বাবুই পাখির বাসা – ১ অমৃতা বন্দ্যোপাধ্যায়

বাবুই পাখির বাসা – ১
অমৃতা বন্দ্যোপাধ্যায়

তাজ ফালুনকনামার বাগানে আজ আছে একটা বিশেষ অনুষ্ঠান |
ভারতীয় স্টার্টআপদের মধ্যে যেগুলো সব থেকে সফল হয়েছে তাদের সৃষ্টিকর্তা কর্তীদের আজ সম্মান জানানো হচ্ছে এখানে | আয়োজন একদম নিজামী ধরণের | টাকা উড়েছে সব দিকে, আলো, ফুল দিয়ে সাজানো, এলাহী খাবার, মদ, গান বাজনা, কোনোদিকে কিছু কম না | দেশি বিদেশী অনেক রথী মহারথী আছেন | শুধু তো সম্মান জানানো না, এইসব জায়গায় ব্যবসার আরও নানা রকম জিনিসের বোঝাপোড়াও হয়ে থাকে |
ট্রফি, হ্যান্ডশেক, ফটো তোলা অনেক কীর্তি পেরিয়ে এইবার সাংবাদিকরা টুকরো টুকরো সাক্ষাৎকার নিচ্ছে | সেরকমই একজনের মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে সাগরনীল | সাগরনীল রায়চৌধুরী, বাড়ি আদতে আসানসোল, সেখানেই স্কুল | তবে তারপর পড়াশোনা, কাজকর্ম, এইসব সূত্রে বহুকাল বাইরে বাইরে | আসানসোলের সাথে আর সেরমকম সম্পর্ক নেই | পাঁচ বছর হয়ে গেছে শেষ বার গিয়েছিল |
সাগরনীল আর নীলেশ সাউ, এই দুই কলেজের বন্ধুর একসাথে শুরু করা একটা এডুকেশনাল স্টার্টআপ খুব সাড়া ফেলেছে | ওদের কোম্পানি নানান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্কুল, কলেজ আরও অনেকের সাথে হাত মিলিয়ে বানিয়েছে একটা অনলাইন আপ্পলিকেশান, যেখানে পড়াশোনার জিনিস ওই একটা ওয়েবসাইট বা ফোনের আপ্পলিকেশন দিয়ে পড়ুয়ারা দেখতে পড়তে পারবে | তাও কম সময় লাগেনি এই জায়গায় পৌঁছতে, প্রায় পাঁচ বছর আগে শুরু করেছিল ওরা | তখন দুজনেই চাকরি করতো | এখন তো নিজেরদের ব্যবসাতেই পুরো সময় দেয়| আরও এইরকম জিনিস বাজারে আছে, তবে ওদেরটা ব্যবহার করা সব থেকে সহজ, দামে সব থেকে কম আর একদম নিচু ক্লাস থেকে কলেজ পর্যন্ত সব পড়াশোনার জিনিস এতে পাওয়া যায় | তাই গ্রামে, মফস্বলেও খুব জনপ্রিয় হয়েছে |
তার সাফল্যের জোরেই আজ ওরাও এখানে নিমন্ত্রিত |

নীলেশও এদিকেই কোথাও আছে, তবে ও কথা বলতে পছন্দ করে না, তাই সাগরনীলকেই এইসবে এগিয়ে দেয় | সাগরনীল কথাবার্তায় চটপটে | ওর আপত্তি নেই | তাছাড়া ,ব্যবসা করবে কিন্তু কথা বলবো না এই বললে চলে না, সবই মার্কেটিং আর প্রোমোশনের উপর | তাই মুখে একটা নকল হাসি ঝুলিয়ে কথা বলতে হয় বৈকি | যাবে কোথায় বাবা ??
সাংবাদিকটি তরুণী, একদমই ছেলেমানুষ, ওই পঁচিশ মতন হবে, তা এখানে পোড় খাওয়া সাংবাদিক এসে কি করবে ? নিজের চিন্তাতে নিজেই একটু অবাক হলো সাগরনীল, পঁচিশের মানুষকে ছেলেমানুষ মনে হচ্ছে ? ও নিজেই তো বত্রিশের ! মনে মনে কি বয়েস আরও বেড়ে গেছে ?
মিষ্টি হেসে প্রশ্ন করলো মেয়েটি, “আপনার এই সাফল্যের জন্যে কে দায়ী মিস্টার রায়চৌধুরী ?”
সেই চর্বিতচর্বন প্রশ্ন, কে আবার দায়ী ?
সাগরনীল মেকি হাসি চওড়া করে বিরক্তি ঢেকে বললো, “আমিই দায়ী, আর কে হবে বলুন ? নিজের সাফল্য নিজেকেই পরিশ্রম করে আনতে হয়, আমার আর নীলেশের বেলাতেও তাই |”
এইবার প্রশ্ন, “আপনার ইন্সপিরেশন কে ?”
সোজা প্রশ্ন, দ্বিধাহীন উত্তর,”আমার বাবা”, এইবার হাসিটাও আসল |

বাবা | সাগরনীলের সহায়, ভালোবাসার অতল খনি | বাবা ওর পাশে পাশে না থাকলে, ওই প্রাণখোলা স্নেহ না ঢেলে দিলে কোথায় থাকতো আজ ও ? কি বা করতো এতদিনে ?
“তা আপনি আজ একা এসেছেন ? বাবাকে আনেন কি সঙ্গে আপনার এই সাফল্যের সন্ধেয় ?”
“আমার বাবা মারা গেছেন প্রায় দশ বছর আগে | আজ বাবা সঙ্গে থাকলে আমার থেকে বেশি খুশি কেউ হতো না |”
“ওহ সরি ! আর মা ?”
মা ? সাগরনীল রায়চৌধুরীর মা ? হ্যাঁ, আছেন একজন নামে, থেকেও নেই তিনি | জটিল ব্যাপার সে |
“থাঙ্কস ফর ইওর টাইম …”, প্রশ্ন যেন শোনেইনি এমন ভাব করে সাগরনীল পা বাড়িয়ে চলে গেল |
এইসব যত ব্যক্তিগত প্ৰশ্ন !
কাজের কথা, আরও কি পরিকল্পনা জিজ্ঞেস কর, তা না মা !
দূর ! বিরক্তিকর! মেজাজটাই নষ্ট হয়ে গেল | খেতেও আর ইচ্ছে করছে না |

এখনই চলে যাওয়া যাবে না, আরও কিছু খেঁজুরে আলাপ সারতে হবে, নেক্সট রাউন্ডের ফান্ডিংয়ের ব্যাপার আছে তাই জোর করে থাকতে হবে | এইসব ভেবেই একটা গ্লাস তুলে নিয়ে ওই একপাশে বাগানটার ফাঁকা জায়গাটায় এসে দাঁড়ালো |
আলো দিয়ে সাজানো হয়েছে চার পাশ | সাদা হোটেলটা, আগে যেটা ছিল রাজপ্রাসাদ সেই আলোয় রঙিন হয়ে আছে | মোহময়ী পরিবেশ | মানুষ জনেরও চাকচিক্য বেশ | অনেকেই ওর মতন যারা হয়তো এমনি দিনে ওই এক জিন্স আর টিশার্ট পরেই ঘরে বাইরে দিনের পর দিন কাটিয়ে দিচ্ছে, আজ তারাও স্যুট টাই পরে এসেছে | মহিলাও আছেন, অপেক্ষাকৃত ভাবে কম তবে আছেন | সেটা দেখেও ভালো লাগলো সাগরনীলের, কিছু উন্নতি তো হচ্ছে দেশে | এখন যদিও অনেক পথ বাকি !
একটু দূরেই দাঁড়িয়ে একজন নিজের ফোন দেখছে | কালো ইভনিং ড্রেস, চুলটা টপনটে বাঁধা, মানসই সামান্য গয়না তার সাথে | ভারী সুন্দর মুখখানা |
ওদের সবারই গায়ে নিজেরদের নাম লেখা আছে নেম ট্যাগে | সাগরনীল দেখলো মেয়েটির নাম লেখা আছে তোয়া | নিজের মনেই ভাবলো, “তোয়া, মানে তো জল ? নাকি নদী? “
মেয়েটি রাইসিং ফিমেল এন্ট্রাপ্রেনিউয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছে, একটা কসমেটিক্স কোম্পানির মালকিন ইনি | সাগরনীল আর নীলেশ পেয়েছে একই পুরষ্কার কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই অন্য বিভাগে | “এই ভালো এদিকে সমতা আর ওদিকে মেয়েদের আলাদা অ্যাওয়ার্ড, সেই উচ্চমাধ্যমিকে ফার্স্ট আর মেয়েদের মধ্যে ফার্স্ট”, ভাবলো, তাও মুখে সাগরনীল বললো, “কংগ্রাচুলেশান্স তোয়া |”
তোয়া মুখ তুলে তাকালো, হাসলো | অপ্রস্তুত হয়ে বললো, “থ্যাংকস, বাট আই ডোন্ট লাইক ইট | ফিমেল এন্ট্রারপ্রেনিউয়ার, সাউন্ডস সিল্লি! এন্ট্রারপ্রেনিউয়ার ইস আন এন্ট্রারপ্রেনিউয়ার |”
বাহ্ ! এ তো বেশ ভালো কথা বলে | নিজেরই পাওয়া পুরস্কার নিয়ে গর্ব না করে বলছে আলাদা করে মেয়েদের বিভাগ না হলেই ভালো, সাউন্ডস সিল্লি!! দারুন লাগলো সাগরনীলের, মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে বললো, “ডাট ইস ট্রু, ওহ বাই ড ওয়ায় আই এম সাগরনীল রায়চৌধুরী “, বলে হাত বাড়িয়ে দিল |
“ওহ বাঙালি ? কংগ্রাটস টু ইউ টু !” বলে হাত মিলিয়ে হাসলো তোয়া |
” থাঙ্কস !”

“আমার পুরো নামটা মন দিয়ে শুনবেন,” তোয়ার এই কথায় সাগরনীল কান খাড়া করলো, মন দিল, “স্বচ্ছতোয়া চ্যাটার্জি|”
চোখে দুস্টুমি খেলিয়ে সাগরনীল বললো, “স্বচ্ছতোয়া ! তা আপনার নামের মানে কি পরিষ্কার জল ? সেটা তো পৃথিবীতে খুবই দরকারি জিনিস | আর হায়দরাবাদে তো জলের খুব কদর, পরিষ্কার হলে তো কথাই নেই |”
তোয়া হাসলো | অনেকবার শুনেছে এই ইয়ার্কিগুলো পুরোনো হয়ে গেছে, তাও সাগরনীল এমন করে চোখ গোলগোল করে বললো, যে এই পরিবেশে অন্যরকম লাগলো | সবাই কেজো কথা বলছে আর নিজের নিজের কোম্পানির গুণ গাইছে, সেই একঘেয়ে | মায়া, মায়া চোখের সাগরনীলকে আগেও লক্ষ্য করেছে তোয়া | এক মাথা কোঁকড়ানো চুল প্রায় কাঁধ অব্দি, গালে হালকা দাড়ি | গায়ের রং ফর্সা ঘেঁষা, তবে সে বোধয় সারাদিন বাড়ি বা অফিসের ভেতরে থাকে বলে আরও ফ্যাঁকাসে হয়ে গেছে | একটু অন্যরকম যেন |
” তা আপনার নাম কি খুব সুন্দর নাকি হ্যাঁ ?সাগরনীল ?”
সাগরনীল হাসলো না, গম্ভীর মুখ করে বললো, “আররে ! আপনার নামটা সত্যি সুন্দর | আমারটা জোড়াতালি দেয়া | ওই নীল দিয়ে শেষ করতে হবে বলে আগে যা পেয়েছে জুড়ে দিয়েছে, সাগর না হয়ে ডাঙাও হতে পারতো | তবে আমাদের দুজনেরই কিন্তু জোড়ায় জোড়ায় নাম, কি কোইন্সিডেন্স !”
এইবার জোরে হাসলো তোয়া, গল্প জমে উঠলো | আশেপাশের কেজো কথা, মানুষজন ঝাপসা হয়ে এলো | দুজনে এটা, সেটা নিয়ে নিয়ে অনেক গল্প জুড়ে দিল | শেষে নীলেশ এসে ডাকলো যখন তখন সাগরনীলের খেয়াল হলো যে ওকে আরও অন্যদের সাথে কথা বলতে হবে |
“ওকে তোয়া বাই, পরে দেখা হবে তাহলে”, ফোন নম্বর আদানপ্রদান করে এগিয়ে গেল ও |
“বাই সাগরনীল, নাকি সাগর ? নাকি নীল ? সি য়া”, তোয়ার হাসিটা ওর নামের মতোই স্বচ্ছ |
“যা ইচ্ছে” হাসলো সাগরনীলও | যেন এইভাবে প্রাণখুলে অনেকদিন পরে, নাকি জীবনে এই প্রথম ?

নীলেশ বন্ধুর মুখ দেখে জিজ্ঞেস করলো, “কি মন দিয়ে ফেলি নাকি রে ?” হাসলো সাগরনীল, দিয়ে ফেললে কি আর ক্ষতি ? মন তো পড়েই আছে, কি আর করছে সেটা দিয়ে সাগরনীল ?
সারাদিন শুধু কাজই তো করে, আর সময় পেলে বই পড়ে, এই টুকটাক গান গায়, একা একাই দাবা খেলে | এইগুলোর কিছুতেই মনের প্রয়োজন নেই | তা সেই মহাশূন্য মন যদি তোয়া নিয়ে যায়, যাক না | প্রেমে পড়লে মন্দ হয় না | সারাজীবন কি একা থাকবে নাকি সাগরনীল ?
তোয়ার মুখটা লেগে রইলো সাগরনীলের মনে, ওই মিষ্টি হাসিখানা যেন চোখের সামনে ভেসে থাকলো, বাড়ি ফিরে এসেও |

বাড়ি ফিরে এসেই, বাবার ছবির সামনে রাখলো ওর আজকের পাওয়া ট্রফিখানা | ওর এই সাফল্য বাবা দেখে যেতে পারলো না, এইটাই আফসোস সাগরনীলের | নিজের আনন্দ ভাগ করে নিতে পারতো যদি বাবার সাথে তাহলে আরও হাজারগুন বাড়তো সেটা | ওর প্রথম চাকরি পাবার পরে পরেই মারা গিয়েছিলেন ওর বাবা, তখন ও সবে তেইশ |
তাই ফ্রেম বন্দি বাবাকেই হেসে বললো, “আমাদের স্টার্টআপটা আজ অনেক পুরস্কার কুড়োলো জানো বাবা ! বেশ দাঁড়িয়ে গেছে এইবার |”
নীলাদ্রি রায়চৌধুরী নিজের ছোট ছেলের দিকে তাকিয়ে হাসছেন | জীবনেও এই ছেলে বড্ডো প্রিয় ছিল উনার, ভালোবেসে ডাকতেন বাবুই বা বাবুই পাখি বলে | কেন এই নাম এখন আর ঠিক মনে নেই সাগরনীলের | ওর যে কোনো সাফল্যে গর্ব বোধ করতেন, আরও এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা দিতেন | আজও সেই মায়া যেন মুড়ে রেখেছে সাগরনীলকে |

জামাপ্যান্ট পালটাতে পালটাতেই ফোন এলো একটা| নম্বর চেনাই, ফোনে দেখাচ্ছে “আসানসোল বাড়ি”| নম্বরটা আসলে ওর মায়ের, স্বপ্না রায়চোধুরীর,তবে ওর কাছে উনি এইটুকুই, বাড়ি |

“হ্যাঁ বলো”, ফোন ধরে গলায় কোনো আবেগ নেই সাগরনীলের, বাবার ছবির সাথে কথা বলার সময় যা উচ্ছাস ছিল তার ছিটেফোঁটাও নেই জলজ্যান্ত মায়ের বেলায় |
“কেমন হলো রে পুরস্কার প্রাপ্তি অনুষ্ঠান ?” ওর মা জিজ্ঞেস করলেন | মনে মনে সাগরনীল ভাবলো, বাবা!! এমন শব্দ ব্যবহার করে না ! উফঃ !
মুখে বললো, “পার্টি ভালোই হলো | কিছু বলছিলে ?”, মায়ের সাথে কথা বাড়ানোর ইচ্ছে নেই ওর, নিজের আনন্দ ভাগ করার ও কোনো তাগিদ নেই | কি যায় আসে ওর আনন্দে ওর মায়ের ? তার তো বড় ছেলে আছেই, নয়নের মনি |
“না, ওই খুব ভালো লাগলো শুনে রে যে তুই এত উন্নতি করছিস …”
“থ্যাংক ইউ | আমি খুব টায়ার্ড | তোমার শরীর ঠিক আছে তো ? দাদা ভালো আছে তো ?”
ওর মা চেনেন ওর গলার এই সুর, “হ্যাঁ রে ভালো আছে | তুই রেস্ট নে তাহলে, ভালো থাকিস সাগর |” উনিও ওকে বাবুই বলে ডাকতেন আগে, ওই বারণ করেছে, তাই সাগর বলেই ডাকেন এখন |
ফোন রেখে গুম হয়ে বসে থাকলো সাগরনীল |

বাবা নেই, আর কেউ নেই ওকে ভালোবাসার ওই আসানসোলের বাড়িতে | মা আর দাদা, একে ওপরের জন্যে | সেখানে ওর জায়গা কোই ? সবাই বলে ওর মায়ের মতন মা হয় না | ছেলের জন্যে কত কষ্ট স্বীকার করেছেন উনি | মমতাময়ী নাকি উনি ! তা সেই মমতার এক কণাও তো সাগরনীল পেল না |
সেটা কেউ দেখেছে ?
বাবা চলে গিয়ে বড্ডো একা হয়ে গেছে ও, আজকের সন্ধ্যেতে বাবা থাকলে কি খুশি যে হতেন !
আচ্ছা ওই তোয়াকে বাবা পছন্দ করতেন ?
কেন ? মানে এই প্রশ্ন কেন হঠাৎ ?
ওর চোখগুলো বড্ডো সুন্দর ! হাসিটাও | কি বুদ্ধিদীপ্ত মুখ | আর ওই যে কথা বলা, সব কিছুই ভালো তোয়ার |
“এই সাগরনীল, তুমি কি প্রেমে পড়িয়াছ ?” ওর নিজের মনই যেন ওকে আওয়াজ দিল |
বত্রিশ বছর বয়েসে কি প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়া যায় ?
কেন যাবে না? প্রেমে পড়ার আবার কোনো বয়েস হয়ে নাকি রে বাবা !! আর বত্রিশ তো আর বাহাত্তর না |
ফোন বের করে তোয়াকে মেসেজ করে দিল একটা,
“ইট ওয়াস গ্রেট টকিং তো ইউ টুডে | লেট্’স হ্যাভ ডিনার টুমোরো ? ~সাগরনীল ”
সুযোগ হাতছাড়া করার মানুষ না সাগরনীল | ভালো লেগেছে যখন মেয়েটাকে, কথা এগিয়ে নিয়ে যেতে ওর কোনো দ্বিধা নেই | তোয়ার সাথে কথা বলেও খুব ভালো লেগেছে সাগরনীলের | তার উপর তোয়াও নিজের ব্যবসা চালায়, কাজের দিকেও একে অপরকে বুঝতে সুবিধে হবে | যদি আগামীদিনে আরও এগোনোয় যায়, এবং এগোলো এর একটা ভালো পরিণতি হয় তাহলে হাত গুটিয়ে বসে থাকা বোকামি |

টুং করে আওয়াজ হলো, তোয়ার মেসেজ ঢুকেছে ফোনে,
“সিওর |আই উয়িল পিক ইউ আপ আট সেভেন পি .এম. |”

রাজি হয়ে গেছে মানে ওদিকেও উৎসাহ না থাক একটা কৌতূহল তো আছেই |
উরিবাবা !! নিতে আসবে লিখেছে তো | একজন মেয়ে ওকে কাল নিতে আসবে ? দারুন ব্যাপার | ও তোয়াকে আরকেজন সমগোত্রীয় ব্যবসায়ীই ভেবেছে | তাই কে কাকে নিতে আসবে তা নিয়ে ওর কোনো উদ্বেগ নেই | তবে ব্যাপারটা বেশ অভিনব !
নাহ! তোয়া মেয়েটা আর পাঁচটা মেয়ের মতন না, একদমই না |
এক রাশ ভালো লাগা সাগরনীলের মনে মাখামাখি হয়ে থাকলো |

 

আজ রবিবার|
উঠতে অনেক দেরি করেছে সাগরনীল | এমনিও ও রাতে জেগে থাকে তিনটে, চারটে অব্দি আর সকালে পড়ে পড়ে ঘুমোয় | এইটাই ওর অভ্যেস হয়ে গেছে এই এত বছরে | তা, রবিবার তো কথাই নেই | কাজের লোককেও আসতে বারণ করা আছে| সে এমনিও আসে নিজের মর্জি হিসেবে,| সাগরনীল কি আর ওইসব হিসেব রাখে নাকি ?
চোখ খুলে দেখলো সাড়ে দশটা বাজে, এইবার উঠতেই হবে খিদে পাচ্ছে যে |
একটা থ্রি রুম ফ্ল্যাটে ও একাই থাকে | রোজগার এখন মন্দ না, তাই কিনেই নিয়েছে বাড়িটা | বাড়িটা এমনিতে বেশ বড়, কিন্তু কোনো শ্রী নেই | একটা ঘরে খাট আছে সেখানেই ঘুমোয়, হলে কিছু বিন ব্যাগ, দু চারটে মোড়া এইসব | একটা ঘরে শুধুই বই, গোটা ঘর জুড়ে, মেঝে থেকে দেয়াল অব্দি তাক করা আছে | বইয়ে ঠাসা | যখন ইচ্ছে টেনে টেনে পড়ে | যত ইচ্ছে কিনে কিনে ঘর বোঝাই করে | তিন নম্বর ঘরটা একদম খালি, দরজা লাগানোই থাকে সেটার | ও হ্যাঁ, একটা আট জনের ডাইনিং টেবিলও আছে, সেখানে দু তিনটে ল্যাপটপ, মনিটর এইসব সাজিয়ে কাজ হয় | আর আছে একটা বিশাল ফ্রিজ | তাতে থাকে চকলেট, জুস্, কোল্ড্রিংকস, পাউরুটি, কার্টনে করা দুধ, এইসব জিনিস | এইগুলোর উপরেই থাকে সাগরনীল বেশিরভাগ সময় | ছন্নছাড়া সংসার একদমই |
কে দেখছে ? কি যায় আসে ?
বন্ধু বান্ধব আসলে ওই পার্টি হয়, আবার সব চুপচাপ | একটা একলা মানুষ | তার নিজেস্ব চিন্তাভাবনা, সুখ, দুঃখ, ভয়, কষ্ট সব এইখানে দেয়ালে, দেয়ালে ঠোক্কর খেয়ে বেড়ায় | কেউ দেখার নেই, শোনার নেই |
যা প্রাণ চায় করে, যখন ইচ্ছে খায়, যখন ইচ্ছে ঘুমোয় | শরীর খারাপ করলেও একটু যত্ন করার নেই, মাথার কাছে বসার কেউ নেই | তাও নীলেশ আছে, একসাথে কাজ করে তাই খোঁজ পায়, আসে দেখতে | কিন্তু তারও তো নিজের সংসার আছে, ছোট ছেলে আছে একটা, সব সময় তার পক্ষে সম্ভব না আসা | তাই মাঝেমাঝেই জিজ্ঞেস করে, “ধর আমি আসতে পারলাম না কোনোদিন, আর সেদিনই সত্যি বাড়াবাড়ি হলো তখন? কেউ তো জানতেও পারবে না |”
সোজা উত্তর সাগরনীলের, “সেরম হলে হয়েই গেল | কারুর কিছু জানার দরকার কি ? দি এন্ড হয়ে যাবে, তুই বিজনেসে আমার ভাগটা আপন করে নিস্, এই ফ্লাটটাও তোকে লিখে দিয়ে যাবো | যদি একদম পচে, গোলে যাই তাহলে ফিউমিগেশন করিয়ে নিস্ | ওহ হ্যাঁ, বাড়িতে আমার সেভিংসগুলো পাঠিয়ে দিস প্লিজ | ”
নীলেশ অসন্তোষ প্ৰকাশ করে মাথা নাড়ে, “বাজে কথা রাখ ! এইবার সংসার কর সাগর, অনেক তো হলো |”

সংসার পাতার কথা ছিল সাগরনীলের, বিয়ে অব্দিও কথা এগিয়েছিল | সেসব চুকে বুকে গেছে তো কবেই ! প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হত, ক্রমশ সয়ে গেছে | তারপর, ভেবে দেখেছে ভালোই হয়েছে | সঙ্গীতার সাথে ও মানিয়ে চলতে পারতো না, ভালোবাসা সেই কম পড়তো | তার থেকে এই ভালো |
আর পাঁচটা মানুষের মতন না সাগরনীল, ওর মনটা অন্য রকম | সেভাবে দেখলে খুব সহজ আবার সাংঘাতিক জটিলও | সেখানে রাগ, দুঃখ, অভিমান সব কিছুই সাধারণের থেকে বেশি ধ্বনিত হয় | প্রতিটা আবেগের অনুরণন দরকারের থেকে বেশি নাড়িয়ে দিয়ে যায় ওকে | ও ভালোবাসে যেমন একদম নিজের সবটুকু দিয়ে, সেরম একবার মুখ ফিরিয়ে নিলে আর তাকিয়েও দেখে না | তাই সঙ্গীতার সাথে ছাড়াছাড়ি হবার পর আর কোনোদিন ওর সাথে কথাও বলেনি, নিজের মন হাজার টুকরো হয়ে ভেঙেছে তবুও না |
সাগরনীলের এখন যা বয়েস, তাতে ওর আর সেই ছেলেবেলার চোরা চোরা ভালোলাগার শিরশিরানি নেই | এখন কাউকে যদি মনে ধরে, তার সাথে কথা বলে জানতে চাইবে আজীবন হাঁটবে কিনা পাশে | ওইসব ছেলেমানুষি, প্রেম প্রেম খেলা …দূর ওইসব আর পোষায় না | হাত ধরার থেকে এখন মনের দুটো কথা বলাটাই বেশি দরকারি মনে হয় ওর কাছে | এমন কেউ যে ওকে বুঝবে, যাকে ও বুঝবে | একে ওপরের পাশে থাকবে |
এমন কাউকেই খুঁজছে ও |
নীলেশের স্ত্রী, শ্রুতি, অনেকজনের সাথে ওকে দেখা করিয়ে দিয়েছে এই ক’বছরে, শুধু বলবে, “সাগরদা এইরকম একা একা থাকো তুমি আমাদের ভালো লাগে না |” এই করে করে, এর ওর সাথে ওকে দেখা করতে পাঠায় | যায় সাগরনীল, শ্রুতির সাথে কে তর্ক করবে বাবা !! রাখি বাঁধে ওর হাতে প্রতি বছর, নিজেই নিজেকে ওর বোন বানিয়ে ফেলেছে | ভালোও বাসে নিজের দাদার মতন |
তাই যায় সাগরনীল| কিন্তু কথা বলে কারুর সাথেই জুৎ পায় না | হয় ভীষণ মেকি মনে হয়, নাহয় একদম নির্বোধ সুন্দরী, নাহলে আরও অন্য কিছু | একবারের বেশি কারুর সাথে দেখা হয়নি ওর |
ফিরে এসেই অন্ধকার মুখ করে বলে শ্রুতিকে, “না রে, আমার সাথে জমবে না |”
সৌন্দর্য্য নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই ওর, ও নিজেও সাধারণ দেখতে | কিন্তু নির্বুদ্ধি মানুষের সাথে ও থাকতে পারবে না, বা একদম অযৌক্তিক কথা বলবে যে, বা এমন কেউ যে বলবে, “অঙ্ক তো খুব ভয়ঙ্কর জিনিস !” না ভাই ! ক্ষমা করো |
শ্রুতি রাগ করে, বলে “তুমি এন্ট্রান্স টেস্ট নিয়ে নাও |”
সাগরনীল হাসে, বলে, “আচ্ছা তুই বল তার সাথে যদি সুখ, দুঃখের কথা না বলা গেল তাহলে আর কি লাভ ? আমি জোক মারলাম বৌয়ের মাথায় ট্যানগেন্ট ও হলো না, ওপর দিয়ে গেল…সারা জীবন গোমড়া হয়ে থাকবো ? না তিন কিলো আটা, পাঁচ কিল চাল শুধু এই কথা বলবো ?”

তাই কি কাল তোয়াকে ভালো লেগেছে ওর ? ওর সাথে যেন মিল আছে তোয়ার |
তোয়ার ওই প্রাণখোলা হাসিতে যেন অনেক অভিজ্ঞতা লুকিয়ে আছে | পৃথিবীতে যেন অনেক কিছু দেখেছে মেয়েটা, ওর ওই কাজল কালো চোখে অনেক কথা | আর কথা বলেই বোঝা যায় যে ও খুব বুদ্ধিমতী | ঐটুকু আলাপেই বেরিয়ে এসেছে ওরা দুজনেই বইয়ের পোকা | বই পড়তে ভালোবাসে এমন মানুষের সাথে সাগরনীলের সহজেই বন্ধুত্ত্ব হয়ে যায় | তার উপর তোয়া বলেছে, “নন ফিকশনই পড়ি আজকাল, ফিকশন আর সেভাবে ভালো লাগে না, খুব ভালো না হলে |” উফঃ ! কি ভালো যে লেগেছে সাগরনীলের শুনে | ওর ও তো একই বক্তব্য |
এক বাটি দুধ আর অনেকটা কর্নফ্লেক্স নিয়ে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালো ও | এইটাই জলখাবার, আবার হয়তো এই জিনিসই দুপুরেও খাবে | খেতে, খেতেই মাথায় মাথায় অনেক কিছু হিসেবে করলো | খাওয়া শেষ করে ল্যাপটপটা নিয়ে বসলো | কাজ, কাজ এই নিয়েই থাকে ও | শনি-রবি, দিন, রাত কিছু নেই |
কতক্ষন কাজ করেছে জানে না | টুং করে মেসেজ এল ফোনে, তোয়া ঠিকানা জিজ্ঞেস করেছে ওকে | হাসলো সাগরনীল, পাঠিয়ে দিল ঠিকানা | তারপর দেখলো ঘড়িতে একটা বাজছে, চান করতে গেল | গালে দাড়ি জমেছে হালকা, কেটেই ফেললো | ওই ঝাঁকড়া চুলে শ্যাম্পু দিয়ে দিল বেশ করে | গতকাল এই চুলেই জেল ফেল মেরে কিসব করে আঁচড়ে দিয়েছিল শ্রুতি | ” চুলটা কাটো, চুলটা কাটো” বলতে থাকে, তবে নিজের চুলটা দিব্যি লাগে সাগরনীলের | কাঁধ অব্দি এসেছে অনেকদিন ধরে বেড়ে বেড়ে | আরো বাড়াতে চায় |
শ্যাম্পু হয়ে গেল বাবা ! শ্রুতি বলতে পারবে না “পরিচ্ছন্ন হয়ে যাও না কেন, উস্কোখুস্কো হয়ে গেলে আর কে ভালো কথা বলবে ?”
শ্রুতি বলবে বলেই কি শুধু ? না ও নিজেই চায় যে তোয়ারও ওকে ভালো লাগুক | নিজের ভাবনায় দরাজ হাসলো সাগরনীল, বাথরুমটা গমগম করে উঠলো, “হয়েছে রে !! ফেঁসে গেছে সাগরনীল রায়চৌধুরী ! পরিষ্কার জলে ডুবে মরেছি শেষে !! ”
অন্যদিনের মতন যা পরে আছে তাই পরে যাবে না, আজ বের করলো একটা ভালো শার্ট | কেনে মাঝে মধ্যেই জামাকাপড় ওই এদিক ওদিক যেতে হয় বলে | তারপর একবার পরার পর সেগুলো পড়েই থাকে, আর ও সেই দুটো কালো টিশার্টই ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে পরে | আগে তাও অফিসে কাজ করতো তাই শার্ট পড়তে হত | এখন নিজের ব্যবসায় কোনো বাধ্যবাধকতা নেই, জামা পরে গেলেই হলো, ব্যাস !
জামা, প্যান্ট পরে, নিজের চুলটাকে আঁচড়ে মাথায় একটা ঝুঁটির মতন করে জড়িয়ে পেঁচিয়ে বেঁধে নিল | এত কোঁকড়ানো চুল যে খোঁপার মতন দেখতে লাগছে | খুব সুন্দর করে বাঁধা যে তা না, তবে মুখ চোখে পড়বে না, ওই যাকে বলে পরিছন্ন লাগবে | আর এইরকম আজকাল অনেক ফুটবলাররা বাঁধে, বেশ লাগে সাগরনীলের |
তারপর জুতো পায়ে গলিয়ে একদম তৈরী হয়ে, দরজা লাগিয়ে নিচেই নেমে গেল |

ঠিকানা আগেই জেনে নিয়েছিল তোয়া, ঠিক সাতটায় সে গাড়ি নিয়ে হাজির হলো | কমপ্লেক্সের গেটের সামনে এসেই দেখলো সাগরনীল বাইরেই দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে মুখ করে কি যেন ভাবছে | দু, তিন বার হর্ন দিল তোয়া, তবে ওকে খেয়াল করলো | এক গাল হেসে এগিয়ে এল |
চুলগুলো মুখের পাশ থেকে সরিয়ে বেঁধে ফেলায় মুখটা কালকের পার্টির থেকে একদম অন্যরকম লাগছে, আরও পাতলা, ছোট্ট যেন | তার ওপর আজ দাড়িও নেই গালে | কেমন যেন ছেলেমানুষ ছেলেমানুষ দেখাচ্ছে | চেহারাটাও একদমই রোগা, তাই পাঁচ আট হলেও যেন আরও লম্বা লাগে ওকে দেখতে | সব মিলিয়ে ত্রিশের উপর মনে হচ্ছে না | যদিও তোয়া কাল বাড়ি ফিরেই একটু ইন্টারনেট ঘেঁটে দেখেছে যে সদ্য ওর বয়েস বত্রিশ ছাড়িয়ে গেছে এই বছরই, মনে মনে ভেবেছে “ভালো, ম্যাচুওর হবার আশা রাখা যায় |” নাহলে ওর অভিজ্ঞতায় বেশিরভাগ ছেলেই তিরিশের কাছাকছি এসেও মনে মনে সেই কলেজেই থেকে গেছে, বয়েসেই বেড়েছে শুধু, মানুষ হয়নি |
ভালো করে লক্ষ্য করলো তোয়া, সাগরনীল সত্যিই খুব রোগা | গতকাল রাতে তাও ওই সুট পরেছিল বলে অতটা বোঝা যায়নি, কিন্তু আজ সাদা শার্টের হাতা অযত্নে গুটোনো ওই কনুই অব্দি, আর তার তলায় হাতগুলো একদমই হাড় সর্বস্ব | দু-হাতেই কাটা-ছেঁড়ার হাজার আঁকিবুকি | জামাটাও গায়ে যেন আলগা হয়ে আছে, ঠিক জুৎ করে বসতে পারছে না| সেটাকে গুঁজেছে প্যান্টে,তাও যেন ওই কোনোমতে, ফুলে ফেঁপে আছে জায়গায় জায়গায় | জুতো পরেছে পায়ে, তার সাথে মোজা পরেনি | কি একটা অবলহেলা যেন সারা গায়ে মেখে আছে | কাল কিন্তু এরকম লাগেনি, মানে গতকাল কেউ ধরে বেঁধে সাজিয়ে গুছিয়ে পাঠিয়েছিল |
তোয়া নিজে যত্ন করে সাজে, এইরকম ছন্নছাড়া মানুষজন ওর পছন্দ হয় না, কিন্তু আজ ওই রাস্তার আলোতে সাগরনীলকে দেখে কেন জানি অপছন্দ হলো না উল্টে একটু মায়াই লাগলো |
সাগরনীল ওর গাড়িতে বসতেই ও জিজ্ঞেস করল, “ডিনারে কোথায় যাবেন ? কোনো প্রেফারেন্স ?”
“আপনার যেখানে ইচ্ছে |”
হেসে গাড়ি চালালো তোয়া, “ওভার দা মুন যাই |”
ওভার দা মুনের ম্যানেজার তোয়াকে চেনে, ওর পছন্দের একটা কোনার টেবিলে ওদের জায়গা করে দিল | সুন্দর সন্ধ্যেটা | রেস্টুরেন্টের আলোতে তোয়ার কানের দুল ঝিলিক দিচ্ছে | সাগরনীল লক্ষ্য করলো আজ ও একদমই অল্প সেজেছে, পরেছে একটা হালকা লাল টপ আর জিন্স | গয়না বলতে শুধু কানের দুল, আর হাতে একটা বড় ডায়ালওয়ালা ঘড়ি | অল্প প্ৰসাধনী, ওই চোখে কাজল আর ঠোঁটে লিপস্টিক| কি মিষ্টি যে লাগছে দেখতে | চুল আজ আর মাথায় টেনে বাঁধা না, এমনি একটা ক্লিপ দিয়ে আলগা করে লাগানো |
তোয়াই কথা শুরু করলো, হেসেই বললো, “আমি কোনো ছেলেকে নিতে আসবো বললেই বেশির ভাগই আপত্তি করে দেখেছি, ওটা দেখেই আমি বুঝে যাই এর সাথে বন্ধুত্ত্ব এগোবে না | আপনি দেখলাম কিছুই বললেন না |”
সাগরনীল হাসলো, “তুমি বলা যাবে ? মানে সারা সন্ধ্যে আপনি আজ্ঞে করতে হলে চাপ |”
তোয়াও হেসে বললো, “একদম, একদম |”
“আসলে আমিও একটু আশ্চর্য হয়েছিলাম | তবে আমার তো খুব ভালো লেগেছে এই প্রস্তাব, আপত্তি করার কোনো কারণই ছিল না আমার | ‘আমি পুরুষমানুষ আমিই তোমাকে নিতে যাবো’ এইসব চিন্তাধারা আমার পোষায় না | আর তাছাড়া, আমার এই শহরের ভেতরের রাস্তায় গাড়ি চালাতে একদম ভালো লাগে না | আমার ধৈর্য থাকে না এই ট্রাফিকে | আমাকে যদি গাড়ি চালিয়ে কোথাও না যেতে হয় সব থেকে খুশি হবো আমি | ওই রোড ট্রিপ বাদে | সে আমি যেতে এক পায়ে খাড়া | ”
সাগরনীলের কথায় তোয়া একটু অবাক হলো, ভালোও লাগলো শুনে |
হেসে বললো, “বাহ্ ! তাহলে পরের বারও আমিই পিকআপ করে নেবো তোমাকে ? কি ?”
এই যাহ!! দুম করে প্রথমেই বলে দিল ও যে আবার দেখা করতে চায় ?
ওর কথায় মিটিমিটি হাসছে সাগরনীল, থমকালো না, সহজ গলাতেই বললো , “তাহলে তো খুব ভালো হয়, আমিই বলতে যাচ্ছিলাম যে পরের বারেও যদি প্লিজ তুমিই গাড়ি চালাও বড় উপকার হয় | আমি অন্য কিছু কাজ করে দেব নাহয় |”
এইসব কথাই তো বলতে সময় লাগে, না ? যে পরের বার দেখা করবো কবে ? রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা থাকে ? না ? তাহলে ওরা খাবার আসার আগেই কি করে এইসব পেড়িয়ে এলো ? দুজনেরই কেন যেন মনে হলো যে কতদিন চেনে ওরা একে অপরকে | সদ্য কাল সন্ধ্যেবেলায় দেখা হয়নি, ওরা যেন একসাথে এইরকম আড্ডা দিয়ে কাটিয়েছে অনেক সকাল, সন্ধ্যে |
কথা সহজেই শুরু হয়েছিল, এগোলোও দিব্যি | সাগরনীল মনের মতন মানুষ পেলে অনেককিছুই বলে, সে জমিয়ে আড্ডা দিল | তোয়াও ওর সাথে কাল থেকেই সাচ্ছন্দ বোধ করছিল | আজ অনেকটা সময় কাটিয়ে যেন আরও ভালো লাগলো এই আপনভোলা ছেলেটাকে |
নিজেদের পড়শোনা, ব্যবসা এইসব নিয়েই বেশি কথা হলো | তোয়া দিল্লিতে জন্মেছে, ওখানেই ছিল ছোটবেলায় | তারপর দেরাদুনে ওয়েলহাম গার্লস স্কুলে পড়েছে ক্লাস সেভেন থেকে | কলেজও আবার দিল্লিতে, এখন কাজের সূত্রে হায়দরাবাদে থাকে| সাগরনীল তো আসানসোলের স্কুলে পড়েছে, তারপর আইআইটি দিল্লি, হিসেবে করে বললো,”আমরা তো দুজনে একই সময় দিল্লিতে ছিলাম তবে দেখা হয়নি, কেউ কাউকে চিনতাম না |”
মাঝে মধ্যেই ছোট ছোট প্ৰশ্ন উত্তরে একে অপরকে আরও জানাও হলো|
“প্রিয় লেখক কে ? আমার ডালরিম্পেল |”
তোয়া উত্তর দিল,”আমার এখন হারারি |”
“আমি অনেকদিন কত্থক শিখেছি, তুমি গান বা নাচ কিছু করো ?”
এইবার সাগরনীল উত্তর দিল, “দুটোই করি | গানটা মন্দ করি না, নাচটা ভালো করি না | তবে করতে ছাড়িনা কোনোটাই”, বলে নিজেই জোরে হেসে উঠলো, “গান আমার বাবা খুব ভালো গাইতেন, উনিই অল্প অল্প শিখেয়েছিলেন |আর আমি এক বছর কাজের সূত্রে কেরিয়ারের শুরুর দিকে এই সাত মাস মতন নিউ ইয়র্কে ছিলাম | ওখানে বলরুম ডান্সিং শিখেছিলাম প্রায় তিন চার মাস, আমার ম্যানেজার জেসিকার চক্করে | নাচ, গান দুটোরই তো অংকের সাথে একটা গভীর যোগসূত্র আছে | সুর,তাল সবেতেই তুমি ম্যাথসের আপ্পলিকেশান পাবে, আমার ঐটা খুব ইন্টারেষ্টিং লাগে |”
তোয়া দেখলো এই কথা বলতে বলতে সাগরনীলের চোখ, মুখ যেন উজ্জ্বল হয়ে উঠলো | তোয়াও পড়েছে যে সংগীত আর অংকের একটা মেলবন্ধন আছে, তাল, লয় এইসব তো সহজেই অংকের ধারায় বাঁধা যায়, এবং এইটা আজকের জিনিস না | প্রাচীন কাল থেকে এ নিয়ে গবেষণা চলে আসছে | তবে কজন আর এইভাবে ভাবে বা বলে ?
তাই বললো, “সেটা ঠিক| মিউসিক থিওরি নিয়ে কিছু লেখা আমিও পড়েছি |” ও এই কথা তুলতেই সাগরনীলের চোখে মুখে আরও উত্তেজনা খেলে গেল | গল্প জমে উঠলো|
রোগা হলে কি হবে, সাগরনীল খায় প্রচুর, গায়ে লাগে না সেটা অন্য ব্যাপার | সে অনেক কিছু অর্ডার করলো, আর তোয়া অবাক হয়েই দেখলো সেইসব দিব্যি খেয়েও ফেললো | ও নিজে নিয়েছিল এক প্লেট পাস্তা, তাও সবটা শেষ করতে পারেনি | পাতে থেকে গিয়েছিল | সেটা দেখে সাগরনীল একটু ভুরু কুঁচ্কেই জিজ্ঞেস করলো, “ওইটা খাবে না তুমি আর ?”
তোয়া ঘাড় নাড়লো, “একদম ফুল আমি ! আর পারছি না |”
হাত বাড়িয়ে ওর প্লেটটা নিয়ে নিল সাগরনীল, বললো, “আশা করি আমি বাকিটা খেয়ে নিলে তুমি আপত্তি করবে না | আসলে, খাবার নষ্ট করাটা আমি একদম পছন্দ করি না, ” বলে ওর চামচ দিয়েই খেতে শুরু করে দিল |
তোয়া ভাবলো, এ ভারী অদ্ভুত মানুষ তো ! একদম অন্যরকম | সাগরনীলের মতন আর কাউকে ও চেনে না |

 

বিল কিন্তু সাগরনীল দিতে দিল না তোয়াকে |
তোয়া বললো, “বা রে ! এইযে বললো তুমি ছেলে, মেয়ের তফাৎ করো না | তাহলে আমি দিলে কি ক্ষতি ?”
দমল না সাগরনীল, বললো,” এতে জেন্ডারের কোনো ব্যাপার নেই | আমার সমান না হোক অন্তত নিজে যেটা অর্ডার করেছিলে সেটাও পুরোটা খেতে যদি তুমি আমি কোনো আপত্তি করতাম না | কিন্তু তুমি খেয়েছো আমার থেকে অনেক অনেক কম | এমনকি তোমার পাস্তাও আমিই অর্ধেক খেয়েছি | তাহলে কি করে মেনে নি তুমি বিল দেবে, বল? এ তো একদম কাঙালি ভোজন হয়ে যাবে | আমি বুভুক্ষুর মতন খেয়ে গেলাম আর তুমি পায়সা দিলে |”
যুক্তি আছে কথায়, হেসে ফেললো তোয়া |
সাগরনীল নিজেই মীমাংসা করে বললো, “তুমি আমাকে আইসক্রিম খাওয়াও বরং, চলো ..”
এত খেয়ে আবার আইসক্রিম খাবে ? ওর মুখে প্রশ্নটা পড়ে ফেলে সাগরনীল ফাজিলের মতন হেসে বললো, “আমি রোগা দেখতে কিন্তু খাই অনেক | না খাওয়াতে চাইলে অসুবিধে নেই, সে আমি বাড়ি গিয়ে খেয়ে নেব | ”
“না না, চলো খাওয়াবো আইসক্রি,”,তোয়ার যেন মজাই লাগলো, এত গুরুগম্ভীর কথা বলে, এত পড়াশোনা নিয়ে আগ্রহ আর আইসক্রিম খেতে চাইছে কেমন ছেলেমানুষের মতন |
আইসক্রিম খেতে খেতেও অনেক কথা হলো |
সাগরনীল হঠাৎ বললো, ” আচ্ছা আমার ব্লাড গ্রূপ বি পসিটিভ, তোমার?”
তোয়া হকচকিয়ে গেছে এইটা শুনে, একটু সামলে বললো, “আমার ব্লাড গ্রূপ এ বি পসিটিভ | কেন বলোতো ?”
সাগরনীল বললো, “দেখো যদি আমাদের মধ্যে ব্যাপার এগোয়, এইগুলো জেনে রাখা জরুরি| এমার্জেন্সিতে কাজে লাগে | আমার যদি আক্সিডেন্ট হয় তখন আমার প্রিয় রং কি জেনে তো লাভ নেই, ব্লাড গ্রূপ জানাটা কাজে লাগতে পারে, তাই না ?”
তোয়া নিজেও সোজা কথা বলা পছন্দ করে তাই বলে একদম এইরকম ??
ওর মুখের অভিব্যক্তি দেখে সাগরনীল হেসে বললো, “আমি জানি এইভাবে কথা বলে না সবাই, তুমি কি বিরক্ত হলে ?”
তোয়া ঘাড় নেড়ে একটু আমতা আমতা করে বললো, “না, তা নয় |”
সাগরনীল কিন্তু খুব গম্ভীর হয়ে বললো, “আমি খুব অদ্ভুত একটা মানুষ তোয়া | আমাকে সবার পছন্দ হয় না | হবার কথাও না আর দরকারও নেই আমার…”
বলে তোয়ার দিকে তাকালো, কি ছিল ওর দৃষ্টিতে ? কি ধার সেই চাহুনিতে! যেন তোয়ার মন পড়তে চাইলো | তোয়া কিন্তু ধরে রাখলো নিজের চোখে ওর চোখ, অন্যদিকে তাকালো না | অমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতেও কেন জানি তোয়ার অস্বস্তি হলো না, মনে হলো যেন এইরকম একজন মানুষই ও খুঁজছিলো, যে মনের কথা সহজে বলে দেবে কোনো ভনিতা ছাড়াই |
ওর চোখে চোখ রেখেই আবার কথা বললো সাগরনীল, “আমার কোনো লুকোছাপা নেই, সোজা কথা সোজা ভাবেই বলি | তোমার সাথে কাল কথা বলেই খুব ভালো লেগেছিল আমার | আজ আরও ভালো লাগছে | আমার সবাইকে…মানে কাউকেই এইভাবে ভালো লাগেনা, লাগেনি আগে | তাই শুধু সময় কাটানোর ইচ্ছে নেই আমার, যদি আমরা কম্প্যাটিবল হই আমি সিরিয়াস একটা রিলেশানে যেতে চাই | আই এম থার্টি টু প্লাস, এন্ড আই এম নোট লুকিং ফর ফান তোয়া”, বলে একটু থেমে হেসে জুড়ে দিল, “তবে তুমি টেনশন নিও না তোমার আমাকে পছন্দ না হলে আমি তোমাকে ইররিটেট করবো, বার বার ফোন করে হ্যারাস করবো এরকম একদমই না | আমাকে তুমি না বলে দিলে আমি আর কোনোদিন আসব না | আই উয়িল রেসপেক্ট ইওর ডিসিশান | আমি অদ্ভুত ঠিকই তবে সাইকো না|”

তোয়া চুপ করে ওর কথাগুলো শুনলো, মনে মনে একবার ভাবলো, সাগরনীল তখনও ওর দিকে তাকিয়েই আছে | একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে তোয়া এইবার বললো, “দেখো নীল, তুমি যেটা বললে আমিও সেটার সাথে একমত | আমার নিজেরও তিরিশ বছর বয়েস, আমিও ক্যাজুয়াল সম্পর্কে জড়াতে চাইনা এখন | তবে এক্ষুনি তো কিছু বলা যাবে না | আমাদের একটু একে অপরকে জানতে সময় লাগবে | প্রশ্ন উত্তর দিয়ে তো সব কিছু বোঝা যায় না |”
“অবশ্যই, সময় তো লাগবেই”, সাগরনীল সহমত হয়ে বললো, “আমার কোনো তাড়া নেই তোয়া, আমি শুধু আমার ইচ্ছেটা, উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার করে বলে দিলাম | আমাদের দুজনেরই ব্যস্ত জীবন, সময়ের দাম আছে | সেখানে আমি তোমার বা নিজের কারুর সময়ই নষ্ট করতে চাই না | দ্যাটস অল |”
আরেকবার ওকে ভালো করে দেখলো তোয়া | সত্যি বড় অদ্ভুত মানুষ এই সাগরনীল রায়চৌধুরী | রোগা পাতলা চেহারা, গমগমে গলার আওয়াজ, যুক্তি তক্কো অনেক আবার আইসক্রিমে ঝোঁক |
মনে মনে তোয়া ভাবলো, “আর যাই হোক ইন্টারেসর্টিং কিন্তু বেশ | একে চিনে, জেনেও মজা আছে |”
আইসক্রিম শেষ করে, সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সাগরনীল মাথার ঝুঁটিটা খুলে ফেললো, এক রাশ কোঁড়ানো চুলের মুখের দুপাশে নেমে এলো, “এই চুল বেঁধে রাখলেই বড্ডো টান পরে…”বলে দুহাতে আবার তুলে একজায়গায় করে বাঁধতে গিয়ে গার্ডারটা ছিঁড়ে ফেলে, হতাশ হয়ে বললো, “ব্যাস হয়ে গেল |”
তোয়া নিজের হ্যান্ডব্যাগ থেকে একটা ভালো হেয়ার ব্যান্ড বের করে বললো, “দাও আমি বেঁধে দি | এইভাবে কেউ চুল বাঁধে নাকি ? যেন চোরকে মেরে ধরে বেঁধে রাখছো |”
এই প্রস্তাবে সাগরনীলে অবলীলায় একটা সিঁড়ির ধাপেই বসে পড়লো, যাতে তোয়া ওর চুলগুলো নাগালে পায় | বললো, “দাও বেঁধে একটু, তুমি তো এক্সপার্ট এইসবে| যা সুন্দর চুল বেঁধে এসেছিলে কাল |” বাবা!! এইসবও লক্ষ্য করেছে নাকি ? তোয়া হেসে ফেললো, নিজে এক ধাপ ওপরে বসলো | নিজের চিরুনি একটু চালালো ওর মাথায়, বাগে আনতে না পেরে বললো, “কি ঘন চুল তোমার আর ভীষণ কার্লি তো!” শেষে আঙ্গুল চালিয়েই কিছুটা সামলে এনে বেঁধে দিল | বেশ মজা লাগলো সাগরনীলের | ও নিজে তো একদম রুক্ষ হাতে করে, তোয়ার নরম হাতে আসতে আসতে বেঁধে দেয়াতে যেন খুব আরাম হলো |
লাগলো না তো একটুও ? মনে মনে ভাবলো, তোয়া মেয়েটা খুব অন্যরকম | বড্ডো ভালো |
গাড়িতে বসেও আরও কথা হলো টুকটাক | সারা সন্ধ্যে নানান আলোচনা হলো কিন্তু দুজনেই লক্ষ্য করলো অন্যজনও বাড়ির কথা সেভাবে তুলছে না |
তাই ওকে আবার ওর বাড়ির গেটে নামানোর সময় তোয়াই বললো, ” দেখো এই নিয়ে কথা উঠবেই, তাই আমি আগেই বলে রাখতে চাই | আমার বাবা, মা ডিভোর্সড | দুজনেই আবার বিয়ে করেছেন | আমি সেই বারো বছর বয়েস থেকে ঐজন্যেই হস্টেলে, হোস্টেলে মানুষ | আমার বাবা, মায়ের কারুরই আমার প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নেই সেভাবে | ওই বছরে দু তিনবার দেখা হয়, আলাদা আলাদা করে | আর ওই মায়ের সাথে ফোনে কথা হয়, বাবার সাথে কম | এই অব্দি|”
ও এই কথা কাউকে বললেই অন্যদিকে থেকে হয় সহানুভূতির বন্যা বয়ে আসে, নাহলে প্রচুর প্রশ্ন আসে | কেন ডিভোর্স হলো ? তোমার কি মনে হয়েছিল ? এই ওই অনেক কিছু, বিরক্তিকর!! তাই এখনও সেটাই হবে ভেবে ও নিজেকে প্রস্তুত করলো মনে মনে |
সাগরনীল কিন্তু সেরম কিছু বললো না, সহজ গলাতেই বললো, “তোমার তো আমার থেকে অনেক বেশি কঠিন অবস্থা দেখছি | আমার মায়ের ওই যেটা তুমি বললো আমার প্রতি কোনো ইন্টারেস্ট নেই, কোনোদিনই ছিল না | উনি নিজের বড় ছেলে নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, আমার জন্যে সময় পাননি কোনোদিন”, একটু থেমে বললো, “আমি লাকি যে আমার বাবা আমাকে খুবই ভালোবাসতেন | তবে উনি মারা গেছেন দশ বছর আগেই, আই মিস হিম এ লট “, শেষের কথাটাতে সত্যি অনেক দুঃখ মিশে ছিল, সেটা যেন তোয়াও শুনতে পেল |
মিথ্যে সান্ত্বনা দেয়নি আবার ওর পরিস্থিতিটাকে ছোটও করেনি | তবে এইরকম উত্তর পাবে কল্পনা করেনি তোয়া, “সো সরি |“
সাগরনীল হালকা হাসলো, “আমাদের অনেক জায়গায় মিল আছে দেখছি |”
“হ্যাঁ সেটা ঠিক”, বলে এইবার কিন্তু তোয়া নিজেই একটা প্ৰশ্ন করে বসলো, “তোমার দাদার সাথে তোমার সম্পর্ক কেমন?”
দাদার সাথে সখ্যতা নেই সাগরনীলের, আবার বিবাদও নেই | বিবাদ থাকার প্রশ্ন ই ওঠে না, আলগা একটা মায়া আছে ব্যাস | নিজেই প্ৰশ্নটা আবার করলো, “দাদার সাথে সম্পর্ক ?”
কোনোদিন ভেবে দেখেনি তো |
নীলাদ্রি আর স্বপ্না রায়চৌধুরীর দুই ছেলে, রুদ্রনীল আর সাগরনীল | দুই ভাই | কি তাদের মধ্যের সমীকরণ ?
আজ যেন একটু থমকালো এই প্রশ্নে | ভাবলো, তারপর গলা পরিষ্কার করে বললো, “সম্পর্ক সেভাবে কিছুই নেই | দাদা এমনিতে আমার থেকে তিন বছরের বড় | বাট অনলি ইন এজ | মন, মাথা, বুদ্ধি ওর সবই তিন বছরের বাচ্চার মতন | জন্মে থেকেই ও আলাদা,” তোয়া বুঝতে পেরেছে তাও সাগরনীল পরিষ্কার করে বলে দিল, “তোয়া, আমার দাদা যাকে বলে স্পেশাল, বা মেন্টাললি চ্যালেঞ্জড, লোকে বলবে প্রতিবন্ধী | অনেক রকম শারিরীক অসুবিধেও আছে ওর, কথাও একদম লিমিটেড বলতে পারে | ওকে আমি ভালোইবাসি, তবে ওই আরকি | দুই ভাইয়ের স্বাভাবিক সম্পর্ক কোনোদিনই পসিবল ছিল না, হয়েও নি | বাড়ির মধ্যে শুধু মায়ের সাথেই ওর যা একটা ওই সম্পর্ক আছে | ”
“আই এম সো সরি”, এইভাবে জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হয়নি, তোয়ার শুনে খুব খারাপ লাগলো |
“ইটস ওকে”, সাগরনীলের গলায় কিন্তু অভিযোগ নেই কোনো |
তোয়া চুপ করে আছে দেখে ওই আবার বললো, “তোয়া আমার এই কথাটাও বেরিয়েই আসবে তাই আগে বলে দেয়াই ভালো | আমার মায়ের সাথেও আমার সেরম কোনো সম্পর্ক নেই | ওই মাসে মাসে টাকা পাঠানো আর মাঝে মাঝে একটু ফোনে কথা বলা | ব্যাস ! আমি আমার মাকে পাঁচ বছর দেখিনি | আর কোনোদিন দেখবো কিনা সেটাও জানি না | আমার মায়ের আমার লাইফে কোনো রোল নেই তোয়া | সেখানে ওই মিটিয়ে নাও, মানিয়ে নাও ধরনের কোনো কম্প্রোমাইজ আমি করতে রাজি না | সেটাতে তোমার যদি প্রব্লেম থাকে আমাকে এখনই বলতে পারো, আমি আর তোমাকে বিরক্ত করব না”, এইবার কিন্তু গলায় রাগ স্পষ্ট |
সাগরনীল জানে যে ওর এই কথা সাধারণ মানুষের ভালো লাগে না | ওর আত্মীয়দের মধ্যে কেউ কেউ ওকে বোঝাতে এসেছে যে ওর দাদা অন্যরকম, সেই জন্যে মাকে ওদিকেই বেশি সময় দিতে হয়েছে | আর ঠিক সেই কারণেই উনি হয়তো ওকে অতটা সময় দিতে পারেননি যেটা ওর নিজের প্রাপ্য মনে হয়, কিন্তু আসলে নাকি ওর মা ওকেও খুব ভালোবাসেন | এইরকম অসামঞ্জস্য এসে যায় নাকি দুই সন্তানের একজন অসুস্থ হলে, বা একটু বেশি নির্ভরশীল হলে | এত অভিমান করা ওরই নাকি অনুচিৎ হচ্ছে !
এইসব ওর কানে ঠুনকো অজুহাত মনে হয় | হ্যাঁ ও বেশি অভিমানী, সেটা জানে সাগরনীল | তাই বলে অকারণ ওর অভিমান ? না, যথেষ্ট কারণ ছিল, আজও আছে | ও সুস্থ, স্বাভাবিক হয়ে জন্মেছে সেটাই কি ওর দোষ ? আর কম বেশি হতে পারে, তাও মানা যায় কিন্তু ওর ভাগে মায়ের মমতা পড়েইনি | শূন্য | তাহলে ওকে জন্ম দেবারই কি দরকার ছিল ? তাই এইরকম কথা শুনলে ওর মাথা গরম হয়ে যায় | ও গাড়ির দরোজায় হাত দিয়েই আছে, তোয়াও যদি এই ধরনের কিছু বোঝাতে আসে, ওর আর এগোনোর কোনো আগ্রহ থাকবে না |
কিন্তু তোয়া নিজেও তো একটা ভাঙা সংসার দেখেছে, অনাদর পেয়েছে | জানে যে বাবা, মায়ের কাছে পাওয়া অবহেলা কিরম বাজে একজন সন্তানের মনে | ও বুঝলো সাগরনীলের কথাটা | হতে পারে কারণগুলো আলাদা, কিন্তু ওর মতোই মায়ের স্নেহ থেকে বঞ্চিত এও, সেটা সহজেই দেখলো তোয়া | চুল চেরা হিসেবে বা পালটা প্ৰশ্ন করলো না | বিশ্লেষণ করতে বসলো না, বললো না যে “হতে পারে উনি সত্যি ব্যস্ত ছিলেন” বা “তুমি যদি উনার সাথে কথা বলো খোলাখুলি”| ও জানে এইসবে কোনো সান্ত্বনা পাবে না সাগরনীল, কোনো সুরাহা হবে না | নিজেকে দিয়েই জানে | সামান্য কারণে কেউ নিজের মাকে নিজের জীবন থেকে বাদ দিয়ে দেয় না, আর সাগরনীলের সাথে কথা বলে ওকে অযৌক্তিক মনে হয়নি একদমই | কাজেই একদিন হঠাৎ এই সিন্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে হলো না তোয়ার |
সাগরনীলের হাতে হালকা চাপ দিয়ে বললো, “আই গেট ইট”|
আবার সহজ হয়ে এল সাগরনীল, বললো,”আমার বাড়িটা একবার ঘুরে যেতে পারো, এতদূর এলে |”
“পরের দিন আসবো”, বলে তোয়া হাসলো |
হ্যাঁ পরের বার দেখা হবে, আর কোনো সন্দেহ নেই তাতে | ওদের মধ্যে সত্যিই অনেক মিল আছে | দুজনেই নিজের নিজের কাজে সফল, পরিণত দুটো মানুষ | আর দুজনেই যেন খুব একা |
ওকে নামিয়ে দিয়ে নিজের বাড়ি ফিরে গেল তোয়া, একা ফিরতে ফিরতে, নিজের মনেই বললো, “কমপ্লেক্স মানুষ তুমি সাগরনীল…অনেকটা আমার মতোই যেন |”

বাড়ি ফিরে, নিজের ব্যালকনিতে এসে বসলো সাগরনীল | অনেকদিন পর কারুর সাথে এত কথা হলো, দিব্যি কেটে গেল সন্ধ্যেটা | ওর তো তোয়াকে খুব মনে ধরেছে, তোয়ার কি মতামত কে জানে |
টুং, মেসেজ এল তোয়ার, “পৌঁছে গেছি, গুডনাইট “|
সাগানীলের মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, লিখে পাঠালো, “গুডনাইট তোয়া |” তারপর বসে বসে আকাশ পাতাল চিন্তা করতে থাকলো | সবে সাড়ে বারোটা, ওর এখন সন্ধ্যে, এত বেলাতে উঠেছে ঘুম পায়নি একটুও |
নিজের ছেলেবেলার কথা ভাবছে আর চোখের সামনে ভাসছে আসানসোলে ওদের ওই বাগান ঘেরা, দোতলা বাড়িটা | ওর ঠাকুরদার বানানো, বাবা উপরের তলাটা তুলেছিলেন | হালকা হলদে রং বাইরে, খয়েরি রঙের কাঠের জানলা, দরজা | বেশ বড় একটা ছাদ ছিল, ওর জ্বালায় তালা দেয়া থাকতো সেটা বেশিরভাগ সময় | বাগানে ছিল অনেক ছোট বড় গাছ | সেই বাগানে কত খেলেছে ও, দুস্টুমি করেছে কত | আনমনেই নিজের হাতে পায়ের নানা জায়গায় আঙ্গুল চালিয়ে দেখলো সাগরনীল | প্রচুর কাটাছেঁড়ার দাগ ওর সারা শরীরে, সব ওরই ছেলেবেলার বদমাইশির সাক্ষর | কেটে আবার জুড়ে মসৃন হয়ে গেছে চামড়া অনেক জায়গায়, রং বদলে গেছে কোথাও হালকা, কোথাও গাঢ় | কাজ করতে করতে, বা কিছু মন দিয়ে ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক ভাবে এইসব জায়গায় হাত বুলোনো ওর একটা মুদ্রাদোষ |
ওর ডান হাঁটুর কাছে একটা বড়সর কাটা দাগ আছে | ছোটবেলায় একবার গাছ থেকে পড়ে গিয়ে কেটে গিয়েছিল অনেকটা | আজও হাত দিলে যেন মনে হয় ওই সেদিনের ব্যাথাটা এক মুহূর্ত শিরশির করে জেগে উঠেই মিলিয়ে গেল |
সেই দিনটা ওর মনে জ্বলজ্বল করে |
সেইদিন শুধু শরীরে ব্যাথা লাগেনি, ভীষণ একটা ধাক্কা লেগেছিল ওর মনে | সেইদিন থেকেই বুঝি ওর মায়ের সাথে ওর সম্পর্কে একটা নতুন মোড় এসেছিল, যা দিয়ে এগিয়েই আজ সাগরনীল এইরকম একটা মানুষ হয়ে দাঁড়িয়েছে |

উঠে এসে ল্যাপটপ খুলে বসলো সাগরনীল, নিজেকেই বললো, “কাজ করো সাগরনীল, কাজেই মুক্তি ” |

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here