#বেলির_কথা (০৬)
‘আম্মা এসব কি বলছো?’
‘তুই জানলে আরো অবাক হবি তোর বাবাকে বি*ষ দিয়ে মে*রেছে তোর জলিল কাকা ই।’
বেলির বিষ্ময় কাটে না।সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
‘কিভাবে জানলে তোমরা?’
‘শোন তাহলে?তোর বাবা আর জলিল ভাই একে অপরের খাটি বন্ধু ছিল।একই জমিতে মিলেমিশে চাষ করতো।তবে জমিটা তখন চেয়ারম্যান এর ছিল,আর ধান গুলো বেশিরভাগ কিনে নিয়ে যেত চেয়ারম্যান।তোর বাবাকে চেয়ারম্যান বেশি ভালবাসত।মানুষ টা যে খুব সরল ছিল।তাই তোর বাবাকে ন্যায্যমূল্যর পাশাপাশি দু চার টাকা বাড়িয়ে দিত।এটা জলিল ভাইয়ের সহ্য হতো না।জেনে রাখ ‘হিংসা মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।’
বেলির এসব বিশ্বাস করতে মন চায় না তবুও শেষ পর্যন্ত শুনতে হবে।
‘তারপর?’
‘তারপর জলিল ভাই ভাবলো তোর বাবাকে কোনোমতে সরিয়ে দিতে পারলে পুরা জমি সে একায় দেখবে তারপর সব টাকা ও সে পাবে।’
বেলি ফুফিয়ে কেঁদে উঠে,
‘আমার আব্বাকে কেমনে মা’রছে আম্মা?’
বেলির মা ঢোক গিলে।তারপর বলে,
‘তারা একসাথে সকালে ভাত খেত,তোর আব্বার অগোচরে ভাতে বি*ষ মিশিয়ে দেয়।খাওয়ার কিছুক্ষণ এর মধ্যেই মা*রা যায়।তারপর জলিল ইট দিয়ে মাথায় আ*ঘা*ত করে কিন্তু নাটক সাজায় তারা তালগাছের নিচে বসে ছিল,তাল পড়ে মাথায় আঘাত পেয়েই মারা যায়।প্রতিদিন শাহেদ তোর বাবার সাথে থাকলে ও সেদিন শাহেদ যায়নি।’
বেলি হু হু করে কেদে উঠে।
‘কাঁদিস না।এ কথাগুলো আমরা কেউ ই জানতাম না।তোর আব্বা চলে যাওয়ার পর শাহেদ বলল সে জমিতে জলিল কাকার সাথেই কাজ করবে।যে ভাগ তোর আব্বায় করতো সেটা শাহেদ করবে।তাই শাহেদ রাতে জলিল ভাইয়ের বাড়ি যায় এ বিষয়ে কথা বলার জন্য।অথচ দরজার কাছাকাছি যেতেই এসব শুনে,জলিল তার বউকে সব খুলে বলছে।শাহেদ এটা শুনে রাগে ঘরে ফিরে ব*টি হাতে নেয়।আমি তার হাত ধরে রাখি।’
বেলি তখন চোখের জল মুছে বলে,
‘কেন ধরলে?এক কো*পে শেষ করে দিতো?’
বেলির মা হাসার চেষ্টা করে,
‘তোদের এখন বয়স কম অল্পতে রেগে যাস।কিন্তু প্রমাণ ছাড়া একটা মানুষকে এভাবে মা*রা ঠিক?সামনে শাহেদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ আছে।তাই আমি তারে বুঝিয়েছি,সমাজের মানুষ বিচার করতে আসলে প্রথমে প্রমাণ চাইবে কিন্তু প্রমাণ নেই।তাই আমি বিচার আল্লাহর হাতে দিলাম।যদি কথাগুলো সত্যি হয়ে থাকে আল্লাহ বিচার করবেন।’
বেলি চুপ হয়ে যায়।বেলির মা বলে,
‘কিছুক্ষেত্রে মা*রের বদলে মা*র সমাধান নয়।নিরবতা অনেক সময় বড় অভি*শাপ ডেকে আনে।তার কিছুদিন পর ই জলিল ভাই এক্সি*ডেন্ট করে হাত হারায়।কিছুদিন আগে শাহেদকে ধরে সব বলেছে ক্ষমা ও চেয়েছে।জানি ক্ষমা করা যায়না।কিন্তু যেখানে মহান আল্লাহ তার বান্দাদের এত দোষ থেকেও তওবা করলে ক্ষমা করে দেন আমি তো সাধারণ মানুষ আমি কেন ক্ষমা করবো না।মানুষটা এখন মৃত ক্ষমা করে দিলাম।’
বেলি মাকে জড়িয়ে ধরে কাদে।বেলির মা আবারো বলে,
‘অনেক সময় বন্ধু ও শত্রু হয়ে যায়।জীবনে সরল হতে নেই।কাউকে সরলভাবে অন্ধবিশ্বাস করতে নেই।তবে জেনে রাখ,কেউ কারোর ক্ষতি করে কখনো ভাল থাকেনা।মনে কখনো রাগ রাখিস না।আম্মার উপদেশ গুলো মাথায় রাখিস।একদিন পরিস্থিতি তোকে অনেক কিছু শেখাবে।তবে সীদ্ধান্ত নেয়ার আগে হাজারবার ভাববি।ভেবে কাজ করবি, কথা বলবি।আশেপাশে অনেক মুখোশওয়ালা মানুষ থাকবে একাই লড়াই করতে হবে জীবনে।শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার উপর ই ভরসা রাখবি।সবাই নিরাশ করলে ও তোর রব তোকে কখনো নিরাশ করবেনা।’
বেলি মাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে,
‘আমার খুব ভয় হয় আম্মা।আমি জীবনে কেমনে এগিয়ে যাব?কেউ বড় করে ধমক দিলেই আমার কান্না পায়।’
মেয়ের কথায় বেলির মা হাসে।
.
.
ভোর হয়ে যায়।ফজরের আযান কানে আসে। বেলি আর ঘুমায়না।ওযু করে এসে জায়নামাজ এ দাঁড়িয়ে পড়ে।নামাজ শেষে বাবার জন্য দোয়া করে,
‘হে আল্লাহ! আমার আব্বাকে যেখানে নিয়ে গেছেন সেখানে ভাল রাখুন।’
.
.
স্কুলে যাওয়ার জন্য বেলি রেডি হয়।চা আর পরোটা খেয়ে বেরিয়ে পড়ে।পথে সীমা আর প্রিয়ার সাথে দেখা হয়।বেলি হেসে বলে,
‘রিয়া কোথায় অসুস্থ নাকি?’
‘আরেহ না রিয়া আগে চলে যায়।’
‘কেন?’
‘জানিনা।’
বেলি সীমার দিকে তাকায়,
‘তোকে এত মনমরা লাগছে কেন?’
‘থাক বাদ দে?’
‘আমরা তোর বান্ধবি?আমাদের কি বলা যায় না?’
‘আব্বা আমার বিয়ে ঠিক করছে?’
প্রিয়া,বেলি অবাক হয়ে একসাথে বলে উঠে-‘বিয়ে?’
‘হ্যা,পাত্র বড়লোক।শুনেছি অনেক ব্যবসা আর টাকার মালিক।ঘরে দুইটা বউ আছে সন্তান আছে।শুনেছি বড়বউ কে বেশি দেখতে পারলেও ছোটটাকে তেমন মহব্বত করেনা।আমার খুব ই মন খারাপ।অই পাত্রের সাথে আমার বয়সের কত তফাৎ।’
বেলি বলে,
‘কিন্তু তোর তো এখনো বিয়ের বয়স হয়নি।অন্তত এসএসসি টা দে?’
‘আব্বারে বুঝাইছি কিন্তু কিছুতেই বুঝছে না।আমরা নাকি গরিব আজকাল মেয়েদের বিয়ে দিতে অনেক কষ্ট নাকি।তাছাড়া পাত্রকে খুশি করানোর জন্য হলেও নাকি টাকা ও দিতে হবে।কিন্তু বড়লোক পাত্র দেখে আব্বা এতকিছু বুঝতে চায়ছে না।’
বেলি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
‘আচ্ছা আমি চাচাকে বুঝিয়ে বলব,মন খারাপ করিস না।’
.
তিনজনে স্কুলে গিয়ে দেখে স্কুলের পুকুরের পাড়ে রিয়া বসে আছে।সাথে আরেকটা ছেলে।এদিকটায় শিক্ষার্থীরা তেমন আসেনা।তবুও দূর থেকে বেলি বুঝে গেলো এটা রিয়া ই।
বেলি আরেকটু কাছে গিয়ে দেখে রামিম।
বেলি অবাক হয়ে যায়।
তখন প্রিয়া বলে,
‘রিয়া নাকি নতুন রিলেশনে গেছে রামিম ভাইয়ার সাথে।’
বেলি অবাক হয়।কিন্তু কিছুই বলেনা।পরপুরুষের প্রতি আকর্ষন তার নেই।ভবিষ্যৎ এ ও এমন হয়ে থাকার চেষ্টা করবে।
তিনজনে চুপচাপ ক্লাসে যায়।
রিয়া আর রামিম গল্প করতে করতে উঠে দাঁড়ায়।রামিম বলে,
‘তোমার সঙ্গ ছাড়া আমি এখন এক মুহুর্ত ও ভাবতে পারিনা।একদিনের ব্যবধান সব কেমন উলটপালট হয়ে গেলো।প্রেম এত মধুর জানতাম না।’
রিয়া হাসে।আর বলে,
‘তাহলে বউ করে ফেলো আমায়?’
‘তুমি তো বউয়ের মতো ই।আর কি বউ করবো?আমাদের মনের বিয়ে হয়ে গেছে যে?এসো একটু জড়িয়ে ধরি?’
‘ইশ শখ।এখানে কেউ দেখে ফেলবে।আর স্যার কিছুক্ষণ পর ক্লাসে যাবে চলো যাই?’
দুজনে যে যার ক্লাসে ডুকে পড়লো।রিয়া বেলিদের সাথে আর বসলো না।বেলি আর রিয়া চোখাচোখি হলেও কথা বলেনা।বেলি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।মানুষ এত সহজে কেমনে বদলে যায়?
.
.
শাহেদ বিল থেকে আসে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য।শাহেদ ভাত আগে খেয়ে আবার চলে যায়।তারপর বেলির মা বেলি আসলে বেলিসহ একসাথে খায়।
শাহেদকে ভাত দিয়ে বেলির মা উঠে দাঁড়াতেই কেমন যেন মাথা ঘুরে উঠে পড়ে যেতে চায়।শাহেদ তাড়াতাড়ি হাত ধরে বসায়।
‘আম্মা তোমার কি অসুখ লাগে?চলো ডাক্তার দেখায়?’
‘আরে না।মাথাটা একটু ঘুরে উঠেছিল।’
‘উঠবেই তো এত কাজ করো?দাড়াও তোমার জন্য একজন কাজের মহিলা ঠিক করি।গ্রামে অনেক মেয়ে আছে কাজ করে এমন।’
‘না তা আর দরকার নেই।আগে একটা ঘর বাধ তারপর একেবারে বউ নিয়ে আসবো।এ ভাঙ্গাঘরে আমার ছেলের বউয়ের জায়গা হবেনা।’
শাহেদ একটু লজ্জা পাওয়ার মতো করে মাথা নিচু করে ভাত খেতে থাকে।বেলির মা হেসে বলে,
‘বলি আমার কিছু জমানো টাকা আছে।অই যে উঠান টা,উঠান তো অনেক বড় এর অর্ধেক এ একটা ঘর বাধ।আমি চাই একটা ভাল ঘরে আমার বউমা আসুক।আমার মতো এমন ভাঙ্গা ঘরে এসে কষ্ট না করুক।’
শাহেদ অবাক হয়।মায়েদের যতই দেখে ততই মুগ্ধ হতে হয়।তারা কত অনায়াসে সন্তানদের সুখের কথা ভাবে।সন্তানদের এতটুকু কষ্ট হবে বলে তারা কষ্ট করে।
কিন্তু সন্তান বড় হয়ে ‘মা’ নামক শব্দকে দূরে ঠেলে দেয়।প্রত্যেক সন্তান যদি মায়েদের ত্যাগ এর কথা একটু হলেও ভাবতো তাহলে দুমুঠো ভাতের জন্য রাস্তায় ভিক্ষা করা সেসব মায়েদের রাস্তায় নামতে হতো না।
মাকে ভরণপোষণের এত অভিযোগ ও থাকত না।আফসোস নয়কি?
চলবে..
#তাহরীমা
(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ।গল্প পচা লাগলে ইগনোর করুন।আর যারা পড়বেন তাদের গল্প কেমন লাগছে মন্তব্য করবেন।আসসালামু আলাইকুম)