তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (৩৮)

#তুমি_অন্য_কারো_সঙ্গে_বেঁধো_ঘর (৩৮)

লুবনার বিয়ের পর কাল বিকেলে প্রথম বার বাবার বাসায় এসেছে।যাকে ফিরতি বলে। সাথে এসেছে ৭-৮ জন ননদ দেবর।সকাল সকাল তাহেরা বেগম নাশতা বানানোর যুদ্ধে নেমে গেলেন।বরাবরের মতো দিশা নিজের মতোই আছে।

নতুন কুটুম এরা,তার উপর বড়লোক। এদের জন্য তো যেই সেই খাবারের আয়োজন করা যায় না।তার উপর লুবনা আজকে বিকেলেই চলে যাবে।
তাহেরা বেগম নিজে যতোটুকু পারলেন ব্যবস্থা করলেন,বাকিটা দিশাকে দিয়ে অনলাইন থেকে অর্ডার করে নিলেন।

আতিথেয়তার চূড়ান্ত করলেন তাহেরা বেগম। বিদায় বেলায় মেয়েকে সাড়ে আট ভরি গহনা দিলেন।এই সেই গহনা যা হামিদুর রহমান সাহেব নবনীকে দিয়েছিলেন।নবনী ফিরিয়ে দিয়েছিলো।
মেয়েকে গহনা দেওয়ার পর তাহেরা বেগম বেশ উৎফুল্ল অনুভব করলেন মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজন এবার চমকে যাবে ভেবে।ওরা নিশ্চয় প্রত্যাশা করবে না লুবনাকে তিনি এতো গহনা দিতে পারবেন।

শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে লুবনার নিজের ও কিছুটা গর্ব অনুভব হলো। সগৌরবে গহনা পরে ড্রয়িং রুমে এলো।
লুবনার ননদ মালিহা এসব গহনা দেখে ডাক দিয়ে লুবনার শাশুড়ীকে নিয়ে এলেন।
সবার থমথমে মুখ দেখে লুবনা কিছুটা ভড়কে গেলো। লুবনার শাশুড়ী আমেনা বেগম জিজ্ঞেস করলেন, “এখানে কতোটুকু সোনা আছে?”

লুবনা কোনোমতে জবাব দিলো, “সাড়ে আট ভরি।”

মালিহা অট্টহাসি দিয়ে বললো, “আমি তোমাকে আগেই বলেছি মা,দিশার শ্বশুর বাড়ি হলেই ওরা আমাদের ক্লাসের মানুষ হবে না।ভাইয়ার জন্য আমি আরো বড় ঘরের মেয়ে দেখেছি তুমি তো রাজি হলে না।দেখলে এবার?ওরা কি দেখে নাই দিশাকে চাচা কতো ভরি গহনা দিয়েছিলো?”

আমেনা বেগম শীতল কণ্ঠে বললেন,”তোমাদের কালচার এরকম কেনো?আমরা দিলাম তোমাকে ১২ ভরি গহনা অথচ তোমার মা তোমাকে মাত্র ৮ ভরি সোনার গহনা দিলো?যেখানে তোমার মায়ের দেয়ার কথা ছিলো আমাদের চাইতে দ্বিগুণ।তোমার মা তোমাকে যা দিবে তা তো তোমারই থাকবে,আমরা তো আর নিয়ে যাবো না এসব।নিজের মেয়েকে দিবে তাতেই যদি এরকম কিপ্টামি করে মানুষ তাহলে এরা কেমন মানুষ?
তোমার মা’কে কল দাও,আমি কথা বলবো।”

লুবনার হাত পা কাঁপতে লাগলো এসব শুনে।অপমানে লজ্জায় চোখে পানি চলে এলো। জীবনে প্রথম বারের মতো লুবনা অনুভব করলো,জীবন ভীষণ কঠিন। বিয়ের আগের জীবন ছিলো যেমন, এখন আর তেমন নেই।এখানে লুবনা বড় গলায় কথা বলতে পারবে না।মাথা নিচু করে শুনে যাবে সব।এরকম অসহায় লুবনা আগে কখনো বোধ করে নি।আজ বুঝলো সে ভীষণ রকম অসহায়।

আমেনা বেগম ফোন দিয়ে তাহেরা বেগমকে বেশ কিছু কথা শুনিয়ে দিলেন।নিরবে অশ্রু বিসর্জন দেওয়া ছাড়া লুবনার আর কিছু করার রইলো না।
রুমে এসে লুবনা কিছুক্ষণ কাঁদলো।মুহিত বিছানায় বসে সিগারেট ফুঁকছে।লুবনার কান্নায় বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বললো, “খবরদার, কিছু হইলেই আমার সামনে এসে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবে না।ভীষণ বিশ্রী লাগে তোমাকে কান্না করলে।”

লুবনা হতভম্ব হয়ে গেলো এরকম ব্যবহারে। মানুষটা কোথায় একটু সান্ত্বনা দিয়ে কথা বলবে তা না করে উল্টো তাকে অপমান করলো!

পরদিন তাহেরা বেগম সবার জন্য কাপড়, সেমাই,পিঠা,গরু নিয়ে মেয়েকে দেখতে এলেন।
গরু দেখে আমেনা বেগম বললেন,”এটা কি গরু কিনলেন আপা?গোশত তো ২ মন ও হবে না।না দিলে না দিবেন,এভাবে মানুষ হাসাবেন না। ”

তাহেরা বেগমের বুক ধড়ফড় করে উঠলো এরকম কথা শুনে। ১ লক্ষ ২৭ হাজার টাকা দিয়ে গরু কিনেছেন। অথচ এরা বলছে এদের পছন্দ হয় নি।কিছু বলতে পারলেন না তাহেরা বেগম জবাবে।মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন, একবার জামাইকে বশ করে নিই,তারপর সব মজা বের করবো।

জামা কাপড় দেখে সবাই নানা প্রতিক্রিয়া দেখালো।মালিহা বললো, “খালাম্মা,আমরা সবাই আড়ং এ পোশাক চুজ করে রেখেছি,আপনি এসব কি এনেছেন।আমাদের কারোর পছন্দ হয় নি।বড় ভাবীর বাবার বাড়ির থেকে প্রতি ঈদে আমাদের শপিং এ নিয়ে যায় আমরা পছন্দ করি সব।এসব আপনি নিয়ে যান।বড় ভাবী ডাক্তার দেখাতে গেছে উনি এসে এসব দেখলে ছোট ভাবী,ভাইয়ার মান সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে।”

ভারাক্রান্ত মন নিয়ে তাহেরা বেগম সব নিয়ে চলে এলেন।সিদ্ধান্ত হলো পরের দিন সবাইকে নিয়ে তিনি শপিং এ যাবেন,সবাই নিজের পছন্দ মতো কিনবে।

————–

নিতুর অবস্থা কিছুটা ভালো। তবে মনের অবস্থা ভীষণ খারাপ। ফয়সাল ঘন্টায় ঘন্টায় এসে নিতুকে দেখে যাচ্ছে। কোনো এক কারণে নিতুর অনাগত বাচ্চাকে বাঁচিয়ে রাখতে ফয়সালের ভীষণ ইচ্ছে। শুধু নিতু কেনো,পৃথিবীর সকল অনাগত বাচ্চাকে ফয়সাল পৃথিবীর মুখ দেখাতে চায়। হয়তো তাদের মধ্যে নিজের অনাগত বাচ্চাকে খুঁজে পেতে চায়।

দুদিন পর নিতুকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হলো। অফিস থেকে রিতু কিছু সময়ের জন্য বাসায় এলো বোনকে দেখতে।কেউ কোনো কথা বললো না।নির্বাক তাকিয়ে রইলো। তাদের এই নিরবতা বলে দিচ্ছে হাজারো না বলা কথা।

কিছুক্ষণ পর রিতু বললো, “এরকম করে মানুষ হাসাস না নিতু।আমার মান সম্মান কিছু নেই আর।আমাকে নিয়ে সবাই হাসাহাসি করছে ওই বাড়িতে।আমার মেয়েটাও বড় হচ্ছে।তুই এরকম কান্ড করলে এসবের প্রভাব আমার মেয়ের উপর পড়বে নিতু।সবাই বলবে এই মেয়ের খালার চরিত্র ভালো ছিলো না। ”

নিতু শুকনো হেসে বললো, “আমার কথা তোরা কেউই ভাবিস না আপা,তোরা শুধু তোদের সম্মান,সমাজ নিয়ে ভেবে যাচ্ছিস।”

রিতু ধমকে বললো, “বিয়ের আগে মনে ছিলো না এসব?তখন তো নাচতে নাচতে বিয়ে করে নিলি,এখন এতো নখরা কিসের?”

নিতু জবাব দিলো না। আপন মানুষ যখন ভুল বুঝে,তখন কার কাছে অভিযোগ করে মানুষ? সে তো বিশ্বাস করে ঠকে গেছে। কাউকে বিশ্বাস করা কি অন্যায়?
না-কি যে বিশ্বাস করে সে পাপী?তবে কেনো দিন শেষে সে ঠকে যায় আর বিশ্বাস ভঙ্গকারী জিতে যায়?

রেবেকা এসে বললেন,”তুই একটু নিতুরে বুঝা রিতু।ওকে বল এর চাইতে ভালো আমাকে আর তোর বাবাকে গলা টিপে মেরে ফেলতে।তারপর ওর যতো নাটক করতে ইচ্ছে করে, করুক।লোকের কাছে মুখ দেখাতে পারি না।ছি ছি করে লোকে আমাকে।”

রিতু কোমল গলায় বললো, “বোন আমার, এরকম পাগলামি করিস না।যা হবার হয়ে গেছে। জীবনে এরকম কতো ঘাত,প্রতিঘাত আসে।মেয়েদের জীবন এরকমই বোন।তোরা কেউ জানিস না,কখনো কাউকে আমি বলি নি আমি কি অশান্তিতে আছি।তবুও কি আমি মাটি কামড়ে পড়ে নেই?বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে সব সহ্য করে যাচ্ছি না আমি?
এসব সহ্য করেই সংসার করতে হয়।তামিম যা করে ফেলেছে তা তো এখন চাইলেই তুই আমি বদলাতে পারবো না। উল্টো অশান্তি বাড়বে এসবে।
বাবা,মা,আমি,আমরা কেউই সমাজে মুখ দেখাতে পারবো না। সবাই এক নামে তোকে ডিভোর্সি বলবে।তুই ও তখন সহ্য করতে পারবি না।”

নিতু হতাশ হয়ে বললো, “আমি তো চেষ্টা করেছি,বাবু হবার কথা জানার পর আমি সব ভুলে তামিমের সাথে যোগাযোগ করেছি।কিন্তু ও তো উল্টো আমাকে গালাগাল দিয়ে বললো ওর সাথে যোগাযোগ না করতে।এমনকি আমার বাচ্চাটাকেও ও স্বীকার করে না।”

রিতু বললো, “দরকার হলে ওর পায়ে ধর,স্বামীর পায়ে ধরলে লজ্জার কিছু নাই।ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নে।সব ঠিক করে নে।”

নিতু অবাক হয়ে বললো, “কি বলছিস আপা?তোর মুখ থেকে এসব কথা আমি আশা করি নি।”

রেবেকা বেগম তেঁতে গিয়ে বললেন,”কি আশা করছিস তুই?জামাই তোর পায়ে ধরবে?”

নিতু আর কথা বলতে পারলো না। এদের সাথে তর্ক করার মুড নেই নিতুর।এমনিতেই শরীর খারাপ লাগছে। বরকত সাহেব বাসায় না থাকার সুযোগে রেবেকা আর রিতু মিলে নিতুকে সমানে বকাবকি করে গেলেন।পাথরের মতো নিশ্চুপ হয়ে নিতু সব শুনে গেলো।

পৃথিবীতে কেউ আপন না,এই সত্যটা নিতু ভালো করে বুঝে গেলো এই কয়দিনে।সবাই নিনের কথা ভেবে যাচ্ছে অথচ নিতুর মনের কথা কেউ ভাবছে না।কেউ একবার কোমল গলায় জানতে চাচ্ছে না ওর ভেতরে কি চলছে!

মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো, নিজের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা নিজে করবে,যতো শীঘ্রই সম্ভব একটা চাকরি যোগাড় করতে হবে।তারপর সবার থেকে অনেক দূরে হারিয়ে যাবে।অনেক অনেক দূরে।যেখানে কেউ তাকে নিয়ে মাথা ঘামাবে না।তার জন্য বাবা মা বোনকে লজ্জা পেতে হবে না আর।নিজের সন্তানকে নিয়ে জীবন যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।সবাই থাকুক নিজ সম্মান নিয়ে।

————–

রাবেয়া বেগমের হাতে নবনী গুণে গুণে ৫০ হাজার টাকা দিলো।রাবেয়া বেগম অবাক হলেন এতো টাকা দেখে।নবনী হেসে বললো, “তোমার ব্যবসায়ের টাকা এগুলো মা।তোমার উপার্জনের টাকা। ”

রাবেয়া বেগম মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন।তারপর বললেন,”আল্লাহ তোকে অনেক বড় করুক মা।তোর স্বপ্নের সমান বড় করুক।”

রাতে খাবার সময় বেতনের টাকা নিয়ে নবনী বাবার হাতে তুলে দিলো নিজের জন্য ৫ হাজার টাকা রেখে।নবনী দেয়ার পর রাবেয়া বেগম তার ৫০ হাজার টাকা নিয়ে লজ্জিত মুখে স্বামীর হাতে তুলে দিলেন।

হাশেম আলী এতো টাকা দেখে অবাক হলেন।রাবেয়া বেগম মাথা নিচু করে বললেন,”সারাজীবন আপনে কষ্ট কইরা আমাগোর জন্য টাকা উপার্জন করছেন।আমাগোরে ভালো রাখনের চিন্তা করছেন।কোনোদিন নিজেরর কথা ভাবেন নাই।আপনার ঘরে আইসা আপনার থাইকা যেই ভালোবাসা পাইছি,সেই ভালোবাসা কোনোদিন আমারে অভাব টের পাইতে দেয় নাই।টাকা পয়সার অভাব আপনে ভালোবাসা দিয়া পোষাই দিছেন।অনেক দিনের স্বপ্ন আছিলো আপনার জন্য কিছু করি,আপনার মুখে যাতে একটু হাসি ফুটে।স্বপ্ন বাস্তব করনের উপায় জানা ছিলো না। আল্লাহ আমার মাইয়ারে দিয়া সেই স্বপ্ন পূর্ণ করে দিছে।আপনার না খুব শখ ছিলো কুরবানি দেওয়ার। এই টাকা দিয়া কুরবানি দিবেন আপনি। ”

হাশেম আলীর দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়লো।জীবনে এতো বেশি সুখ সৃষ্টিকর্তা তার জন্য রেখেছেন তা তিনি কখনো ভাবেন নি।
সিদ্ধান্ত হলো,সবাই মিলে গ্রামে যাবে ঈদ করতে।রাবেয়া বেগম ভীষণ আনন্দিত হলেন গ্রামে যাবার কথা শুনে।

নবনী মেঘকে জানালো গ্রামে যাবার কথা। শুনে মেঘের মন খারাপ হয়ে গেলো।
নবনীর সাথে কথা শেষ করে মেঘ বাবা মায়ের কাছে গেলো। ১ ঘন্টা রুদ্ধদ্বার বৈঠক শেষে শফিক আহমেদ হাশেম আলীকে কল দিলেন।অত্যন্ত বিনীত হয়ে বললেন,”ভাই সাহেব,আমরা চাচ্ছি কাল দুপুরে নবনী আর মেঘের বিয়েটা সেরে ফেলতে। অনুষ্ঠান ঈদের পর করবো।ঘরোয়াভাবে বিয়েটা হয়ে যাক আমাদের দু-চারজন মানুষ নিয়ে। আপনার কাউকে বলার থাকলে বলে দিন।”

হাশেম আলী জিজ্ঞেস করলেন, “এতো তাড়া কেনো ভাইসাব?”

শফিক আহমেদ বললেন,”মেঘের ইচ্ছে ভাই,ছেলের কথা ঈদের আগেই বিয়ে করবে।আমি ও ভাবলাম শুভ কাজে দেরি করে কি হবে!”

হাশেম আলী বললেন, “আমি সবার সাথে কথা বলে দেখি ভাইসাব।”

নবনী সব শুনে মেঘকে কল দিলো। মেঘের সোজা জবাব,”তোমার গ্রামের সেই এক্সিডেন্টের কথা তুমি ভুলে গেছো,আমি ভুলি নি নবনী। আমি চাই না সেকেন্ড টাইম এরকম কিছু হোক।বিয়ে হয়ে গেলে যখন প্রয়োজন আমি তোমাকে প্রোটেক্ট করতে পারবো, এখন তো তা সম্ভব না নবনী। আমাকে ভুল বুঝো না।আমি তোমাকে নিয়ে কখনো ০.১% রিস্ক ও নিতে চাই না।তুমি আমার কাছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে। ”

নবনী নির্বাক হয়ে গেলো। এই আকাশসম ভালোবাসার মর্যাদা সে দিতে পারবে তো!
এই মানুষটা আজীবন এরকম থাকবে তো?

আনন্দ, বেদনা নিয়েই মানব জীবন। সুখ এবং দুঃখ মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। চাইলেই আমরা জীবন থেকে দুঃখ মুছে দিতে পারি না। দুঃখ না থাকলে কি সুখপাখির মূল্য মানুষ বুঝতো?একটা সময় প্রচন্ড কষ্ট পাওয়া নবনী আজ যেমন সুখের সাগরে ভাসে তেমনি একটা সময় প্রচন্ড ভালোবাসা পাওয়া নিতু আজ কষ্টের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে।
জীবন আসলেই অদ্ভুত!

চলবে…..

রাজিয়া রহমান

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here