পদ্মফুল #জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা |২১|

#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|২১|

“তোমার কাছে যতদিনে এই লেখা’টা পৌঁছাবে ততদিনে হয়তো আমি আর বেঁচে থাকবো না। জানতো, ওরা আমাকে খুব কষ্ট দিচ্ছে। আমি মরে যাচ্ছি, ডাক্তারবাবু। আমাকে বাঁচাও না প্লীজ। আমি তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসি ডাক্তারবাবু, প্রচন্ড। তবে সত্যি’টা বলার মতো সাহস আমার ছিল না। পারলে আমায় ক্ষমা করো তুমি…”

নিচে আরেকটু কিছু লেখা ছিল। কিন্তু সেটা অনেকটাই মুছে যাওয়ায় আদিদ কোনোভাবেই সেটা বুঝে উঠতে পারছে না। আদিদের শ্বাস প্রশ্বাস আটকে আসছে। সুজানা এই ছবির পেছনে কখন এসব লিখল? সে কীভাবে পেল এই ছবি? এই ছবির কথা তো আদিদ তাকে কখনো বলেনি, না কখনো তাকে ছবিটা দেখিয়েছে। তার মানে সুজানা নিশ্চয়ই তার খেলার রুমে গিয়েছিল, আর সেখানেই সে এই ছবিটা পেয়েছে। আর এসব লেখা? সুজানা-কে কারা এত কষ্ট দিচ্ছিল? আর কী এমন সত্যিই বা ছিল যেটা সুজানা তাকে বারবার বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। উফফ! আদিদের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। এই ছবিটা সে আগে কেন দেখল না। এখন তো ভয়ে তার গা শিউরে উঠছে। সুজানার সাথে নিশ্চয়ই খুব খারাপ কিছু হয়েছে। আদিদ আর থাকতে না পেরে সঙ্গে সঙ্গেই তার ডিটেক্টটিভ বন্ধু “অভি” কে কল দেয়। কল’টা রিসিভ করতেই আদিদ অস্থির হয়ে বলতে লাগে,

‘দোস্ত, আমার মনে হচ্ছে সুজানার সঙ্গে খারাপ কিছু হয়েছে। খুব খারাপ কিছু। মেয়েটা আমাকে কিছু বলতে চাইছিল। ওর সাথে কেউ বোধ হয় খুব অন্যায় করেছিল। হয়তো সেই লোকটার কথাই সে আমাকে বলতে চাইছিল কিন্তু বলতে পারেনি। শোন, আমি তোকে একটা ছবি পাঠাচ্ছি। তুই ছবিটা ভালো করে দেখ, তারপর বলিস, তুই কী বুঝেছিস। আমার মাথা কাজ করছে না দোস্ত। আমি আর এত টেনশন নিতে পারছি না।’

‘তুই এত হাইপার হোস না। কী ছবি পেয়েছিস তুই? ছবিগুলো আগে আমায় দে। আমি ভালো করে দেখি আগে। তুই একটু শান্ত হ। আমি তোকে আবার কল করছি।’

‘আ-আচ্ছা।’

অভির কাছে আদিদ ছবিটা পাঠায়। দুশ্চিন্তায় সে ভীষণ রকম কাতরাচ্ছে। এতদিন যা ভেবে এসেছে এখন তার সব কিছু উল্টো মনে হচ্ছে তার। সবকিছু ধোঁয়াটে মনে হচ্ছে। সুজানা এমনি এমনি উধাও হয়নি। ওর সাথে কেউ কিছু করেছে। কপালের ঘামগুলো মুছে আদিদ সুজানার ছবিগুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চোখের দৃষ্টি তখন ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে উঠল তাল। বুকের ভেতরের এই অসহ্য যন্ত্রণা সে আর সহ্য করতে পারছে না। ঝিম মেরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সে ধপ করে নিচে বসে পড়ে। হাতের ছবিটা বুকের মাঝে চেপে ধরে সে তখন কেবল ঘন ঘন নিশ্বাসই ফেলতে থাকে।
.

চারদিক নিস্তব্ধ। অনেক রাত হয়েছে। বাইরে সো সো করে বাতাস বইছে। রাস্তার ধারের নারকেল গাছগুলো “ঝপাৎ ঝপাৎ” করে আওয়াজ তুলে বাতাসের তালে নেচে চলছে। অনেক দূর থেকে শোনা যাচ্ছে কিছু কুকুরের আর্তনাদ। সেই আর্তনাদ শুনে আদিদের মনে হচ্ছে, কুকুরগুলোও হয়তো কাঁদছে। রাত হলে মানুষের মতো হয়তো কুকুরদেরও কষ্ট বাড়ে। তাই তারা গভীর রাত হলেই এমন আর্তনাদ শুরু করে। ঘেউ ঘেউ করে জানান দেয় তাদের কষ্টের কথা। যেমনটা দিচ্ছে আদিদ, তার নিরব চোখের জল ফেলে।

অভি তাকে তখন কল করে। আদিদ কল রিসিভ করে উত্তেজিত হয়ে পড়ে। অভি তাকে শান্ত হতে বলে। তারপর বলে,

‘দোস্ত, আমাকে আগে একটু বলতো তুই এই ছবিটা কোথায় পেয়েছিস?’

‘আমার খেলার রুমে। তোর মনে আছে, আমাদের ছাদে আমার একটা এক্সট্রা রুম ছিল। যেখানে আমি আবার সব খেলনা আর পুরোনো জিনিসপত্র গুছিয়ে রেখেছি। সেখানেই আমি এই ছবিটা রেখেছিলাম। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে কোনোদিন আর সেই রুমটাতে যাওয়া হয়ে উঠেনি। আজ হঠাৎ কী ভেবে মন চাইলো একটু যাওয়ার জন্য আর তখন এই রুমে গিয়েই আমি এই ছবিটা পাই। আর তার পেছনে এই লেখাগুলো। এই গুলো সুজানার হাতের লেখা। আর সবথেকে আশ্চর্যের কথা কি জানিস? এই ছবির কথা সুজানা জানতোই না। কিংবা সুজানা কোনোদিন আমার ঐ রুমেও যায়নি। তাহলে সে কীভাবে এই ছবি পেল, আর এই ছবিতে এসব কেন লিখল? ওর সাথে কী হয়েছে আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। ও এসব কেন লেখল দোস্ত? ও কি সত্যি সত্যিই আর বেঁচে নেই? কে মে*রে*ছে ওকে? কে?’

আদিদ কোনোভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। কথায় আছে, ডাক্তারদের কাঁদতে নেই। কিন্তু, সুজানার এই ডাক্তারবাবু অন্য সবার থেকে আলাদা। সে কাঁদে। সুজানা হারিয়ে যাওয়ার পর থেকেই হুট হাট করেই তার কথা ভেবে সে কেঁদে উঠে। সেই হয়তো একমাত্র ডক্টর যে কিনা এইভাবে বাচ্চাদের মতো করে কাঁদে।

অভি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে,

‘তুই শান্ত হ আদিদ। এইভাবে ভেঙ্গে পড়লে, আমরা আসল রহস্য ভেদ করবো কী করে? শোন, আমাকে একবার তোর বাড়িতে আসতে হবে। আর তোর সেই রুমটাও একবার ভালো করে চেক করতে হবে। আমার মন বলছে ঐ রুমের মধ্যেই এই রহস্যের সমাধান লুকিয়ে আছে। তুই কি কাল ফ্রি আছিস, তাহলে আমি কালই আসবো?’

আদিদ হ্যাঁ বলতে নিলেই তার মনে পড়ল, কাল তো আবার পদ্ম’র বিয়ে। বিয়ের দিন এসব করলে যদি উনার বিয়েতে কোনরূপ বিঘ্ন ঘটে, তখন আবার আরেক ঝামেলা হবে। ঐ মেয়েটাও খুব কষ্ট পাবে। আদিদ তাই ভেবে বললো,

‘এক কাজ করিস, তুই রাতে আসিস। কাল আমাদের বাড়িতে একটা প্রোগ্রাম আছে সেইজন্য চাইলেও তোকে সকালে আনতে পারবো না।’

‘কাল আবার তোদের বাড়িতে কীসের প্রোগ্রাম?’

‘আরে আর বলিস না, আমাদের বাড়িতে একটা মেয়ে থাকে। মা কাল আবার ঐ মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছে। আহামরি কিছু না হলেও, এই বাড়িতে যেহেতু বিয়েটা হচ্ছে সেহেতু কিছু মানুষ তো থাকবেই তাই আর কী এত মানুষের মাঝে আর এইসব ঝামেলা করতে চাইছি না। তাই এইসব বিয়ে টিয়ের ঝামেলা মিটলে রাতে তুই আসিস। তখন আর তোর কাজেও কোনো সমস্যা হবে না।’

‘তা তো বুঝলাম। কিন্তু, আমি এই বিয়েতেও থাকতে চাই। জাস্ট উপস্থিত থাকবো তেমন কিছুই করবো না। আমার কিছু ব্যাপার একটু দেখতে হবে। তাই এই প্রোগ্রামে থাকাটাও আমার খুব জুরুরি।’

আদিদ বললো,

‘ঠিক আছে তাহলে, তুই সকাল সকাল চলে আসিস। আমি তোর অপেক্ষা করবো। এখন রাখছি তাহলে।’

‘আচ্ছা। রেখে সুন্দর করে একটা ঘুম দে। আর এত হাইপার হোস না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

কল’টা কেটে দিয়ে আদিদ নিচেই চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। চোখ বুজে মনে মনে বললো,

“আর কিছু ঠিক হওয়ার নেই। যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে।”

_________________________

সকাল সকাল গোসল করে পদ্ম আস্তে আস্তে তৈরী হতে থাকল। বাইরে ঝকঝকে রোদ। কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলেই চোখ যেন ঝাপসা হয়ে উঠে। লাল বেনারসী আর হাত ভর্তি রেশমী চুরি পরে সে তার ভেজা চুল মুছে চলছে। বড়ো মা’র কাছে শুনেছে, আরাফাত’রা নাকি রওনা দিয়ে দিয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো চলে আসবেন। আর তারপরই তার সেই কাঙ্খিত সময়ও চলে আসবে। যে সময়ের অপেক্ষায় তাদের বুকের ভেতরটা এইভাবে ধরফর করছে।
.

বাইরে গাড়ির শব্দ শুনেই পদ্ম ছুটে বারান্দায় গেল। উনারা কি চলে এসেছেন? পদ্ম দেখল কালো রঙের একটা গাড়ি ঢুকেছে। গাড়িটা বাড়ির কাছে এসে থামল। সেখান থেকে বেশ বড়ো সড়ো দেহের একটা লোক নামল। গায়ে তার সুট কোট আঁটা। চোখের কালো চশমা’টা নামিয়ে লোকটা এদিক ওদিক তাকিয়ে কী যেন দেখছে। হঠাৎই সে উপরের দিকে তাকিয়ে পদ্ম-কে দেখে বিস্মিত হয়। লোকটার সাথে চোখে চোখ পড়তেই পদ্ম জলদি তার রুমে চলে আসে। এই লোকটা আবার কে? এইভাবে তাকায় কেন? পদ্ম ফোঁস করে নিশ্বাস ছেড়ে নিজের সাজগোজে আবার মনোযোগ দেয়।
.
.
অনেকদিন পর বন্ধুকে দেখে আদিদ প্রচন্ড খুশি হয়েছে। আর তার বিপরীতে তাকে দেখে প্রচন্ড ক্ষেপে গিয়েছেন আদিদের মা, বাবা। এই ছেলে এখানে কেন? পারছে না শুধু এক্ষুণি তাকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে। রুবি হোসেন আদিদ-কে আড়াল করে নিয়ে অভির এই বাড়িতে আসার উদ্দেশ্য জানতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আদিদ তাকে সত্য না বলে, কিছু একটা বলে বুঝিয়ে দেয়। আর উনাকেও তখন বাধ্য হয়ে তার ছেলের কথা মেনে নিতে হয়।

.

দুপুর তিন’টা বেজে চল্লিশ মিনিট। ছেলে পক্ষ চলে এসেছে। ছেলের নাকি মসজিদে কবুল বলাও হয়ে গিয়েছে, এবার মেয়ের পালা। কাজী সাহেব পদ্ম’র রুমে গেলেন। সঙ্গে রুবি হোসেন, আকবর সাহেব আর আরাফাতের চাচাও গেলেন। পদ্ম খুব ভয় পাচ্ছে। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করছে তার। এই তিন অক্ষরের ছোট্ট একটা শব্দ বললেই জীবন পাল্টে যাবে তার। সবকিছু তখন অন্যরকম হয়ে যাবে। তার শরীর যেন হালকা পাতলা কাঁপছে। রুবি হোসেন তাকে বুঝিয়ে চলছেন। এক পর্যায়ে নিজেকে শান্ত করে পদ্ম বলেই ফেলল, “আলহামদুলিল্লাহ, কবুল”। ব্যস, তার বিয়ে…

চলবে…

(আর বেশি অপেক্ষা করতে হবে না। পরের পর্বেই ধামাকা আসতে চলেছে। আর হ্যাঁ, নায়ক নিয়ে কনফিউজড হবেন না। আদিদ ই গল্পের নায়ক।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here