দিন কেটে যায় আশায় আশায়
শেষ পর্ব
– দরজাটা একটু খুলতো
আমি পাশ ফিরে তাকালাম I বুবু মোবাইলের মধ্যে মুখ ডুবিয়েই কথাটা বলল I মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল আমার I এমনিতেই সুমাইয়ার ঘর থেকে বেরোনোর পর থেকে কেমন ঘোর লেগে আছে I বিশ্বাস হচ্ছে না যে ও বিয়েতে রাজি হয়েছে I একটু বিরক্তি নিয়েই উঠলাম I এবং সত্যি কথা বলতে দরজা খোলার পর বিরক্তি বিস্ময়ে রূপান্তরিত হল I দৈত্যাকৃতির ছেলেদুটোকে দেখে I আগে থেকে চেনা না থাকলে আমি ভয় পেয়ে যেতাম I রুম্মন এবং জুম্মন দুই ভাই I আপাদের চালের আড়ত পাহারা দেয় I ওদের বাসায়তেই থাকে I ছেলেদুটোর ব্যাপারে গল্প শুনেছি I বয়স বেশি না 21, 22 হবে I ওদের মা বুবুর শশুরবাড়ীতে কাজ করতো I যমজ ছেলে হওয়ার পর ছেলেদের চেহারা দেখে বাবা পালিয়ে গিয়েছিল I কিছুদিন পর শোনা গেল আবার বিয়ে করেছে I ছেলেগুলো ওই বাড়িতেই বেড়ে উঠেছে I বুবুর যখন বিয়ে হয় তখন ওদের বয়স অল্প I বোরহান চাচাকে ওরা নানা বলে ডাকতো I আর দুলাভাইকে মামা I কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো বুবুকে ওরা আম্মাজান বলে ডাকে I বুবু ওদেরকে অসম্ভব স্নেহ করে I দেখতে দৈত্যাকৃতির হলেও স্বভাব খুব ভালো I সবাইকে খুব সম্মান করে I তবে বুবুর ওরা অন্তপ্রাণ I বুবু একবার বললে আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারবে I
আমি ওদেরকে দেখে একটু বিরক্ত হলাম I ওদেরকে কেন ডেকে পাঠানো হয়েছে ঠিক বুঝতে পারলাম না I ওরা আমাকে দেখে লম্বা সালাম দিল I আমি ওদের ভিতরে নিয়ে এসে বসার ব্যবস্থা করলাম I ছেলে দুটো খেতে খুব পছন্দ করে Iবুবু ওদের খাবারের ব্যবস্থা করে দিল I খাওয়াতে খাওয়াতে কি সব বুঝিয়ে দিল I ছেলে দুটো ঘাড় কাত করে শুনে গেল সব I আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, বুবুর প্ল্যানটা ঠিক কি I আমি ওর কানের কাছে এসে বললাম
– ওদেরকে খবর দিয়েছিস কেন ?
– তোর অত কিছু নিয়ে ভাবতে হবে না I বিয়ে করতে এসেছিস জামাইয়ের মত থাক I বেশি লাফালাফি করার দরকার নেই I
বুঝলাম নিশ্চয়ই ওর মাথায় কিছু একটা চলছে I আমি আর কথা বাড়ালাম না I কিছুক্ষণের মধ্যেই সুরমা আপা এসে বলল সুমাইয়া তৈরি হয়ে গেছে I বুবু আর সময় নিল না I ঝটপট কাজী সাহেবকে পাঠিয়ে দিল ভেতরে I সই সাবুত আর কবুল পড়তে বেশি সময় লাগল না I আধাঘন্টার মধ্যে আমার ম্যারিটাল স্ট্যাটাস চেঞ্জ হয়ে গেল I
বিবাহ সম্পন্ন হবার পর ,খুব ইচ্ছা করছিলো একবার সুমাইয়ার সঙ্গে দেখা করতে I ও হয়তো আমার মতো এতো খুশি হয়নি Iহয়তো বিপদে পড়ে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে I কিন্তু আমি মনে মনে ঠিক করলাম আমি ওকে খুব যত্ন করে রাখবো I আমি জানি এত গুলো দিন ও খুব কষ্ট করে ছিল I সুমাইয়ার ঘরে যাওয়ার আর সুযোগ পেলাম না I তাড়াহুড়া করে নামাজ পড়তে চলে গেলাম I আরিফ ভাই , মালিহা আপু চলে যাবে I ওনাদের তারা আছে I আজকে আমরা সবাই ওখানেই থাকবো কাজেই গোছগাছের ব্যাপার আছে I নামাজ শেষ করে উনারা চলে গেলেন I
ফিরে এসে আমি ভাবলাম এইবার সুমাইয়ার সাথে একটু দেখা করা যেতেই পারে I কিন্তু দরজা খুলল ওর বান্ধবী I কোনমতে হাজার খানেক টাকা খসিয়ে যা ও বা একটু ভেতরে ঢুকতে নিয়েছিলাম ততক্ষনে সম্মানিত দুলাভাই এসে হাজির হলেন I বুবু অবশ্য দুলাভাই কে সাইজ করার ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছে I এত ক্ষণে বুঝলাম রুম্মন এবং জুম্মনকে কেন আনিয়েছে I তবে ও যে রায়হান সাহেবের ঠিকুজি বের করে ফেলেছে সেটা অবশ্য আন্দাজ করতে পারিনি I তবে ব্যাটা ভালই ভয় পেয়েছে I
সম্মানিত দুলাভাই এবং রায়হান ভাই খাচ্ছেন I রফিক সাহেব নামের এক ভদ্রলোক বসেছেন তাদের সাথে I তার মধ্যে অবশ্য কোন বিকার নেই I বেশ আয়েশ করেই খাচ্ছে মনে হচ্ছে I বোধহয় খাওয়া-দাওয়া পছন্দ হয়েছে I রুম্মন কে দেখলাম তার প্লেটে আরেকটা রোস্ট তুলে দিতে I ভদ্রলোক বেশ বিগলিত হাসি হাসলো I দুলাভাই অগ্নি দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালো I তিনি বিশেষ একটা গ্রাহ্য করলেন না I মুরগির হাড় চিবোতে লাগলেন I
দুলাভাইয়ের বস মাহফুজ সাহেব কিংবা রায়হান ভাইয়ের স্ত্রী দুজনের একজন ও এলেন না I আমি বুঝলাম আপা এটা ভয় দেখানোর জন্য করেছে I তবে ওষুধে কাজ দিয়েছে I যদিও মনে হচ্ছে ওষুধের ডোজ বেশিক্ষণ থাকবে না I হল ও তাই I
খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই বুবু তল্পিতল্পা গুটিয়ে ফেলল I খাওয়া-দাওয়া শেষ হওয়ার সাথে সাথেই বলল
আমরা বউ নিয়ে চলে যাচ্ছি I
দুলাভাই উঠে দাঁড়িয়ে বলল
শুধু বউ না এর বোন এবং বাচ্চাকে ও নিয়ে যান I
বুবু বোধহয় এমন একটা কিছুর জন্য তৈরি ছিল I বেশ স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল
অবশ্যই নিয়ে যাব I এখানে ফেলে রেখে যাবো ভেবেছেন? শুধু মাস শেষে বউ আর ছেলের ভরণপোষণ পাঠিয়ে দেবেন I
দুলাভাই বাঁকা হেসে বলল
কিসের ভরণপোষণ ? যে বউ স্বামীর কথা শোনে না তার আবার কিসের ভরণপোষণ ?
শোনার মত কথা হলে নিশ্চয়ই শুনবে I কিন্তু তার জন্য তো আর আপনার দায়িত্ব আটকে থাকবে না I ভরণপোষণ তো আপনাকে দিতেই হবে I আপনার নামে আইন ও সালিশ কেন্দ্রে আমি চিঠি দিয়েছি I ওরা আপনার এখানে আসবে I আপনার অফিসের ঠিকানা , বসের নাম ঠিকানা সবি দেওয়া আছে I ভালোয় ভালোয় না দিলে কিভাবে নিতে হয় সেটা ওরা জানে I যাইহোক আপনি যদি মনে করেন আপনি উনাদের নিয়ে আসতে চান তাহলে নিয়ে আসবেন I আপাতত ওরা আমার সঙ্গে যাবে I
তারপর গলা উঁচিয়ে বলল
সুরমা , তোমার আর সুমাইয়ার গোছগাছ হয়েছে ? আমাদের রওনা দিতে হবে I
কোন রকম ঝামেলা ছাড়াই আমরা বাড়ি ছাড়লাম I আরেকটা ছোট গাড়ির ব্যবস্থা করা হয়েছে I ওইটাতে আমি সুমাইয়া , সুরমা আপা আর আমার শ্যালিকা জুই উঠলাম I অন্য গাড়িতে আপা দুলাভাই ও বাকিরা আসছে I গাড়িত উঠেই জুই আমার কানে কানে বললো
কি দুলাভাই একটার সঙ্গে তো আরেকটা ফ্রী পাচ্ছেন I ম্যানেজ করতে পারবেন তো ?
আমি বললাম
আমার লেখা দুই একটা গান শুনলেই তুমি ম্যানেজ হয়ে যাবে I মাছ নিয়ে একটা গান আজ সকালেই লিখেছি I অনুমতি দিলে শোনাতে পারি I
সুমাইয়া থমথমে গলায় বলল
এখন কোন গান শোনানো হবে না I
আমি বললাম
বউয়ের আদেশ অমান্য করার সাহস আমার নেই I তার প্রথম দিনের পারফরম্যান্স এখনো মনে আছে I
************
মালিহা আপুর বাসায় ঢুকে আমি অবাক হয়ে গেলাম I এত ছোট ,পুরনো আমলের একটা বাসা কেউ এত সুন্দর করে রাখতে পারে I তাও আবার খুব যে দামি আসবাব পত্র রাখা হয়েছে তা নয় I তবে সব কিছুতেই কেমন রুচির ছাপ I শুধু রুচির বললে ভুল হবে I প্রতিটা জিনিসে একটা শিল্পের ছোঁয়া দেখতে পেলাম I রিমি আপা আর মালিহা আপু আমাকে একটা ঘরে নিয়ে গেল I বাড়িতে ঢুকে যতটা অবাক হয়েছিলাম ঘরে ঢুকে রীতিমতো বিস্মিত হলাম I এত অল্প সময়ে এত সুন্দর করে সাজিয়েছে ! এটা বোধহয় ওদের সেকেন্ড বেডরুম I বুঝলাম ওদের শোবার ঘর বাবু আর আপার জন্য ছেড়ে দেয়া হয়েছে I এই ঘরে ছোট একটা খাট I বিছানার চাদর পর্দা সব মিলিয়ে পড়ানো I সাদা আর হালকা নীল এর সমন্বয় I ভারী স্নিগ্ধ লাগছে দেখতে I টেবিলের ওপর একটা ফুলদানিতে অনেকগুলো রজনীগন্ধা I সবচেয়ে যে জিনিসটা ভালো লাগলো সেটা হচ্ছে পুরো ঘরটা কৃত্তিম মোমবাতি দিয়ে সাজানো I বাইরে থেকে দেখতে মোমবাতির মত কিন্তু ভেতরে লাইট দেয়া I এত সুন্দর জিনিস আমি আগে কখনো দেখিনি I
তখনো সন্ধ্যা হয়নি I আরো বেশকিছু আত্মীয়-স্বজন বন্ধু-বান্ধব এসে দেখা করে গেল I আরেক দফা খাওয়া-দাওয়া হলো I আমি ঘরেই বসে ছিলাম I জুইএবার আমাকে খাইয়ে দিল I সন্ধ্যার দিকে ও আমাদের থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে গেল I রাশেদ অবশ্য ওকে থাকতে বলেছিল I মন খারাপ করা গলায় বলল
তোমাকে তো গানটাই শোনানো হল না
এবার আপনার বউকে ইচ্ছামত গান শোনান I আমারটা পাওনা থাকল I আর একদিন এসে শুনে যাব I
আমার খুব অস্বস্তি হচ্ছিল I মালিহা আপুর শোবার ঘরটাতে বাবু আর আপাকে বিছানায় শুতে দেয়া হয়েছে I মেঝেতে রিমি আপা আর মালিহা আপু ঘুমাবে I ছেলেরা সবাই ড্রইং রুমের মেঝেতে বিছানা করে শোবে I ড্রইং রুমেটা এই ঘরের একেবারেই কাছে I ওদের সব কথা আমি এখান থেকে শুনতে পাচ্ছি I তার মানে এখানে কথা হলেও নিশ্চয়ই তারা সব শুনতে পাবে I অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা চলল I
আমি জড়োসড়ো হয়ে বিছানায় বসে ছিলাম I রাশেদ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দরজায় হেলান দিয়ে দাড়িয়ে রইল আমার দিকে তাকিয়ে I আমি মাথা নীচু করে বসে ছিলাম I কিছুক্ষন পর ওর দিকে তাকিয়ে বললাম
আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন ?
কাছে আসতে ভয় পাচ্ছি I তুমি আবার কোথায় লাথি টাথি মেরে বস I
আমি ঠিক করেছিলাম হাসবো না I পাশের ঘর থেকে নিশ্চয়ই শোনা যাবে I তারপরে ও হেসে ফেললাম I বললাম
সারারাত কি ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন ?
না তুমি অনুমতি দিলে বসতে পারি
অনুমতি দিলাম
ও বিছানার এক কোনায় জড়সড় হয়ে বসে পরলো I তারপর বলল
মাছ নিয়ে একটা গান লিখেছিলাম I তুমি অনুমতি দিলে শোনাতে পারি I
মাছ নিয়ে কেন ?
মাছ আমার প্রিয় খাবার I তোমার ও নিশ্চয়ই ?
আমি মাছ খাই না
সর্বনাশ ! আমি দরিদ্র মাস্টার মানুষ I প্রতিদিন তোমাকে মাংস খাওয়াবো কেমন করে ?
ওর কথার ধরন শুনে আমি হেসে ফেললাম I কোনমতে হাসি চেপে বললাম
আচ্ছা I গানটা শুনান
রাশেদ শুরু করল
কই মাছের মাথায় কাটা
ইলিশ মাছের লেজে
চিংড়ি মাছের ভর্তা মজা
বানাও যদি ভেজে
চান্দা মাছের রূপ নাই তাও
রূপচাঁদা কয় তারে
সিং নাই তাও গুতা বল
কোন মাছেতে মারে ?
আমি এক হাতে মুখ চাপা দিয়ে কোনমতে হাসি আটকানোর চেষ্টা করছি I কিছুতেই পারছি না I হাসতে হাসতে আমার চোখে পানি এসে যাচ্ছে I আচ্ছা ,এই লোকটা কি আমাকে সারা জীবন এভাবেই হাসাবে ?
এক সপ্তাহ পর দুলাভাই এসে বাবু আর আপাকে নিয়ে গেল I তার যে খুব বেশি কোন পরিবর্তন হয়েছে তা না I বোঝা যাচ্ছে ভালো ডলা খেয়েছে I আমি ভেবেছিলাম আপা হয়তো যেতে চাইবে না I কিন্তু আপা বেশ আগ্রহ করেই গেল I হয়তো আশা নিয়ে গেছে I আমরা তো সবাই আশা নিয়েই বেঁচে থাকি I যাওয়ার সময় রিমি আপা বাবুকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলো I আমরা সবাই মনেপ্রাণে আশা করছি রিমি আপার যেন একটা ফুটফুটে বাবু হয় I এমন তো কত কিছুই আছে , যা আমরা জানি অসম্ভব I তবু আশা করি I আশা নিয়ে বাঁচি I আশায় আশায় আমাদের দিন কেটে যায় I
সমাপ্ত