#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (১৮)
আজকে নবনীর অফিসে প্রথম দিন।সকাল থেকে নবনী ভীষণ নার্ভাস। সকালে কিছুই খেতে পারলো না এই নার্ভাসনেসের জন্য।
বুকের ভেতরটা কেমন ঢিপঢিপ করছে। নবনী বের হলো বেবি পিংক কালার একটা সুতি থ্রিপিস পরে,বেবি পিংকের উপর সাদা সুতার কাজ করা। হাতে গোলাপি রেশমি চুড়ি। চোখে হালকা কাজল।ঠোঁটে মেরিল দিলো।লম্বা চুলগুলো আজকে ও বিনুনি করে নিলো।
আজ বহুদিন পর খুব যত্ন করে সেজেছে নবনী। সাজলে মন খারাপ,নার্ভাসনেস কিছুটা কমে নবনীর।কনফিডেন্স বাড়ে কিছুটা।
হামিদুর রহমানের দেওয়া ব্যাগটি নিয়ে বাবা মা দুজনকে সালাম করে নবনী বের হলো অফিসের জন্য। সারা পথ নবনীর শরীর ঠকঠক করে কেঁপেছে।নবনী মনে মনে দোয়া ইউনুস পড়তে লাগলো। অফিসের সামনে আসতেই নবনীর যেনো প্রেশার লো হয়ে গেলো। মাথা ঘুরতে লাগলো।
আকাশ আজ ঝকঝকে নীল।রৌদ্রময় একটা দিন।রোদের তেজ নেই বললেই চলে। কেমন আরামদায়ক রোদ।নবনীর ইচ্ছে করছে এঝানে দাঁড়িয়ে থাকতে।ভেতরে গেলে কি হবে সেটা ভেবেই নবনী অস্থির হয়ে যাচ্ছে।কিভাবে কাজ করবে,কে তার বস হবে এসব কিছুই তো জানে না সে।যদি কাজ করতে না পারে তখন কি হবে?
সবার সামনে কি তাকে বকা দেওয়া হবে?
এসব আজেবাজে কথা ভাবতে ভাবতে নবনী ঘামতে লাগলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর বুঝতে পারলো না গিয়ে উপায় নেই। যেতে তো হবেই তাকে।সুতরাং যা হবার হবে।
নিজেকে এসব বুঝিয়ে নবনী ভেতরে গেলো। রিসিপশনিস্ট মেয়েটা নবনীকে দেখেই এগিয়ে এলো।দুজনে হাই/হ্যালো করে নবনীকে তার ডেস্ক দেখিয়ে দিলো।নবনীর ডেস্কের সামনেই বসের কেবিন।৭,৮ তলা মিলিয়ে পুরো অফিসে প্রায় ৪৫-৫০ জনের মতো লোক কাজ করে। ৯ তলায় হচ্ছে হলরুম এবং ক্যান্টিন।
নবনীকে রিসিপশনের মেয়েটা যার নাম লিজা,সে সব দেখিয়ে দিলো। নবনীর সবচেয়ে বেশি ভালো লাগলো মেয়েদের জন্য রাখা রেস্ট রুম।
ওখানে কয়েকটা সিঙ্গেল বেড রাখা আছে। সবচেয়ে যেটা নবনীকে বেশি মুগ্ধ করেছে তা হলো,এক পাশে একটা যার্কের উপর কয়েকটা ব্রান্ডের স্যানেটারি ন্যাপকিন,৪ টা হট ওয়াটার ব্যাগ রাখা আছে।
নবনী বুঝতে পারলো এরা যথেষ্ট মানবিক। নয়তো অফিসের স্টাফদের এসব প্রয়োজনীয় জিনিস রাখতো না।
নবনী লিজাকে বললো,”এই পদক্ষেপটা কিন্তু সত্যিই ভালো ছিলো। ”
লিজা মুচকি হেসে বললো,”যিনি এই পদক্ষেপ নিয়েছেন তিনিও কিন্তু যথেষ্ট দারুণ ম্যাডাম। আপনাকে যে কতোজন ঈর্ষা করবে আজ থেকে বুঝতে পারবেন।অফিসের প্রায় সব মেয়েই এই কয়েকদিন ধরে দোয়া করেছে স্যারের পিএ যেনো কোনো ছেলে হয়।এমনকি আমিও চেয়েছি।”
এটুকু বলেই লিজা ফিক করে হেসে দিলো।নবনী অবাক হলো। এরা কি সুন্দর করে অবলীলায় এসব কি বলে যাচ্ছে। কাউকে ভালো লাগলে তাও বলে দিচ্ছে।অথচ নবনী?
ওদের কথা ভেবে তার নিজেরই বুক কেঁপে উঠছে ভয়ে।এতো সাহস তার কখনো হবে না।
নবনী তার ডেস্কে গিয়ে বসতেই দেখলো সেই লোকটা এগিয়ে আসছে ভেতরের দিকে যার সাথে নবনীর রাস্তায় দেখা হয়েছিলো, যে নবনীর গায়ে রাস্তার কাদা ছিটিয়ে দিয়েছে গাড়ি দিয়ে।
শিমলার বাসায় যে নবনীর সাথে গায়ে পড়ে আলাপ করতে এসেছে।
বিদ্যুৎ গতিতে নবনী ডেস্কের নিচে ঢুকে গেলো। নবনী ভেবেছিলো লোকটা হয়তো এখানে কোনো কাজে এসেছে তাই যাতে দেখা না হয়ে যায় তার জন্য লুকাতে গেলো।
নবনীকে অবাক করে দিয়ে মেঘ ডেস্কের পেছনে এসে নবনীর পাশে নিচে বসে ফিসফিস করে বললো,”হ্যালো ম্যাডাম,ডেস্কের নিচে কি করছেন?
বিড়ালের মতো নিচে লুকিয়ে বসে আছেন কেনো,ভয় পেয়েছেন নাকি?
নাকি কোনো ইদুর খুঁজছেন? ”
নবনীর হার্টবিট বেড়ে গেলো। সাথেসাথে উঠতে গিয়ে ডেস্কের কোণায় একটা অনাকাঙ্ক্ষিত আঘাত লেগে গেলো তার।
মেঘ হাত বাড়িয়ে বললো,”আমি মেঘালয় আহমেদ মেঘ ম্যাডাম,আজ থেকে আমি আপনার স্যার আর আপনি তো আমার আগে থেকেই ম্যাডাম। ”
নবনী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। মেঘ হেসে বললো,”নীড়ের ম্যাডাম তো আমার ও ম্যাডাম তাই না?”
নবনীর ভীষণ রাগ হলো। এই লোক এরকম একটা উচ্চ পর্যায়ে থেকে ও পাড়ার ছেলেদের মতো করে কেমন ফ্ল্যার্টিং করছে!
অথচ অফিসের সব মেয়ে না-কি এর উপর ক্রাশ খেয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে!
মনে মনে নবনী মেয়েদের রুচিকে অত্যন্ত বাজেভাবে কয়েকটা বকা দিলো।অতি ভদ্র বলে কোনো গালি দিতে পারলো না।
তবে এটুকু বুঝে গেলো নবনী এই লোকের আন্ডারে বেশিদিন কাজ করবে না।এরকম গায়ে পড়া স্বভাবের মানুষ নবনীর অপছন্দ। এরা সবার সাথে এরকম বিহেভ করে। চান্স পেলেই এভাবে কথা বলে। খুব শীঘ্রই অন্যত্র সিভি জমা দিবে।
নবনী ভাবতে ও পারে নি তার এ সিদ্ধান্ত কিছুক্ষণ পরেই চেঞ্জ করে ফেলবে।
মেঘ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো নবনীর দিকে। বুকের ভেতর থেকে একটা চাপা ব্যথা যেনো দেহের প্রতিটি শিরায় শিরায় ছড়িয়ে গেলো।
মেঘের মনে হলো এটাই যেনো, “বাজিল বুকে সুখের মতো ব্যথা।”
মেঘ জিজ্ঞেস করলো, “কেমন আছেন?এখনো কি রেগে আছেন?”
নবনী কোনো কথার জবান না দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো। নবনীর থেকে কোনো জবাব না পেয়ে নবনীকে কিছু ডাটা এন্ট্রি করতে দিয়ে মেঘ চলে গেলো নিজের কেবিনে।
নবনীর মনে হলো এই কেবিনটার সামনে তার ডেস্ক না থাকলে ভালো হতো। কেননা কাঁচের দেয়ালের ওপাশে স্পষ্ট মেঘকে দেখা যাচ্ছে। মেঘ ও তাকে দেখছে।অন্য কোনো পাশ থেকে আর দেখা যায় না কেবিনের ভেতরের দিক।শুধু নবনীর জায়গা থেকে দেখা যায়।
নবনী কাজের মধ্যে ডুবে ছিলো কিন্তু হঠাৎ করেই তার সারা শরীরে যেনো শক লাগলো। সেই চেনা কন্ঠস্বর শুনে নবনী চমকে তাকালো।
তামিম দাঁড়িয়ে আছে হাতে কতোগুলো ফাইল নিয়ে। নরম স্বরে নবনীকে এক্সকিউজ মি বলে ডাকছে তামিম।নবনীকে দেখতে পাবে এভাবে তা তামিমের ভাবনাতেও ছিলো না।
নবনী মাথা তুলে তাকাতেই তামিমের হাত থেকে সবগুলো ফাইল নিচে ছিটকে পড়লো। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে তামিম তাকিয়ে রইলো নবনীর দিকে।
নবনীর ফর্সা মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গেলো তামিমকে দেখে।কেউ কোনো কথা বলতে পারছে না।
কেবিনের ভেতর থেকে এক জোড়া শিকারী চোখ সমস্ত ঘটনা নজর বন্দী করছে কেউই তা টের পেলো না।
নবনী নিজেকে সামলে নিলো তামিমের আগে।কিন্তু কথা বলতে গিয়ে টের পেলো গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। নবনী অনেক কষ্টে নিচের দিকে তাকিয়ে বললো, “কিছু বলবেন?”
তামিম তাকিয়ে রইলো নবনীর দিকে। আজ নবনীকে ভীষণ সুন্দর লাগছে।তামিমের মনে হলো বিচ্ছেদের পর নবনী যেনো আরো বেশি সুন্দর হয়ে গেছে।
ওপাশ থেকে মেঘের তখন ভীষণ রাগ হচ্ছে তামিমকে এভাবে নবনীর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে।
সবগুলো ফাইল তুলে নিয়ে তামিম আড়ষ্ট হয়ে বললো,”স্যারের কিছু সাইন লাগবে এই ডকুমেন্টসে।”
নবনী কিছু না বলে কাজে মন দিলো।তামিম ফাইল রেখে চলে গেলো এক আকাশ বিস্ময় নিয়ে।
সেই মুহুর্তে নবনী সিদ্ধান্ত নিলো সেই এই অফিসেই কাজ করবে।অবশ্যই করবে।
নবনী নিজের কাজ অর্ধেক সমাপ্ত করে ফাইলগুলো নিয়ে মেঘের কেবিনে গেলো।মেঘ চেয়ারে হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। নিজের উপর তার নিজের ভীষণ রাগ লাগছে।
নবনীকে তামিমের দিকে এভাবে তাকাতে দেখে তার বুকে এরকম জ্বালা অনুভব করছে কেনো?
নবনী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “আসবো স্যার?”
মেঘের বুকের সকল জ্বালা মুহুর্তে বিলীন হয়ে গেলো। নবনী গলার নরম স্বরে মুহুর্তেই সব ক্ষোভ চলে গেলো।
নবনী ফাইলগুলো টেবিলে রেখে বললো,”এগুলোতে আপনার সাইন লাগবে।”
মেঘ নরম স্বরে বললো, “আর কখনো আমার কেবিনে আসার সময় অনুমতি চাইবে না।”
নবনী কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো। মেঘ মাথা চেপে ধরে ভাবতে লাগলো এই লৌহ মানবীর মুখ থেকে কেনো কথা বের হয় না।
লাঞ্চ আওয়ারে নবনী গেলো ক্যান্টিনে। এখানে লাঞ্চ ফ্রি,কোম্পানির খরচে সবাই খায়।নবনী গিয়ে একটা চেয়ারে বসলো। আশেপাশে সব চেয়ারে সবাই বসে গেছে।হৈহল্লা কথাবার্তায় ক্যান্টিন মেতে উঠেছে।
নবনীর সামনের চেয়ারটা খালি।সবাই নিজের বন্ধুবান্ধব নিয়ে খেতে বসেছে।
নবনী নিজের জন্য একটা সবজি খিচুড়ি নিয়ে বসলো।তার থেকে কিছুটা দূরে তামিম বসেছে নিতুকে নিয়ে। নিতু তামিমের সাথে কথা বলতে বলতে খাচ্ছে। তামিম সেদিকে মনোযোগ না দিয়ে নবনীর দিকে তাকিয়ে আছে।
মেঘ আজকে ক্যান্টিনে উঠে এলো খাবার খেতে।প্রতিদিন তার লাঞ্চ তার কেবিনে দিয়ে আসা হয়।সিসি ক্যামেরায় মেঘ এতোক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছে তামিমের আচরণ কিছুটা অদ্ভুত।নিযের ওয়াইফের সাথে কথা না বলে সে বারবার নবনীকে দেখছে।মেঘের প্রেমিক হৃদয় এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারলো না।বিদ্রোহ জানিয়ে চলে এলো ক্যান্টিনে।
মেঘ আসতে আসতে দেখতে পেলো অফিসের তিনজন মেয়ে নবনীকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। হাসাহাসি করছে।
নবনী ভীষণ বিব্রতবোধ করছে।
একে তো সে এদের মতো স্মার্ট না,তার উপর ওদের পোশাকের দিকে তাকালেই বুঝা যায় এরা এ যুগের আধুনিকা মেয়ে।নির্বিঘ্নে নবনীকে বলছে,”মেঘ স্যারের দিকে অন্য নজরে তাকাস না বোন,পাত্তা পাবি না।”
আরেকজন বললো, “স্যারের রুচি এতোটা ও খারাপ হয় নি যে এরকম আনস্মার্ট কাউকে পাত্তা দিবে।আমরা এতো চেষ্টা করেও পারছি না।বাদ দে।”
নবনী কিছুক্ষণ এসব চুপচাপ শুনলো।তারপর মুচকি হেসে বললো, “এক্সকিউজ মি,এখানে আমি কাজ করতে এসেছি। আপনারা সবাই হয়তো ধনীর দুলালি,আমি তেমন কেউ না।আমি গ্রাম থেকে উঠে আসা একজন সাধারণ মেয়ে।যার একমাত্র ধ্যান ধারণা নিজের ফ্যামিলিকে ফিন্যান্সিয়াল সাপোর্ট দেওয়া।এসব পটানোর কাজ আমার জন্য আসে নি।বেটার আপনারা ট্রাই করেন,লাক ভালো যার সে লটারি জিতে যাবেন।আমাকে আমার মতো কাজ করতে দিন।”
মেঘ এসে সবার পিছনে দাঁড়িয়ে সব শুনলো।তারপর গম্ভীর হয়ে বললো, “এক্সকিউজ মি,এখানে এতো ভীড় কেনো?”
মেঘের গম্ভীর কণ্ঠ শুনে সবাই নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেলো। মেঘ নিজের জন্য খাবার নিয়ে এসে নবনীর সামনে ধপ করে বসে পড়লো।
নবনীর খাবারের বারোটা বেজে গেলো। মেঘ নির্দ্বিধায় হাত দিয়ে খেতে লাগলো। নবনী খাওয়া বাদ দিয়ে উঠে চলে গেলো।
মেঘ কিছুতেই বুঝতে পারছে না এই মেয়ের তাকে এভাবে ইগনোর করার কারণ কি?
কি এমন অপরাধ করেছে সে?
নবনী পেটে ক্ষুধা নিয়ে চলে গেলো। সকালে কিছু না খেয়ে আসায় ভীষণ ক্ষুধা পেয়েছে তার।যাবার সময় একটা পানির বোতল নিয়ে গেলো।আজ সে শুধু পানি খাবে।
মেঘ হতাশ হয়ে ক্যান্টিনে বসে রইলো। তারপর একজন ওয়েটার কে ডাক দিয়ে নবনীর জন্য খাবার পাঠিয়ে দিলো ওর ডেস্কে।নবনীর খাবার শেষ না হওয়া পর্যন্ত মেঘ আর নিচে গেলো না।
বুঝতে পারলো এ শুধু লৌহ মানবী নয়,সাথে আরো যা আছে স্টিল,পাথর সব মানবী।একে পাওয়ার জন্য মেঘকে কঠিন তপস্যা করতে হবে।
বিকেলে সবার ফোনে মেসেজ এলো স্যালারির।নিতু তামিমের কাছে বলে বাবার বাসায় গেলো। যাবার পথে স্যালারি তুলে বাবার বাসায় গিয়ে বাবাকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে এলো।নিজের জন্য ৫ হাজার টাকা রাখলো।তারপর বাসার দিকে চলে গেলো বাবা মায়ের থেকে বিদায় নিয়ে।
তামিম বাসায় গিয়ে স্যালারির ৫০ হাজার টাকা মায়ের হাতে দিলো,নিজের একাউন্টে ১০ হাজার টাকা জমা রাখলো নিজের জন্য।
তাহেরা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,”নিতু কই?”
তামিম বললো,”ওর বাবার বাসায় গিয়েছে।চলে আসবে এক্ষুনি। ”
আর কথা না বাড়িয়ে তামিম নিজের রুমে চলে গেলো। কিছুক্ষণ পর কি আগ্নিকান্ড ঘটবে তা তামিম ঘুণাক্ষরেও টের পেলো না।
চলবে……
রাজিয়া রহমান