#অপ্রিয়_প্রেয়সী
#লিখা_তানজিলা
#পর্ব- ৮
আকাশের পানে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে এলো আইজার। এই মুহুর্তে বহমান মেঘের ভেলা দেখে বেশ বড়সড় কমলা রঙের কেক মনে হচ্ছে। বিরক্ত ভঙ্গিতে পাশে বসে থাকা সীমান্তর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো আইজা। সেই কখন থেকে নদীর পাড়ে বসে আছে ওরা। জায়গায় টা আইজার বেশ প্রিয়। সেদিন সীমান্তকে নিয়ে এখানে ঘুরতে চেয়েছিলো ও। কিন্তু সীমান্ত আসেনি। আজ আইজাকে এখানে টেনে এনে নিজে চোখ বন্ধ করে বসে আছে।
-“আপনার হঠাৎ এই ইন্টার্নশীপ করার ইচ্ছে কেন হলো বলুন তো!”
হুট করেই প্রশ্ন করলো সীমান্ত। আইজাও সোজাসাপটা ভাষায় বলে উঠলো,
-“প্রজেক্ট বালুচর।”
প্রজেক্ট বালুচরের নাম শুনতেই কিছুটা স্থির হয়ে বসলো সীমান্ত। কৃত্রিম ভাবুক চাহনিতে প্রশ্ন করে উঠলো,
-“হঠাৎ এ বিষয়ে এতো কৌতূহল কেন?”
-“কৌতূহল থাকবেই বা না কেন? পাপা সর্বশেষ এই প্রজেক্টেই কাজ করছিলো। তাকে কেউ বাজেভাবে ফাঁসাচ্ছে! মেয়ে হিসেবে একটু জানার আগ্রহ তো থাকবেই!”
-“আপনি এতোটা নিশ্চিত কি করে যে তাকে কেউ ফাঁসিয়েছে। এমনও হতে পারে সে আসলেই অপরাধী!”
সীমান্তর মুখ থেকে কথাটা বের হতেই আইজা কিছুটা সতর্ক হয়ে বসলো। নিজেই নিজেকে বলতে শুরু করলো, কন্ট্রোল আইজা! কন্ট্রোল! এখনই রাগের মাথায় হুট করে কোন ঝামেলা করতে চায় না ও। সকল অনুভূতিকে উপেক্ষা করেই শান্ত গলায় বলে উঠলো,
-“এই প্রজেক্টে পাপা ছাড়া আরও তিনজন কাজ করছিলো। আপনি কি করে নিশ্চিত হতে পারেন যে তাদের মধ্যে কোন অপরাধী ছিলো না। এতোগুলা মানুষের চোখে একাই ধুলো দেয়া কি আদৌও সম্ভব! আর আমি যতটুকু জানি প্রজেক্টের কাজের জন্য তহবিল থেকে কয়েকদিন পর পর টাকা কমে যাওয়ার ব্যপারে আমার পাপা সবার আগে নজর দিয়েছিলো। থানায় ডায়েরি করার কথা পর্যন্ত উঠিয়েছিলো। কিন্তু আপনার বাবা তাতে বাঁধ সেধেছিলো! পাপা যদি আসলেই টাকার হিসেবে গড়মিল করতো তাহলে নিশ্চয়ই তিনি থানা পুলিশ করতে চাইতেন না। এখানে সন্দেহের তীর তো অন্য কারো দিকে থাকার কথা।”
শেষের কথাগুলো তীক্ষ্ণ স্বরে বললো আইজা। সীমান্ত হয়তো বুঝতে পেরেছে ও কাকে উদ্দেশ্য করেছে শেষ বাক্যে। তাই হুট করে উঠে দাঁড়ালো সে। শান্ত হয়ে থাকা মুখে মুহুর্তেই থমথমে ভাব এসে জমলো। সীমান্তর সাথে সাথে আইজাও উঠে দাঁড়ালো। লোকটা ওর দিকে না তাকিয়েই গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
-“প্রজেক্ট বালুচর নিয়ে আপনার মাথা ঘামানোর কোন প্রয়োজন নেই। এ বিষয় থেকে দূরেই থাকুন। পারিবারিক মায়ায় আটকে পড়েছেন আপনি। অন্য কারও ওপর কোন প্রমান ছাড়াই দোষ চাপিয়ে দেয়া টা আমি মোটেও পছন্দ করি না।”
ক্রোধ তাড়নায় দুই হাত মুঠ করে রাখলো আইজা। যথাসম্ভব নিজেকে সামলে সীমান্তর সামনে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো,
-“আপনিও কি আমার থেকে আলাদা! গতকালই তো কোন প্রমান ছাড়া আমাকে পরকীয়ার অপবাদ দেয়া হলো। আপনার কাছে আদৌও কি কোন প্রমান ছিলো সীমান্ত!”
নিঃশব্দে হেসে উঠলো সীমান্ত। আইজার চোখে চোখ রেখে ধীর গলায় বলে উঠলো,
-“জানেন তো আইজা, পৃথিবীতে প্রত্যেক মানুষেরই কিছু না কিছু দূর্বলতা থাকে। আপনার দূর্বলতা কী বলুন তো?”
ভ্রু কুঁচকে এলো আইজার। কন্ঠে বিরক্তির রেশ এনে বললো,
-“আপনি কিন্তু কথা ঘুরাচ্ছেন!”
সীমান্তর কানে যেন আইজার কোন কথাই প্রবেশ করেনি। সে নিজের মতো করেই বলতে শুরু করলো,
-“এর আগেও বলেছি আর এখনো বলছি, আমি আপনার সাথে কোন বিদ্বেষমূলক সম্পর্কে জড়াতে চাই না। আপনি সহ্য করতে পারবেন না।”
-“নিজেকে নিয়ে এরকম গর্ব করতে যাবেন না প্লিজ। চার মাস হয়ে গেছে আপনাকে সহ্য করছি। আমার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে এতোটাও স্ট্রং না আপনি সীমান্ত!”
আইজার ব্যাঙ্গাত্বক কথা কানে যেতেই তার দিকে ঠান্ডা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সীমান্ত। কয়েক সেকেন্ড পর্যন্ত কেউই কিছু বললো না। সীমান্তর এ চাহনি হয়তো আইজার অজানা। বাহ্যিক দৃষ্টিতে তা কতটা স্পষ্ট জানে না সীমান্ত। কিন্তু নিজ মস্তিষ্কের কাল্পনিকতার মাঝে এই মুহুর্তে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানবীকে যে কতবার আঘাত করছে হিসাব করতে পারবে না ও!
-“দুপুর থেকে কিন্তু আমাদের কিছু খাওয়া হয়নি। আপনার ক্ষিদে পায়নি? না-কি আপনার সাথে কাজ করতে গেলে না খেয়ে থাকার অভ্যেস ও থাকতে হবে!”
হুট করে কথা পালটে দিলো আইজা। তবে আইজার কথায় কোন জবাব দিলো না সীমান্ত। আগের ভঙ্গিতেই শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তবে ঠোঁটের কোণে জেগে থাকা স্মিথ হাসির রেখা চক্ষুগোচর হয়নি আইজার।
বাড়িতে পৌঁছে সীমান্ত সোজা নিজের স্টাডি রুমে চলে গেল। আইজা মৃদু হেসে সোফায় গা এলিয়ে দিলো। রাজিয়াকে চা আনার কথা বলেই ব্যাগ থেকে ফোন টা বের করলো ও। সীমান্ত যদি আইজার অফিসে জয়েন করা নিয়ে সন্দেহ করে থাকে তাহলে নাজিম শিকদারও এর ব্যতিক্রম হবে না। আইজাকে তো সেরকম কষ্ট পর্যন্ত করতে হয়নি! না! বিষয় টাকে ছোট ভাবে নিচ্ছে না ও! আইজার উদ্দেশ্য হয়তো আন্দাজ করতে পেরেছে নাজিম!
***
মাঝরাতের দিকে নিভু নিভু চোখে নিজের সাথে মিশে থাকা ঘুমন্ত মানবীর দিকে তাকালো সীমান্ত। এই মুহুর্তে আইজার স্নিগ্ধতায় ঘেরা মুখ টা দেখে হয়তো বলা যাবে না কী পরিমাণ অশান্ত আভাসে ঘিরে আছে সে। বালিশকে উপেক্ষা করেই সীমান্তর বুকের ওপর মাথা এলিয়ে দিয়েছে মেয়েটা।
কী অদ্ভুত অভ্যেসে পরিণত হয়েছে সে এই কয়েক মাসে। যেদিন ওদের বিয়ে হয়েছিলো সে দিন সীমান্ত কোনরূপ ইতস্ততবোধ ছাড়াই বলেছিলো আইজার প্রতি ওর মনে কোন অনুভূতি নেই। আজও তাই। কিন্তু এই মুহুর্তে সেই একই বাক্য নিজেকে মনে করিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে না সীমান্তর। দুটো চুম্বক সংস্পর্শে এলে দক্ষিণ মেরু আর উত্তর মেরু একে অপরকে আকর্ষিত করবেই। ইদানিং হাজার অমিচ্ছা স্বত্বেও এ অসহ্য বাঁধনে আটকে পড়ছে ও। মৃদু হেসে আইজাকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো সীমান্ত। চোখ জুড়ে এসে ভর করলো ঘুমের ঘোর।
দেখতে দেখতে চলে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। অফিস বিল্ডিংয়ের সামনে বাইক থামিয়ে ক্রমাগত বাজতে থাকা ফোন রিসিভ করে কানের কাছে ধরলো সীমান্ত। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো আইজা। অন্তত রাস্তায় ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েনি সে। নইলে কানের পর্দা বাজার পাশাপাশি এক্সিডেন্টের সম্ভাবনাও হতো প্রবল।ফোনে কথা বলতে বলতেই বাইক পার্ক করে অফিসের ভেতর প্রবেশ করলো সীমান্ত। আইজা চুপচাপ তাকে ফলো করে যাচ্ছে। মাথা টা প্রচন্ড ভনভন করছে ওর।
মনে হচ্ছে সীমান্তর ফোনের রিংটোন আইজার মস্তিষ্কে সেভ হয়ে গেছে। ফোনে শব্দ বন্ধ হলেও ওর মগজে বিনামূল্যে বেজে যাচ্ছে সেই রিংটোন। অফিসে ঢুকতেই যেন কোন আর্মি অফিসারের মতো নিজেকে সাবধান কমান্ড দিয়েছে সীমান্ত। সোজা সিঁড়ির দিকে সীমান্তকে এগোতে দেখেই আইজা প্রশ্ন করে বসলো,
-“লিফট কি খারাপ হয়ে গেছে?”
-“আমি সিঁড়ি ব্যবহার করতেই স্বাচ্ছন্দবোধ করি।”
কথাটা বলেই হনহন করে সিঁড়ি বেয়ে চলে গেল সীমান্ত। আইজা এক সেকেন্ডের মতো তাকিয়ে রইলো শুধু। পরক্ষণেই ভ্রু কুঁচকে লিফটের দিকে পা বাড়ালো ও। লিফট থাকতেও সিঁড়ি চড়তে হবে! বিরক্তিকর! আরে সকাল সকাল জগিং করাই কম না-কি!
পাঁচ তালায় পৌঁছে সীমান্তর কেবিনে চলে গেল আইজা। সীমান্ত এখনো কেবিনে আসেনি। এই সুযোগে জায়গাটা ঘুরে ঘুরে দেখছে ও। হঠাৎ দরজার ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠ কানে যেতেই টনক নড়লো আইজার। ও কেবিনের ভেতর আসতে বলতেই কচ্ছপের গতিতে ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করলো চব্বিশ কী পঁচিশ বছরের এক মেয়ে। সামনে আইজাকে দেখেই মুখে মিষ্টি এক হাসি টেনে বলে উঠলো,
-“আইজা ভাবি! আপনাদের বিয়ের সময় দেশের বাইরে থাকায় আসা হয়নি। সীমান্ত ভাইয়ার ফোনে ছবি দেখেছি শুধু। আজ এভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি!
গরগর করে বলে যাওয়া কথাগুলো এক ভ্রু উঁচু করে শুনে গেলো আইজা। মেয়েটাকে কেন যেন বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে। কোথায় যেন দেখেছে! এক মিনিট! সেদিন সাহিলের সাথে এই মেয়েটাই তো ছিলো! এই মুহুর্তে সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে সে হয়তো সাহিলের নতুন শিকার!
চলবে…
আগের পর্ব
https://m.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/494568962264881/