#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|২৪।
পদ্ম অনেকক্ষণ হলো রুমে একা বসে আছে। তার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। আরাফাত সেই কখন গিয়েছে এখনো তার আসার নাম নেই। এদিকে তার পরিবারের কেউও আসছে না। পদ্ম ভাবছে, একবার কি বাইরে গিয়ে দেখবে সে? এভাবে আর কতক্ষণ সে রুমে বসে থাকবে? খিদেও লেগেছে খুব।
পদ্ম ভাবনার মাঝেই হঠাৎ দরজায় কারো ঠকঠক আওয়াজ শুনতে পেল। সতর্ক গলায় বললো,
‘কে?’
‘পদ্ম, আমি। খুলো।’
আরাফাতের গলা চিনল সে। উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিল। আরাফাত তখন একটা খাবারের প্লেট নিয়ে ভেতরে ঢুকল। তারপর দরজা’টা আটকে দিয়ে পদ্ম-কে বললো,
‘তোমার নিশ্চয়ই খুব খিদে পেয়েছে। খাবার নিয়ে এসেছি, খেয়ে নাও।’
পদ্ম একবার খাবারের দিকে তাকিয়ে আবার আরাফাতের দিকে তাকায়। নিচু সুরে বলে,
‘সবাই কি খেয়ে ফেলেছে?’
আরাফাত বললো,
‘সবার কথা আমি জানি না। মা তোমার জন্য খাবার পাঠিয়েছেন। বলেছেন খেয়ে দেয়ে রেস্ট নিতে।’
এখানের সবকিছুই কেমন যেন অদ্ভুত। পদ্ম’র মনটা খচখচ করছে। তাও সে নিজেকে এটা বলে বোঝ দেয় যে, “নতুন পরিবেশ তাই হয়তো তার এমন মনে হচ্ছে, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আরাফাত খাবারের প্লেট’টা পদ্ম’র হাতে দিয়ে বললো,
‘তুমি খাও, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।’
‘আচ্ছা।’
.
.
‘অফিসার, আপনার সমস্ত জিজ্ঞসাবাদ শেষ হয়ে থাকলে আমরা কি এখন বাড়ি যেতে পারি?’
অফিসার আড় চোখে আকবর সাহেবের দিকে তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
‘এত কিসের তাড়া আপনার?’
‘আরে আজব তো, কয়টা বাজে দেখেছেন? রাতে কি আমরা এখানেই বসে থাকবো? বাসায় যেতে হবে না আমাদের?’
অফিসারের মোটা ব্রু গুলো কুঁচকে এলো। বিরস মুখে বললো,
‘আজকে রাত’টা বরং এখানেই কাটান। একটু অভ্যাস করুন। এমনও হতে পারে, হয়তো বাকি রাতগুলো আপনার এখানেই কাটাতে হলো।’
আকবর সাহেব চটে গেলেন যেন। রাগি গলায় বললেন,
‘কী বলতে চান আপনি?’
‘কিছু না। আপাতত চুপচাপ এখানে বসে থাকুন। কাজ শেষ হলে আমরাই আপনাদের বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করবো।’
‘কিন্তু আপ…’
‘বাবা থাক না। উনারা যখন বলছেন, আমরা আরো কিছুক্ষণ থাকি না এখানে। এমনিতেও বাসায় গিয়ে টেনশনে আমি থাকতে পারবো না। তার চেয়ে বরং এখানেই থাকি। এই সবকিছুর একটা সমাধান হোক। আমি আর নিতে পারছি না। আমাদের বাড়ি থেকে ক*ঙ্কা*ল, মোবাইল ফোন, ছবি…কী করে সম্ভব? আমার মাথায় কিছু ঢুকছে না। প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে।’
অভি আদিদের কাঁধে হাত রেখে বলে,
‘শান্ত হ। এত হাইপার হলে তো মাথা ব্যথা করবেই। একটু শান্ত হয়ে বস, আমরা দেখছি ব্যাপার’টা।’
‘আমার কী মনে হয় বলতো, কেউ হয়তো আমাদের ফাঁসানোর জন্য এসব করেছে। আমার তো আবার শত্রুর অভাব নেই। আরে ঐ আই.বি.এস কম্পানি আছে না, ওরা তো আরো আগে থেকেই আমার পেছনে পড়ে আছে। আমার তো মনে হচ্ছে ওরাই এসব করেছে।’
‘তার মানে আপনি কী বলতে চান আংকেল, ঐ কম্পানির লোকেরা আপনার বাড়িতে ক*ঙ্কা*ল রেখে গিয়েছে আবার এই মোবাইল ফোন আর ছবিগুলোও ওরা’ই রেখেছে, তাই তো?’
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, একদম তাই।’
অভি তপ্ত শ্বাস ফেলল। বললো,
‘এটা কি কোনো ভাবে সম্ভব আংকেল? কেউ আপনার বাসায় ঢুকে এত কিছু করে ফেলবে আর আপনি জানবেন’ই না? আমার তো মনে হয় না এমন কিছু হয়েছে। আমার তো মনে হচ্ছে, আপনাদের মধ্যেই কেউ এসব করেছে? আন্টি, আপনার কী মনে হয়?’
রুবি হোসেন আর আকবর সাহেব একজন অন্যজনের মুখের দিকে তাকালেন। রুবি হোসেন নাকের পাল্লা ফুলিয়ে ফোস ফোস করতে করতে বললেন,
‘তুমি আমাদের সন্দেহ করছো? আদিদ, শুনেছো তোমার বন্ধু কী বলছে?’
আদিদ চুপ থাকে। অভি বলে,
‘সন্দেহ তালিকায় আপনারা সবাই’ই আছেন। ইনফেক্ট আদিদ ও। যেহেতু এসব কিছু আপনাদের বাড়ি থেকে পাওয়া গিয়েছে তাই আপনাদের সন্দেহের তালিকায় রাখতেই হবে। কিছু করার নেই।’
আকবর সাহেব তখন তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন,
‘এসব দু টাকার গোয়েন্দার সন্দেহ তে আমাদের কিচ্ছু যাই আসে না। যত্তসব।’
আদিদ ব্রু কুঁচকে বললো,
‘বাবা, কী বলছো এসব?’
অভি কিঞ্চিত হাসল। বললো,
‘থাক আদিদ, বলতে দে। যে যাই বলুক, সত্য তো আমি ঠিকই খুঁজে বের করবো। ওহ, বাই দ্যা ওয়ে, তোদের বাড়িতে আজকে একটা বিয়ে গেল না? ঐ মেয়েটা এখন কোথায় আছে?’
রুবি হোসেন তখন ভড়কে গেলেন। উচ্চ স্বরে বললেন,
‘ওর খবর জেনে তুমি কী করবে? ও এখন ওর শ্বশুর বাড়িতে আছে।’
‘শ্বশুর বাড়ি কোথায়?’
‘তুমি এত কিছু জেনে কী করবে বলতো?’
পুলিশ অফিসার উনাদের কথা শুনে বলে উঠল,
‘আজ উনাদের বাড়িতে বিয়ে ছিল? কার বিয়ে?’
আদিদ বললো,
‘আসলে আমাদের বাড়িতে কিছুদিন যাবত একটা মেয়ে ছিল, উনার’ই আজ বিয়ে হয়েছে।’
অফিসার চোখ ছোট করে সন্দিহান গলায় বললো,
‘মেয়েটা আপনাদের কী হয়?’
‘উনি আমার পেশেন্ট ছিলেন। উনার একটা এক্সিডেন্টের পর উনি আমাদের হসপিটালে এসে ভর্তি হোন। উনি উনার মামা মামীর কাছে থাকেন। কিন্তু, সেই এক্সিডেন্টের পর উনি আর উনার মামা মামীর কাছে ফিরে যেতে চান না। কারণ, উনারা নাকি পদ্ম’র উপর খুব অত্যাচার করতো। তখন মা উনাকে দেখে, আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসে। তবে এতে উনার সম্পূর্ণ মত ছিল। আমাদের পক্ষ থেকে কোনপ্রকার জোর করা হয়নি।’
‘উনি যদি অত্যাচারের স্বীকার হয়ে থাকেন তবে আমাদের সাথে কেন যোগাযোগ করেননি? আপনারাই বা এভাবে অচেনা অজানা একটা মেয়েকে আপনাদের বাড়িতে নিয়ে গেলেন কী করে? আর উনাকে বিয়েও দিয়ে দিলেন? মানে সবকিছু তো কেমন অদ্ভুত লাগছে। আজকাল পৃথিবীতে নিজের কাছের মানুষের জন্যই কেউ কিছু করতে চায় না আর আপনারা অপরিচিত একটা মেয়ের জন্য এত কিছু করলেন? ব্যাপার’টা বেশ ইন্টারেস্টিং! তা, মেয়েটা আছে কোথায় এখন? উনাকে ডাকতে হবে। যেহেতু উনি এতদিন আপনাদের বাড়িতে ছিলেন সেহেতু উনিও এই কেইসের সঙ্গে সম্পূর্ণ জড়িয়ে আছেন। উনার নাম্বার দিন, আমরা যোগাযোগ করবো।’
অস্থির হয়ে উঠলেন রুবি হোসেন। শেষ সময়ে এসে তারা নৌকা বুঝি এবার ডুবল। তিনি উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,
‘আরে, ওর আজকে মাত্র বিয়ে হয়েছে। সবে মাত্র মেয়েটা নতুন একটা জীবন শুরু করেছে, দরকার আছে ওকে এত ঝামেলার মধ্যে টানার?’
অফিসার হাসল। বললো,
‘বাহ, আপনার তো দেখছি ঐ মেয়েকে নিয়ে খুব চিন্তা। ভালো, চিন্তা থাকা ভালো। কিন্তু, আমাদের তো কিছু করার নেই, ডিউটির খাতিরে এখন আমাদের এসব করতেই হবে। উনাকে এখন এখানে আসতে হবে, আমাদের সাথে কথা বলতে হবে।’
‘কাল সকালে আসলে হয় না? এখন তো অনেক রাত হয়ে গিয়েছে।’
‘কে বলতে পারে, দেখা যাবে কাল সকালে আবার হয়তো এই মেয়েটাও উধাও হয়ে গেল…সুজানার মতো। কি, হতে পারে না?’
অফিসারের কথা শুনে ভয়ে আকবর সাহেব আর রুবি হোসেনের মুখ চুপসে গেল।
আদিদের কাছ থেকে অফিসার পদ্ম’র ফোন নাম্বার নিল। ফোন দিয়ে দেখল, নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছে। অফিসার আদিদ-কে বললো,
‘নাম্বার তো বন্ধ দেখাচ্ছে।’
‘এক কাজ করুন, আমার কাছে উনার হাসবেন্ডের নাম্বার আছে, আপনি বরং উনার নাম্বারে কল দিন।’
আদিদ নাম্বার দিতেই অফিসার সেই নাম্বারে কল করলো। কিছুক্ষণ পর কল’টা রিসিভ ও হলো।
‘হ্যালো, কে বলছেন?’
‘আমি ইন্সপেক্টর রকিব বলছি, থানা থেকে। আপনি কি পদ্ম’র হাসবেন্ড বলছেন?’
ইন্সপেক্টরের কথা শুনেই আরাফাত ফট করে কল’টা কেটে দিল। অফিসার ফোন’টা হাতে নিয়ে কপাল কুঁচকে বললো,
‘কল’টা কেটে দিল কেন?’
অভি বললো,
‘আরেক বার কল করুন।’
অফিসার আরেকবার কল করলো। এবার ফোন নাম্বার বন্ধ দেখাচ্ছে। অফিসার অভিকে বললো,
‘নাম্বার বন্ধ।’
অভি বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তাড়া দিয়ে বললো,
‘নাম্বার’টা দিন। এক্ষুণি লোকেশন ট্র্যাক করতে হবে। নিশ্চয়ই কোনো ঘাপলা আছে, এমনি এমনি ও ফোন কাটেনি। এই আদিদ, পদ্ম-কে কোথায় বিয়ে দেওয়া হয়েছে? লোকেশন’টা বল আমায়।’
‘আমি তো জানি না। মা, তুমি কিছু বলছো না কেন? বিয়ে তো তোমরা দিয়েছো। আরাফাতদের বাড়ি কোথায়, কোথায় থাকে ওরা?’
রুবি হোসেন চোখ মুখ কুঁচকে বললেন,
‘আমি কী করে জানবো। আমাকে তো শুধু বলেছে, ওরা নাকি খিলক্ষেত থাকে। আর কিছু জানি না আমি।’
অভি তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,
‘না জানলেও সমস্যা নেই। লোকেশন ট্র্যাক করতে দু মিনিট লাগবে আমাদের।’
‘তো যাও না, করো গিয়ে লোকেশন ট্র্যাক। এখানে বসে থাকতে কে বলেছে।’
‘করবো তো অবশ্যই। খালি একটা ভয় হচ্ছে আরকি এটা ভেবে যে, কান টানলে তো আবার মাথাও আসে।’
রুবি হোসেন আর আকবর সাহেব রাগে দাঁতে দাঁত পিষছেন। এই অভি যে তাদেরকেই সন্দেহ করছে সেটা আর উনাদের বুঝতে বাকি রইল না। এইদিকে উনারা বসে থেকে কিছু করতেও পারছে না। আরাফাতকে যে একটা ম্যাসেজ দিয়ে সতর্ক করবে সেই উপায়ও নেই। মোবাইল এখন সব পুলিশের কাছে। কিন্তু, এইভাবে হাত গুটিয়েও তো বসে থাকাও তো যায় না। এইভাবে বসে থাকলে তো তাদের এতদিনের ব্যবসা সব লাটে উঠবে…
রুবি হোসেন হঠাৎ কেমন যেন করতে লাগলেন। দু হাত নাড়িয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে লাগলেন। আকবর সাহেবকে ইশারা দিতে তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন,
‘এই আদিদ, দেখো না তোমার মা কেমন করছে।’
আদিদ মায়ের দিকে তাকিয়ে দ্রুত উনার কাছে গেল। উত্তেজিত কন্ঠে বললো,
‘কী হয়েছে মা, এমন করছো কেন?’
‘আমার প্রেশার’টা মনে হয় বেড়েছে, আদিদ। এখনও ঔষধ খাইনি। তাই শরীর’টা খুব খারাপ লাগছে বাবা। মাথা’টা খুব ঘুরাচ্ছে। শ্বাস ফেলতেও কষ্ট হচ্ছে। বুকে চাপ লাগছে খুব।’
আদিদ তার মায়ের পালস্ চেক করে। অফিসার-কে ডেকে বলে,
‘আমার মায়ের বিশ্রাম প্রয়োজন। উনার হঠাৎ খুব শরীর খারাপ লাগছে। একটা রুমের ব্যবস্থা করা যাবে?’
রুবি হোসেন তখন অস্থির কন্ঠে বললেন,
‘আমাকে বাসায় নিয়ে চল না, বাবা। এখানে থেকে আমার আরো বেশি কষ্ট হচ্ছে।’
‘সরি ম্যাডাম, আপনি এখন বাসায় যেতে পারবেন না। আমাদের রেস্ট রুমে আপনার বিশ্রামের ব্যবস্থা করছি। আর যদি প্রয়োজন পড়ে তবে আমরা আপনার চিকিৎসার ব্যবস্থাও করবো, চিন্তা করবেন না। চলুন।’
রুবি হোসেনের শরীর রাগে রি রি করছে। কী ভেবেছিল আর কী হলো। বাধ্য হয়ে উনাকে রেস্ট রুমে পরে থাকতে হলো। এত অভিনয় করেও লাভের লাভ কিছুই হলো না, উল্টো এখন তাকে রুমে বন্ধী হয়ে পরে থাকতে হবে।
.
.
আরাফাতের লোকেশন ট্র্যাক করা হয়ে গিয়েছে। অফিসার তার কিছু সদস্য নিয়ে অলরেডি সেই জায়গার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়েছে। অন্যদিকে থানায় আকবর সাহেব আর রুবি হোসেন দুজনই চিন্তায় অস্থির হয়ে উঠলেন। এবার বুঝি সত্যি সত্যিই তাদের পতন ঘটল বলে…
চলবে…