জীবন মানে তুমি পর্ব:১৬

জীবন মানে তুমি
লেখিকা:H.B.Irini Ori
(৫৮)
টানা দু’ঘন্টা ধরে ইয়ারাবী শাওয়ারের নিচে বসে আছে।হয়তো কান্নাও করছে,কেননা শাওয়ারের পানি আর চোখের পানি মিলে একাকার হয়ে গেছে।গাছ থেকে পাতা ঝরার আগে যেমন পাতার রং পাল্টে যায়,তেমনি মানুষ বদলানোর আগে রুপ বদলে যায়।আবরার আজ সেই রুপটা দেখিয়েছে।
বিকালের দিকে ইয়ারাবী ঘুমাচ্ছিলো,হঠাৎ আবরার ওকে টান দিয়ে উঠায়।আচমকা উঠাতে ওর মাথা ঠিকমত কাজ করেনা।আরো চমকে যায় যখন আবরার ওকে প্রশ্নটা করে।
ইয়ারাবী আবরারের দিকে তাকিয়ে একটু হলেও বুঝতে পারে কিছু নিয়ে রেগে আছে।আবরার নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বলে,
-“তুমি কী কাউকে ভালোবাসো?”
ইয়ারাবী ওর কথা শুনে অবাক হয়ে যায়।আবরার এক ঝটকায় ওকে টান দিয়ে বেড থেকে উঠায় আর ওর মুখটা শক্ত করে চেপে ধরে চিল্লিয়ে বলে,
-“এন্সার মি,কী হলো কথা কী কানে যায়না?”
-“ক্ কী ব্ ল লছেন এসব?আমি ক্ কাকে ভালোব্ বাসবো?”
আবরার জোরে একটা চড় মেরে দেয়।চড়ের মাত্রা অনেক বেশি থাকায় ও বেডের উপর পরে যায়,তলপেটে অনেকটা চাপ লাগে।কিন্তু ও একটা শব্দও করেনা।আবরার ওর সামনে ফোনটা ছুড়ে মারে।ও ওর কাঁপাকাঁপা বামহাতে ফোনটা উঠিয়ে দেখে আননোন নাম্বার থেকে একটা ম্যাসেজ এসেছে:
“ইয়ারাবীর বিয়ের পর আমাকে ভুলে গেলে,এতগুলো বছরের ভালোবাসা শূন্যে মিলিয়ে দিলে।হতে পারে তুমি আমাকে এখন অস্বীকার করবে তাই প্রমাণ স্বরুপ কিছু ছবি দিলাম আমাদের সোনালি দিনের।ও এখনো কিন্তু তোমার ভালোবাসি,আই লাভ ইউ…”
ফোন স্ক্রোল করে কিছু ছবি দেখতে পায়।একটা ছেলেকে ও জড়িয়ে ধরে আছে,ওর হাতে খাচ্ছে,ওর হাত ধরে পার্কে হাঁটছে।ছবিগুলো দেখে মনে হচ্ছে দুই-তিন বছর আগের।ছবিটার মেয়ে ও কিন্তু ছেলেটা কে ও জানেনা।আবরার ওর বাম হাতের বাহু শক্ত করে ধরে বলে,
-“এখনো বলবে তুমি,বলো কে এই ছেলে?কী এর পরিচয়?ইয়ারাবী কিছু জিজ্ঞাস করছি তোমাকে বলো কে এই ছেলে?”
ইয়ারাবী চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।যদিও এসবের কিছু জানেনা তবুও ওর মনে হচ্ছে সাফাই দিলেও আবরার বিশ্বাস করবেনা।কেননা এর আগেও ওর সাথে এসব হয়ে আসছে।ওর চুপ থাকতে দেখে আবরার ওকে ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে চলে যায়।
শরীরে অসম্ভব ব্যাথা করছে কিন্তু মনের ব্যাথার কাছে এই ব্যাথা কিছুইনা।আবরারের একটু ছোঁয়ায় পুরানো ক্ষতগুলো কিছুটা মুছার চেষ্টা করছিলো কিন্তু তারই ছোঁয়ায় আবার জেগে উঠলো।আবরার ও বাকী সবার মতো ওকে ভুল বুঝলো।জীবন্ত লাশের মতো বেঁচে ছিলো,তাহলে দূরে যখন ঠেলে দিবে পুনরায় বাঁচার স্বপ্ন কেন দেখালো।মুখোশের আড়ালে মুখোশ,খারাপটাকে বের করার আগে কিছু ভালো দেখায়।নাকী সব ওর ভাগ্যের দোষ,যে কোনোদিন ওর কপালে সুখ লেখা নেই।রাত এগারোটা বাজে,শাওয়ারের নিচে বসে নানান কথা চিন্তা করছিল।হঠাৎ কারোর শব্দে ওর হুশ আসে।ভালো করে শুনে বুঝে এটা জারবার গলা।ও ওয়াশরুমের দরজায় নক করছে আর বলছে,
-“ছোটভাবী তুমি কী এখন শাওয়ার নিচ্ছো?কথা বলছনা কেন,ঠিক আছো তুমি?”
-“আ আমি ঠিক আছি জারবা।”
-“রাতে তো ডিনারও করলেনা।মম তোমার আর ভাইয়ার খারাব পাঠিয়েছে… রুমে রেখেছি,খেয়ে নিবে।”
-“জারবা আমার একটা কাজ করে দিবে?”
-“বলো ছোটভাবী?”
-“বলছি আমার ড্রেস আনতে মনে ছিলোনা,প্লীজ তুমি কার্বাড থেকে একটা ড্রেস বের করে দিবে?”
-“প্লীজ কেন বলছো বলতো,তুমি ওয়েট করে আমি বের করে দিচ্ছি।”
জারবা ওকে একটা ড্রেস বের করে দিয়ে রুম থেকে চলে যায়।ইয়ারাবীর পুরো শরীরটা অবাসের মতো হয়ে গেছে।ও আসতে করে দাঁড়িয়ে ড্রেসটা পরে বাইরে বেরিয়ে আসে।চুল থেকে টপটপ করে পানি ঝড়ছে,বাইরে ঠান্ডা বাতাস বইছে।ও তার মধ্যে অন্ধকারে বেলকনিতে যেয়ে নিচে একপাশে হাটুতে মুখ গুজে বসে আছে।
আবরার বিকাল থেকে ল্যাবে ছিলো।ওর ছবিগুলো দেখে বেশি রাগ লাগছিলো।আরো বেশি রাগ লাগছিলো যে ইয়ারাবী নিজের পক্ষ থেকে কোনো প্রতিবাদ করেনি।ওর রাগ কিছুটা কমলে ও বুঝতে পারে কতটা ভুল করেছে,ইয়ারাবীকে মেরে।রাতে ও বাসায় ফিরে আসলে নিচে ওর মায়ের সাথে দেখা হয়।
-“মম রাত বারোটা বাজে,তুমি এখনো জেগে আছো?”
মিসেস রায়হান হেসে বলেন,
-“সন্তানরা যখন বাইরে থাকে তখন মায়ের চোখে ঘুম আসেনা”
আবরার ভালো করে তাকিয়ে দেখে সোফায় ওর মা বসে আছে আর ওনার কোলে মাথা রেখে মেঘ শুয়ে বই পড়ছে।আর জারবা সোফায় বসে টিভি দেখছে আর কিছু খাচ্ছে।আবরার ওর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোমার ব্যাপার না হয় বুঝলাম,কিন্তু এই দু’টা বাদর এখানে কেন?লেখাপড়া নাই।”
মেঘ আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ভাইয়া মিথ্যা অপবাদ দিয়েনা, আমি পড়ছি কিন্তু।”
জারবা ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ভাইয়া তোমাদের খাবার রুমে দিয়ে এসেছি..”
-“তোমাদের মানে?”
-“তোমার আর ছোট ভাবীর,ডিনারের সময় ডাকতে গিয়েছিলাম বললো খাবেনা।আচ্ছা ভাইয়া তোমাদের মধ্যে কিছু হয়েছে নাকী?”
-“আমাদের মধ্যে কী হবে?”
-“তুই জানিস মেয়েটা কিছু খায়নি,নয়টার দিকে তোর ভাবী ওকে ডাকতে যেয়ে দেখে ও শাওয়ার নিচ্ছিলো,আবার জারবা এগারোটার দিকে যেয়ে দেখে ও তখনো ওয়াশরুমে।এমন করলে তো মেয়েটা অসুস্থ হয়ে পরবে।”
আবরার ওর মায়ের কথা শুনে সাথে সাথে রুমে যেয়ে দেখে পুরো রুম অন্ধকার হয়ে আছে হয়ে আছে।হঠাৎ বেলকনি থেকে ফোনের আওয়াজ আসে,ও বেলকনিতে যেয়ে দেখে ইয়ারাবী হাটু ভাজ করে মুখে গুজে বসে আছে,বাতাসের সাথে সাথে কেঁপে উঠছে।আবরার ওর কাছে যাবে তখনি ইয়ারাবীর ফোন বেজে উঠে।ইয়ারাবী ফোনটা রিসিব করে কাঁপাকাঁপা গলায় সালাম জানায় আর বলে,
-“ইরাক ভ্ ভাইয়া,তুমি এই সময় কল কেন করেছো?”
-“……”
-“না আমি ঠিক আছি,আমার ক্ কী হবে?”
-“…….”
-“ভাইয়া,আই ওয়ান্ট ডাই..”
কথাটা বলেই ইয়ারাবী কান্না করতে থাকে।ওপাশ থেকে ইরাক কী বলছে কী শুনতে পারছেনা আবরার।তারপরও ইয়ারাবী কী করে দেখার জন্য একপাশে বুকে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকে।ইয়ারাবী চোখমুছে ওর ভাইকে ঘটনাটা খুলে বলে শুধু আবরারের ব্যাবহার ছাড়া।
-“…….”
-“ন্ না ভাইয়া,উনি জানেন না।আমি জ্ জানিনা ছেলেটা কে বাট্ এ এটা প্ পিয়াস নয়।ভাইয়া এ সব আমি আর ন্ নিতে পারছিনা,ছোট থেকে এসব ক্ করতে করতে আমি সত্যিই ক্লান্ত হয়ে গেছি।”
-“…….”
-“ঠিক আছে,না প্রমিস্ এমন কিছু করবোনা।ভাইয়া,এ্ একটা কথা কী জানো?জীবন্ত লাশ কখনো মরেনা,মরে যায় তাদের স্বপ্নগুলো।”
ফোনটা কাঁটতেই ইয়ারাবী কান্নায় ভেঙে পরে।আবরারের বুকটা ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে।ও ওকে না মারলেও পারতো,ঠান্ডা মাথায় ব্যাপারটা মিটাতো।আবরার একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেলকনির লাইটটা জ্বালায়।আলো দেখে ইয়ারাবী মুখটা তুলে সামনে তাকিয়ে দেখে আবরার দাঁড়িয়ে আছে।ও আবরারকে দেখে অনেকটা ভয় পেয়ে যায়।ওকে দেখে দেওয়ালের সাথে একদম মিশে যেয়ে বসে।আবরার খেয়াল করে দেখে ওর চুলের পানি পরে ও জামাটা পুরো ভিজে গেছে।ঠোঁটের একপাশে কেঁটে গেছে।
আবরার যত ওর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ও ততো পিছানোর চেষ্টা করছে কিন্তু ফলস্বরুপ শুন্য।কেননা পিছানোর কোনো জায়গা নেই।আবরার ওর সামনে হাটু গেরে বসে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দেয় আর বলে,
-“সরি,আমি আসলে তোমাকে হার্ট করতে চাইনি বাট্ রাগটা এতটা বেড়ে গেছিলো যে কন্ট্রল করতে পারিনি।”
ইয়ারাবী কোনো কথা না বলে চুপ করে আছে।আবরার ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“তোমার ভাইয়াকে বললে না কেন আমি তোমাকে মেরেছি?”
ইয়ারাবী এবারও চুপ করে আছে।আবরার বুঝতে পারছে সহজে ও কথা বলবেনা।হঠাৎ ও ইয়ারাবীকে কোলে তুলে নেয়।ইয়ারাবী অবাক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে।আবরার ওকে রুমে নিয়ে এসে বেডে বসায়।রুমের লাইটটা জ্বেলে কাবার্ড থেকে রাতের একটা পোশাক বের করে ওর হাতে দিয়ে বলে,
-“আমি বেলকনিতে যাচ্ছি,এটা চেন্জ করে নাও।জাস্ট দু’মিনিট পরে এসে দেখি তুমি যেনো চেন্জ করেছো।”
কথাটা বলে আবরার রুম থেকে বের হয়ে যায়।ইয়ারাবী কোনো কথা না বলে ড্রেসটা চেন্জ করে নেয়।আবরার রুমে এসে একটা মলম বের করে ওর মুখের বামপাশে আর ঠোঁটের কোনে লাগিয়ে দেয়।তারপর খাবারটা নিয়ে ওর মুখের সামনে ধরে বলে,
-“এত অবাক হওয়ার কোনো দরকার নেই,আমি মারবো আবার আদরও করবো।সুতরাং চুপচাপ খাবার খেয়ে নাও মেডিসিন নিতে হবে।”
ইয়ারাবী মাথা নিচু করে আস্তে করে বলে,
-“আমি খাবোনা….”
-“”না” শব্দটা আমার একদমই পছন্দ নয়।আর আমি তোমাকে ম্যাসেজ আর ছবির জন্য মারিনি,মেরেছি তোমার জন্য।”
ইয়ারাবী ওর দিকে তাকায়।ও আসলে বুঝতে পারছেনা আবরার কী বলতে চাচ্ছে।আর বিকালের আবরার আর এখনকার আবরারের মধ্যে অনেক তফাত দেখছে।ক্ষণিকের জন্য সেই আবরার খুবই ভয়ানাক ছিলো।আবরার ছোট করে পরাটা ছিরে একটু মাংস নিয়ে ওর মুখে দিয়ে বলে,
-“দেখ ম্যাসেজ আর ছবি দেখে রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। কেননা কোনো স্বামী চাইবেনা তার স্ত্রীর এমন কোনো কিছু দেখুন।আমার রাগটা তো তখন বেড়েছিলো যখন তুমি নিজের হয়ে একটা কথাও বললেনা।”
ইয়ারাবী মুখের খাবারটুকু খেয়ে বলে,
-“বললে কী বিশ্বাস করতেন?জানি আপনিও সবার মতো করতেন না,তাই কিছু বলিনি।”
-“একবার বলেই দেখতে,বিশ্বাস-অবিশ্বাস সেটা পরের ব্যাপার।”
আবরার আর কোনো কথা না বলে ওকে খাবারটা খাইয়ে নিজেও খেয়ে নেও।তারপর নিচে ফোন করে একগ্লাস গরম দুধ আনতে বলে কাবার্ড থেকে কাপড় বের করে ওয়াশরুমে চলে যায়।এর ভিতর একজন সার্ভেন্ট এসে দুধ দিয়ে খালি প্লেটগুলো নিয়ে যায়।
আবরার ফ্রেস হয়ে এসে দেখে ইয়ারাবী চুপ করে বসে আছে।আবরার ওর কাধে হাত রাখতেই ও লাফিয়ে উঠে।ও কিছু মেডিসিনে আর দুধের গ্লাস ইয়ারাবীর হাতে দিয়ে বলে,
-“খেয়ে নাও..”
-“আমার দুধ খেলে বমি পায়…”
-“কিছু হবেনা খাও,”
ইয়ারাবী হাফ গ্লাস মতো দুধটা খেয়ে শুয়ে পরে।আবরার ওর পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলে,
-“ছেলেটা কে ছিলো ইয়ারাবী? “
-“আমি সত্যি জানিনা ওকে?শুধু আমার ভাইয়াদের ছাড়া কোনোদিন কোনো ছেলের ক্লোজলি হয়নি।হ্যাঁ,ফ্রেন্ডশিপ করেছি কিন্তু কোনোদিন বাইরে ঘুরিনি।শুধুমাত্র ভার্সিটিতে উঠে মেঘদের সাথেই কিছুটা ক্লোজ।বিশ্বাস ক্ করুন আমার জানিনা।”
-“যদি নাই চেনো তাহলে ছবিগুলো কোথার থেকে এলো?”
-“ওই ছবিগুলো সিলেটের। আমি শুধু খালামনিদের সাথে একবার ওখানে গেছিলাম।”
-“তোমার মেজো খালার কথা বলছো,ইরাক ভাইয়ারা।”
-“হ্যাঁ,ওনারা ছাড়া কখনো কোথাও ঘুরতে যেতে পারতাম না।”
-“যদি তুমি ছবিগুলো না চেনো তাহলে এলো কোথার থেকে?”
-“আপনিও ওদের মতো,জানতাম বিশ্বাস করবেন না।”
-“ঘুমিয়ে পরো,তোমার ঘুমের দরকার।”
ইয়ারাবীর মনে এক প্রকার ভয় সৃষ্টি হচ্ছে আবরারের শান্তভাবে কথা বলার জন্য।ও ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠছে।আবরার প্রতিরাতের মতো দোয়া পরে ওকে ঝেড়ে দেয়।বিকাল থেকে কান্না করতে করতে ও অনেকটা ক্লান্ত হয়ে পরেছে,তাই আর বেশিক্ষণ জাগতে না পেরে ঘুমিয়ে যায়।ইয়ারাবী ঘুমিয়ে গেলে আবরার ওর ফোনটা নিয়ে নাম্বারটা নিজের ফোনে নেয়,আর ছবিগুলো ভালো করে দেখতে থাকে।ছবিটা দেখে বুঝা যাচ্ছে ওর বয়স তখন ১৫-১৬ বছর হবে।
(৫৯)
মাঝরাতে আবরারের ফোনে একটা কল আসে।আবরার খানিকটা হেসে ফোনটা রিসিব করে।ওর হাসি দেখে মনে হচ্ছে জানতো কলটা আসবে।কেননা কলটা আর কেউ নয় ইরাক করেছে।ও রিসিব করার সাথে সাথে ওপাশ থেকে ইরাক ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠে,
-“তুই জেনেশুনে পিচ্চির গায়ে কেন হাত তুলেছিস?আমি তোকে বলেছিলাম আবরার ও ভুল করলে বকবি,শাষন করবি,বুঝিয়ে বলবি কিন্তু গায়ে হাত তুলবিনা।”
-“আরে বাবা আমার কথাটা শুনবি তো?”
-“রাখ তোর কথা,কালই আমি পিচ্চি নিয়ে আসবো।”
-“আউট অফ কন্ট্রল হয়ে গেছিলাম,ও নিজের পক্ষে একটা কথাও বলেনি।তাই রাগটা মাথায় উঠে গেছিলো।”
ইরাক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
-“বলবেও না…কেন বলবেনা জানিস?নিজের পক্ষে সাফাই দিতে দিতে অনেক ক্লান্ত।ছোট থেকে প্রতিটা জিনিসের জন্য প্রতিবাদ করতে হয়েছে ওর।ওর কথা ওর বাবা-মা বিশ্বাস করতো না,ওকে কোনো গুরুত্ব দিতোনা,সবাই যেটা বলতো সেটা মানতো ওনারা।এসব দেখে ও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে।জানিস ওকে লাস্ট হাসতে দেখেছি ওর তেরো বছর বয়সে।”
-“সরি,আমি জানি কাজটা আমার করা উচিত হয়নি।”
-“কী করছে ও?”
-“ঘুমাচ্ছে এখন।শোন ভিডিও কলে আয়,আমি তোকে ছবিগুলো পাঠাচ্ছি।”
আবরার ফোনটা কেটে দিয়ে ল্যাপটপ অন করে।ইরাকও কানেক্ট করে ওর সাথে ইফাজও আছে।ইফাজ ওকে দেখে বলে,
-“ছবিগুলো দু’বছর আগের,সিলেটে ঘুড়তে গেছিলাম তখনকার।”
আবরার একবার সামনের বেডে শুয়ে থাকা ইয়ারাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“ওই সেটা বলেছে,কিন্তু ছেলেটা কে?”
ইফাজ হেসে বলে,
-“ছেলেটা ইমন,শুধু মুখটা অন্যকারোর বসানো।কিন্তু একে সেটা আমরাও চিনিনা।আর এই ছবিগুলো ভাইয়া তুলছিলো।”
ইরাক কফি খেতে খেতে বলে,
-“হামম,তোকে কিছু ছবি পাঠিয়েছি মিলিয়ে দেখ,একদম সেম।শুধু চেহারাটা চেন্জ করা।”
আবরার ই-মেইল চেক করে ছবিগুলো মিলায়।কিছুক্ষণ ভেবে বলে,
-“এই কাজ কে করবে বলতো,আই থিন্ক কেউ ওকে ব্লাকমিল করতে চাইছে।কেননা ও ছবি আর ম্যাসেজ ইয়ারাবীকে পাঠিয়েছে।”
ইরাক ডানহাত দিয়ে নিজের কপালটা স্লাইড করতে করতে বলে,
-“দেখ আবরার আমাদের তিন ভাইয়ের কোনো বোন নেই,ছোট থেকেই বাবা-মা ওকে নিজের মেয়ে আর আমরা ওকে আপন বোনের মতো ভালোবাসি।তাই আমরা কখনো চাইবোনা ও কষ্টে থাকুক।তবে যে করেছে সে ফ্যামিলির খুব কাছের।”
ইফাজ বলে,
-“তোকে আমরা চিনি,তোর ফ্যামিলি সম্পর্কেও জানি তাই তুই যখন আগ্রহ দেখালি,আমরা যা জানতাম সব খুলে বলেছিলাম।তুই সব জেনে রাজি হয়েছিলি।”
আবরার দু’হাতে মুখটা ঢেকে মাথা নিচু করে বলে,
-“আমি জানি,বাট্ আমার কী হয়েছিলো আমি নিজেও বুঝতে পারিনি।কিন্তু এখন কথা হলো ছেলেটাকে খুঁজে বের করতে হবে।”
-“বিকালের মধ্যে পেয়ে যাবো কিন্তু তোকে লাস্টবারের মতো ওয়ার্ন করছি পিচ্চির গায়ে হাত তুলবিনা।তাছাড়া ও প্রচুর সিক,ডা.প্রমা কী বলেছে মনে আছে তো।ইমিডিয়েটলি ওর ট্রিটমেন্ট শুরু করতে হবে।”
-“হ্যাঁ,আর….”
আবরার আর কিছু বলতে পারেনা।কারো একটা চাপা কান্নার আওয়াজ ওর কানে ভেসে আসে।ভালো করে শব্দটা শুনে বুঝতে পারে ইয়ারাবী ঘুমের ভিতর কান্না করছে আর কিছু বলছে।আবরার ইরাকদেরকে বাই বলে কলটা কেটে ইয়ারাবীর কাছে যায়।
ইয়ারাবী ঘুমের ঘোরে অস্পষ্টভাবে কিছু কথা বলছে আর কেঁপে কেঁপে উঠছে।আবরার ওর কপালে হাত দিয়ে দেখে ওর শরীর খুব গরম হয়ে আছে।থার্মোমিটার দিয়ে মেপে দেখে জ্বর ১০৪ডিগ্রী এসেছে।ও সাথে সাথে এসিটা অফ করে ওর গায়ে একটা ব্লাঙ্কেট দিয়ে ওয়াশরুমে যেয়ে একটা বোলে পানি নিয়ে আসে।তারপর একটা রুমাল ভিজিয়ে ওকে পানিপট্টি দিতে থাকে।
আবরারের খুব খারাপ লাগছে।কেননা ইয়ারাবীর এই অবস্থার জন্য ও নিজে দায়ী।শুধু পানিপট্টি দিয়ে জ্বর কমছেনা দেখে ও ইয়ারাবীকে ডাকতে থাকে।কিন্তু ইয়ারাবীর মুখে যা শুনে তাতে ও অবাক হয়ে যায়।ইয়ারাবী জ্বরের ঘোরে বিরবির করে বলতে থাকে,
-“জানো মিসেস ইশানি তুমি ঠিকই বলেছিলে আমার কপালে সুখ নেই,কী জেনো বলো তুমি অপয়া।তোমরা আমাকে যেভাবে মারো আবরারও আমাকে মেরেছি।উহু,তবে তোমাদের মতো বাজে ভাবে না শুধু একটা চড় দিয়েছে।তোমরা সবাই খারাপ খালামনি আর মনি ভালো।জানো তোমরা যেখানে মেরেছো না ঠান্ডার সময় আমার সেই জায়গাতে ব্যাথা করে।কিন্তু তোমাদের কী?তোমরা তো সব সময় আমার মৃত্যু কামনা করো।ভালো হয়েছে তোমাদের আপদ বিদায় হয়েছে,জ্ জানো সবার ব্ বাবা-মা য্ য খন্ ন…”
ইয়ারাবী আর কোনো কথা বলতে পারেনা।তার আগেই বেহুশ হয়ে যায়।আবরার ওর মুখে পানি ছিটায়,তারপরও কাজ হয়না।ও বিছানা থেকে উঠে মাজায় হাত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে কিছু একটা ভাবে।তারপর ড্রয়ার থেকে একটা বক্স বের করে ওকে একটা ইনজেকশন পুশ করে দেয়।তারপর একটা মলম বের করে ওর মারের দাগগুলোর উপর লাগিয়ে দেয়।তবে ওর পিঠে মলম লাগাতে যেয়ে ওকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়।কেননা হাজার হোক নিজের স্ত্রী কিন্তু না বলে স্পর্শ করারটা ওর কাছে কেমন একটা লাগে।তারপর ও নিজেকে বুঝিয়ে ও মলমটা লাগায়।পুরোটা রাত ইয়ারাবীর কপালে পানিপট্টি দিয়েছে,ভোরের দিকে ওর জ্বরের মাত্রা কিছুটা কমে এলে মনে হয় ওর বুকের উপর থেকে পাথর নামে।ফরজের নামাযের সময় ও ইয়ারাবীর জন্য দোয়া করে।তবে পুরো রাত ইয়ারাবীর কথাগুলো ভাবাই ওকে।
(৬০)
“এই থাকতে হবে তোমায় ছাড়া কথা ছিলোনা
আজ ভিতর ঘরে ধোঁয়া থাকে তুমি থাকোনা, আমার লাল রঙ্গা হৃতপিন্ড হইতেছে কালো কলিজাটা যাক পুরে তবু তুমি থাকো ভালো ||
আজ আমার ভিতর জুড়েই..শুধু নেশার বসবাস নেশা হাসায় নেশায় কাঁদায়…নাই আমি আমার রোজ বিকালের মতো তোমার আর তো দেখিনা
আমি আমার মতো থাকবো ভালো খবর নিয়োনা”
🎶🎶🎶🎶🎶
একটা ছেলে সকালের দিকে রুমে গিটার হাতে নিয়ে চোখ বন্ধ করে গানটা গায়ছে।হঠাৎ কেউ ওর কাঁধে হাত রাখে।ফিরে তাকিয়ে দেখে ওর ভাবী দাঁড়িয়ে আছে।ছেলেটা গিটারটা নামিয়ে রেখে ওর ভাবীর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আরে ভাবী কখন এলে তুমি?”
-“এইতো আজ খুব ভোরেই চলে এসেছি,তোমার গিটারের আওয়াজ পেয়ে রুমে আসলাম।”
-“তোমার বোনের বিয়ে হয়ে গেলো অথচ আমাকে বললেনা পর্যন্ত।”
ওর ভাবী একটা হতাশার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিছানায় বসে বলে,
-“দু’মাস পরে হওয়ার কথা ছিলো,কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি যে হবে বুজে উঠতে পারিনি।আর তুমি গেছিলে ইন্ডিয়ায়…তাই”
-“তুমি আমাকে কী প্রমিস্ করেছিলে আর কী হলো?”
-“শুনো দেবর জী,আমি চেষ্টা করিনি তা কিন্তু নয়।ফুপিকে রাজী করিয়ে ফেলেছিলাম কিন্তু বাধ সাধলো ওর সো-কল্ড ভাইগুলো।”
রেগে গজগজ করতে করতে মিলিস্তা কথাটা বলে শাওনকে।হ্যাঁ,শাওন মিলিস্তার সম্পর্কে দেবর হয়।আর শাওন ইয়ারাবীকে পছন্দ করে,কিন্তু ইয়ারাবী এর কিছুই জানেনা।বলতে গেলে ও শুধু দু’বার শাওনকে দেখেছে।
শাওন মিলিস্তার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আচ্ছা ওনারা সম্পর্কে খালাতো ভাই হয়,তাহলে অতো মাতামাতি কেন করে ওকে নিয়ে।তোমার বিয়ের সময় দেখেছিলাম ওকে,বয়স তখন মনে হয় ওর চৌদ্দ হবে।তোমার সেই ফুফাতো বড় ভাই ওর হাত ধরে নিয়ে বেড়াচ্ছিলো।”
-“ওদের ভয়ে তো ইয়ারাবীকে কেউ কিছু বলতে পারেনা।আর ইয়ারাবী নিজের বাবা-মার থেকে ওদেরকে বেশি বিশ্বাস করে।”
-“জাস্ট নাম শুনেছিলাম বলে মার খেতে হলো।”
-“তুমি কী সত্যিই নাম শুনেছিলে নাকী অন্যকিছু?আচ্ছা,তুমি থাকো আমি আবার চুলায় রান্না বসিয়ে এসেছি,আম্মায় তো বাসায় নেই।”
মিলিস্তা এই বলে শাওনের রুম থেকে বেরিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়।শাওনের আজও ঘটনাটা মনে পরলে রাগ মাথায় উঠে যায়,ও মিলিস্তাকে সবটা খুলে বলেনি।ঠিক চার বছর আগে ইয়ারাবীকে দেখেছিলো,আর সেদিনই ঘটনাটা ঘটে।
মিলিস্তার বিয়েটা রংপুরের একটা বড় কমিউনিটি সেন্টারে হচ্ছে।সব আত্মীয়-স্বজনরা এসেছে।শাওনরা যখন গেট দিয়ে ঢুকছিলো তখন ওর চোখ আটকে যায় সিলভার কালারের বার্বিগাউন পরা একটা শ্যামলা মেয়ের দিকে।চুলগুলো কোমর পর্যন্ত নিচে থেকে হালকা কার্ল করা,চোখে একটা চশমা,কানে দুল আর হাতে একটা ঘরি।দেখেই বুঝা যাচ্ছে বয়স ১৩-১৪ বছর হবে।
মেয়েটা চেয়ারে একাএকা বসে ফোনে কিছু একটা করছে।শাওন অানমনেই মেয়েটির দিকে পা বাড়াতে থাকে।হঠাৎ একটা ২২-২৩ বছরের ছেলে এসে মেয়েটার হাতে একটা কোক দেয়।মেয়েটা ফোনটা ছেলেটার হাতে দিয়ে কোক খেতে শুরু করে।হঠাৎ স্পন্দন শাওনের বড় ভাই ওকে ডাক দেয়।নিরুপায় হয়ে ওকে ভাইয়ের সাথে যেয়ে স্টেজে বসতে হয়।কিন্তু শাওনের চোখ শুধু মেয়েটাকে খুঁজছিলো।
হঠাৎ ও দেখে একটা ছেলে মেয়েটার হাত ধরে রেখে বাকীদের সাথে কথা বলছে।শাওন মিলিস্তার কাছে যেয়ে মেয়েটার কথা জিজ্ঞেস করে,
-“ভাবী,ওই মেয়েটাকে চেনেন ?”
-“কোন মেয়ে?”
-“আরে সিলভার কালারের গাউন পরা,ব্লু-পান্জাবি পরা ছেলেটা হাত ধরে রেখেছে।”
-“ওর কথা বলছো?আমার ফুফাতো বোন নাম ইয়ারাবী,আর ছেলেটা নাম ইফাজ,সম্পর্কে ওই ফুফাতো ভাই।”
-“ওহ্ তারমানে এরা আপন ভাই-বোন।”
-“আরে আপন না খালাতো।তবে ইয়ারাবীকে আপন বোনের মতো ভালোবাসে তিনভাই।”
-“তাতো বুঝতেই পারছি এত বড় মেয়ের হাত ধরে রেখেছে,যাতে হারিয়ে না যায়।ওর বাবা-মা কোথায়?”
-“ওর শরীরটা কিছুটা খারাপ,ফুপি-ফুপারা বিজি তাই ভাইয়াদের সাথে আছে।কেন মনে ধরেছে নাকী?মাত্র চৌদ্দ বছর বয়স কিন্তু…”
-“যদি বলি হ্যাঁ,তাহলে…”
-“আমি তাহলে বলবো ভুলেও যাবেনা ওর কাছে।আমার ফুফাতো ভাইদেরকে তো চেনোনা তাই…”
-“যদি বলি ওকে আপনার জা বানাবো তো…”
-“বয়স কম…”
-“তো কী হয়েছে?এদেরই পটানো সহজ হয়,তাছাড়া বেশি বুঝবান মেয়ে আমার পছন্দ নয়।মায়েরও খু্ব মনে ধরেছে।”
-“যা খুশি করো,তবে পরে কিছু হলে আমাকে বলতে এসোনা।”
শাওন মেয়েটার সাথে কথা বলার জন্য এগিয়ে যায়।কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ও ইফাজের সাথে আছে।হঠাৎ ও মেয়েটার কন্ঠশুনে আরো বেশি বিমোহিত হয়ে যায়।ইফাজ ওর বন্ধুদের সাথে কথা বলছে এর মধ্যে বারবার ইয়ারাবী ওর হাতে চিমটি মারছে।ইফাজ এবার ওর দিকে রাগী কন্ঠে বলে,
-“তোকে বলছিনা চিমটি কাটবিনা,দেখ হাতের কী করছিস?”
-“আমি তোমার সাথে থাকবোনা,সেই কখন আমার হাত ধরে রেখে বাকীদের সাথে রাজহাঁসের মতো প্যাকপ্যাক করছো।”
-“যাই বলিস না কেন,এসব ভিতরের মধ্যে তোর হাত ছাড়তে পারবোনা।আম্মু মানা করেছে।”
-“বকো কেন তোমরা?আমি খালামনির কাছে যাবো।”
-“আম্মু কাজ করছে,চুপ করে বসে থাক এখানে।”
-“তাহলে ফোন দাও..”
ইফাজ ওর ফোনটা পকেট থেকে বের করে ওর হাত দেয়।হঠাৎ ইফাজের কোনো এক বন্ধু ওকে ডাক দিলে ইয়ারাবীকে ওখানে বসতে বলে ইফাজ ওখান থেকে বন্ধুর সাথে চলে যায়।শাওন এসে ওর সামনের চেয়ারে বসে বলে,
-“হাই,আমি শাওন।”
-“আসসালামুআলাইকুম….”-বলেই ফোনে গেমস্ খেলতে থাকে।শাওন হাল্কা হেসে সালামের উত্তর দিয়ে বলে,
-“তোমার নাম?”
ইয়ারাবী ওর দিকে তাকিয়ে আবার ফোনে চোখ দেয়।শাওন আবার বলে,
-“ও হ্যালো আমি তোমাকে বলছি,নাম কী তোমার?ম্যানাজ বলতে কিছু নেই নাকী তখন থেকে নাম শুনছি,”
ইয়ারাবী ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে ওখান থেকে হেঁটে বাইরে বেড়িয়ে আসে।শাওনের খুব রাগ হয় ওর ইগনোরের কারনে।শাওনের মা এসে ওর সামনে বসে বলে,
-“কীরে মেয়েটার সাথে কথা বলেছিস?”
-“ভাব দেখিয়ে চলে গেলো…”
-“চলতো আমার সাথে,কথা বলে আসি…”
শাওন ওর মায়ের সাথে ইয়ারাবীকে খুঁজতে লাগলো।ইয়ারাবী বাইরে একটা চেয়ারে বসে ফোনের গেমস্ খেলছে।শাওনের মা ওর সামনে যেয়ে ওর মুখে হাত দিয়ে বলে,
-“বাহ্ চেহারাটা তো অনেক সুন্দর,শ্যামলা আছো।তবে চলবে…”
ইয়ারাবী ওনার কথাশুনে ভ্রু কুচকে বলে,
-“মানে?”
-“তার আগে সালাম করোতো দেখি,কী ব্যাপার বাপ-মায় কী সালাম কালাম শেখায়নি।মুরব্বিদের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে হয় জানোনা।”
-“আমি কী আপনাকে চিনি যে সালাম করবো।আর মুরব্বি হয়েছেন এটা জানেন না পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে হয়না।
শাওন ওর কথা শুনে রেগে বলে,
-“তোমার সাহস তো মন্দ নয় তুমি আমার মায়ের সাথে খারাপ ব্যাবহার করছো।”
-“আরো খোকা বাচ্চা মেয়ে এখন ভুল করছে,বিয়ের পর শিখিয়ে পরিয়ে দিলে সব হবে।তা কোন ক্লাসে পরা হয় শুনি?আর তোমার বাপ-মা কোথায় বলতো,তাদের সাথে কথা ছিলো।”
-“আজিব মহিলাতো আপনি,সুপার গ্লুর মতো পিছনে লেগেই আছেন।”
-“আদব-কায়দা কিছু নেই দেখছি,কোনো ব্যাপার না আগে বিয়ে হোক ডানা ছেটে দিবো একদম।”
-“আপনি ওর ডানা ছাটানোর কে শুনি?”
কারোর কথার আওয়াজে পিছনে তাকিয়ে দেখে ১৮-১৯ বছরে ফর্সা,লম্বা করে দেখতে একটা গোল্ডেন কালারের পান্জাবি পরা ছেলে পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ইয়ারাবী ওকে দেকেই ওর কাছে চলে আসে আর বলে,
-“ইমু ভাইয়া,দেখনা এই মহিলা কখন থেকে বাজে বকেই যাচ্ছে।”
ইমন ওর কথা শুনে ওনার দিকে তাকিয়ে বলে,
-“আমি অনেকক্ষণ ধরে দেখছি আপনি আপনার ছেলে এর পিছনে লেগে আছেন?কারনটা কী জানতে পারি?”
শাওনের মা ইমনের সামনে যেয়ে বলে,
-“তুমি কে আগে তাই বলো?”
-“বাহ্ আমার জায়গায় এসে আমার উপর দাদাগিরি।ইমন ওর ভাই আর কিছু?”
-“এই মেয়ের তো শুধু একটা বোন আছে কোন ভাইতো নেই?তুমি কোথার থেকে পরলে শুনি…”
-“ওই আকাশ থেকে পরেছি খালাম্মা..”
-“তুমিতো বাপু খুব অসভ্য আর ঘাড়ত্যাড়া ছেলে”
-“কী করবো বলেন খালাম্মা,আমি জন্ম থেকেই এমন”
শাওন এবার রেগে তেরে এসে ইমনকে বলে,
-“আমাদের পার্সোনাল ব্যাপারে ইন্টারফেয়ার না করলেই খুশি হবো।তুমি জানো আমি তোমার কত বড়।ওর খালাতো ভাই,খালাতো ভাইয়ের মতো থাকবে।নাকী অন্যকোনো চক্কর চলছে তোমাদের?”
ইমনের রাগ ওঠানোর জন্য এই ওয়ার্ডটা যথেষ্ট ছিলো।প্রথমে এমন জোরে একটা চড় মারলো ছিটকে পাশে থাকা গাছের সাথে বারি খেলো।তারপর লাথি,কিল,ঘুষিতো আছেই।শাওনের মা আর ইয়ারাবী ওকে ঠেকাতে পারছেনা।ইয়ারাবী না পেরে ইরাক কে ডেকে আনে যাতে ইমনকে আটকায়।কিন্তু ওর মনে হচ্ছে খাল কেটে কুমির ডেকে এনেছে।সব শুনে ইরাকও শাওনকে মারতে থাকে।শেষে শাওনের মা সরি বলে ওখান থেকে চলে যায়।কিন্তু ইরাক ওদেরকে ওয়ার্ন করে দেয় এই ব্যাপারে যেনো কেউ কিছু না জানে।হলের পিছনের দিকে কেউ না থাকায় বিষয়টা কেউ জানতেও পারেনি তবে ইয়ারাবীর উপরে ইরাক ঝড় তুলে দিয়েছিলো,একা বের হওয়ার জন্য।
শাওনের অতিত থেকে বাইরে বেরিয়ে ইয়ারাবীর একটা ছবি হাতে নিয়ে বলে,
-“ডোন্ট ওরি মেরি জান,তোমাকে আমি নিজের করেই ছাড়বো।আফটারঅল আমার মায়ের পছন্দ তুমি।বিয়ে হয়েছে তো কী হয়েছে জান বেশিদিন টিকবেনা।তোমাদের ওই সো-কল্ড ভাইদের থেকেও আমাকে বদলা নিতে তো হবে।”
শাওন আবার গিটারটা হাতে নিয়ে গানটা শুরু করে।
“এই থাকতে হবে তোমায় ছাড়া কথা ছিলোনা
আজ ভিতর ঘরে ধোঁয়া থাকে তুমি থাকোনা”
(৬১)
রোদের আলো চোখের উপরে পরার সাথে সাথে ইয়ারাবীর ঘুমটা ভেঙে যায়।মাথা প্রচুর ভার হয়ে আছে,সারা শরীরে প্রচুর ব্যাথা করছে।বামহাত নাড়াতে যেয়ে বুঝতে পারে কেউ অনেক শক্ত করে ওর হাতটা ধরে রেখেছে।আস্তে করে মাথা ঘুরিয়ে দেখে ওর হাতে একটা স্যালাইন লাগানো আর আবরার ওর হাতটা শক্ত করে ধরে এক পাশে মাথা দিয়ে রেখেছে।ইয়ারাবী হাতটা নাড়াতে গেলে আবরার বলে উঠে,
-“প্লীজ,হাতটা নাড়াবেনা,ব্যাথা করবে।”
-“ক্ কটা বাজে?”
-“নয়টা সাড়ে নয়টা,কেমন লাগছে এখন?”
-“আলহামদুলিল্লাহ,ত্ তবে সারা শরীরে খুব ব্যাথা করছে।আ আপনি হ্ হাসপাতালে যাননি?”
আবরার জ্বরটা চেক করে বলে,
-“তোমাকে এই অবস্থায় রেখে কীভাবে যায় বলো?আর কে বলেছিলো রাতে শাওয়ার নিয়ে আবার ঠান্ডায় বসতে।একটা চড় মেরে খুব অন্যায় করে ফেলেছি,জানো রাতে কত ভয় পেয়েছিলাম।এই ফাস্ট ডাক্তারি ক্যারিয়ারে ভয় পেলাম।”
-“স্ সারারাত না জেগে ঘুমাতে পারতেন।আর এসব আগেও হতো আর এমনিতে ঠিক হয়ে যেতো।”
-“হুম জানি কেমন ঠিক হতো।তাছাড়া আমি আমার সুন্নত আদায় করেছি।জানো স্ত্রীর প্রতি স্নেহশীল আর দয়া-পরবশ থাকা সম্পর্কে কী বলা হয়েছে?রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন : “তোমরা নারীদের ব্যাপারে কল্যাণকামী। কারণ, তারা পাঁজরের হাড় দ্বারা সৃষ্ট। পাঁজরের উপরের হাড়টি সবচে’ বেশি বাঁকা। (যে হাড় দিয়ে নারীদের সৃষ্টি করা হয়েছে) তুমি একে সোজা করতে চাইলে, ভেঙে ফেলবে। আবার এ অবস্থায় রেখে দিলে, বাঁকা হয়েই থাকবে। তাই তোমরা তাদের কল্যাণকামী হও, এবং তাদের ব্যাপারে সৎ-উপদেশ গ্রহণ কর।” [বুখারি] “
-“স্ত্রীকে মারাও কী সুন্নতের মধ্যে পরে?”
আবরার ইয়ারাবী হাত থেকে স্যালাইনটা খুলতে খুলতে বলে,
-“সরি,ইয়ারাবী প্লীজ মাফ করে দাও”
-“আহ্হ্,আস্তে।অাপনার জায়গায় আপনি একদম ঠিক ছিলেন।”
-“হয়ে গেছে,যখন উঠেই পরেছো চলো ফ্রেস হয়ে নেবে।”
আবরার ইয়ারাবীকে ওয়াসরুমে নিয়ে যায়।ও হালকা হাত-মুখে পানি দিয়ে ড্রেসটা চেন্জ করে বাইরে আসে।আবরার উঠতে গেলে ইয়ারাবী ওর হাত ধরে বলে,
-“আপনি এখনো রেগে আছেন?”
-“তুমি বসো আমি খাবারটা আনতে বলি…”
-“আবরার আমি সত্যি জানিনা ছেলেটা কে?”
-“আই নো,তুমি মিথ্যা বলোনা সেটা আমিও জানি।ওসব নিয়ে আর ভেবোনা।”
এর মধ্যে মিসেস রায়হান সার্ভেন্টের সাথে রুমে আসেন।
-“মা এখন কেমন আছিস তুই?”
-“ভালো আম্মু..”
-“কেমন ভালো দেখতেই পারছি ঠিকমতো কথাটাও বলতে পারছিসনা।”
ইয়ারাবী মুখটা নামিয়ে নিয়ে বলে,
-“সরি আম্মু এসে ধরে আপনাদের খুব বিরক্ত করছি।”
-“তাতো করছিসই,কোথায় রান্না-বান্না করবি,শ্বশুড়-শ্বাশুড়ির সেবা করবি তা না পরে পরে ঘুমাচ্ছিস।”
-“কাল থেকে সব করে দিবো..”
মিসেস রায়হান ওর কথায় হেসে দিয়ে বলেন,
-“পাগলি,তুই কী ভাবলি তোকে দিয়ে এসব করাবো?জারবার মতো ইকরা আর তুইও আমার মেয়ে।তোর তো জ্বর ছিলো সবাই ব্রেকফাস্ট করে নিয়েছে তুই আর আবরার বাকী আছিস।খাবারটা খেয়েনে।”
আবরার এসে ওর মায়ের পাশে বসে বলে,
-“তোমার নানুর ওখানে যাওয়ার কথা ছিলো,তুমি যাও।আমি আজ বাসায় আছি,আর খাবার আমি খাইয়ে দিবো।”
মিসেস রায়হান ইয়ারাবীর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে যেতেই আবরার একবাটি স্যুপ ওর সামনে ধরে। ইয়ারাবী ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
-“জ্বর হলে কিছু খেতে পারিনা,প্লীজ জোর করবেন না।”
-“উহু,নো এক্সকিউজ্ পুরোটা শেষ করো।”
ইয়ারাবী মুখ ফুলিয়ে স্যুপটা খেতে থাকে।অসম্ভব বাজে লাগছে ওর কাছে।কিন্তু কিছু করার নেই।হঠাৎ ওর ফোনে একটা ম্যাসেজ আসে।ইয়ারাবী ফোনটা অন করে ভয়ে ভয়ে আবরারের দিকে তাকায়।কিন্তু আবরার কোনো রিয়্যাক্ট না করে ওকে খাওয়াতে থাকে।কেননা সেই আননোন নাম্বার থেকে আরো কিছু ছবি এসেছে,যার আসল রহস্য আবরার জানে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here