📚গল্পটা আমাদের
আপনিতেই আমরা
পর্ব-১
# লেখনীতে- মারজানা দীনা
সে আমার জুনিয়র ছিলো।বেশি না এক বছরের জুনিয়র।ক্লাস সেভেনে থাকতেও সে আমাকে বড় আপু বলে জানতো আর আজ সেই আমিটাই তার স্ত্রী।
অদ্ভুত না!!একদম গল্পের মত হয়ে গেলো।যেদিন আমার সাথে তার বিয়ে হলো সেদিনই বুঝতে পেরেছিলাম জীবন টা গল্পের চেয়েও বেশি গল্পময়।
বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়েছে। আমি বরাবরই পরিবারের বাধ্যগত ছিলাম।তাই না টা আর করা হয়ে উঠে নাই।বিয়ের প্রথম রাতেই তাকে দেখেছিলাম।সে ও হয়ত তখনই আমাকে প্রথম দেখেছে অথবা বিদায় বেলায়। গত বছর অনার্স শেষ করেছি। মাস্টার্স করার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু পরিবার সেটা মানলো না।বয়স নাকি বেড়ে যাচ্ছে। আরো দেরি হলে নাকি ছেলে পাবে না।মেয়ে তো তাই কিছু বলতেও পারলাম না।ছেলে ভালো নম্র ভদ্র লেখাপড়ার পাশাপাশি নিজস্ব ব্যবসা আছে।আসলে ঠিক ব্যবসা না নিজস্ব ফার্ম। সে নাকি সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।
চাকুরী করা তার পছন্দ না। অন্যের অধীনে না অন্যকে নিজের অধীনে রাখতে পছন্দ করে।সে থেকেই নাকি তার পথ চলার শুরু।অল্প সময়েই বেশ সুনাম অর্জন করেছে।
বাবার সাথে তার কাকতালীয় ভাবেই দেখা হয় আমার বিয়ের মাসখানিক আগে।সে সূত্রেই চেনা পরিচিতি ভালো লাগা আর শেষে কন্যাদান।
আর আমি নিরব দর্শক।তার পরিবার বলতে তেমন কেউ নেই আবার সকলেই আছেন।মা মারা গিয়েছিলেন সে যখন ৬ষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র।পরে তার বাবা অন্য পরিবার গড়েন।আর সে নিজ দক্ষতা অর্জনের সাথে সাথে আলাদা হয়ে পড়েন।এমন না যে তার নতুন মা গল্প উপন্যাসের মত অত্যাচার করত বা তাকে সহ্য করত না।বরং তিনি ভীষণ অমায়িক একজন মহিলা। তার শুধু একটাই সন্তান হয়েছিলো। কন্যা সন্তান। মিয়ামি নাম।আমার একমাত্র ননদিনী। ভীষণ আদুরে। নতুন মাকে মানতে না পারলেও বোনের সাথে তার সম্পর্ক ভীষণ গভীর।বোন ছাড়া কিছু বোঝেন না।আমার সাথে তার বিয়ে হয়েছিলো কারণ মিয়ামি আমাকে চেয়েছে।
বিয়ের অর্ধ বছর গড়িয়ে গেছে।আমরা আলাদা থাকি।দুই রুমের ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটেই আমরা সংসার সাজিয়েছি। কিছুদিন পরে তার নিজস্ব ফ্ল্যাটে শিফট হব।কাজ এখনো শেষ হয় নি তাই আপাতত ভাড়া বাসাতেই আছি।আমার অবশ্য খারাপ লাগে না।মানুষ মোটে দুজন বড় ফ্ল্যাট নিলে নিজেরই ভালো লাগত না।
আপনার কি বেশি খারাপ লাগছে? জ্বর কি বেড়েছে?
আমার এতসব ভাবনার মাঝেই সে বলে উঠল কথাটা।আমার বর।তিনদিন ধরে জ্বর আমার। আজ কিছুটা কম। সব তার যত্নের কারণেই।শুয়ে ছিলাম তাই জ্বরের ঘোরে পুরনো কথা স্মৃতিমন্থর করছিলাম।
প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা না করেই আমার ললাটে হাত ছুঁয়ে দিলেন হয়ত জ্বর পরিমাপের জন্য।ঈষৎ কেঁপে উঠলাম।কেনো জানি না তার ছোট থেকে ছোট স্পর্শেও কেঁপে উঠি আমি।
আমি আজও বুঝতে পারি না আপনি কি আমার স্পর্শ গ্রহণ করতে পারেন না বলেই কেঁপে উঠে চোখ বুজেন না কি আবে…
থেমে গেলেন তিনি চোখ মেললাম আমি।কথাটা বলেই বেরিয়ে গেলেন।আর আমি বরাবরের মতই নিরুত্তর। হ্যাঁ আমরা আপনিতেই আছি।তাই বলে সম্পর্কটা এগোয় নি এমন না।অন্য আর স্বামী-স্ত্রী রা যেমন আমরাও তেমনই শুধু পার্থক্য এটাই আমরা নিরব।একসাথে সময় কাটানো বা গল্প করা ঘুরতে যাওয়া কিংবা রোমান্টিক কাপল বলে না তেমন কিছু আমাদের মাঝে পরিলক্ষিত হয় না। তবে মাঝে মাঝে আমার বাবা বাড়ি বা উনার বাবা বাড়ি গিয়ে কিছু সময় কাটানো হয়।আর মিয়ামির বায়না মিটানোর জন্য পার্কে ঘোরাফেরা খাওয়া দাওয়া। ব্যাস এভাবেই দিন পার হচ্ছে। আসলে কি বলে কোথা থেকে শুরু করব তা কেউই বুঝতে পারতাম না। তাই কথা বলে নিজেদের মধ্যে ফ্রি হয়ে উঠাটা আর হয়ে উঠেনি।তবে নিরবেই সে আর আমি গভীর হয়েছিলাম।সে আরেক ইতিহাস আসলে…
খাবার টা খেতে হবে দেখি উঠে বসুন।ঔষধও আছে।
আমার ভালো লাগে না খেতে। তিতা লাগে খাব না।রেখে দিন না।
হ্যাঁ তাই তো খেতে ভালো লাগবে কেনো এটা তো ভালো জিনিস না। পানিতে ভিজতে ভালো লাগবে আপনার।আবার বৃষ্টি নামিয়ে দেই ভিজবেন?
এভাবে বলছেন কেনো? আমি কি ইচ্ছে করে এমন করেছি বলেন।
এই এই একদম ঠোঁট ফুলাবেন না বাচ্চাদের মত।দুদিন পরে যার নিজেরই বাচ্চা হবে সে আবার ঠোঁট ফুলাই।একদম বেশি কথা বলবেন না।দেখি হা করুন..
আপনি ভীষণ বাজে আ আ.. কথা শেষ না করতেই মুখে খাবার পুরে দিলেন। একারণেই বলি তিনি ভীষণ বাজে।হুহ্…খাবার চিবুতে চিবুতেই তার দিকে দৃষ্টিপাত করলাম।মনে পরে গেলো বিয়ের প্রথম রাতের কথা_
সাদামাটা বিয়েই হয়েছিলো আমাদের।ঘরোয়া ভাবে শুধু পরিবারের মধ্যে।প্রথম রাতটা অবশ্য আমার শ্বশুর বাবার বাড়িতেই ছিলাম আমরা। তেমন কোনো সাজসজ্জা ছিলো না আমার।শুধু বিয়ে উপলক্ষে তার থেকে দেয়া সিঁদুরে লাল একটা শাড়ী পড়েছিলাম। সবসময়ের মতই চোখে কাজল।বড় করে ঘোমটা দিয়ে মাথা নুয়ানো ছিলো তাই তাকে নজর তুলে দেখাটা হয়ে উঠে নাই। মিয়ামি আমাকে একটা সাধারণ ঘরেই বসিয়ে রেখেছিলো।না ছিল গল্প উপন্যাসের মত ফুল দিয়ে সাজানো আর নাই বা ছিলো কোনো সোফা।আসবাব বলতে একটা বেড, ওয়াড্রব, ড্রেসিন টেবিল এই তিনটাই।বুঝতে পারলাম এ ঘরে তেমন কেউ থাকে না।পুরো ঘরটাই যখন নজর বুলাচ্ছিলাম ঠিক তখন ই দরজা খুলে কেউ প্রবেশ করলো বুঝতে পারলাম।
মায়ের শিখিয়ে দেওয়া অনুযায়ী সালাম দিলাম।সে ও জবাব দিল। তারপর আমার পাশে কিছুটা দূরত্ব রেখে বসল।
আসলে কি বলে শুরু করব বুঝতে পারছি না।আমার মনে হচ্ছে বিয়েটা একটু তাড়াতাড়িই হয়ে গেলো।আসলে মিয়ামির কোনো আবদার ফেলতে পারি না তো তাই আরকি।আপনার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?
মাথা দুলিয়েই না বুঝিয়েছিলাম।ঠিক তখনও কিন্তু তাকে আমি দেখিনি আর না সে আমাকে দেখেছিলো। বুঝতে পেরেছিলাম আমি যেমন ইন্ট্রোভার্ট সেও তেমন।তাই কি বলা উচিত কি বলবেন বুঝতে পারছেন না।আমিও চুপ ছিলাম।সে আবারো বললো_
এ রাতে নাকি বর বউকে কিছু দিতে হয়।আসলে আমার কাছে তেমন কিছু নেই আপনাকে দেওয়ার মত শুধু আমার আম্মুর শেষ স্মৃতিটুকু ছাড়া।যদি অনুমতি দিতেন তাহলে আরকি…
আবারও মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিয়েছিলাম।আর তিনি তার হাতে রাখা স্বর্ণের চেইনটা পড়িয়ে দেওয়ার জন্য অগ্রসর হয়ে ঘোমটা সরাতেই প্রথমবারের মত সরাসরি দেখা হলো।
থমকে গেলাম দুজনেই…
তিল আপনি!!!
মেহরাবব!!( এটা কিভাবে সম্ভব?? কিন্তু এই নামে তো একজনই ডাকতো আমায়।হায় আল্লাহ্)
অনুভব করতে পারলাম তার হাত কাঁপছে।অনেক কষ্টে চেইন টা পড়িয়ে দিয়েই মাথা নিচু করেছিলেন।বেশ বুঝতে পেরেছিলাম অস্বস্তি বোধ করছেন।আমিও স্তব্ধ হয়েছিলাম।তাই আর কথা না বাড়িয়ে বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার জন্য শুধু এতটুকু বলেছিলাম _
নামাজ টা পড়ে নিলে মন হয় ভালো হতো।আপনি যদি…
হু…হুম!!
এটুকুই ছিলো প্রথম রাতের গল্প।নামাজ পড়েই বিছানার দুপাশে চোখ বুজেছিলাম দুজনেই।অস্বস্তি থেকে বাঁচতে ঘুম না এলেও ঘুমের অভিনয় করেছিলাম।এরপর আর কি এভাবেই দিন যাচ্ছিলো। পুরোনো কথা তেমন বলতাম না।।নার্ভাস হয়ে পড়তাম দুজনেই।কারণ বিষয়টাই হতবাক হয়ে যাওয়ার মত।পরে ধীরে ধীরে জানতে পেরেছিলাম মায়ের হঠাৎ মৃত্যু মেনে নিতে না পারায় পড়ালেখায় পিছিয়ে গিয়েছিলেন।আমার থেকে বছর তিনেকের বড় হওয়ার পরেও এক বছরের জুনিয়র হয়েছেন।আর স্কুল জীবনে আমি সামনের সারির ছাত্রী ছিলাম তাই স্যারদের প্রিয় আর সে সূত্রেই পরিচয়। স্যারের মাধ্যমেই তার সাথে আলাপ হয়েছিলো। সে আমার কাছে স্কুল ছুটির পর বা টিফিন পিরিয়ডে পড়া বুঝত।তিল বলে ডাকতেন আমাকে।যদিও আমার নাম তিল না।তার মায়ের মতই নাকি আমারো বামগালের মাঝে তিল তাই সে ডাকতো।কখনো আপু বলত।একবছরের মত ছিলাম ঐ স্কুলে পরে স্কুল পরিবর্তন করার কারণে আর দেখা হয়ে উঠেনি।আর আজ এত বছর পর তার সাথে দেখা তাও ভিন্ন এক মোড়ে..
আমার এতসব কথার মাঝেই কলিংবেল বেজে উঠল।খেয়াল করলাম খাওয়াও শেষ হয়ে গিয়েছে।সযত্নে আমার মুখ মুছে দিয়ে উঠে গেলেন…
#চলবে
এটা ছোট্ট একটা গল্প হবে।কেমন হয়েছে জানাবেন।আর অবশ্যই ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইল।