বাবুই পাখির বাসা – ৪
অমৃতা বন্দ্যোপাধ্যায়
কোচিন থেকে ফিরে এসে বিয়ের দিন ক্ষণ, কোথায় কি হবে, কাকে কাকে ডাকা হবে সব ঠিক করা শুরু হলো | শ্রুতি নিজের কাঁধে অনেক দ্বায়িত্ত্ব স্বেচ্ছায় নিল, ও সত্যি অনেকদিন থেকে চাইছিল সাগরনীলের একটা বিয়ে হোক |
বললো, “সাগরদা তোমার বিয়ে, আমি খুব খুশি | আমার নিজের দাদা নেই, তাই তোমার বিয়েতে আমি সেই সব করবো যা দাদার বিয়েতে করে বোনেরা |”
সাগরনীল ফিচেল হেসে বললো, “অতি উত্তম | তুই সব করে ফেল, আমাকে বিয়ের দিন ডেকে দিস, চলে আসবো |”
নীলেশই দ্বায়িত্ত্ব নিয়ে আইআইটির বন্ধুদের নেমন্তন্ন করলো, সাগরনীলের বিয়ে শুনেই অনেকেই আসবে জানালো | নিজের খেয়ালে থাকা এই বন্ধুটাকে অনেকেই মনে রেখেছে | ও হয়তো সেভাবে যোগাযোগ রাখেনি খুব বেশি কারুর সাথে, কিন্তু ওর আনন্দের দিনে আসতে তাদের বেশ উৎসাহ দেখা গেল |
সাগরনীলের নিজের যদিও কাজকর্ম ফেলে বিয়ের প্রস্তুতিতে সেরম ইচ্ছে দেখা গেল না | ওর ভাগে যা কাজ পড়লো, পার্টির জন্যে হোটেল বুক করা, কতজন আসবে সেইসব হিসেবে করে তাদের থাকার ব্যবস্থা করা, এইসব ও দিব্যি অফিসের কিছু জুনিয়রদের পটিয়ে ধরিয়ে দিল |
নীলেশ তো শুনে রেগে বললো,”আচ্ছা ওরা তো এতে রাগ করবে | এইটা ওদের কাজ না সাগর, তোর পার্সোনাল ব্যাপার | ওরা কেন করতে যাবে রে ?”
“ঠিক কথা | বারণ করে দে, আমি কোনো ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে বলে দেব”, সাগরনীলও ভালো মানুষের মতন মুখ করে মেনে নিল |
বারণ করে দিল নীলেশ ওদের, ক্ষমা চেয়ে নিল বললো, “এইটা তোমাদের করতে বলা উচিত হয়ে নি | প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড |”
কিন্তু দেখা গেল তাতেই মুষড়ে পড়লো ওরা | ওদের মধ্যেই যে একটু নেতা ধরণের সে বললো, “কেন ? আমরা নিজেদের পার্সোনাল টাইমে কাজ করবো, কোম্পনির কাজে কোনো ক্ষতি হবে না |”
নীলেশ একটু অবাক হয়ে বললো, “না না এইটা তো তোমাদের কাজ না, তাই আরকি …”
অন্য একজন জিজ্ঞেস করলো,” আমরা এখন অব্দি যা করেছি সেটা কি পছন্দ হয় নি ?”
নীলেশ পড়লো ফ্যাঁসাদে, জাব্বাবা!! এরা তো উল্টে করতেই চায় মনে হচ্ছে | ওদের বক্তব্য থেকে যা বেরোলো তা হলো এই যে, ‘সাগরদা’ নাকি ওদের খুব ভরসা করে এই কাজ দিয়েছে, বলেছে যে “আমার তো আর তো কেউ নেই এই নীলেশ আর তোমরাই আছো, প্লিজ উৎরে দাও”, তাই ওরা এইটা করতে চায় | প্লিজ যেন নীলেশ বারণ না করে, ও নিজেও তো বিয়ের কাজে হাত লাগাচ্ছে তাহলে ওদের বেলা এখন অসুবিধে কেন? ওরা কি শুধুই কোম্পানির এমপ্লয়ি নাকি ? তাহলে যে সাগরনীল আর নীলেশ বলে যে ওরাও ফ্যামিলি !!
নীলেশ আর কথা বাড়ালো না | মনে মনে হাসলো, ভাবলো, “উফঃ ! সাগরদা নাকি ! এই সাগর পারেও বটে, এদের কেমন হাত করেছে দেখো | দেখতে আপনভোলা হলে কি হবে, সেয়ানা আছে ব্যাটা |”
সাগরনীলের জামাকাপড়, তোয়াকে সাগরনীলের তরফ থেকে যা যা দেয়া হবে সে সব সামলালো শ্রুতি | পার্টির মেনু কি হবে, কি ভাবে সাজানো হবে সে ভার তোয়া নিজেই নিল | এই করে করে সাগরনীলের নিজের ভাগে সেরম কাজ থাকলো না | ও নিজের মনেই অফিসের কাজ করতে থাকলো, একটা বই লিখছিল অনেক দিন ধরে ওই কম্পিউটার সাইন্সেরই সেটাও দিব্যি শেষ করে ফেললো |
নীলেশ লক্ষ্য করে দেখেছে আজকাল সাগরনীল বাড়ি যায় হয় খুব দেরি করে নাহলে মাঝেমাঝেই অফিসের সোফাতেই ঘুমোয় |
একদিন জিজ্ঞেস করলো, “এই তোর কি ব্যাপার বলতো ? এত কাজ তো নেই এখন যে তুই এখানেই রাতেও থাকছিস, এদিকে শ্রুতিকে বলেছিস তোর নাকি খুব কাজের চাপ চলছে | তোয়ার সাথে কিছু হয়েছে নাকি ?”
সাগরনীল অফিসের সোফাতেই শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল, সেটা নামিয়ে রেখে বললো, “আররে না না ! তোয়ার সাথে আমার কোনো ঝগড়া হয়নি রে বাবা |”
নীলেশ তাও ছাড়বে না, “বল কি হয়েছে ? তোর বিয়ে সামনে আর তুই এখানে পড়ে আছিস কেন ?”
সাগরনীল খুব গম্ভীর হয়ে বললো, “শুধু তোকে বলছি, আর কাউকে বলবি না তুই | একটা সমস্যা হয়েছে |”
নীলেশও চিন্তায় পড়ে গেল, “কি হয়েছে ?”
“তোয়া পাগল হয়ে গেছে রে বিয়ে, বিয়ে করে ! বাড়িতে থাকলেই সারাক্ষন জিজ্ঞেস করে এই ফুলটা ভালো না এইটা, এই শাড়িটা পরবো না ওইটা …সে কি কষ্ট রে ! আমার কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে | তার সাথে জুটেছে এই শ্রুতি !! সে আরেক কাঠি ওপর দিয়ে যায় | আমাকে দেখলেই না কিসব জিনিস বলে রে ! শেরওয়ানি না সুট, কি ঘড়ি, কি পারফিউম, এই, ওই ! দূর! ওদের ভয়ে আমি বাড়ি যাচ্ছি না | তুইও যাস না | আমি অনেক খাবার কিনে অফিসের ফ্রিজে রেখে দিয়েছি | থেকে যা এখানে | খাবো, কাজ করবো, ঘুমোবো ! কোনো চাপ নেই !” তারপর উদাস মুখ করে বললো, “নৈঋতই ঠিক বলেছিল, বিয়ে করবো না বললেই ভালো হতো |”
তোড়জোড় দেখে সাগরনীল পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল, কিন্তু কিছু কাজ ওরও ছিল | সেগুলো ও নিজে না করলেই না | প্রধানত, ওই রেজিস্ট্রির নোটিস ইত্যাদি দিতে যাওয়া আর ফোন করে কজনকে নেমন্তন্ন করা | এরা একদম কাছের মানুষ, এদেরকে নিজেই বলতে হবে |
ওর অনেকদিন আগের ম্যানেজার জেসিকাকে একদিন রাতে ফোন করলো | এনার ইচ্ছেতেই এক সময় বলরুম ডান্সিং শিখেছিল সাগরনীল | তিনি শুনে খুব খুশি হলেন, বললেন আসবেন বিয়েতে | আর ফোন করলো কিছু খুব ভালো বন্ধুদের | তারাও আসবে বললো, একজন বাদে, সে সদ্য লন্ডন গেছে |
তারপর ফোন করলো নিজের পিসি অঞ্জনাকে, করেই বললো, “পিসি সেপ্টেম্বরে আমার আর তোয়ার বিয়ে, তোমরা সবাই আসবে | আমি টিকিট, গাড়ি, হোটেল সব বুক করে দেব | না বললে হবে না |”
অঞ্জনা শুনে খুব খুশি হলেন, বললেন, “আসবো তো অবশ্যই | তোকে কে টিকিট বুক করতে বলছে রে ? একদম পাকামো করবি না তো !”
সাগরনীল হাসলো, বললো, “কেন ? না না, আমি বুক করে দেব, তুমি তারপর আসবে না বলবে ‘সাগর আর এখন টিকিট নেই তাই আসা হলো না রে’, ওসব আমি জানি না | ”
পিসি ওকে সত্যি খুব ভালোবাসেন, এই জেদ মেনে নিলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন সব খুঁটিনাটি | “এই শোন সব নিয়ম মেনে বিয়ে করবি তো তোরা ? না শুধু সই সাবুদ করেই ছেড়ে দিবি ?”
সাগরনীল তো হেসেই খুন,পিসি ঠিক ধরে ফেলেছে দেখে | বললো, “তুমি এসই না | দেখতেই পাবে তো, আমার জন্যে একটু মিষ্টি নিয়ে এস তো ওখান থেকে |”
রাখার আগে অঞ্জনা একটু অপ্রস্তুত হয়েই জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ রে সাগর, তোর মাকে বলেছিস তো বাবু ? আমিই তোয়ার কথা বলেছিলাম, বিয়ের কথাটা তুই নিজে মুখে জানিয়ে দে | ডাকিস মাকে, কেমন ?”
সাগরনীল একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “আমি তো ডাকবো পিসি, কিন্তু আমি ডাকলেই কি আর মা আসবে ?”
মাকে জানোটা সবার শেষে রেখেছিল সাগরনীল | কি বলবে ? নিজেই ঠিক করতে পারছিল না, অনেক ভাবনা চিন্তা করলো | তোয়ার যুক্তিটা ঠিক মনে হয়েছে | ডাকা তো উচিত ওর, না ডাকলে আর কি করে আশা করা যায় যে উনি আসবেন |
কিন্তু সত্যি কি আর আশা করছে নাকি ও ? মনে মনে কি আর জানে না যে উনি আসবেন না ? এতদিন ও বাড়ি যায় না, আর ও একবার বললেই ওর মা আসতে রাজি হয়ে যাবেন? বিয়ে তো তাও আনন্দের জিনিস, ও যদি ভয়ঙ্কর রকমের অসুস্থ হয়ে পড়ে তাও কি ওর মা আসবেন ওর দাদাকে ছেড়ে, ওকে দেখতে ? না তো | জানে সাগরনীল, আসবেন না | যদি মরেই যায় ও এখানে …দূর কিসব ভাবনা !!
এই একমাত্র মায়ের কথা ভাবতে গেলেই যেন বড্ডো উল্টোপালটা চিন্তা এসে ভিড় করে মাথায় | যুক্তির বাঁধন মানে না তখন সাগরনীলের বাস্তববাদী মন | একটা সরল মনের বাচ্চা যেন ঠোঁট ফুলিয়ে অভিমান করে বলে, “মা আমাকে ভালোই বাসে না |”
না, এই অভিমান আর বয়ে বেড়াবে না সাগরনীল | কি লাভ হয়েছে এতে ওর এত বছর ? হ্যাঁ, মায়ের সাথে ওর দূরত্ত্ব থাকবেই কিন্তু এই ভার আর দরকার নেই | মা যদি নিজের মতন ভালো থাকে থাকুক না |
ও নিজে কি মন্দ আছে ?
এত উন্নতি করেছে, তোয়া ওকে এত ভালোবাসে, সামনেই ওদের বিয়ে | কিসের অভাব ওর ?
“তুমি তো ভালো আছো সাগরনীল, ছেড়ে দাও এইসব ভাবনা | যেতে দাও”, কে বললো ? ওর মনের মধ্যেই কেউ বললো, ও নিজেই বললো কি ?
হ্যাঁ, ভালো আছে সাগরনীল | তাই মায়ের উপর এই রাগ, এই কষ্ট, দুঃখ যাই এই অনুভূতির নাম হোক, সেটা আজ ও আলগা হাতে ছেড়ে দেবে আর ধরে রাখবে না নিজের মনে | ও তো তাও বাবার কাছে কত আদর পেয়েছে | এই তোয়াকেই দেখো, সেটুকুও পায়নি মেয়েটা | তাহলে নিজের জন্যে এত কিসের হাহুতাশ ?
আর আজ যদি ওর মা এসেও দাঁড়ান অন্য সব কিছু ফেলে, এই এত বছরের হিসেবে মিলবে না | একদিনের সোহাগে কি আর সারাজীবনের অবহেলা মুছে যায় ? তবে ?
তার থেকে থাক না যেমন আছে |
নিজের মনের সাথেই যেন এক বোঝাপড়া করে নিল সাগরনীল | হালকা লাগলো কি ? অভিমান নিজের মনে পুষে রাখাও তো একটা কাজ, তাতে শক্তি ক্ষয় হয় তো |
তাও এতবছর এরম কিছু বলেনি তো মাকে, শেষ কবে বলেছিল মনেও নেই | ওই স্কুলে পড়ার সময় বোধয় | “মা,আমার বিয়ে, তুমি এস”, সাধারণ একটা কথা | মা এসে বিয়ের যাবতীয় কাজের হাল ধরবেন, নিয়ম কানুন বলবেন, ওদের বিয়েতে আনন্দ করবেন, আশির্বাদ করে যাবেন | তাই তো হবার কথা, না কি ? কিন্তু সে তো হবার না |
আর ও শুধু একা না, তোয়ারও সেই একই অবস্থা | ওরও নিজের বাবা, মাকে ডাকা নিয়ে একই উদ্বেগ বরং বেশি | তোয়াই অনুরোধ করছে, “নীল আমি যেদিন বাবা, মাকে বলবো তুমি প্লিজ একটু বাড়িতে থেকো | তুমি যেদিন ফ্রি সেদিন বলবো | তুমি আসেপাশে থাকলেই হলো, থাকবে তো ?” হ্যাঁ থাকবে, কেন থাকবে না | আর ঠিক করেছে সেদিন ও নিজের মাকেও বলে নেবে |
রাতে খেয়ে উঠে, তাই সেই দুঃসাধ্য কাজ করতে বসেছে দুজনে | সাগরনীল বারান্দায় আর তোয়া ঘরে |
নিজেই ফোন করে সহজ ভাবেই মাকে জানালো, আর বললো “মা, তুমি যদি আসো আমার খুব ভালো লাগবে |”
স্বপ্না শুনে খুশি হলেন, বললেন,”বাহ্ খুব ভালো খবর রে |”
তবে উনার মনে আছে সঙ্গীতার সাথে সাগরনীলের সেই ঝগড়া, উনাকে মাঝে রেখে| ভাবলেন হয়তো এমনিই বলছে আসলে চায় না যে উনি যান, আর তাছাড়া উনি যাবেন কি করে ? উনার তো সেই এক চিন্তা | সেখানে তো কিছুই বদলায় নি,কাজেই …
উত্তরে সেই একই জিনিস শুনলো মায়ের কাছে যা শুনে শুনে সাগরনীল ক্লান্ত, ভীষণ ক্লান্ত |
স্বপ্নাই দেখতে পাচ্ছেন না নিজের আসল সমস্যাটা | উনার শুধু তো এইটা ভয় না যে উনি না থাকলে উনার বড় ছেলের কিছু একটা ক্ষতি হয়ে যাবে | উনার মনের ভেতরে আসল ভয় যে উনি না থাকলেও সে ঠিকই থাকবে, কিছুই হবে না | উনি যে নিজেকে ওর কাছে অপরিহার্য্য হিসেবে দেখে এসেছেন এতগুলো বছর | সেই ছবিটা তো ভেঙে পরবে | সেটা ছাড়া তো স্বপ্নার আর অবলম্বন নেই !! তাই উনি যেতে পারবেন না সাগরনীলের বিয়েতে | এইসব জিনিস সাগরনীল কি করে বুঝবে ? ওর বোঝার কথাই না |
সাগরনীল ফোনটা রেখে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকলো কিছুক্ষন |
কি আশা করেছিল ও ? ভেবে দেখলো, সেরম কিছুই ও আশা করেনি | জানিয়ে দিল, হয়ে গেল |না, আজ ও রাগারাগি করেনি, একদম ভালো করেই কথা বলেছে | এই নিয়ে আর ওর আফসোস থাকবে না, পরিষ্কার মনেই বলতে পারবে, “আমি মাকে ডেকেছিলাম কিন্তু আমার মা আসেনি আমার বিয়েতে |”
একই জিনিস অনেকদিন ধরে হতে থাকলে সয়ে যায় মানুষের, ওর বেলাতেও তাই হয়েছে | কষ্ট হচ্ছে না আলাদা করে, আর মনে হচ্ছে না “কেন ? আমার বেলাতেই কেন ?”, ওই একটা খুব হালকা খারাপ লাগা …ব্যাস | অনেকদিন আগে কাটা ছেঁড়ার দাগের উপর হাত বুলোলে যেমন লাগে, ব্যাথা না…ব্যাথার স্মৃতি শুধু |
এমন সময় তোয়া এসে দাঁড়ালো ওখানে, ওর হাতটা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করলো, “কি হলো ? তোমার মা আসবেন বললেন ?”
“না, আসবে না”, বলে হালকা হাসলো সাগরনীল, “তোমার বাবা, মা কি বললেন ?”
তোয়া ওর বুকে মাথা ঠেকিয়ে বললো, “না | বাবা বললো ব্যস্ত থাকবে সেই সময় আর মা বললো চেষ্টা করবে | ওই ধরে নাও যে আসবে না |” তোয়ার গলাটা ধরা ধরা, খেয়াল করলো সাগরনীল |
তোয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে, ওর মন ভোলাতেই ইচ্ছে করে খুব দুঃখের সুরে বললো, ” কি আর করবে বোলো তোয়া ? তোমার কপালটা খুব খারাপ | মেনে নেয়া ছাড়া উপায় কি ?”
তোয়া এক মহুর্ত মন খারাপ ভুলে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “আমারটা খারাপ আর তোমারটা ?”
“আমারটা তো ভালো | আমার কাছে তুমি আছো তো”, বলেই মিচকে হাসলো সাগরনীল |
তোয়াও অল্প হাসলো, বললো, “আমারটাও ভালো, আমার কাছেও তো তুমি আছো |”
“উঁহু!! টুকলি করে বললে হবে না তোয়া !! দেখতেই পাচ্ছি আমি, তোমার মুখ শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেছে | এখন আর বলে কি হবে এইসব ? আমি কাছে আছি তাতেই খুশি হলে কি আর এরম মুখ করতে ? যাই আমি আবার অফিস চলে যাই”, এই বলে হাত ছাড়িয়ে নিল সাগরনীল |
তোয়া কিন্তু জড়িয়ে ধরলো | অদূরে গলায় বললো, “না, প্লিজ যেও না, তুমি বলেছিলে আজ থাকবে আমার কাছেই | আমি তোমার জন্যে অনেক আইসক্রিম নিয়ে এসেছি, খাবে চলো |”
“ঘুঁষ ! আইসক্রিমের ঘুঁষ !” এমন করে চোখ কপালে তুলে বললো সাগরনীল, তোয়া এইবার সত্যি জোরে হাসলো |
বাবা, মা না থাক, ওরা তো আছে একে ওপরের জন্যে |
ভালো আছে ওরা |
সাগরনীলের পিসি, পিসেমশাই আর তাদের ছেলে, বৌমা এসে পরলেন রেজিস্ট্রির দুদিন আগেই | পিসি একাই মাতিয়ে রাখলেন | খুব হাসিখুশি মহিলা | এসেই সাগরনীলকে এমন গাল টিপে, জড়িয়ে ধরে আদর করে দিলেন যেন ও একটা ছোট ছেলে, বললেন, “ইশ! কতদিন পরে দেখলাম তোকে ! সেই হাড়গিলেই আছিস তুই, গায়ে একটু গত্তি লাগে না কেন রে তোর সাগর ! এই না তোর জন্যে মিষ্টি”, বলে এক বাক্স কড়া পাকের সন্দেশ ধরিয়ে দিলেন ওকে | সাগরনীল খুব ভালোবাসে খেতে |
তোয়াকেও খুব আপন করে নিলেন, বললেন, “ছবির থেকেও মিষ্টি দেখতে তুমি” |
পিসিকে ওর ছবি দেখিয়েছে নীল ? যাহ! তোয়াকেই বলেনি |
পিসতুত দাদার ছোট্ট মেয়েও এসেছে সাথে, তার নাম আহেলী, বয়েস সবে সাড়ে তিন বছর | ওর মা প্রথমেই বলছিল যে কারুর কোলে যেতে চায় না | সত্যি, তোয়া কোলে নিতে হাত বাড়ালো যখন মায়ের কাছে সেঁধিয়ে গেল |
ওমা !! সাগরনীল ডাকলোও না শুধু মেঝেতে বসলো আর কাগজ ছিঁড়ে নৌকো, প্লেন এইসব বানাতে শুরু করলো | সেই দেখে আহেলী গুটিগুটি পায়ে নিজেই ওর পাশে গিয়ে বসলো | এটা সেটা জিজ্ঞেস করে একদম খুব ভাব হয়ে গেল | কখন কোলেও উঠে পরলো দিব্যি | সারা বাড়ি ঘুরে এলো, ফ্রিজ খুলে চকলেট নিয়ে এল | কাকাকে গলা জড়িয়ে বেশ আদরও করে দিল, ছোটরা যেমন করে |
সেই দেখে ওর মা অবাক হয়ে তোয়াকে বললো, “কারুর কাছে দিলেই কাঁদে খুব জানো, কেউ কোলে নিতে পারেনা | এই প্রথম দেখছি নিজেই কাকার কোলে উঠে পরলো | তোমার তো কোনো টেনশনই নেই, ছেলেমেয়ে ওকেই ধরিয়ে দেবে |” তোয়া হাসলো, বাচ্চাদের সাথে সহজেই ভাব জমিয়ে ফেলে সাগরনীল, দেখেছে তোয়া আগেও |
ওদের কারুরই মা আসেনি, পিসিই দুতরফের কত্রী হয়ে দাঁড়ালেন যেন |
রেজিস্ট্রির দিন তোয়া নিজের আগের পছন্দের শাড়িটা ছেড়ে, পরলো উনার উপহার দেয়া একটা সিল্কের শাড়ি | হালকা সবুজ জমির উপর ঘন নীল রঙের কাজ করা, খুব পছন্দও হয়েছে তোয়ার | শ্রুতি আর অঞ্জনা সাজিয়ে দিয়েছিলেন ওকে | তা, অঞ্জনারও খুব ভালো লাগলো যে ওরা দুজনে উনাকে এতটা সম্মান করছে, উনার দেয়া শাড়িটা পরেছে তোয়া | সাগরনীলকে যদিও বাগে আনতে পারেননি | অনেক বলেও, ওকে পাঞ্জাবি কিছুতেই পরাতে পারেননি, সেই সাদা শার্ট আর জিন্স পরেই রেজিস্ট্রি হলো |
পিসির সব কথায় ও হেসে হেসে, ঘাড় নেড়েছে আর আজে বাজে উত্তর দিয়েছে |
খুব করে ধরেছিলেন, “চুলটা কেটে আয় | কি এই লম্বা লম্বা নেশাখোরদের মতন চুল !!”
সেই শুনে তো কি হাসি সাগরনীলের, বললো, “পিসি এই চুল দেখেই তো তোয়া পছন্দ করলো আর তুমি এইরকম বলছো ? প্রাণ থাকতে আমি চুল কাটবো না |”
“এই সাগর যজ্ঞ না হলে কি বিয়ে হয় নাকি রে ? তুই কি রে !!” উনার এই কথায় ও বলেছে, ” সেই তো আমিও ভাবছি, তাহলে মনে হয় বিয়ে হবে না জানো পিসি | তবে যজ্ঞ ছাড়া ম্যারেজ হয়, চলবে ?”,এই বলে ফাজিলের মতন হেসেছে |
“আচ্ছা, অন্তত মালা বদল, সিঁদুর দান তো হবে নাকি রে ?”
“মালা বদল ? কেন ? নিজের মালা নিজে পরে থাকলেই তো ভালো, শুধু শুধু বদলাবে কেন ? আর কেউ কাউকে কিছু দান তো করবে না | আমরা সমান, সমান কিনা, দানের কোনো সিন্ নেই | সব খরচা ভাগ হবে |”
উনি এইসব শুনে রাগ করে শুধু বললেন, “মস্ত ফাজিল তুই, তোকে কোনো কথা বলাই বেকার |”, ওর পিসেমশাই কিন্তু ওদের এই আদান প্রদানে খুব খুশি হয়ে হেসে বললেন, “তোর কাছে একদম টাইট হয়ে গেছে রে! আমাকে জ্বালিয়ে মারে তোর পিসি |”
ওর মা আসেনি ঠিকই কিন্তু পিসির হাতে নিজের বিয়ের দুটো সোনার বালা পাঠিয়েছিলেন তোয়ার জন্যে | সেগুলো উনি ওর হাতে তুলে দিয়ে, বললেন, “এইগুলো সাগরের মায়ের | আরও গয়না পাঠাতে চেয়েছিল আমিই ভয়ে আনতে পারিনি | বৌদি আসতে পারেনি ঠিকই কিন্তু তোমাদের অনেক আশীর্বাদ পাঠিয়েছেন | তুমি এইগুলো কাল রেজিস্ট্রির সময় পরতে পারো |”
সাগরনীলের এক মুহূর্ত আগেকার হাসি মুখ কিন্তু অন্ধকার হয়ে এল, এই কথা শুনে | তোয়ার দিকে তাকালো একবার, কিছু বললো না | তোয়া বুঝলো, তুলে রাখলো বালা দুটো | পরেনি |
রেজিস্ট্রি বাড়িতেই হলো, একটু বেলাতেই, যার বিয়ে সে ঘুম থেকে উঠবে তবে তো ! পিসিরা, শেফালীরা আর শ্রুতিরা ছিল শুধু | বাড়িতেই খাওয়া দাওয়া হলো | তবে শ্রুতি ছাড়েনি, মালা বদল করতে হয়েছে | আর তোয়ার নিজেরই ইচ্ছেতে সিঁদুর পরানোও হয়েছে, ওই রেজিস্ট্রির পরেই | মালা তো এক মিনিট গলায় রাখতে অসুবিধে সাগরনীলের, “দূর !! কি ভারী মালা রে বাবা! আমার ঘাড়ে ব্যাথা হয়ে যাচ্ছে “| ওই ছবি তোলার সময়ই যা পরেছিল, তার পরেই খুলে শ্রুতিকে ধরিয়ে দিয়েছে |
তবে একটা জিনিস সাগরনীল নিজেই করেছে | কাউকে বলতে হয়নি |
বাবার ছবিতে নতুন মালা দিয়েছে আর সামনে জ্বালিয়েছে একটা ছোট্ট প্রদীপ | রেজিস্ট্রি শেষ করেই প্রথমেই তোয়ার হাত ধরে সঙ্গে নিয়ে গিয়ে বাবাকেই প্রণাম করলো | মনে মনে বললো, “বাবা আমাদের তুমি আশীৰ্বাদ করো”, তোয়া লক্ষ্য করে দেখলো সাগরনীলের চোখ একদম ছলছল করছে | অঞ্জনা কে প্রণাম করতে উনি তো অনেক আদর করলেন দুজনকেই, আর বললেন, “আজ দাদা থাকলে খুব খুশি হতো রে সাগর” | সত্যি খুব খুশি হতেন নীলাদ্রি আজ, আজ এত আনন্দের মাঝেও বাবার জন্যে খুব মন খারাপ করছে সাগরনীলের | বললো,”হ্যাঁ পিসি, আজ বাবা থাকলে খুব ভালো হতো |”
রেজিস্ট্রির পরেই অঞ্জনা এত রকম আচার, নিয়ম বের করতে লাগলেন দেখে সাগরনীল সন্ধ্যে হতেই বললো, “পিসি তুমি আমাকে পাগল করে দিচ্ছ ! তোমাদের হোটেলে দিয়ে আসি | চলো চলো | কাল পার্টি আছে আজ রেস্ট নাও |”
ওর পিসতুত দাদা দৃপ্ত বললো, “তুইও যেমন সাগর | মাকে ডেকেছিস আর ভাবছিস পার পাবি ! একবার এইসব শুরু করলে না, একদম ঘোরে চলে যায়”|
ওর পিসেমশাইও ফুট কাটলেন, “দেখ! কি জিনিস নিয়ে ঘর করি আমি !”
উনাদের হোটেলে নামিয়ে খানিক গল্প করে ও বেরোনোর সময় ওর পিসি ওর সাথে গাড়ি অব্দি এলেন, জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা এইবার একবার তোয়াকে নিয়ে বাড়ি যাবি তো রে সাগর ? কত দিন হয়ে গেছে বল তো !”
“কি করবো ওখানে গিয়ে ? আমার ইচ্ছেই করে না |”
“একবার মাকে দেখে আসবি আর তোয়াকেও তোর ছোটবেলার বাড়িটা দেখিয়ে আনবি | ওই তোর সেই গাছের উপর কাঠের বাসাখানা দেখবে না ও ?” হেসেই বললেন, হালকা সুরে |
“আছে ওটা এখনো ?”, কৌতূহল ভরে জিজ্ঞেস করলো সাগরনীল, ছোটবেলার স্মৃতি চোখে চকচক করে উঠলো |
“আছে রে ! দিব্যি পোক্তই আছে,” উনি হেসে ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিলেন, তারপর একটু গম্ভীর হয়েই বললেন বললেন, “জানিস সাগর আমার মাঝেমাঝে কি মনে হয় ? বৌদি না ওই এক ঘরে রুদ্রর সাথে এই এতগুলো বছর থেকে থেকে বাকি সবার থেকে একদম আলাদা করে ফেলেছে নিজেকে | স্বাভাবিক মানুষের কথা আর বুঝতে পারেনা রে জানিস | কিরম যেন হয়ে গেছে বৌদি |”
সাগরনীল শুনলো, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “কি করবে বলো ? যেমন ভাবে ভালো আছে থাকতে দাও, ছেড়ে দাও |” পিসিকে বললো, না নিজেকে বললো ?
পরেরদিন পার্টিতে তো খুব আনন্দ করলো সবাই | তোয়া খুব সুন্দর করে সাজলো | গোলাপি রঙের লেহেঙ্গা, ফুল ফুল আঁকা তাতে, সবুজ চোলি আর গাঢ় নীল ওড়না | সাথে মাননসই একটু ভারী গয়না | শ্রুতি সাগরনীলকে নিয়ে পড়লো, “তুমি আজ একদম তর্ক করবে না সাগরদা” এই বলেই শুরু করলো | তোয়ার লেহেঙ্গার সাথে মিলিয়ে ওর জামা হালকা সবুজ, স্যুট গাঢ় নীল রঙের | সব শ্রুতিই ঠিক করে দিয়েছে | নতুন স্যুট যদিও কিছুতেই কিনতে দেয়নি সাগরনীল, “পায়সা কি গাছে ফলে রে শ্রুতি ? নতুন স্যুট কি হবে আমি তো সেই পুরোনোই “| কি আর করবে শ্রুতি !
চুলও ভালো করে বেঁধে দিয়ে শ্রুতি বললো, “দুজনে একটু পোস দিয়ে বেশ কাপল ছবি তুলবে তো হ্যাঁ সাগরদা ? ওই ব্যাংকুয়েট হলের বাইরে বেলুন দিয়ে একটা হার্ট বানানো হয়েছে | ”
সাগরনীল তাতে চোখ বড় বড় করে বললো, ” তোর মাথা খারাপ রে!! পোস দিয়ে ছবি তুলবো কেন ? খাবো না এইসব করে সময় নষ্ট করবো!”
শ্রুতি তাতে রাগ করে বললো, “ভীষণ আনরোমান্টিক তুমি ! তোয়া কত সুন্দর প্রপোজ করলো তোমাকে আর তুমি!! দূর ! ”
সাগরনীল গম্ভীর হয়ে বললো,”শ্রুতি জীবন রোমান্স দিয়ে চলে না, রেস্পন্সিবিলিটি নিতে হয় |”
শ্রুতি জ্ঞান শুনে কেটে পড়লো |
নয় নয় করে পার্টিতে নিমন্ত্রিত অনেকেই | ব্যবসার কাজ দুজনেরই, ডাকতে তো হবেই লোককে | তাছাড়া বন্ধুবান্ধবও কম না |
অনেক বন্ধুদের সাথেই বহু বছর পরে দেখা হচ্ছে সাগরনীলের | জেসিকাও খুব খুশি হয়েছেন এসে, নিজের বরকেও এনেছেন, ওরা এই সুযোগে এই দেশে নানা জায়গা ঘুরেও দেখবেন জানালেন | গল্পে গল্পে সন্ধ্যে ভালোই এগোলো | অনেক ছবি তোলা হলো | শুধু দুজনের, আবার অন্যদের সাথেও | পিসিদের ডেকে একটা ছবি সাগরনীল নিজের গরজেই তুললো | উনারা আসতে সত্যি খুব ভালো লাগছে ওর | নৈঋতের আবার আহেলীকে খুব পছন্দ হয়েছে, বললো, “সাগরমামা ওকে আমার গর্লফ্রেন্ড হতে বলো না |”
সাগরনীল হাসি চেপে চোখ পাকিয়ে, বললো, “নিজে বল বাবা, আমি কেন বলতে যাবো ? আমার মার খাবার ইচ্ছে হয়েছে নাকি ? আমি বরং তোর বাবাকে বলে রাখি …এই নীলেশ”, যেই না ডাকা অমনি নৈঋত পালালো |
অবাঙালিদের, বিশেষ করে উত্তরভারতীয়দের বিয়েতে নাচ ব্যাপারটা খুব প্রাধান্য পায়| তোয়া দিল্লিতে থেকেছে, বিয়ের পার্টিতে নাচ দেখতে অভ্যস্ত, নিজের বন্ধুদের বিয়েতে নেচেছে ও আগে | তাই ওর সেই বন্ধুরা ওর জন্যে আজ সন্ধেয় নাচলো, লুটেরা সিনেমার এই গানে:
“হাওয়া কে ঝোঁকে আজ মাউসমো সে রুঠ গায়ে
গুলান কি সখিয়ান যো ভাঁওরে আঁকে লুট গায়ে”
তোয়াকেও তারা টানলো নাচে, সে আপত্তি করলো না | তোয়া নাচ করতে ভালোবাসে, আর নাচেও সুন্দর |
তোয়ার বন্ধুরা ওরকম সুন্দর নাচলো দেখে, নীলেশ নিজেদের বন্ধুদের বললো, “আরে তোরা কিছু করবি না ? যাহ! মেয়ে পক্ষের সামনে এইভাবে নাক কাটা যাবে ?” সাগরনীল মিটিমিটি হাসলো, কিছু বললো না |
তা, ওদের বন্ধুদের মধ্যেই দু একজন এগিয়ে এসে গান গাইলো, তাই দেখে তোয়ার বন্ধুদের মধ্যেও কেউ কেউ গান ধরলো, শ্রুতিও গাইলো | সাগরনীলকেও গাইতে বলা হলো, সে কিন্তু মাথা নেড়ে দিল, “না না আমি না, তোরাই গা “| শ্রুতি তাতে আবার মুখ বেঁকালো, ” কি বাজে তুমি ! তোয়ার জন্যে একটা গান তো গাইতে পারতে |”
গানে গানে বেশ জমে উঠলো পার্টি | তারপর খাওয়া দাওয়াও এগোলো বেশ ভালোই | এই এগারোটা নাগাদ হোটেলের কিছু লোক এসে সাজানো টেবিলগুলো সরিয়ে, সরিয়ে বেশ খানিকটা জায়গা করে দিল হলের মাঝে | সাগরনীল এইবার মাইক তুলে নিয়ে ছোট্ট করে বললো, “স্বচ্ছতোয়া, ডিস্ ইস ফর ইউ “|
ওর কথার সাথে সাথেই খালি জায়গায় এসে দাঁড়ালো আট-জন, চারটে জোড়া | ওই সাগরনীলদের কোম্পানির যে জুনিয়রদের ঘাড়ে ও নিজের কাজ চাপিয়ে দিয়েছিল, তারাই | শুরু হলো বাজনা, তারা নাচের তালে দুলে উঠলো | মহিত চৌহানের গাওয়া এই গানটা তো তোয়ার খুব পছন্দের !
না হায় য়ে পানা
না খোনা হি হায়
তেরা না হোনা জানে
ক্যুন হোনা হি হায়
কিন্তু এইটা তো মোহিত চৌহানের গলা না, এটা তো সাগরনীলের গলা !! রেকর্ড করেছে কখন ? তোয়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে, খুশি চিকচিক করছে সেখানে | এক গাল হেসে তাকালো সাগরনীলের দিকে |
তবে দাঁড়াও তোয়া, আরও বাকি আছে |
এইবার, তোয়া সমেত সবাইকে অবাক করে দিয়ে জুনিয়রদের মাঝখানে, নিজের জ্যাকেট আর টাই খুলে রেখে, মুখে ফিচেল হাসি ঝুলিয়ে নাচে যোগ দিতে এগিয়ে এল সাগরনীল | এই গানটাই নীলেশ শুনেছে অফিসে | অনেক রাতে, কনফারেন্স রুমে বাজতো | তার মানে সেখানে নাচের মহড়া চলতো !! বোঝো !! এইসব করলে তো সদ্য কলেজ পাস্ করে আসা ছেলেমেয়ে মজা পাবেই বাবা ! এইবার নীলেশ বুঝলো “সাগরদা” অন্তপ্রাণ কেন এই জুনিওরগুলোর |
মোটেও মন্দ নাচে না সাগরনীল | ওর নিজের মাপকাঠিতে যেটা মোটামুটি সেটা আসলো বেশ ভালোই | আর এই এক গানে অনেকদিন ধরে নাচ ঝালাচ্ছে, বলেনি কাউকে | শুধু ওই জুনিয়রেরাই জানে, ওদের সাথেই এই বন্দোবস্ত | ওই যে রাতে অফিসে থাকতো, এটার জন্যেই | তাই আজ মোক্ষম দিনে এসে নাচখানা ভালোই দাঁড়িয়ে গেছে | সবার থেকে বেশি অবাক হয়েছে তোয়া |
না, না | সবার থেকে বেশি অবাক হয়েছেন অঞ্জনা ভাইপোর কান্ড দেখে, এ ছেলে করে কি রে বাবা !!
প্রথমে কিছুক্ষন তো ওরাই নাচলো | তারপর তোয়ার দিকে হাত বাড়িয়ে তাকেও ডেকে নিল সাগরনীল | সে তো দিব্যি নাচতে পারে, কোনো অসুবিধেই নেই দুজনের একসাথে নাচতে | পুরো জায়গাটা জুড়ে, তোয়ার হাত ধরে ঘুরিয়ে, এদিকে টেনে ওদিকে পাঠিয়ে, অনেক কায়দা করে নাচ হলো | ওদের চারপাশে ঘুরে ঘুরে নাচলো আট-জন, সব সাধা, কোনো ভুল চুক নেই |
রাস্তে মিল যাতে হায়
মনজিলে মিল যাতি হায়
তুমসে হি তুমসে হি
তুমসে হি তুমসে হি
তোয়ার তো হাসি আর ধরে না | খুব আনন্দ হয়েছে ওর, এইটা তো প্রত্যাশার বাইরে ! ভাবলো, “উফঃ! কি যে করে না নীল একবার বলেও নি দেখো !”
ওই যে তোয়া ওরম সুন্দর করে প্রপোজ করেছিল, তা সাগরনীল হিসেব সমান না করে থাকতে পারে নাকি ? তাছাড়া কবে তোয়াও অভিযোগ করবে, “তুমি কি আনরোমান্টিক নীল!” কে বাবা রিস্ক নেবে ? তাই বুদ্ধি করে সবার সামনে একদম এইটা নামিয়ে দিয়েছে | এ একদম মাঠের বাইরে ছয়, জানে সাগরনীল | তোয়া আর কিছু বলতে পারবে না !
শ্রুতি পুরো পাল্টি খেয়ে নীলেশের কাছে ঘেঁষে বললো, “ইশ ! সাগরদা কি রোমান্টিক !! আর তুমি !” নীলেশ মনে মনে সাগরনীলকে কাঁচা খিস্তি দিল |
ওদের নাচটা শেষ হতেই, প্রচুর হাততালি পড়লো | আবারও গান বেজে উঠলো, এইবার সবার নাচার পালা, পার্টি এইবার শেষের দিকে | কেউ একজন মাইকে বললো, “ড ডান্স ফ্লোর ইস ওপেন”|
অনেকেই এগিয়ে এল | শেফালী আর সুমিত, শ্রুতি আর অগত্যা নীলেশও | নৈঋত নাচলো তোয়ার হাত ধরে | সাগরনীল ডেকে আনলো জেসিকাকে | খানিক্ষন উনার সাথেই নাচলো, আর তোয়াকে চোখ মারলো অকারণ | তারপর গিয়ে ধরে নিয়ে এলো পিসিকে |
“না না, আমাকে ছাড় | তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে রে সাগর !”, এই বলে তো উনি খুব আপত্তি করলেন |
সাগরনীল গম্ভীর হয়ে বললো,”পিসি কিন্তু এইটা তো এখানকার নিয়ম | বিয়ের পার্টিতে ছেলের পিসি না নাচলে ঘোর অমঙ্গল |”
অঞ্জনা একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, “আমাদের এইসব কোনো নিয়ম নেই | বাঙালির বিয়েতে নাচানাচি হয় না সাগর |”
ওর পিসেমশাই ইচ্ছে করে বললেন, “কিন্তু এখানে নিয়ম অনুযায়ী তো নাচতে হয় বলছে, তুমি না নেচে রিস্ক নেবে ?”
অঞ্জনা ফাঁপরে পড়ে রাজি হয়ে গেলেন, সাগরনীল পিসেমশাইকেও ছাড়লো না, বললো, “এ নিয়ম তোমার জন্যেও চলো চলো “|
সবাইকে নাচিয়ে ছাড়লো সাগরনীল, খুব আনন্দ করলো |
সব শেষে তোয়ার সাথে ফিরে এলো নিজেদের বাড়ি | এইবার সব সময় একসাথে আর আলাদা আলাদা না, তোয়া এন্ড নীল ফরেভার…
না, বিয়ের পরে কিছু ছন্দপতন হয়নি | সে প্রেম প্রথম দিন থেকেই চিরকালের অঙ্গীকার নিয়ে এসেছিল, সে তেমনই থেকে গেছে | ওরা শুধু একে ওপরের স্বামী-স্ত্রী না তো | ওরা দুজন ভালো বন্ধু, ভরসার জায়গা, জ্বরের রাতে মা |
সাজানো, গুছোনো সংসার ওদের, সেখানে তোয়াই সর্বেসর্বা ! ওর কথার উপর কোনো কথা চলে না |
এখন ফ্রিজ ঠাসা শুধু চকোলেট, আইসক্রিম থাকে না | সব রকমের খাবার থাকে, রান্নার লোক আসে এখন, নিয়মিত | বেচারা সাগরনীল আইসক্রিম রক্ষা করতে পারলেও, কোল্ডড্রিঙ্কস বাঁচাতে পারেনি | বিয়ের আগে থেকেই তোয়া বকতো | পার্টির পরের দিনই সব ক্যান বের করে একদম টান মেরে ফেলে দিয়েছিল, চোখ পাকিয়ে বলেছিল, “কোনো গুণ নেই, শুধু চিনি গোলা জল এইগুলো | একদম খাবে না আর |” খায় না |
ছন্নছাড়া মানুষরা মনে মনে চায় কেউ শাসন করুক, বকুক, ভালো থাকার, মন্দ থাকার হিসেবে রাখুক | যা ইচ্ছে করবো শুনতেই ভালো লাগে, সত্যি যারা যা ইচ্ছে করতে পারে তাদের কি আর বছরের পর বছর ভালো লাগে নাকি ? কে জানে ? সাগরনীলের তো এইটাই অনেক, অনেক বেশি ভালো লাগে | ইচ্ছে করে তোয়াকে রাগায়, যাতে তোয়া বকে |
তা বলে এরকম না যে শুধু ওই বকা খায় আর তোয়া সবেতে পাস | আজ্ঞে না | হ্যাঁ, সাগরনীলই বেশি বকুনি খায় সেটা ঠিক, তবে দেয়ও মধ্যে মধ্যে উল্টে |
এই যেমন তোয়ার একটা খুব বদ অভ্যেস হলো, পাতে নিয়ে পুরোটা খায় না | প্রথম, প্রথম সাগরনীল খেয়ে নিত | এখন ধরে বসিয়ে রাখে, পুরোটা না খেয়ে তোয়া উঠতে পারবে না, “ঐটুকু খাবার নাও, সেটাও যদি না খেয়ে উঠে পড়ো তুমি কাজ করবে কি করে শুনি ? খেয়ে নাও সবটা তোয়া, আমি নাহলে রেগে যাবো |”
আর তোয়া যদি ওর চোখ বাঁচিয়ে কম খাবার নেয় তাহলেও ধরা পড়ে যায়, “এই যে ম্যাডাম, শুধু একটা রুটি ? কেন অন্যটা কি দোষ করলো ?”
তোয়া যদি রাগ করে বলে, “সবাই তোমার মতন না নীল, কিলো কিলো আইসক্রিম খেয়েও রোগা থাকবে | আমি মোটা হয়ে যাচ্ছি !” সেসব সাগরনীল শোনে না, বলে ” আমি মোটা হচ্ছি না তার জন্যে তোমাকে আরও রোগা হয়ে যেতে হবে কেন ? এইটা আবার কি লজিক ? পেট ভোরে খাবেই না তো এত কাজ করে লাভ কি ?”
তবে রান্নার লোককে কিছুতেই শনি-রবিবার ডাকা যাবে না | সেদিন নাকি অন্য কেউ আসবে না বাড়িতে এইটা একদম দাবি সাগরনীলে | বেলা করেই ওঠে এখনও আর এই দুদিন তো এগারোটার আগে বেরোয় না ঘর থেকে | রান্নার লোক বেল বাজাবে, রান্নাঘরে আওয়াজ হবে ওর ঘুম নষ্ট হবে, “প্লিজ, তোয়া প্লিজ “|
তা সেই দাবি শুনে তোয়া ভালোমানুষের মতন মুখ করে বললো, “বেশ ঠিক আছে, আসবে না | তাহলে সেদিন গুলোতে তুমি রান্না কোরো, চলবে তো ?”
হ্যাঁ চলবে, মেনে নিয়েছে সাগরনীল |
অন্যায় দাবি ও করবে না | রান্নার লোককে আসতে দেবে না আবার নিজেও করবে না, তা কি করে হয় ? যুক্তি দিয়ে বোঝালে সব মেনে নেয় সাগরনীল | তাই এখন সাগরনীল রান্না করতেও শিখে গেছে | বলেছে রান্না নাকি সবটাই কেমিস্ট্রি, আগেই নাকি ওর শিখে নেয়া উচিত ছিল|
তোয়া হাতে হাতে এগিয়ে দেয়, সাগরনীলই শনি-রবিবার দিব্যি রান্না করে | আগে তো শুধু ওমলেট বানাতে জানতো| এখন বানায় পনির, মাংস আর সব থেকে বেশি বানায় তোয়ার খুব পছন্দের মাছ ভাজা | ওটা তোয়ার উৎসাহেই শেখা, সে বেচারি নিজে মাছ ভাজতে ভয় পায় | এমন করে গরম কড়াইতে মাছ ছাড়ে যেন বোম্ব ছাড়ছে | দেখে তো সাগরনীল হেসেই খুন !!
বলতো,” তোয়া তুমি বোম্ব ডিস্পোজাল ডিপার্টমেন্টে জিজ্ঞেস করো, ওরা যদি একটা স্যুট দেয় তোমাকে, ভালো হয় তাই না ?”
তোয়া কাঁচুমাচু হয়ে তাকাত এই কথায়, তাই সাগরনীলই এখন মাছ ভাজে | প্রথম প্রথম করতে গিয়ে গন্ডগোল করে ফেলতো | কোনোদিন তেল গরম হবার আগেই দিয়ে দিত, কোনোদিন এত গরম হয়ে যেত তেল যে বলার না, আর হাতে গরম তেলের ছিটে তো রোজ খেত | ওর হাতে তেলের ছ্যাঁকা লাগলেও তোয়া ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলতো ! সেই দেখে সাগরনীল ওকে রাগাতো, “আমার লাগলো আর তুমি কেমন করছো দেখো ! ফুটেজ খাওয়া আর কাকে বলে !” এখন হাত পাকিয়ে ফেলেছে | একটাই জিনিস এখনও পারে বা ভালো করে, ভাতের ফ্যান ঝাড়তে | গরম ফ্যান হাতে ফেলবেই, আর তারপর লাফালাফি করবে | তাই ওইটা তোয়াই করে দেয় |
তোয়া এখন অনেক রকম কেক, পাস্তা এইসব বানিয়ে ফ্রিজে রাখে | এই রাত জেগে কাজ করে যখন সাগরনীল, সেই সময় কাজে দেয় | তোয়া খেয়াল করে দেখেছে কাজের মাঝে, “খিদে পেয়েছে নীল ?” জিজ্ঞেস করলে উত্তরে “উহুঁ”, বলে মাথা নাড়ে সাগরনীল | কিন্তু যদি কিছু না বলেই পাশে পাস্তা, স্যালাড এইসব রেখে দেয়, তাহলে সাগরনীল অন্যমনস্ক ভাবেই খেয়ে ফেলে | কি খেলো দেখেও না, খেয়েছে সেটা ওর মনেও থাকে না | আর কেক তো যখন তখন খায় সাগরনীল, তোয়ার মতন কেক নাকি আর কেউ বানাতে পারে না |
তোয়ার বাবা, মা ওদের বিয়েতে আসেননি, তবে পরে উপহার পাঠিয়েছিলেন, একজনের হাত দিয়ে | তোয়ার জন্যে গয়না আর সাগরনীলের নাম করে একটা দামি গাড়ি | তোয়া গয়নাটা নিয়েছে তবে গাড়িটা ওরা ফেরত পাঠিয়ে দিয়েছে | সেদিনের অপমান সাগরনীলের সারাজীবন মনে থাকবে | একবার দেখা করতে এলেন না, ওকে গাড়ি দিয়ে কি বোঝাতে চান ? আর এমনিও গাড়ি সাগরনীল বাধ্য হয়ে চালায়, ঐসব দামি গাড়িতে ওর কোনো ঝোঁক নেই | তোয়ার নিজেরও এইটা ভালো লাগেনি, তাই বিনা দ্বিধায় ফিরিয়ে দিয়েছে |
ওরা দুজন একে অপরকে নিয়েই দিব্যি খুশি !
কাজের জন্যে যদি বাইরে যেতে হয়, তাহলে যে যায় তার মন পড়ে থাকে বাড়িতে | আর যে বাড়িতেই থাকে সে প্রহর গুনতে থাকে, কখন আসবে ? কখন আসবে ? দুজনেই খুব ঘরকুনো হয়ে গেছে | পাশপাশি বসে বই পড়ে, গান শোনে, দুজনেই গল্প তর্ক করে ওদের সময় কোথা দিয়ে চলে যায় ওরাই বুঝতে পারে না | “ইশ! আরো আগে কেন তোমার সাথে দেখে হলো না তোয়া !!” এই একটা আফসোস আর যায় না সাগরনীলের |
দেখতে দেখতে সময় এগিয়েছে | সাগরনীলের এখন তোয়া ছাড়া থাকাই যেন মুশকিল হয়ে গেছে | তোয়া ছাড়া বেচারা একদম নিরুপায়, তোয়া তো হেসে হেসে বলে, “আমি রাগ করে চলে গেলে কি করবে তুমি ?”
সাগরনীলের উত্তর হলো, “তুমি যেতেই পারবে না | ওই খালি সুটকেস দেখে আমি আর ভয় পাবো না ”
আর তোয়া যাবে কোথায় ? যে সময় বাড়িতে তোয়া একা থাকে ওর মন বসে না | ওই দুস্টু বুদ্ধিআর ফিছেল হাসির নীল বাড়িতে না থাকলে, তোয়ার ভালোই লাগে না | সাগরনীল বলে ফেলে তাই, কিন্তু তোয়াও মনে মনে জানে সাগরনীল পাশে না থাকলে ওর চলে না |
সব কথাই বলে, তবে একটা বিষয়ে নিজের মনের কথা সাগরনীল ওকে বলে না | একই জিনিস তোয়ার মনেও ঘোরে | কিন্তু কেউই এখনো বলে উঠতে পারেনি | দুজনেই ভাবে অন্যজন তুলবে কথা, এইকরে আর বলা হয় না |
সন্তান |
বয়েস তো বসে নেই, বিয়েরও তো এক বছর হতে চললো | যদি চিন্তা ভাবনা মেলে, তাহলে এগোতে হবে এখন | তোয়ার অন্তত তাই মনে হয় | বিয়ের কথাও তোয়াই বলেছে, এইটাও ওকেই বলতে হবে মনে হচ্ছে, ভাবে, ‘দূর ! নীল না কি একটা ! আচ্ছা ওর কি ইচ্ছে নেই তাই বলে না? ” নিজেকে বুঝিয়েছে তোয়া যে সাগরনীল না চাইলে ও এইটা নিয়ে আর কিছু বলবে না | সন্তান যদি বাবা, মা দুজনেই সমানভাবে না চায় তাহলে লাভ নেই | ওরা দুজনেই দেখেছে যে বাবা, মায়ের অবলহেলা কিরম কষ্টকর জিনিস | তাই যদি সাগরনীলের মনে এতটুকু দ্বিধা থাকে তোয়া আর কথা বাড়াবে না | তাও একবার জিজ্ঞেস করতে হবে | সাগরনীল সোজা কথা বলে, না করে দিলে না | মেনে নেবে তোয়া, এই নিয়ে জেদাজেদি কাজের কথা না | ওর কোনো কথা তো সাগরনীল ফেলে না, কারণ থাকবে নিশ্চয় | আর ওর নিজের মায়ের সঙ্গে সমীকরণ এরম খাপছাড়া, সেখানে ইচ্ছে বা সাহস নাই হতে পারে |
বিবাহবার্ষিকীতেই কথাটা তুললো তোয়া | খাওয়া দাওয়া বাড়িতেই করে, ওর ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ছিল |
হালকা সুরেই জিজ্ঞেস করলো ,“আচ্ছা নীল নার্সারি কোথায় করবো আমরা? তুমি কিছু ভেবেছো এই বিষয়ে?”
সামনের গাছ দেখে দুম করে উত্তর দিলে সাগরনীল, “বাড়িতে নার্সারী করতে যাবো কেন রে বাবা ?? আর কত গাছ লাগাবে ? এই ব্যালকনিতে ভালো লাগছে বলেছি বলে কি ঘরেও লাগাবে নাকি ? এই তোয়া জঙ্গলে থাকবো আমরা ?”
এ আবার কি কথা ? তোয়া বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো, “নার্সারিতে কি শুধু গাছ থাকে নাকি ?”
“আর কি থাকে ?”
তোয়া অবাক চোখে দেখলো ওকে, কি নির্বুদ্ধি মানুষ রে বাবা!! বললো, “যাও ডিকশনারিতে আগে মানে দেখে এস | শব্দের মানেই জানো না কথা বাড়িয়ে আমার সময় নষ্ট !”
এইবার মাথায় ঢুকেছে সাগরনীলের, মুখ গম্ভীর হয়ে এলো, “তোয়া..”
তোয়া ওরা গলা শুনে একটু ভয় পেল | চায় না !!
ওকে অবাক করে দিয়ে কিন্তু সাগরনীল জিজ্ঞেস করলো, “তুমি সিওর তো তোয়া ? এইসব কাজকর্ম, সব সামলে তুমি এদিকে এগোতে চাও তো ? পরে আফসোস হবে না তো ?”
মানে ? উল্টে ওকে জিজ্ঞেস করছে ? তাহলে কি সাগরনীলও ভেবেছে এটা নিয়ে ?
তোয়া সামলে নিয়ে উত্তর দিল, “হ্যাঁ আমি তো সিওর, অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হবে, তবে মনে হয় পারবো | তবে …”
“তবে ?”, সাগরনীলের মুখে কিন্তু হাসি নেই |
এইবার কিন্তু জোর দিয়ে বললো তোয়া, “তবে একা একা পারবো না | তুমি যদি ইন্টারেস্টেড না হও তাহলে…”
সাগরনীল বসলো, তোয়ার হাত দুটো ধরে ওকে পাশে বসিয়ে বললো, “আমি তো খুবই ইন্টারেস্টেড তোয়া, বাচ্চাদের তো আমি এমনিই খুব ভালোবাসি |”
তোয়া ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,”বা রে ! তা আমাকে বলোনি কেন ? সব কি আমিই বলবো ?”
সাগরনীল গম্ভীর হয়ে বললো,”এটা আমি কি করে বলবো বলো ? আসলে এইটা তো সবটাই তোমার উপর, আমার তো কোনো কন্ট্রিবিউশান থাকবে না | তাই আমার ইচ্ছে আমি তোমার উপর কি করে চাপিয়ে দি ? সেটা তো ঠিক না তোয়া | আমি ভাবলাম আমি বললে যদি তুমি আমার কথা রাখতে রাজি হয়ে যাও, সেটা তো ভালো হবে না | আর তুমিও তো কিছু বলোনি, আমি বুঝবো কি করে ?”
তোয়া ভাবলো,”কি মুশকিল রে বাবা !! এইরকম আবার কে ভাবে ?”
সাগরনীল ওর মুখ দেখে এইবার হেসে বললো, “আচ্ছা আমার উপর আর রাগ করতে হবে না | দুজনে যদি রাজি তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই | তবে এইটা একটা বড় ব্যাপার, আমাদের দুজনের অনেক সময় এটাতে দিতে হবে | হয়তো কাজে এতটা সময় আর দেয়া যাবে না”, তরপর একটু ভেবে জিজ্ঞেস করলো, “আর বলছি যে তোয়া তোমার কি প্ল্যান ? মানে কটা তুমি কিছু ভেবেছো ?”
এই দেখো নিজে এদিকে কিছু বলবে না, আর প্রশ্ন করতে শুরু করলে তোয়ার রেহাই নেই | দূর!
তোয়া উল্টে ওকেই জিজ্ঞেস করলো,”তোমার কতগুলো প্ল্যান ?”
এইবার খুব জোরে হাসলো সাগরনীল,”একটাই যথেষ্ট | একজনই ভালো! আমরা দুজনেই ভালোবাসবো তাকে |”
“এইযে! দুজনে সমান শাসনও করতে হবে বুঝেছো ?”, তোয়া চোখ পাকালো|
সাগরনীল আরও হাসলো, বললো,” না, না | নিজেই ভয়ে ভয়ে থাকি, তোমার মতন শাসন আমি করতে পারবো না তোয়া | তুমিই বোকো বাবা | তবে মারবে না কিন্তু একদম, আগেই বলে দিচ্ছি ”, তারপর তোয়াকে একদম জড়িয়ে ধরে বললো, “তবে আমি খুব, খুব ভালোবাসবো | সেদিকে কোনো অভিযোগ রাখব না | আর রাতে তো আমি এমনিই জেগে থাকি, আমি সামলে দেব, তুমি দেখো”, একটু থেমে বললো,”একা একা সব করতে হবে না | আমি তোমার পাশেই থাকবো তোয়া |”
তোয়া হাসলো, আরও কাছে সরে এল | এইটুকুই তো শুনতে চেয়েছিল |
চাইলেই তো আর সঙ্গেসঙ্গে হয়ে যায় না, কাজেই অপেক্ষা করতে হবে | ওরা দত্তক নেবার কথাও ভেবে রেখেছে, যদি সেরম হয় ঐটাতে কারুরই আপত্তি নেই |
সাগরনীলের তো পরিষ্কার কথা,”তোমার বাবা, মা আর আমার মা এই তিন জনের ভালোবাসার বন্যা তো দেখতেই পাচ্ছ ! মানে আমরা ওদের বায়োলজিক্যাল সন্তান, তাতেই এরকম অবস্থা ! মুখ দেখাদেখি নেই | তা এডপ্টেড হলে আর কি করতো ? আমার তো মনে হয়ে না রক্তের সম্পর্কের কোনো সেরম ইম্পর্টেন্স আছে বুঝলে, ও নিয়ে আমার কোনো টেনশন নেই | হ্যাঁ ভালো করে মানুষ করতে হবে সেটাই ইম্পরট্যান্ট |”
তোয়াও সেটা ভেবেছে, ওই হরমোন থেরাপি, আইভিএফ এইসবে ওরও আগ্রহ নেই | স্বাভাবিক ভাবে না হলে দত্তক নিয়ে নেয়াই ভালো বাবা !
দেখা যাক সবে তো তিন মাস গড়িয়েছে ওদের আলোচনার পরে | এখনো আরেকটু সময় তো দেয়াই যায়, ডাক্তারও তাই বলেছেন |
এখন ডিসেম্বর শেষের দিকে | হায়দরাবাদে শীত সেভাবে পড়ে না | ওই আরামের ঠান্ডা হালকা একদম | তা সাগরনীল চিরকালই শীতকাতুরে, আর তাতে ছুটির দিন, শনিবার | তাই সকাল নটায় সাগরনীল তো মাথা থেকে পা পর্যন্ত চাদর টেনে ঘুমোচ্ছে আর তোয়া উঠে জলখাবার খেয়ে বাইরে বসে বই পড়ছিল |
তোয়া বাইরে থেকেই শুনতে পাচ্ছে একটানা বাজছে সাগরনীলের ফোনটা, ধরছে না | শুনতেই পাচ্ছে না, ঘুমিয়েই কাদা | উঠে এসে দেখলো অঞ্জনা ফোন করেছেন, তোয়া নাড়া দিল, “নীল ফোনটা ধরো… পিসি কল করছে, আমি ধরবো ?”
সাগরনীল ধরলো হাত বাড়িয়ে, ঘুম জড়ানো গলাতেই বললো, ” হুঁ, বলো..”
কি বললেন ওর পিসি তোয়া শুনতে পেল না, কিন্তু দেখলো সাগরনীল উঠে বসলো, খুব চিন্তিত দেখালো হঠাৎ | বেশিক্ষন কথা হলো না, শুধু বললো, “আচ্ছা ঠিক আছে | আমি আসবো পিসি, তোমাকে জানাচ্ছি |”
তারপর ফোন রেখে কিরম হতভম্ব হয়ে বসে থাকলো |
“কি হয়েছে ?”, তোয়া জিজ্ঞেস করলো | উত্তর দিল না, ওর চোখ মুখ দেখে তোয়া বুঝলো ভাবছে কিছু একটা কিন্তু সাগরনীল সেটা মেলাতে পারছে না যেন |
কিছু খারাপ খবর নিশ্চয়, তোয়া ওর পাশে বসলো, ” নীল, কি হয়েছে ? মায়ের শরীর খারাপ নাকি ?”
ঘরের মধ্যেই বললো সাগরনীল, “না, দাদা ! দাদা কাল রাতে মারা গেছে | পিসি বললো যেতে ….আমাকে …দেখি আজ বেরোলে…”, কথা বলছে ঠিকই কিন্তু শুনে মনে হচ্ছে ওর সব যেন হঠাৎ গুলিয়ে গেছে | এই পরিস্থিতির কথা যেন ওর মাথাতেই আসেনি | ওর কি করার কথা ? যাবে ? গিয়ে কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না |
অঞ্জনা বলেছেন, “তোর মা খুব ভেঙে পড়েছে রে, একদম একা হয়ে গেছে | তুই একবার আয়|”
মা ভেঙে পড়েছে ? একা হয়ে গেছে? সেটা তো স্বাভাবিক, মায়ের যাকে কেন্দ্র করে বাঁচা সেই হঠাৎ করে চলে গেছে …কিন্তু সেখানে সাগরনীল কি করবে ?
মাথা যেন কাজ করছে না সাগরনীলের, কি বলবে গিয়ে ? কোথা থেকে খুঁজে আনবে ও মায়ের জন্যে সান্ত্বনা ?
“আমাকে যেতে বললো পিসি”, নিজের মনেই যেন বললো সাগরনীল |
তোয়া ওকে এরকম উদ্ভ্রান্ত দেখে নি কোনোদিন | ওর কাঁধে হাত রাখলো তোয়া, ওকে একা যেতে দিতে পারে না, “আমিও যাবো তোমার সাথে নীল|”
(চলবে)