‘মেয়েটা ছোট এখনো,ছেড়ে দে ওকে।’
‘আম্মা তুমি এই কালির ব্যপারে কোনো কথা বলবা না।’
‘শরীরের আঘা*তের চেয়ে বেশি তিক্ত কথার আ*ঘাত।শরীরের আ*ঘাতে একসময় ঔষধ লাগিয়ে সাড়ানো যায়। কিন্তু কথার আ*ঘাত কে কখনো সাড়িয়ে তুলা যায় না,আজিবন মনে গেঁতে থাকে।
এক ভাই তার বোনকে
‘কালি’ বলে বলে মা*রছে।এই ‘কালি’ শব্দটা শুনলে বোনটার এত কষ্ট হয়!
.
লম্বা একটি বাঁশের বেত নিয়ে শাহেদ মা*রছে বেলিকে।নরম শরীরে চারপাঁচ টা আ*ঘাত হওয়ার সাথে সাথে ফুলে যায়।
কাপড়ের জন্য শরীরের অন্য স্থানের আ*ঘাত দেখা না গেলেও হাতে যেগুলো লেগেছে সব লাল লাল হয়ে ফুলে গেছে।ফুলা ক্ষ*ত দেখে শাহেদ থামে।এবং সেখান থেকে চলে যায়।
___________
বেলি নাম টা ফুলের নাম।বেলি যখন হয়েছিল বেলির বাবা নামটা রাখেন।উনার ইচ্ছে ছিল একটা যদি মেয়ে হয় তার নাম বেলি রাখবেন।বেলি হওয়ার পর সবাই বলেছিল শাহেদের গায়ের রঙ ফর্সা হলেও এ মেয়ে কালো হবে।কিন্তু বেলির বাবার চোখে মেয়েটিকে বেলিফুল এর মতো সুন্দর লেগেছিলো।বাবা মায়ের কাছে সন্তান কখনো কালো হয় না বিধায় বেলি নামটায় রেখেছিলেন তিনি।বেলি চাপা রঙ্গের হলেও দেখতে খুব ই মায়াবি।
.
বেলিদের পরিবারে তিনজন সদস্য।মা বেলি আর শাহেদ।ছোট পরিবার ই।
বেলির বয়স দশ।শাহেদ এর বয়স একুশ।
.
শাহেদ একজন কৃষক।কৃষিকাজ করেই সংসার চালায়।তার বাবা ও একজন কৃষক ছিলেন।কয়েকবছর আগে তাদের বাবা মারা যান।তাই পরিবারের হাল ধরতে হয়েছে অল্প বয়স থেকেই।শাহেদ পড়ালেখা তেমন করেনি তবে বেলি স্কুলে যায়।পড়ালেখা করে।
_________
কিছুক্ষণ আগের ঘটনা,
.
টিনের চালওয়ালা বেলিদের ছোটঘর।দুইটা থাকার রুম। একটাতে বেলি আর তার মা থাকে,আরেকটাতে শাহেদ।একটা রান্নাঘর।
আর বারান্দা।
ঘরের সামনে বড়ই আর আম গাছ আছে।বেলি বেশ ভালো গাছে উঠতে পারে।যখনি সে দেখে গাছে ফল পেকেছে সে যতক্ষণ না ফলটা ছিঁড়বে মনে শান্তি পায়না।
.
বড়ই গাছে বেশ বড়ই ধরেছে।গাছ নাড়া দিলেই অনেক বড়ই পড়বে।
বেলি গাছে উঠে পড়ে।রান্নাঘর থেকে মা চেঁচিয়ে বলে,
‘বেলি কোথায় তুই?’
বেলি চুপিসারে গাছে উঠে।তারপর গাছ নাড়া দিতেই অনেক বড়ই পড়ে।তারপর আস্তে আস্তে নেমে পড়ে।
ফ্রকের মধ্যে বড়ই কুড়িয়ে মায়ের সামনে দাঁড়ায়,
‘তুই কবে বড় হবি বলতো?আবার গাছে উঠেছিস?তোর বয়সের মেয়েরা মায়েদের কত সাহায্য করে জানিস?আর তুই’
মায়ের বকা শুনে বেলি রাগ তো করেনা উলটা বেলি খিলখিল করে হাসে।
.
রান্নাঘর থেকে গুড়ামরিচ আর লবণ নেয়।কাচা বড়ই মরিচ আর লবণ দিয়ে খেতে দারুণ মজা।বেলির পছন্দ।বেলি লবণ মরিচ নিয়ে এসে বারান্দায় বসলো।
ঘরে নতুন ধান এসেছে।
শাহেদ বাইরে বের হয়েছিল।ফিরে এসে উঠানে ধান শুকাতে দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।ধান যদি ভালভাবে না শুকানো হয় তাহলে পোকা ধরে যায়।শাহেদ একায় সব কাজ করে।কাজের লোক যে রাখবে সে টাকা ও যে শাহেদের নেই।
.
বড় উঠানে কড়া রোদে শাহেদ ধান নাড়ছে।বেলি ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইল একমনে।
একটা বড়ই নিয়ে তাতে লবণ মরিচ লাগিয়ে খাওয়া শুরু করলো।শাহেদ বেলির সামনে আসে।
‘শোন বেলি।আম্মা রান্নাঘরে তুই ধান গুলো দেখে রাখবি।নড়বি না খবরদার।’
বেলি চুপ করে রইলো।তবে সে ভাইয়ের কথা শুনতে পেয়েছে।
‘এখানে আশেপাশে কবুতর আছে।একবার ধানে পড়লে গটগট করে সব খেয়ে ফেলবে বুঝেছিস?’
বেলি মাথা নাড়ায়।শাহেদ কড়াগলায় কথাগুলো বলে মাঠে চলে যায় কাজ করতে।বেলি কিছুক্ষণ ধানের দিকে তাকিয়ে ছিল।একটা দুইটা পাখি আসতেই সে হাত নেড়ে উড়িয়ে দিচ্ছিলো।
বড়ই খেতে খেতে কখন যে সে ভাবনায় ডুবলো টের পেল না।বেলি ভাবতে পছন্দ করে।কল্পনার রাজ্যটা তার অনেক সুন্দর।
ভাবনাতে আসে বেলি একজন রাজকন্যা।একটা ফুলের বাগানে সুন্দর একটা ফ্রক পড়ে হাটছে।ফুল ছুঁয়ে দিচ্ছে।
বেলি মুচকি হাসে।
.
তখনি একঝাক কবুতর এসে ধানের উপর বসে।আশেপাশে কারোর তাড়া না পেয়ে তারা মনের খুশিতে ধান খেয়ে চলেছে।
রান্নাঘর থেকে বেলির মায়ের কানে আসলো কবুতরের ডাকের আওয়াজ।
কিন্তু ওখানে তো বেলি রয়েছে।তাই তিনি আর পাত্তা দিলেন না।কবুতররা ইচ্ছেমত ধান খেয়ে চলেছে।আর বেলি এখনো ভাবনার দেশে।ভাবছে আর মুচকি হাসছে।
.
মাঠ থেকে শাহেদ ফিরেছে।পান্তাভাত খাওয়ার সময় হয়েছে তার।প্রতিদিন বেলি পান্তাভাত দিয়ে আসলে ও আজ ধানের জন্য যাওয়া হয়নি।শাহেদ এসে দেখে ধানে কবুতর বসে ধান খাচ্ছে।তাও একটা দুইটা না একঝাক।
শাহেদ দৌড়ে কবুতর তাড়িয়ে বেলির সামনে দাঁড়ায়।রাগে সে ধমকে বলে,
‘বেলি,তোকে কি বলে গেছিলাম?’
হঠাৎ এমন ধমক খাওয়ায় সে কেপে উঠে।ধ্যান ফিরে তার।ভাইয়ের দিকে অসহায় চোখে তাকায়।
‘আমি কি বলে গেছিলাম?বল?তোকে এখানে কেন বসিয়েছি?’
তারপর বেলির মনে পড়ে সে ধান দেখতেছিল।কিন্তু ধান ত ঠিকই আছে।
শাহেদের চিৎকার শুনে রান্নাঘর থেকে তার মা আসে।এসেই ধান দেখে অবাক হন।অর্ধেক মত ধান কবুতরে খেয়ে নিয়েছে।
শাহেদ হনহন করে কোথায় যেন চলে যায়।
মা তখন বলে,
‘বেলি! কিরে তোর আক্কেল নেই।তুই এতগুলা কবুতর বসলো?তাড়ালি না কেন?’
বেলি বলে,
‘আম্মা।সত্যি বলছি আমি কবুতর দেখিনি।’
‘কেন দেখিস নি।তুই জানিস না তোর ভাইয়ের কত কষ্টের ফসল এগুলো?এখানেই তো ছিলি তুই?’
বেলি চুপ করে থাকে,কেন যে সে ভাবনার জগতে চলে যায় নিজেও জানেনা।
.
শাহেদ ফিরে আসে বাঁশের বেত নিয়ে।তারপর বেলিকে মা*রা শুরু করে।বেলির মা বেলিকে ধরতে চেয়েও পারেনা।মা*রা শেষ করে শাহেদ চলে গেলে বেলির মা কাছে আসে।
বেলির মা দূরে দাঁড়িয়ে ছিল।শাহেদ যখন রেগে যায় তখন তার আশেপাশে মা থাকতে পারেনা।তিনি দূর থেকে দাঁড়িয়ে কান্না করেন।শাহেদ চলে যাওয়ার পর তিনি দৌড়ে এসে বেলিকে জড়িয়ে ধরে,
‘কত করে বলি ভাইয়ের সবকথা ভালই ভালই শুনতে।কেন এমন করিস?বলতো?’
বেলি চুপচাপ মায়ের দিকে টলমল চোখ নিয়ে তাকায়।
‘তাই বলে আম্মা ভাই আমারে এত মারবে?’
বেলির মা আবারো বেলিকে জড়িয়ে ধরেন।
বেলিদের ঘরের আশেপাশে তেমন আর ঘর নেই।খালি ভিটা তে তারা তিনজন ই থাকে।বাড়ি যেগুলো আছে সেগুলো একটু দূরে।
বেলিকে ধরে তার মা ঘরে নিয়ে যায়।
শরীর টা বড্ড ব্যথা করছে।নিশ্চুপ হয়ে বেলি কাঁদে।
বেলির মা ও চুপ করে আছে।
কিছুক্ষণ পর শাহেদ ফিরে আসে,গলার স্বর শান্ত দেখায়।বেলিকে বলে,
‘আজকে আর স্কুলে যাস না,নে ডাক্তার কাকা থেকে মলম এনেছি লাগিয়ে নিস।শুয়ে থাক গা।’
.
শাহেদ ভীষণ রাগি মানুষ ।রাগ কন্ট্রোল করতে পারেনা বলে হুটহাট রেগে যায়।আর রেগে গেলে তার মাথায় কাজ করেনা।বেলিকে সে যতেষ্ট আদর করে।কিন্তু বেলির এই ভুলগুলো সে মেনে নিতে পারেনা।যদিও বেলি ছোট।শাহেদকে সাহায্য করার মতো আর কেউ নেই যে।তাই এসব ভুলে সে রেগে যায়।যায় বলে আর করে রাগ থেকেই।
বেলি ভাইয়ের দিকে তাকায় হাসার চেষ্টা করে।বেলি পৃথিবীতে তিনজন মানুষ কে ভালবাসে,একটা বাবা যাকে আল্লাহ নিয়ে গেছেন।আর দুজন ভাই আর মা।তাই বেলি কখনো ভাইয়ের প্রতি রাগ রাখেনা।
.
.
‘বেলি অ বেলি স্কুলে যাবিনা আজ?’
বেলির বান্ধবীরা স্কুলে যাওয়ার জন্য ডাকতে এসেছে।প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার সময় বেলিকে ডাকে তারা।বান্ধবীদের গলার স্বর শুনতে পেয়ে বেলির মা বলে,
‘আজ আর স্কুলে যাস না।’
বেলির মা বারান্দায় এসে দেখে বেলির ফ্রেন্ড সীমা,প্রিয়া,রিয়া দাঁড়িয়ে আছে।তারা পাশের বাড়িতেই থাকে।একসাথেই স্কুলে যাওয়া আসা করে।বেলির মা কে দেখে রিয়া বলে,
‘চাচি বেলি কই?’
‘বেলির শরীর একটু খারাপ আজকে স্কুলে যাবে না।’
এটা শুনে তিনজনি চলে যায়।
.
সারা শরীর ব্যথা হয়ে গেছে।তবুও বেলি চুপচাপ থাকে।সে যে অন্যায় করেছে তাই ব্যথা পেয়েছে ভালই হয়েছে।নিজে নিজে এসব ভেবে বেলি সান্তনা দেয় নিজেকে।
______
বেলি বিছানায় শুয়ে ছিল।
বেলির মা রাতের খাবারের জন্য ডাকতে নিলে বেলি বলে,
‘আম্মা কিছুই খেতে মন চাইছে না।’
‘কেন রে?শরীর খারাপ লাগছে?’
‘নাহ।’
মায়ের জুরাজুরিতে বেলি অল্প ভাত খেয়ে আবারো শুয়ে পড়ে।রাত করে খুব জ্বর আসে।মা আর শাহেদ তখন ঘুম।
বেলি বিড়বিড় করে।
‘আম্মা আমারে মাইরো না।’
বেলির মায়ের ঘুম ছুটে যায়।বেলির কপালে হাত রাখে,কি গরম।
‘বেলি অ বেলি কষ্ট হচ্ছে তোর?এত রাতে ডাক্তার কই পাবো?’
মায়ের আওয়াজে পাশের রুম থেকে শাহেদ এর ও ঘুম ভেঙ্গে যায়।সে দ্রুত মায়ের কাছে আসে।
‘বেলির জ্বর আসছে।সব দোষ তোর।আমার মেয়ের কিছু হলে তোরে কোনোদিন ক্ষমা করব না।’
শাহেদ চুপ থাকে।রাগ ছাড়া তার মনটা খুব ই নরম।শাহেদ বলে,
‘এত রাতে ডাক্তার কাকারে তো পাওয়া যাবে না।আচ্ছা তুমি বেলিরে জলপট্টি দাও।’
বেলির মা তাড়াতাড়ি জলপট্টি নিয়ে আসে।শাহেদ বাড়ি থেকে বের হয়।ডাক্তার কাকার বাড়ি গিয়ে রাজি করিয়ে ই এখানে আনতেই হবে।
বেলির মা চোখের পানি মুছে মুছে জলপট্টি দেন।
‘আম্মা ও আম্মা।’
‘বল মা?’
‘আমি যদি হারায় যাই আমার নাম মনে রাখবা?আমারে মনে রাখবা?’
এই একটা বাক্য মায়ের কলিজাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করতে যতেষ্ট।বেলির মা হু হু করে কাদে,
‘চুপ কর বেলি।’
‘আম্মা আমি তো কালি।কালিরা কি বেশিদিন বাঁচে না?’
চলবে….
#বেলির_কথা
পর্ব-০১
#তাহরীমা
(আসসালামু আলাইকুম।কেমন আছেন আপনারা?আরো একটি নতুন গল্প নিয়ে আসলাম।সাদামাটা গল্প।তবুও বলবেন কেমন হয়েছে।আপনাদের সাপোর্ট এ আমাদের লিখার আগ্রহ বাড়ে।)