বেলির_কথা (১২)

#বেলির_কথা (১২)

মিতু ভেবে বলে,
‘শুনেন চাচি আমি নতুন বউ।এই সমাজে নতুন বউয়ের চুপ থাকা মানায়।আমি ও ভেবেছিলাম চুপ ই থাকবো।কিন্তু আপনার শেষের কথাগুলো মানতে পারলাম না।এর কারণ আমার আম্মাকে যখন আমার দাদু তার ছেলের বউ হিসেবে ঘরে এনেছিল তখন আমার ফুফু একটা ও অবিবাহিত ছিলো।কই আম্মার ত তেমন সমস্যা হয়নি।আমি ঘর আলো করেই এসেছিলাম।তাহলে আমার ও ইন শা আল্লাহ সমস্যা হবেনা।আর যদি হয় ভেবে নিবেন এসব শারিরীক সমস্যা,বেলি তার জন্য দায়ী নয়।’

মহিলাটির মুখ বাংলার পাঁচ এর মতো করে চলে গেলো।আর বিড়বিড় করতে লাগলো,
‘নতুন বউ কেমনে এত বিয়াদব হয়?ছি:।’

‘বিয়াদব ‘ শব্দটি শুনে মিতুর খারাপ লাগলো বটে।কিন্তু এসব কথা না বললে ভুল ধারণায় থেকে যাবে আজীবন।জন্ম,মৃত্যু,বিয়ে সব ই আল্লাহর হুকুমের ব্যপার।কিভাবে মানুষ এমন করে বুঝিনা।
.
বেলি ভার্সিটি থেকে ফিরে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে।মিতু বেলি দেখে খুশি হয়ে বলে,
‘এসেছিস,গোসল সেড়ে নে? ভাত দিচ্ছি?’

বেলি ব্যগ থেকে আইস্ক্রিম এর বাক্স বের করে।আর বলে,
‘এই নাও?’
‘কি এটা?’
‘খুলে দেখো?’

মিতু আইস্ক্রিম দেখে লাফিয়ে উঠে খুশিতে।
‘আমার অনেক পছন্দ।তুই জানলি কেমনে?’
‘জানিনা।তবে আমার পছন্দ ভাবলাম তোমার ও হবে তাই।আমি ভার্সিটিতে খেয়েছিলাম।তোমার জন্য মন আকুপাকু করছিল বলেই নিয়ে আসলাম।’

মিতু হেসে বলে,
‘এসব আমার একার?’
‘ভাগ দিলেও দিতে পারো,কিছু মনে করব না।’
‘দিবো না।’

বেলি খিলখিল করে হেসে উঠে।
___

শাহেদ আজ একটা দরকারে অন্যগ্রামে পা রাখলো।গ্রামটি মায়ের বাপেরবাড়ির গ্রাম।মানে শাহেদের নানাবাড়ি।কতদিন পর এই গ্রামে আসলো মনে ও পড়ছে না।সেই ছোটবেলায় মায়ের হাত ধরেই আসতো।

শাহেদ বাজারে প্রয়োজনীয় জিনিস কেনার জন্য ডুকতেই দূর থেকে দেখতে পেলো তার মামাকে।তার স্পষ্ট মনে আছে মামার মুখ।
মায়ের সৎ ভাই।মায়ের বিয়ের পর একটু আধটু যোগাযোগ রাখত তারা।যেদিন থেকে শুনেছে শাহেদের বাবা মারা গেছে সেদিন থেকে তারা আর যোগাযোগ রাখেনি।হয়ত ভেবেছিল মা তাদের কাছে বোঝা হতে চলে যাবে তাই আগেভাগে সাবধান হয়ে গিয়েছিলো।

শাহেদ এসব ভেবে হাল্কা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।
মামা শাহেদ কে দেখে চেনার কথা নয়।সেই ছোটবেলায় দেখেছিল চিনবে কিভাবে?
তবে অনেকদিন পর মায়ের ভাইকে দেখে শাহেদের কেমন যেন মায়া হতে লাগলো।মায়ের কথা মনে পড়লো।

শাহেদ একটু রাগী ছিল বলে মা তাকে সবসময় উপদেশ দিতো,
‘শত্রুকে দেখলে ও সালাম দিবি।মানুষকে আঘাত করে কখনো কথা বলবি না।গুলি যেমন একবার ছুড়ে দিলে ফিরিয়ে আনা যায়না কথা ও বের হয়ে গেলে ফিরিয়ে আনা যায়না।’

এখন শাহেদ অনেকটা চেষ্টা করে কম রাগার জন্য।শাহেদ মামার দিকে এগিয়ে গিয়ে সালাম দেয়।তারপর বলে,
‘আমায় চিনছেন মামা? ‘

মামা বলে,
‘নাহ।কে তুই?
‘আমি শাহেদ।আপনার বোনের ছেলে।’

শাহেদ মায়ের নাম বলে।মামা অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে,
‘এত বড় হয়ে গেছিস?’

শাহেদ হাসার চেষ্টা করে,
‘তোদের গ্রামের একজন থেকে শুনলাম কাল,বিয়ে ও করেছিস নাকি?’
‘জ্বি।’
‘তোর মা কেমন আছে?’

শাহেদ চুপ করে থাকে।যেদিন থেকে ওরা যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে সেদিন থেকে মা বলেছিল,মামাদের ধারে যেন আর না যাই।না খেয়ে থাকলেও ওদের সাহায্য যেন না নিতে হয়।তাই মা মারা গেলে ও মামাদের খবর টা দেয়া হয়নি।

মামা আবারো বলে,
‘কি হলো বল?’
‘বিয়ের খবর শুনেছিলেন এটা শুনেন নি?’
‘নাহ।’
‘আমার আম্মা মারা গেছেন।’

মামার হঠাৎ মুখ চুপসে গেলো।চোখ ছলছল করে উঠলো।অনেকদিন পর বোনটার কথা মনে পড়লো।বেচে থাকতে কদর নেই।মরে গেলে দরদ বেড়ে যায় এটাই নিয়ম।এই বোন সেই বোন যে ভাত খাইয়ে দিত।গোসল করিয়ে দিত।আব্বা টিফিনের টাকা না দিলে বোন নিজের জমানো টাকা ভাইকে খেতে দিত।কিন্তু বড় হয়ে ভালবাসা সব ভুলে যায়।
নিজের সংসারের চাপে পড়ে সব ভুলে যাই আমরা।

মামা এসব ভাবছে তখন শাহেদ বলে,
‘আমি আজ আসি?’

শাহেদের আর কথা বলার ইচ্ছে নেই।মামা তবুও শাহেদকে বলে,
‘আমার বুবু কখন মারা গেলো?’

শাহেদ সব খুলে বলে।এবং বর্তমান পরিস্থিতির কথা ও বলে।
‘তোর বোনের বিয়ে দিয়েছিলি?’
‘নাহ।আল্লাহ যখন চায় হবে আরকি।’

শাহেদ আর দাঁড়ায় না।মামাকে সালাম দিয়েই প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে চলে আসে।ঘরে এসে বেলিকে এসব মামার সাথে দেখা হওয়ার কথা জানায় না।থাক কিছু কথা না জানানোই ভালো।
.
.
এক সপ্তাহ পর আবার ও এক প্রতিবেশি চাচা আরেক পাত্রের সন্ধান নিয়ে আসে।শাহেদ দেখেশুনে ভাল মনে করে।তারা মেয়েকে সরাসরি দেখতে চায়।অনেকদিন ধরে ওরা ভাল মেয়ে খুজছিল বলে জানায়।

শাহেদ বাসায় এসে মিতুকে বলে,
‘বেলিকে দেখতে আসবে।নাস্তাপানির ব্যবস্থা করতে পারবে?ভাত খাবেনা শুধু নাস্তা খাবে।পারবে?’
‘পারব।’
‘অসুবিধা হলে বলো বাইরে থেকে মিষ্টি ফল কিনে নিয়ে আসি?’

বেলি এসে বলে,
‘এতকিছু কেন দিতে হয় ভাবি?’

মিতু বলে,
‘এটাই নিয়ম।না হয় গ্রামের মানুষরা কথা শুনায়।’
‘আশ্চর্য।’

শাহেদ বেলিকে চুপ থাকতে বলে।
বেলি ও আর কিছু বলেনা।শাহেদ অনেক টাকা খরচ করে বাজার করে।ফলমূল কিনে আনে।
ননদ ভাবি মিলে কয়েকটা নাস্তা রেডি করে।

প্রতিবেশি চাচা জানায় সন্ধ্যার দিকে পাত্ররা আসবে।পাত্র,পাত্রর বাবা মা আসবে শুধু।

মিতু নিজের বাবা মাকে ফোন করে আসতে বলে।যদিও শাহেদ আগে থেকে বলেছিল আসতে।যথাসময়ে মিতুর বাবা মা আসে।তারা বেলিকে প্রচুর আদর করে।বেলি তাদের দেখে খুব খুশি হয়।
.

মিতু বেলিকে নিজের একটা শাড়ি পড়িয়ে দেয়।
‘আমার ননদের চেহারা টা কিন্তু সেই।আমরা শুধু ধলা বিলাই।’

বেলি হেসে উঠে বলে,
‘আমার ভাবি ও অনেক সুন্দর।তাইতো এক দেখায় আমাদের বাসায় নিয়ে চলে আসছি।’
‘হুম।আমার মনে দুঃখ থেকে গেলো।আম্মার এত গল্প শুনেও আম্মাকে দেখার লোভ আজিবন থেকে যাবে।আর দেখা হবেনা আমাদের।’

বেলি মিতুর হাত ধরে বলে,
‘আম্মা সবসময় আমাদের দুইভাইবোন ওর জন্য দোয়া করতো।আম্মার দোয়া আমাদের পাশে আছে।’

বেলি কেদে ফেলে।মিতু কিছু বলেনা।কাঁদুক। মায়ের জন্য যদি নাই বা কাদে সে আবার কেমন মেয়ে?
‘তোকে সাজিয়েছি বেশি কাঁদলে সাজ সব ভেস্তে যাবে।’

মিতু কান্না মুছে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে যায়।সব নাস্তা প্লেটে করে সাজিয়ে নেয়।
.
যথাসময়ে পাত্রপক্ষ আসলো।সাথে প্রতিবেশি চাচা ও আসে।শাহেদ তাকে জিজ্ঞেস করে,
‘আমার বোন কেমন সেটা বলেছেন?’
‘বলেছি বলেছি।তারা অনেক ভাল মানুষ।’
‘গায়ের রঙ কেমন বলেছেন?’
‘হ্যা তাদের ভাল মেয়ে হলেই চলবে।’

শাহেদ সস্থি পায়।

শাহেদ অনেক সুন্দর করে পাত্রদের আদর আপ্যায়ন করে।পাত্র দেখতে সুদর্শন।তারা কথায় কথায় একটা কথায় জানায় তাদের ভাল মেয়ে লাগবে।একটা ভাল মেয়ে পুত্রবধূ করতে চায়।উনাদের কথাবার্তা শুনে শাহেদ খুশি ই হয়।

নাস্তার পর্ব শেষ হলে শাহেদ বেলিকে নিয়ে আসে।মিতু আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকে।
বেলিকে দেখে পাত্রের মায়ের মুখ ভার হয়ে আসে।বেলিকে তারা অনেক প্রশ্ন করে।এই যেমন- নাম কি?কতটুকু পড়েছে?জন্মের সাল ইত্যাদি ইত্যাদি।’

বেলি সুন্দর করে সবকিছুর উত্তর দেয়।
পাত্রের মা বেলির হাটা,চুল গলা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নেয়।
পাত্রের মা বেলিকে ভিতরে নিয়ে যেতে বলে।তখন পাত্রের মা পাত্রের সাথে কি যেন বলে।

পাত্রের মা শাহেদের উদ্দেশ্য বলে,
‘কিছু মনে করবেন না।আমাদের আরেকটু ফর্সা মেয়ে লাগবে।’

শাহেদ অবাক হয়ে তাকায়।তারপর ও তাদের সাথে অতিথিদের মত আচরণ করে বিদায় দেয়।

পাশের রুম থেকে বেলি সব শুনে চুপ করে বসে থাকে।মিতু বলে,
‘আল্লাহ যাকে কপালে রেখেছে তার সাথেই বিয়ে হবে।মন খারাপের কিছুই নেই।’

বেলি ভাবিকে জড়িয়ে ধরে।শাহেদ মন খারাপ করে ফেলে।শাহেদের মন খারাপের সুযোগ নিয়ে প্রতিবেশি চাচা বলে,
‘বেলিকে ফর্সা হওয়ার ক্রিম দিতে পারতিস।আজকাল কেউ কালোদের পছন্দ করেনা।আমার কথাটা ভেবে দেখিস?এরকম মেয়ে পছন্দ না হলেও পাড়ার মানুষ অনেক কথা বলে।’

শাহেদ চুপ করে থাকে।মিতু কথাটা শুনে এগিয়ে আসে।কিন্তু তার আগেই পিছন থেকে বেলি এসে বলে,
‘এরকম আর ঘরোয়াভাবে টাকা খরচ করে মেয়ে দেখাবেনা।দেখালে ও একটা টাকা ও খরচ করবে না।আর তাদের বলে দিও এই রূপ আল্লাহর সৃষ্টি।’

চলবে..

#তাহরীমা

(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here