সেলাই মেশিন
————-
(১১)
————-
ছোট ফুফুর বাসায় মৌরির সাথে যে ভদ্রমহিলার পরিচয় হয়েছিল, তার ছেলে আদনানের সাথে মৌরির বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। আদনান সুইডেনে মাস্টার্স করছে বছরখানেক হলো, আরও এক বছর পড়বে। এখন মায়ের পীড়াপীড়িতে দেশে আসছে বিয়ে করতে। ছেলের মায়ের মৌরিকে খুব পছন্দ হয়েছিল। কিন্তু এর মাঝে আদনানের বাবা মারা গেছেন। সংসারে আর্থিক অবস্থার কিছুটা অবনতি হয়েছে , সেটা ফুফু আগেই জানিয়ে দিলেন।
মৌরি বিয়ের প্রস্তাবে এক কথায় রাজি হয়ে গেলো। তার আসলে এই বাড়িতে থাকার কোনো ইচ্ছাই ছিল না। পরপর দুইটা ইন্টারভিউয়ের ডাক এলেও বাবা বললেন আপাতত চাকরির দরকার নেই, ইন্টারভিউ দিলেই কী আর চাকরি হয়? শুধু শুধু সময় নষ্ট। মৌরি বরং মাস্টার্সের চিন্তা করুক, একবার চাকরিতে ঢুকে গেলে নাকি আর পড়ার ইচ্ছা থাকবে না। এদিকে মাস্টার্সে ভর্তির তারিখ পার হয়ে গেছে, এখন পরের বছর ভর্তির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। বাবার সাথে এই নিয়ে কিছুটা বাক বিতন্ডা হলো। বাবা ভয়ানক রেগে সোজা বলে দিলেন মৌরি এখন কোথাও যেতে পারবে না। সেকারণেই ফুফুর আনা বিয়ের প্রস্তাবে মৌরি সম্মতি জানিয়ে দিলো। তবে হবু শাশুড়ির প্রতি ওর একটা অনুরোধ ছিল, ও সুইডেনে মাস্টার্স করতে চায়। শুনে ভদ্রমহিলা বললেন তাতে ওনার কোনো আপত্তি নেই তবে মৌরির লেখাপড়ার খরচ যোগান তার পক্ষে সম্ভব না। যদি ও নিজে কোনো স্কলারশিপ জোগাড় করতে পারে বা সুইডেনে গিয়ে কাজ করে নিজের পড়ার খরচ নিজেই জোগাতে পারে তবেই সম্ভব।
আদনান দেশে আসার পরে একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে মৌরির সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করা হলো। সেদিনের ঘটনার পরে শাহেদা , রুনু ঝুনু কেউ তার সাথে কথা বলে না। এমনকি বাবাও মৌরিকে কথা শুনিয়ে দিলেন, “এতদিন পরে বাড়িতে আইসাও একটু শান্তিতে থাকতে পারলি না? তোর মা সারাদিন তোর জন্য ভালো ভালো খাবার রান্না করে। তুই যাতে একটু আরামে থাকস সেই জন্য রুনু ঝুনু নিজের রুম ছাইড়া দিলো। এর পরেও বোন দুইটারে আপন করতে পারলি না ?”
অভিমানে মৌরি কোনো উত্তর দেয়নি। বাবা শুধু ওদের কথা ভাবলো, মৌরির কথা একবারও চিন্তা করলো না? এসব ভেবে বাসায় ওর খুব মন খারাপ থাকতো।
আদনানের সাথে দেখা করতে যাওয়া নিয়ে ওর মধ্যে কোনো উত্তেজনা কাজ করছিলো না , বরং মনে হচ্ছিলো ওর গায়ের রং দেখে যদি আদনান ওকে অপছন্দ করে তবে এই বিয়েটাও হবে না। বিয়ে হয়ে গেলে ও এই বাসা থেকে চলে যেতে পারবে, ওর একটা থাকার জায়গা হবে, তাছাড়া উচ্চশিক্ষার স্বপ্নও পূরণ হবে। মৌরি ঠিকই মাস্টার্স করার ব্যবস্থা করে নেবে।
আদনান খুবই লাজুক ছেলে, তেমন কিছুই জানতে চাইলো না। মৌরির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী, সেটা জানতে চাইলো। আর টুকটাক সাধারণ কথাবার্তা হলো ওদের। আদনান দারুন সুদর্শন না হলেও চোখে মুখে ভালো মানুষী ছাপ স্পষ্ট। বিনয়ী আর যথেষ্ট পরিণত মানসিকতা। স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিলো ও একজনকে ভালোবাসতো। আদনানাদের বাবা যখন মারা যায় ঠিক তখন মেয়েটির বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। আদনান তখন মেয়েটিকে বিয়ে করার মতো অবস্থায় ছিল না। শুনে মৌরির তেমন ভাবান্তর হলো না। এরকম সম্পর্ক তো হতেই পারে, বিয়ের পর সেই সম্পর্কের ছায়া ওদের যুগল জীবনে না পড়লেই হয়। মৌরি জানিয়ে দিলো, ওর কখনোই কোনো সম্পর্ক ছিল না। ও নিজের ক্যারিয়ারের দিকেই সবসময় মনোযোগ দিয়ে গেছে।
আদনান মৌরিকে ভীষণ পছন্দ করলো। এমন আত্মপ্রত্যয়ী সাহসী মেয়েকে জীবনসঙ্গী করে পাওয়া তার জন্য সৌভাগ্যের বিষয়। সে নিজেই এখন বিদেশে স্ট্রাগল করছে, এই সময় এমন একজন সঙ্গী তার পাশে থাকা দরকার।
মৌরির বাবা, চাচা ফুফুরা খুব খুশি, মৌরির এমন ভালো বিয়ে ঠিক হয়েছে। খুশি না শুধু দাদি। মৌরি দাদিকে বললো, “আমার বিয়েতে আপনে খুশি না ক্যান দাদি?”
“তুই না বলছিলি, ভালো চাকরি করবি, সুন্দর বাসা ভাড়া নিবি, আমারে ওই বাসায় নিয়া রাখবি। এখন দেখি বিয়া কইরা বিদেশ চইলা যাইতাসোস।”
দাদির এই কথার কী জবাব দেবে? মৌরি হাসতে হাসতে বললো, “আপনি না শহরে থাকবেন না বললেন?”
“সেই শহরেই তো আছি।” দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদি বললেন।
মৌরি দাদির হাত ধরে আদুরে গলায় বললো, “দাদি, আমি এইখান থেইকা গেলেই সবার জন্য ভালো। আপনি সব দেখতেছেন না? বিদেশে গেলে আমার পড়াও হইবো, ভালো চাকরিও হইবো। একটু গুছায় নিয়াই আমি ঠিক আপনারে আমার কাছে নিয়ে যামু।”
দাদি নিরাশ ভঙ্গিতে বললেন, “থাক, আর ভুজুং ভাজুং বুঝ দিস না। দেশেই রাখতে পারলি না, এখন আবার বিদেশ নিবি। এইসব আশা দিয়া পরে দেখা যাইবো সবই ভুল। আশা করতে করতে একদিন মইরাই যামু।”
“না না দাদি, এমন বইলেন না। আপনারে রাইখা যাইতে আমার অনেক কষ্ট লাগবো। কিন্তু এত অপমান তো সহ্য করা যায় না। বাবা চাকরির ইন্টারভিউতেও যাইতে দিলো না। যদি পারতাম নিজের চেষ্টায় অন্য কোথাও চইলা যাইতাম, পারতেছি না তো। ”
দাদি ঠিকই মৌরির অবস্থান বুঝতে পারলেন। আর কোনো অভিযোগ করলেন না।
মৌরির বাবা তার সামর্থ অনুযায়ী বিয়ের আয়োজন করলেন। মৌরির মায়ের পুরোনো একজোড়া সোনার চুড়ি ছাড়া কিছু দিতে পারবেন না, জানিয়ে দিলেন। বাসাতেই বিয়ের আয়োজন হবে। ছোট ফুফু স্বর্ণের একটা ছোট হার দিলেন, গয়না বলতে বাপের বাড়ি থেকে ওইটুকুই। দাদি তার সোনার বালা জোড়া মৌরিকে দিতে চাইলেন, কিন্তু ফুফুরা বাঁধ সাধলো। মায়ের গয়নায় তাদের হক আগে, নাতনির কোন হক নেই। চাইলেও দাদি ওই বালা জোড়া দিতে পারলেন না।
আদনাদের বাড়ি থেকে বিয়ের বাকি সামগ্রী গায়ে হলুদের দিন পাঠিয়ে দেয়া হলো। ঘরোয়া আয়োজনে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হলো। সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে গভীর রাতে মৌরি যখন ঘুমাতে যাবে তখন শাহেদা তাকে বারান্দায় ডেকে নিয়ে গেলো।
“তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই মৌরি। কালকে তোমার বিয়া হইতেছে, এরপর আবার কবে এইসব বলার সুযোগ পাই, জানি না।”
মৌরি হেসে বললো, “হ্যা, বলেন।”
“আমি জানি তুমি আমারে পছন্দ করো না। পছন্দ করার কথাও না। আমাদের দেশে সৎ মা একটা খারাপ জিনিস। কিন্তু তুমি কি জানো, আমার বিয়ার আগে জানানো হয় নাই যে আমার হবু স্বামীর একটা সন্তান আছে? আমি খালি জানতাম তোমার বাবার স্ত্রী অসুখে মারা গেছে। বিয়া হয়ে এসেই আমার কোলে পাঁচ ছয় বছরের একটা মেয়েকে উঠায় দিয়া বলা হইলো, এইটাকে নিজের বাচ্চা মনে করে পালতে হবে। কিন্তু কেন এমন হইলো বলো তো? আমার বয়স তখন কতই বা হইবো? বিয়া নিয়ে আমারও অনেক রকম স্বপ্ন ছিল। ধরো, তুমি তোমার স্বামীর বাড়ি গিয়া দেখলে তার আগের ঘরের একটা বাচ্চা ঘুইরা বেড়াইতেছে, তোমার ভালো লাগলো?”
মৌরি হতভম্ব হয়ে বললো, “আমি তো এসব জানতাম না।”
“তোমার মতো আমারও অবস্থা হইছিল।আমিও কিছু জানতাম না। তারপরেও মনরে বুঝ দিয়া তোমারে মাইনা নিতে চেষ্টা করছি। বিয়ার মাত্র দুই মাস পরে তোমার বাবার চাকরি চইলা গেলো। তুমি কি একদিনও খাওয়ার কষ্ট করছো? করো নাই। এমনও হইছে তোমারে ডিম্ ভাজি কইরা দিয়া আমি আলু সিদ্ধ করে ভাত খাইছি। মৌরি, আমি ফেরেশতা না, আমি খুব সাধারণ ঘরের সাধারণ মেয়ে। আমার মধ্যে ধীরে ধীরে রাগ তৈরী হইছে। তোমার বাবার চাকরি নাই অথচ তোমার জন্মদিনে দামি কেক নিয়ে আসছিলো, মনে আছে? আমার সহ্য হয় নাই। আমি কি খাইলাম, কি পড়লাম, সেইটার দিকে তার কোনো খেয়াল নাই, খেয়াল সব তোমার দিকে।”
মৌরি মাথা নিচু করে সব শুনছিলো। শাহেদা একটু থামলো।
তারপর আবার বলতে শুরু করলো , “আমার অবস্থা এমন হইলো যে, তোমারে আর ভালো লাগতেছিলো না। তোমার বাবা তোমারে গ্রামে পাঠায় দিলো।তারপরেও সারাদিন তোমার চিন্তা। আমি ভাবলাম আমার নিজের সন্তান আসলে তোমার বাবা তোমারে ভুইলা এই সংসারে মন দিবো , তা হইলো না। তুমি যখন মেট্রিকে ভালো করলা, তখন রুনুর গলায় টিউমার ধরা পড়লো। তোমার রেজাল্টের খবর শুইনাও তোমার বাবা যাইতে পারে নাই কারণ আমরা তখন রুনুরে নিয়া ডাক্তারের কাছে ছুটাছুটি করতেছি। খুব খারাপ জায়গায় টিউমার হইছিলো, অপারেশন করতে গিয়া গলার রগের কোনো ক্ষতি হইলে রুনু বোবা হইয়া যাইতে পারে। কানতে কানতে আমি মরার পথে আর তোমার বাবা তোমার রেজাল্টের মিষ্টি নিয়া আইসা বলে, খাও। কেমনে খাইতাম ওই মিষ্টি?”
“রুনুর অপারেশনের জন্য আমার বিয়ার সমস্ত গয়না বিক্রি কইরা দিছি, কিন্তু তাতে টাকা জোগাড় হয় নাই। হইবো ক্যামনে? তোমার বাবা কী এমন গয়না দিছিলো আমারে? তোমার মায়ের ওই চুড়ি দুইটা বিক্রি করার কথা বললাম, কিন্তু তোমার বাবা রাজি হইলো না, ওই চুড়ি নাকি তোমার বিয়েতে দিবো। দিছেও, এখন তোমার হাতে ওইটা। অথচ রুনুর অপারেশনের টাকা কিভাবে জোগাড় হইবো, তোমার বাবা জানে না। যাই হোক, তুমি এইখানে আসলা, কলেজে পড়বা বইলা। রুনুর অপারেশন হইছে তখন। আল্লাহর রহমতে ভালো অপারেশন হইছে। তোমার সামনেই গলায় ব্যান্ডেজ নিয়া রুনু ঘুরতেছে , অথচ তুমি একবারও জানতে চাও নাই, ওর কী হইছে। তুমি খেয়ালও করো নাই রুনুর ব্যান্ডেজ । আমারে তুমি আর কোনোদিন মা বলে ডাকো নাই। দেখলাম, আমাদের জন্য আসলে তোমার মনে কোনো জায়গা নাই, মায়া নাই।”
“আমারে তো আপনার কাছেই রাখেন নাই, কিভাবে মায়া হবে? আমারে সব সময় দূর দূর করেই রাখছেন।”
ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে শাহেদ বললো, “তা ঠিকই বলছো। আমিও তোমারে আপন করতে পারি নাই। কিন্তু এখন তোমার নিজের একটা পরিবার হইতেছে, নিজের স্বামী, নিজের শাশুড়ি। দোয়া করি, তুমি নতুন পরিবারে অনেক মায়া পাও, যাতে ছোটবেলার সব কষ্ট দূর হইয়া যায়।”
মৌরি শক্ত গলায় বললো, “আপনি খুশি তো? আমি চইলা যাচ্ছি পুরাপুরি।”
চাঁদের আলোর একফালি শাহেদার পোড় খাওয়া মুখের একপাসে অদ্ভুত ছায়া তৈরী করে। শাহেদা স্পষ্ট স্বরে বলে, “তুমি অনেক আগেই আমার জীবন থেইকা পুরাপুরি চইলা গেছো।”
(ক্রমশ)