর্মি চোখ তুলে ইয়ামিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“ইলিয়াস এটা করতে পারে না ভাইয়া। ও তো এমন না।”
“এমন ছিল না। একটা মানুষকে পরিবর্তন হতে দু মিনিটও সময় লাগে না।”
উর্মি আর কি বলবে ভেবে পেল না। মোস্তফা ইয়ামিনকে বলল,
“তুমি সব জানতে, আমাদের বলো নি কেন?”
“যাতে তোমরা কেও ইলিয়াসের সামনে অস্বস্তি না হও।”
“আমরা তোমাকে সন্দেহ করছিলাম ইয়ামিন।”
“আমিও তো তোমাকে সন্দেহ করেছিলাম। সব সন্দেহ সত্যি হয় না।”
উর্মি বলল,
“ইলিয়াস কেন করলো এটা? ও তো রাবেয়াকে ভালোবাসে। আমাকে বলেছে ও রাবেয়াকে বিয়ে করবে।”
“ইলিয়াস রাবেয়াকে মা*রার প্ল্যান করেছিল।”
উর্মি চমকে উঠল। ইয়ামিন লম্বা নিশ্বাস ফেলে আবার বলল,
“সে ভেবেছিল সময় বুঝে রাবেয়াকে মে*রে ফেলবে যাতে সে স্টেটমেন্ট দিতে না পারে। আমি কিছু বুঝতে না পেরে রশিদকে বলেছি সবাইকে বলতে রাবেয়া কোমায় চলে গিয়েছে। আসলে রাবেয়া একদম সুস্থ আছে।”
“ইলিয়াস এত নিচে নামতে পারে ভাইয়া? আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে খুব। মনে হচ্ছে এটা একটা দুঃস্বপ্ন। এখনই ভেঙ্গে যাবে। আর দেখবো সব ঠিক আছে। ইলিয়াস কিছু করেনি৷ সে নির্দোষ।”
“ঠিক বললে। আমারও মনে হচ্ছে এটা একটা দুঃস্বপ্ন।”
সবাই চুপ হয়ে গেল। কারো মুখে সাড়াশব্দ নেই। উর্মি নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে। মোস্তফা তাকে থামাচ্ছে না। তার কাছে শান্তনা দেয়ার মতো শব্দ নেই। আলী কব্জি উল্টে ঘড়ির সময় দেখে বলল,
“চলুন সবাই হসপিটাল যাই। ইলিয়াসকে এরেস্ট করতে হবে।”
.
.
রাবেয়া আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রেখেছে আসফিয়া বেগমকে। সুলতান সাহেব আর রমজান সাহেব একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। রাবেয়াকে কেও কিছু জিজ্ঞেস করেনি সেইদিনের সম্পর্কে। রশিদ বলেছে তাকে মানসিক চাপ না দিতে। রাবেয়া মাথা তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,
“তাদের পুলিশ ধরেছে আম্মু?”
আসফিয়া বেগম চোখ ঘুরিয়ে উনার স্বামীর দিকে তাকালেন। রমজান সাহেব হাসিমুখে বললেন,
“মামনি স্যুপ খাবে তুমি? কেন্টিনে খুব মজাদার স্যুপ পাওয়া যায় জানো?”
রাবেয়া ঘাড় ঘুরিয়ে বাবার দিকে তাকাল। বাবার সাথে কথা বলতেও অস্বস্তি হচ্ছে তার। সাথে তার সুলতান আংকেলকে দেখে আবার মায়ের বুকে মুখ লুকালো। আসফিয়া বেগম জোরপূর্বক হাসি দিয়ে রাবেয়ার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
“হ্যাঁ, আমার মেয়ের জন্য স্যুপ নিয়ে আসেন। আমি নিজের হাতে তাকে খাইয়ে দেবো।”
রাবেয়া আবার মুখ তুলে বলল,
“আমি খাবো না আম্মু। যদি স্যুপে নে*শা মিশিয়ে দেয়।”
“নে*শা?”
আসফিয়া বেগম কিছু বুঝতে পারছে না। তখনই কেবিনের দরজা ঠেলে আলী আসলো। রাবেয়া চমকে উঠল হঠাৎ কেও আসায়। আলী রাবেয়াকে দেখে নিশ্চিন্তের নিশ্বাস ফেলল। ইয়ামিন বলেছে রাবেয়া ঘুম থেকে উঠে গেলে তার ক্ষতি করার চেষ্টা করবে ইলিয়াস। উর্মি, মোস্তফাও আসলো। এত লোকজন দেখে রাবেয়ার ভয় করছে। আরো শক্ত করে মাকে জড়িয়ে ধরলো। উর্মি রাবেয়াকে দেখে ধীরপায়ে হেটে আসলো। রাবেয়া উর্মির দিকে তাকিয়ে আছে। উর্মি জোরপূর্বক হাসি দিয়ে বলল,
“ভালো লাগছে তোমাকে সুস্থ দেখে। জানো কত টেনশনে ছিলাম আমরা৷”
রাবেয়া কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল,
“তোমরা যাও। তোমাদের দেখে ভয় করে আমার।”
“আমি কি করেছি? আমি না তোমার বেস্টফ্রেন্ড?”
“কেও কারো বেস্টফ্রেন্ড না। সবাই শুধু প্রতারণা করতে জানে। যাও তুমি এখান থেকে।”
“ইলিয়াসের শা*স্তি তুমি আমাকে দেবে রাবেয়া?”
ইলিয়াসের নাম শুনে রমজান সাহেব, সুলতান সাহেব আর আসফিয়া বেগম চমকে উঠলেন। রাবেয়া ফুপাতে ফুপাতে শব্দ করে কেঁদে উঠল। উর্মি এগিয়ে এসে রাবেয়ার পাশে বসে কান্না করতে করতে বলল,
“আমি কীভাবে তোমার থেকে মাফ চাইবো বুঝতে পারছি না।”
আসফিয়া বেগম বললেন,
“কি হয়েছে বলবে তো আমাদের।”
তখনই ইয়ামিন আসলো। কেবিনে চোখ বুলিয়ে বলল,
“ইলিয়াস কোথায়?”
রাবেয়া ইলিয়াসের নাম শুনে এদিক সেদিক দেখে বলল,
“ইলিয়াস..ইলিয়াস আমাকে মা*রতে আসবে। সে লুকিয়ে আছে নিশ্চয়ই। মে*রে ফেলবে আমাকে। আম্মু ইলিয়াস মে*রে ফেলবে আমাকে।”
আসফিয়া বেগম মেয়েকে জাপ্টে ধরে বললেন,
“কি আবল তাবল বলছো? ইলিয়াস কেন তোমাকে মা*রবে?”
“মা*রবেই তো। জানো আমি.. আমি যখন তাকে থাপ্পড় দিয়ে পালিয়ে আসতে নিয়েছিলাম আমাকে অনেক মে*রেছে। আমাকে হাতে গলায় পিঠে অনেক মে*রেছে অনেক। বেল্ট দিয়ে মে*রেছে আমি অনেক ব্যথা পেয়েছি।”
বলেই রাবেয়া আরো জোরে কেঁদে উঠল। ইয়ামিন শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাবেয়ার দিকে। রশিদও আসলো। আলী সবার উদ্দেশ্যে বলল,
“রাবেয়ার রে*প ইলিয়াস এবং তার বন্ধুরা মিলে করেছে।”
চারপাশ হঠাৎ থমকে গেল। সবার মনে হচ্ছে তারা এমন কিছু শুনেছে যেটা অসম্ভব। এটা হতেই পারে না। সুলতান সাহেব তাকিয়ে আছে আলীর দিকে। ইয়ামিন বাবার সামনে এগিয়ে গিয়ে বাবাকে ধরে বলল,
“আপনি বসুন, পুরো কথা শুনুন আমার।”
সুলতান সাহেব ইয়ামিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“মজা করছে ইন্সপেক্টর আলী?”
আলী বলল,
“না আংকেল, আমার কাছে সব প্রমাণ আছে। ইলিয়াসের বন্ধুদের এরেস্ট করেছি। এখন শুধু সে বাকি।”
ইয়ামিন আলীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“সবার সামনে একবার রাবেয়ার স্টেটমেন্ট নিয়ে নাও।”
“ঠিক আছে।”
আলী এগিয়ে গেল। রাবেয়া তাকে দেখে কাঁপছে। আলী কিছুটা দূর থেকেই রাবেয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
“মিস রাবেয়া, আমি জানি আমার এই প্রশ্নটা আপনাকে কতটা কষ্ট দিতে পারে। কিন্তু আমার এটা জানা খুব প্রয়োজন। আপনি কি আপনার ধ*র্ষকদের চিনেন?”
রাবেয়া মাকে জড়িয়ে ধরে আলীর দিকে তাকিয়ে আছে। উর্মি রাবেয়ার মাথায় হাত রেখে বলল,
“আমরা সবাই তোমার সাথে আছি। ওয়াদা করছি সে শা*স্তি পাবে।”
রাবেয়া উর্মিকে এক নজর দেখে আলীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“ইলিয়াস”
কিছুক্ষণের জন্য আবার থমকে গেল পরিবেশ। আসফিয়া বেগম ঠাঁই বসে থেকে মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছেন। রাবেয়া নাক টানতে টানতে আবার বলল,
“যাকে ছোটোবেলা থেকে ভাইয়া ডেকে এসেছি। যে আমাকে এক সময় নিজের বেস্টফ্রেন্ড বলতো। জানি না সেদিন তার কি হয়ে গিয়েছিল। কখনো এত বাজে ব্যবহার করেনি আমার সাথে। বলেছিলাম তাকে, ভাইয়া আমি রাবেয়া। তোমার ক্রা*ইম পার্টনার। তোমার বেস্টফ্রেন্ড। আমরা একসাথে বড়ো হয়েছি। সে শুনে নি আমার কথা। তার বন্ধুদের বাজে বাজে কথায় সেও সাড়া দিয়েছে।”
রাবেয়া মুখে হাত দিয়ে আবার কেঁদে উঠল। সুলতান সাহেবের মনে হচ্ছে উনার নিশ্বাস এখনই বন্ধ হয়ে যাবে। পুরো শরীর ছেড়ে দিলেন উনি। ইয়ামিন উনাকে জাপ্টে ধরে চেয়ারে বসালো। রশিদের দিকে তাকিয়ে বলল,
“রশিদ আব্বুকে দেখ। হয়তো প্রেশার হাই হয়ে গিয়েছে উনার।”
রশিদ দ্রুত গেল প্রেশার মাপার মেশিন নিয়ে আসতে। সুলতান সাহেব ঘনঘন নিশ্বাস নিতে নিতে বললেন,
“ইলিয়াস এটা কি করলো ইয়ামিন? আমার শিক্ষা তো এমন না। আমি তো তোমাদের খারাপ শিক্ষা দিই নি।”
ইয়ামিন জবাব দিলো না। রশিদ এসে উনার প্রেশার চেক করতে লাগলো। ইয়ামিন দাঁড়িয়ে আলীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“ইলিয়াস নিশ্চয়ই পালিয়েছে। আশা করছি তুমি রাবেয়ার ধ*র্ষককে এখন পাতাল থেকে হলেও খুঁজে নিয়ে আসবে।”
“আমি আমার সম্পূর্ণ চেষ্টা করবো। আর আমি জানি, আমি তাকে নিশ্চয়ই খুঁজে পাবো।”
বলেই আলী কেবিন থেকে বেরিয়ে গেল। ইয়ামিন রাবেয়ার দিকে তাকাল। রাবেয়া মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। ইয়ামিন দৃষ্টি ফিরিয়ে নিলো।

চলবে……..

[যারা যারা ইলিয়াসকে সন্দেহ করেছিলেন তাদের অভিনন্দন। আপনারা সঠিক ছিলেন। প্রথম থ্রিলার গল্প এটা আমার। তাই ভীষণ ভাবতে হয়েছে। আপনাদের কনফিউশান দেখে সন্তুষ্ট হয়েছি। গল্পের থ্রিলিং পার্ট আজ শেষ হলো। নিজের অনুভূতি জানাতে ভুলবেন না❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here