#বেলির_কথা (১৩)
______
এ পর্যন্ত বেলিকে দশজন পাত্র দেখে গেছে।কারোর ই পছন্দ হয়নি।সবার কম বেশি গায়ের রঙ নিয়েই সমস্যা।আবার কারোর সমস্যা হাইট,ওয়েট নিয়ে।
কিছুদিন আগেও এক পাত্র দেখতে এসেছিল।পাত্রের রঙ ও কালো ছিল।পাত্রের দুইবোন এসেছিল তারা ও কালো।শাহেদ ভেবেছিল এইবার বোধহয় বেলিকে পছন্দ করবেই।কিন্তু ওরা নিজেরা দেখতে যেমন হোক ওদের ও সুন্দর বউ চায়।
।
।
শাহেদ গ্রামে বের হতে পারেনা।সবাই ধরে ধরে বেলির কথা বলে।নিজেকে এত অসহায় কখনো ই লাগেনি।সে অসহ্য হয়ে কসমেটিকস এর দোকানে গিয়ে একটা ক্রিম নিয়ে আসে।যে করেই হোক।বোনের বিয়ে দিয়ে ছাড়বে।
.
.
বেলির ভার্সিটিতে যায়।জান্নাত এসেছে আজ তবে পূজা আসেনি।জান্নাত অনেক হ্যাপি এখন।ননদের সাথে নাকি এখন খুব ভাল আছে।
বেলির সাথে সংসারের এটাসেটা গল্প করে।জান্নাত বলে,
‘জানো বেলি তোমাকে যে পাবে সে উচ্চলেভেলের ভাগ্যবান পুরুষ।’
জান্নাত কথাটা বলে হু হু করে হেসে ফেলে।বেলি গাল ফুলিয়ে বলে,
‘বেশি ভাগ্যবান যে তাইতো খুঁজে পাচ্ছিনা।পাব বলে ও মনে হয়না।আমি যে সুন্দরী নই।’
‘সবাই এক না।পৃথিবীতে অনেকে আছে গুণ পছন্দ করে।একদিন ঠিকই দেখা হয়ে যাবে মিলিয়ে নিও।’
‘হয়।’
‘দাওয়াত দিবা কিন্তু?’
‘নাহ বিয়ের ভাত আমি একাই সব খাব।আমার যে বিয়ের ভাত খুব পছন্দ।’
জান্নাত হি হি করে হেসে উঠে।
বেলি ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় গাড়িতে বসে আছে।গাড়িতে আরো একজন মেয়ে তার পাশে বসে।আরো দুইজন হলে গাড়ি ছাড়বে।বসে বসে থাকতে বেলি বিরক্ত হয়ে আছে।কিন্তু পাশের মেয়েটি শান্ত,সে কৌতুহলী হয়ে বেলির সাথে মিট করে।বেলিকে জিজ্ঞেস করে,
‘নাম কি আপনার?’
বেলি মেয়েটির দিকে তাকায়।বোরকা পড়েছে।বিবাহিত না অবিবাহিত বুঝা গেলো না।বেলি বলে,
‘বেলি।’
‘মাশা আল্লাহ,সুন্দর নাম।কোথায় থাকেন?’
বেলি গ্রামের নাম বলে।কথা বলতে বলতে মুহুর্তেই মেয়েটির সাথে ভাব জমে উঠে।মেয়েটি বেলির ঠিকানা নেয়।পাশাপাশি বন্ধুত্ব করে।বেলির পরিবারের কথা শুনে।মেয়েটি ও নিজের পরিবার সম্পর্কে বলে।
বেলি বলে,
‘একদিন আসিয়েন আমাদের বাড়ি।আমার ভাবি অনেক খুশি হবে।’
মেয়েটি হেসে ফেলে।নেকাবের ভিতর স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে যে মেয়েটি হাসছে।চোখ দেখেই মনে হচ্ছে মেয়েটি অসম্ভব সুন্দরী।
বেলি চুপ করে থাকে।মেয়েটি কিছুক্ষণ পর ব্যাগ থেকে ফোন বের করে কাকে যেন কল করে।
‘হ্যলো ভাইয়া?’
অপাশ থেকে কি বলছে বেলি শুনছে না।তবে মেয়েটি বলছে।
‘পেয়ে গেছি ভাইয়া।’
——-
‘হ্যা ভাইয়া আমার খুব পছন্দ হয়েছে।এইবার ডান।’
মেয়েটি কল কেটে বেলির দিকে তাকিয়ে হাসে।বেলি কিছু বুঝেনা তবুও হাসার চেষ্টা করে।মাথায় ঘুরছে প্রশ্নটা,
‘পেয়েছি ভাইয়া।কি এমন মহারত্ন পেয়েছে যে এভাবে হাসছে?আশ্চর্য!’
.
গাড়ি থেকে নেমে গ্রামের কিছুপথ হাটতে হয়।তারপর বাড়ি আসে।
গ্রামের পথ দিয়ে হাটতে হাটতে হঠাৎ বেলির বান্ধবী সীমার সাথে দেখা হয়।শশুড় বাড়ি থেকে আসতেছিল সীমা।বেলিকে দেখেই চিনতে পারে সে।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে এট সেটা গল্প করে।কথা প্রসঙ্গে সীমা বলে,
‘তা বেলি বিয়ে করছিস না?’
‘আল্লাহ চাইলে অবশ্যই হবে।’
‘কিন্তু শোন একটু সেজেগুজে থাকিস সবসময়।রূপ..
বেলি আর কথা বলতে দেয়না।শেষমেশ এই রূপের জন্য ফ্রেন্ড ও তাকে জ্ঞান দেয়।কেউ আল্লাহর সৃষ্টিকে মেনে নিতে পারেনা।
সীমা বলে,
‘রাগ করিস না।’
বেলি তখন হেসে বলে,
‘আমি অসুন্দর নই সীমা।যেদিন এই আমিকে এভাবে দেখে কেউ পছন্দ করবে আমি সেদিন বউ হবো।তার আগে নয়।শোন বাইরের সৌন্দর্য্য দেখে যে মানুষ, মানুষের সুন্দর বিচার করে সে মানুষটা আর যাইহোক আমার না হোক।সেই মানুষটায় আমার হোক,যে ভিতরে কতটুকু ভাল মনের সেটা দেখে সুন্দর বিচার করে আর জান্নাত পর্যন্ত নিয়ে যেতে সাহায্য করে।’
সীমা বেলির দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে।বেলি ‘ভাল থাকিস’ বলে বাড়ি চলে আসে।
.
বাসায় এসে বেলি মুখ শুকনা করে রাখে।বেলি ফ্রেশ হয়ে আসে।মিতু ভাত বেড়ে দেয়।মিতু এটাসেটা গল্প করছে বেলি হু হা জবাব দিচ্ছে।তারপর বেলি নিজের রুমে আসে।
টেবিলের উপর একটা ক্রিম দেখে বেলি সেটা হাতে নিয়ে দেখে অবাক হয়ে যায়।
বেলি মিতুর কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘এটা কে এনেছে ভাবি?’
মিতু ও জানেনা।শাহেদ বলে,
‘আমি এনেছি।’
‘কেন?’
‘মুখে দেয়ার জন্য।’
‘আমি এসব দিবো না।’
‘কেন?না দিলে সুন্দর হবিনা।’
‘আমি এমন ই ঠিক আছি।এভাবে কেউ যদি পছন্দ না করে তাহলে বিয়ে ই করবো না জীবনে।’
শাহেদ হুট করে রেগে যায়।বিয়ে না করে আমাদের ছাদের দেয়াল হবি নাকি?
বেলি বলে,
‘হ্য দরকার পড়লে তাই হবো।’
শাহেদ এসে ঠাস করে চ**ড় বসিয়ে দেয়।তারপর রেগে বলে,
‘একটা মেয়ে ঘরে থাকা কতটা অপমানজনক জানিস?আমি বাইরে বের হতে পারিনা।লোকে আমাকে নানান কথা শুনাচ্ছে।’
মিতু বেলিকে জড়িয়ে বলে,
‘মানুষ জ্ঞান দিলে সেসব শুনবেন কেন?আমরা আমাদের মেয়েকে যখন ইচ্ছে বিয়ে দিব।ওরা আমাদের মেয়েকে পড়াচ্ছে না খাওয়াচ্ছে তাদের এত মাথাব্যথা কিসের?তাদের এসব বলার অধিকার দেয় কে?আমাদের ভাল অন্তত তাদের চায়তে হবেনা।’
শাহেদ নিজের চুল টেনে বসে পড়ে।রাগে গা কাঁপছে।
বেলি চুপ করে চোখের জল ফেলছে।ভাই তাকে মেরেছে বিশ্বাস হচ্ছেনা।গাল ব্যথা হয়ে গেছে বেলির।
কিছুক্ষণ পর বেলি শান্তস্বরে বলে,
‘আমার জন্য তোমাদের কষ্ট করতে হবেনা।নিজের আয় দিয়ে আমি নিজেই চলে যাব।দরকার পড়লে একা থাকব।আমার জন্য কারোর কষ্ট পেতে হবেনা।’
শাহেদ বেলির দিকে টলমল চোখে তাকায়, বেলি বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।নদীর পাড়ে যাবে।মন খারাপের সঙ্গী এই নদীর পাড়টা।
শাহেদ ও পিছন পিছন বের হতে নিলে মিতু বলে,
‘কই যাচ্ছেন?’
‘বাজারে যাচ্ছি।আজ যারা যারা আমার বোন নিয়ে জ্ঞান দিতে আসবে সবাইকে বলবো আমার বোনকে দরকার পরলে আমি আলমারিতে সাজিয়ে রাখবো তাতে কেউ যেন নাক না গলায়।আল্লাহ ভরসা।’
মিতু শাহেদের কথা শুনে হেসে ফেলে।আর বলে,
‘কিছু মানুষ আছে সুযোগ পেলেই এমন ব্যবহার করে।তাদের কথায় কান দেয়া উচিৎ না।ধর্য্য ধরেন, নাফরমানি হইয়েন না।’
শাহেদ মুচকি হাসে।এমন বউ পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার।
মিতু মনে মনে বলে,
‘আগে বেলি কি করছে একটু গিয়ে দেখে আসি।’
বয়স হয়েছে বাচ্চামি যায়নি।নিশ্চয় নদীর ধারে বসতে গেছে।শাহেদ থেকে ই শুনেছে মন খারাপ হলে বেলি কি কি করে।
মিতু বোরকা পড়ে নদীর ধারে যাওয়ার প্রস্তুতি নেয়।
.
.
বেলি নদীর পাড়ে বসে ইচ্ছে মতো কাদে।পাখি, নদী সবার সাথে বাচ্চাদের মতো করে কথা বলে,
‘জানিস বুদ্ধির বয়স হওয়ার পর থেকে কখনো কারো ক্ষতি চাইনি।সবার ভাল থাকাটায় চেয়েছি।তারপর ও আমি খারাপ?
যদি ভালো ই হই আজ পর্যন্ত কোনো পাত্রপক্ষ আমারে পছন্দ করলো না।আমি কি সত্যি কারো বউ হওয়ার যোগ্য না?
সবাই ভাল রূপ টায় খুজলো।ভাল মন! চামড়া কালো বলে আমাদের মন ও কি কালো?আমাদের দেখে ভালবাসা যায় না?যদি তারা ভাল মন খুঁজত আমি অনেক আগেই পার হয়ে যেতাম অনায়াসে,এই অপবাদগুলো থেকে।
এই অবহেলা আমার আর সহ্য হয়না।সবার যদি সুন্দর লাগে,আমাদের কালোদের কি হবে,কালো হওয়া কেন এত অপরাধ?তারা যদি আমায় বলতো?
বেলি আবারো অভিমানি কন্ঠে বলে,
‘আজ আম্মা থাকলে আমাকে কেউ মারত না এভাবে।বুকে আগলে রাখত।’
বেলির খুব মা কে জড়িয়ে ধরার তৃষ্ণা লেগেছে মনে।
বেলি অস্ফুট স্বরে বলে,
‘আমি একটুখানি আঘাত পেলে, সে যে আমায় জড়িয়ে নিত বুকে,
সে যে জড়িয়ে আছে, ছড়িয়ে আছে আজ আমার প্রাণের মাঝে,
সে যে আমার মা,সে যে আমারি মা।
বিশ্বভূবন কারোর সাথে তার হয়না তুলনা।
চলবে….
(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)
#তাহরীমা