#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর(২২)
সারা দিন ধরে মেহমান আসতে লাগলো। নবনী শিমলাকে সাহায্য করতে লাগলো নাশতা বানানোতে।মেঘের সামনে পড়ার ভয়েই নবনী কিচেনে নিজেকে আটকে রেখেছে।
শফিক আহমেদ এলেন বিকেলে।শিমলা নবনীকে এক গ্লাস জুস করতে বলে নিজে নাশতা সাজাতে লাগলো।নবনী জুস বানিয়ে ট্রে তে রাখার জন্য নিয়ে যাচ্ছে সে মুহূর্তে নীড় ছুটে এলো। এসেই নবনীকে জড়িয়ে ধরে বললো, “মিস এসে দেখে যান,আমার অ্যাকুরিয়ামে একটা ইলিশ মাছ চাষ করেছি আমি।”
নীড়ের ছুটে এসে জড়িয়ে ধরার জন্য জুস উপচে নবনীর পরনের শাড়িতে পড়লো। পরনের শাড়ি সামনের দিক পুরো ভিজে গেলো। নবনী কিছু বলার আগে শিমলা তেড়ে এলো ছেলেকে মারার জন্য। নবনী গিয়ে নীড়কে আড়াল করে বললো, “আহা,এতো উত্তেজিত হবার কি আছে? ”
শিমলা বললো,”ওর দুষ্টুমি ভীষণ বেড়ে গেছে নবনী। আজ যদি জুসের জায়গায় কফি হতো কি দুর্ঘটনা ঘটতো বলো তো?”
নবনী হেসে বললো, “ঘটে নি তো,তাহলে এখন এতো রাগ হবার কিছু নেই,আমি শাড়িটি ধুয়ে নিলেই হবে।”
শিমলা ভ্রু কুঁচকে বললো,”পাগল হয়েছ তুমি? এই শাড়ি তুমি পড়ে থাকবে?
তাছাড়া গোসল না করলে স্বস্তি পাবে না,জুসের জন্য পুরো শরীর চটচটে হয়ে থাকবে।আসো আমার সাথে,আমার শাড়ি পরবে তুমি গোসল করে। ”
নবনী বললো, “লাগবে না,বাসায় গিয়ে গোসল করে নিবো।এখন এটা ধুয়ে পড়লেই হবে।”
শিমলা মুখ কালো করে বললো, “ভয় পেও না,আমার কোনো ছোঁয়াচে রোগ নেই।আমি সম্পূর্ণ ফিট।আমার মেডিক্যাল রিপোর্ট তোমাকে দেখাতে পারি।তাও যদি তোমার অস্বস্তি হয় বলো,আমি নতুন শাড়ি কিনে আনবো তোমার জন্য। ”
নবনী লজ্জা পেলো ভীষণ। শিমলার হাত চেপে ধরে বললো, “ছি!কি বলছেন এসব।আমি কি এসব ভেবে বলেছি না-কি? আচ্ছা দিন আপনার শাড়ি পরবো।”
শিমলা খুশি হয়ে নবনীকে নিয়ে গেলো নিজের রুমের দিকে। নবনী আড়চোখে চারদিকে তাকিয়ে দেখলো মেঘকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।এখন পর্যন্ত নবনী মেঘের সামনে পড়ে নি।সকালে মেঘের বলা কথাগুলো শোনার পর থেকে নবনীর ভীষণ লজ্জা লাগছে মেঘের সামনে যেতে।নিজেকে ভীষণ তুচ্ছ মনে হচ্ছে। তার জন্য কখনো কেউ এভাবে কষ্ট পাবে তা নবনী কখনো ভাবে নি।কিন্তু তার পক্ষেও তো সম্ভব না এরকম কিছু মেনে নেওয়া।একবার আঘাত পাওয়ার পর থেকে নবনী বিশ্বাস করে সম্পর্ক হতে হয় সমানে সমানে।উঁচু আর নিচুতে কখনো সম্পর্ক টিকে থাকে না।
সেখানে মেঘ হচ্ছে দূর আকাশের চাঁদ। সে বামুন হয়ে চাঁদের দিকে তাকানোর সাহস পায় না,হাত বাড়ানো তো পরের ব্যাপার। তাছাড়া তার পোড়া অতীতের কথা জানতে পারলে মেঘের মনে আর এই ভালোবাসা থাকবে না। ভাবতে ভাবতে শিমলার রুমে চলে গেলো। শিমলা আলমারি খুলে বললো,”তোমার যেটা ভালো লাগে সেটা নাও।”
নবনী হেসে বললো, “আপনিই পছন্দ করে দিন না।”
শিমলা কিছুক্ষণ ভেবে একটা ল্যাভেন্ডার কালার শাড়ি বের করে দিলো। মেঘের প্রিয় রং ল্যাভেন্ডার কালার। আজকের অনুষ্ঠানের জন্য মেঘ আর নীড় ম্যাচিং করে পাঞ্জাবী এনেছে ল্যাভেন্ডার কালারের।শিমলা নবনীকে শাড়ি ব্লাউজ পেটিকোট সব দিয়ে ওয়াশরুম দেখিয়ে দিলো। নবনী ওয়াশরুমে ঢুকে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। নিজেকে মন দিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো নবনী। নিজের কি কি খুঁত আছে তা বের করার জন্য।
খুঁজে পেলো কপালের এক পাশে ছোট একটা কাটা তাছে,নাকে অনেক ব্লাকহেড জমেছে, থুতনিতে একটা ব্রণ,একটা গজদাঁত।
কিছুতেই তাকে নজরকাঁড়া সুন্দরী বলে দাবী করা যায় না।তবে কেনো মেঘ তার প্রেমে পড়লো?
মেঘের পাশে তাকে কিছুতেই মানায় না।হ্যান্ডসাম মেঘ হাজার হাজার মেয়েদের ক্রাশ,কতো ধনীর দুলালি তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে সেখানে নবনী কে?
এ ও কি সম্ভব কখনো? নবনী গুনগুনিয়ে গান গাইতে লাগলো।
মেঘ এসেছে শিমলার রুমে ড্রেস চেঞ্জ করতে।পরনের কাপড় বদলে পাঞ্জাবী পরে নিলো। তারপর চুল পেছনে দিয়ে আয়নায় নিজেকে দেখতে লাগলো।
কোন দিক দিয়ে সে অসম্পূর্ণ মেঘ তা খুঁজতে লাগলো। কেনো তবে সে নবনীর মন পাচ্ছে না? একটা মেয়েকেই তো সে ভালোবেসেছে।কখনো তো কোনো মেয়ের সাথে ভাব জমাতেও যায় নি।সবসময় মেয়েদের এড়িয়ে চলেছে নিজেকে শুদ্ধ রাখতে চেয়েছে। সে যার,তার জন্য নিজেকে স্বচ্ছ রেখেছে, তবে কেনো নবনী তাকে পছন্দ করছে না?
কি করলে নবনী তাকে পছন্দ করবে!
ভাবতে ভাবতে বাথরুমের দরজা খুট করে খুলে গেলো। চমকে উঠে মেঘ পেছনে তাকালো।মেঘকে দেখে নবনী যেনো জমে গেলো। যার ভয়ে সারাদিন লুকিয়ে ছিলো শেষ পর্যন্ত কি-না তার সামনেই পড়তে হলো!
সদ্য গোসল করে আসা নবনীর দিকে তাকাতেই মেঘের কেমন প্রশান্তি অনুভব হলো।ভেজা মুখের দিকে তাকিয়ে নবনীকে তার কাছে শিশিরে ভেজা সাদা গোলাপের মতো মনে হচ্ছে। কি স্নিগ্ধ মুখখানা!প্রসাধনীবিহীন মুখটা যেনো ভীষণ কোমল।
মেঘ সবচেয়ে বেশি অবাক হলো নবনীর চুল দেখে।এক মাথা ঘন কালো চুল নবনীর কোমর পর্যন্ত। দেখেই মনে হচ্ছে ভীষণ সিল্কি!
নবনী কি করবে বুঝতে পারলো না। ইচ্ছে করলো এক ছুটে গিয়ে বাথরুমে লুকিয়ে যেতে।কিন্তু তাতে মেঘের অসম্মান হবে।তাছাড়া সে পা নাড়াতে পারছে না কোনো।
মেঘ দু পা এগিয়ে গিয়ে বললো,”তোমাকে দেখার পর থেকে কীরকম গণ্ডগোল হয়ে গেলো সমস্ত জীবন,
ওলটপালট হয়ে গেলো সবকিছু-
সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেললাম বুঝ খেই, চিন্তাসূত্র হয়ে গেলো
বিশৃঙ্খল, এলোমেলো।”
তারপর বের হয়ে গেলো রুম থেকে। নবনীর জড়তা বুঝতে পেরে মেঘ আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না।মেঘের ভীষণ ইচ্ছে করেছিলো নবনীর ভেজা চুল একবার ছুঁয়ে দিতে। নবনীকে ছোঁয়ার দুঃসাহস মেঘের হয় নি।সে ইচ্ছে ও করে নি। বাহিরে এসে মেঘ আর দাড়ালো না। সোজা বাগানে চলে গেলো সে।
নবনী বের হলে তাকে দেখলে হয়তো বিব্রত হবে।নবনীকে বিব্রত করতে মেঘ চায় না।যাকে ভালোবাসা যায় তার সুবিধার জন্য, স্বস্তির জন্য নিজের ইচ্ছেটা বিলীন করে দেওয়া যায়।প্রচন্ড ইচ্ছে থাকার পরেও তাই মেঘ আর নবনীর সামনে দাঁড়িয়ে থাকলো না।
মেঘ বের হতেই নবনী ছুটে গিয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো।এতোক্ষণ তার যেনো নিশ্বাস বন্ধ হয়ে ছিলো।ভয়ে গলা শুকিয়ে গেলো নবনীর।
নবনী ভেবেছিলো সুযোগ পেয়ে মেঘ হয়তো নবনীকে ভালোবাসার জন্য ফোর্স করবে।
কিন্তু নবনীর বিব্রতভাব দেখে মেঘ চলে যাওয়ায় নবনী ভীষণ কৃতজ্ঞ হলো।মেঘের ব্যবহারে সে মুগ্ধ হলো মেঘের উপর।
চুল খোঁপা করে নবনী বের হলো রুম থেকে। উঁকিঝুঁকি মেরে দেখলো মেঘ কোথাও আছে কি-না।
কিন্তু দেখতে পেলো না বাহিরে।একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লো নবনী।তারপর বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই দেখলো মেঘ স্টেজে দাঁড়িয়ে ডিরেকশন দিচ্ছে।
নবনীর ভীষণ ভালো লাগলো এই ব্যাপারটা। প্রথম বারের মতো নবনীর মনে হলো যতটা খারাপ ভেবেছে সে লোকটা ততটা ও খারাপ নয়।
নবনী আর শিমলার ঘর থেকে বের হলো না বাকী সময়। সন্ধ্যায় কেক কাটার পর গানের অনুষ্ঠান শুরু হলো। নবনী কোণের একটা চেয়ারে বসে রইলো। কিছুক্ষণ পর নবনী চমকে গেলো পুরো বাগান মানুষে ভর্তি হয়ে যেতে দেখে।মেঘের গান শুনতে হাজারের বেশি মানুষ এসেছে। নবনী ভীষণ অবাক হলো।
মেঘলা এসে নবনীর পাশে বসে বললো,”অবাক হচ্ছো ভাবী?ভাইয়া একসময় ভীষণ ভালো গান গাইতো।নিজে একটা দল ও গঠন করেছে।তারপর নিজেই গান ছেড়ে দিয়েছে। শুধু আজকে তোমার জন্য গান গাইবে।”
নবনী ভীষণ লজ্জা পেলো। কারো কাছে সে এতটা স্পেশাল হবে কখনো সে ভাবে নি।মেঘ স্টেজে উঠে দাঁড়াতেই সবাই চিৎকার করে উঠলো। হাত তুলে মেঘ সবাইকে থামতে বললো।তারপর মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বললো,”আজকে আমি একটা গান গাইবো খালি গলায়।একটা মেয়েকে আমি ভীষণ ভালোবাসি।এতোটাই ভালোবাসি যে….. বলতে গিয়ে মেঘের গলা ধরে এলো।তারপর বললো সে আজ এখানে উপস্থিত আছে।
শুধু তাকে উদ্দেশ্য করেই আমি আজ গাইবো।কোনো মিউজিক হবে না।”
তারপর খালি গলায় মেঘ গাইতে শুরু করলো,
“ঢেকে রাখে যেমন কুসুম
পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম
ঢেকে রাখে যেমন কুসুম
পাপড়ির আবডালে ফসলের ঘুম
তেমনি তোমার নিবিড় চলা
মরমের মূল পথ ধরে
ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।
ভাল আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
ভাল আছি, ভালো থেকো
আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো
দিও তোমার মালাখানি
বাউলের এই মনটা রে
ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
পুষে রাখে যেমন ঝিনুক
খোলসের আবরনে মুক্তর সুখ
পুষে রাখে যেমন ঝিনুক
খোলসের আবরনে মুক্তর সুখ
তেমনি তোমার গভীর ছোঁয়া
ভিতরের নীল বন্দরে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে
আমার ভিতর বাহিরে অন্তরে অন্তরে
আছো তুমি হৃদয় জুড়ে।”
গান গাইতে গিয়ে মেঘের গলা বুঁজে এলো,দুচোখ নিজের অজান্তেই ভিজে গেলো।মেঘের কান্না সবাই অনুভব করতে লাগলো। মেঘের একটুও লজ্জা লাগলো না এতে,সে কে,তার স্ট্যাটাস কি কিছুই ভাবলো না।মনের সব আবেগ দিয়ে গাইলো আজ।গান শেষ করতে হাততালির হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো। সবাই চিৎকার চেঁচামেচি করে আনন্দ প্রকাশ করতে লাগলো। মেঘের বুকের ভেতর ভীষণ পুড়তে লাগলো। নিজেকে মনে হলো ভীষণ অসহায়। কাউকে কিছু না বলে মেঘ নেমে গেলো স্টেজ থেকে।
মাসুমা বেগম টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে নবনীর পাশে এসে দাঁড়ালো। নবনীর হাত চেপে ধরে বললো,”দেখলে মা,আমার গাধা ছেলেটার কান্ড দেখলে।মানুষ কাউকে এরকম ভালোবাসে না-কি!
আমার ছেলেটা যে সত্যি সত্যি কাউকে এতোটা ভালোবাসে আমি তো আগে বুঝি নি মা।বুঝলে আমার ছেলেকে এতো কষ্ট পেতে দিতাম না আমি।আরো আগেই ওর মেয়ের কাছে গিয়ে তাকে ভিক্ষা চাইতাম আমার মেঘের জন্য।আমার ছেলেটা ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে অথচ মা হয়েও এতোদিন আমি এটা বুঝলাম না।”
নবনীর নিজের ও চোখ ভিজে গেলো মেঘের গান শুনে।নিজেকে ভীষণ অপরাধী মনে হলো তার। বুকের ভেতর কেমন একটা ব্যথা হচ্ছে। কি করবে সে?
চলবে……
রাজিয়া রহমান
(আপনাদেরকে দুই দিন অপেক্ষায় রাখতে ইচ্ছে করলো না।তাই কষ্ট করে হলেও লিখলাম এতোক্ষণ ধরে।
ঈদ মুবারক সবাইকে।)