#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|২৮|
‘মা, এসব কি সত্যি?’
রুবি হোসেন অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন,
‘না।’
‘তাহলে সত্যি’টা কী আপনিই বলুন মিসেস রুবি হোসেন।’
অফিসারের দিকে তাকিয়ে রুবি হোসেন জবাব দিলেন,
‘আমি কী বলবো? বলেছি তো, ঐ মেয়েটা মিথ্যে বলছে। আমি বা আমার স্বামী এসব ব্যাপারে কিচ্ছু জানি না।’
আদিদ শক্ত গলায় বললো,
‘পদ্ম’র মিথ্যে বলে কী লাভ মা?’
রুবি হোসেন বললেন,
‘লাভ’ই তো। ও মিথ্যে বললে আমরা ফেঁ*সে যাবো। তখন পুলিশ আমাদের ধরে নিয়ে যাবে। আর ও তখন আবার আমাদের বাসায় গিয়ে রাণীর মতো থাকতে পারবে। এসবই তো চায় ও। লোভী মেয়ে একটা!’
রুবি হোসেনের কথা শুনে অফিসার তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললেন,
‘মেয়েটার সাথে এত কিছু হয়ে গিয়েছে। আর একটু হলে হয়তো, মেয়েটাকে আমরা আর কোনো ভাবেই উদ্ধার করতে পারতাম না। আর ওকে একবার নিয়ে গেলে ওর সাথে কী হতো নিশ্চয়ই সেই ব্যাপারে আপনার ধারণা আছে? ওকে বিক্রি করে দেওয়া হতো। আর এই সবকিছু মেয়েটা এখন বুঝতে পারছে। আর তাই সে এখনও সেই ট্রমা থেকে বেরুতে পারছে না। আর এত কিছুর মাঝেও আপনার মনে হচ্ছে মেয়েটা তার লোভে বশীভূত হয়ে আপনাদের নামে মিথ্যে বলছে? আমার তো তা মনে হয় না। দেখুন, প্রথম থেকে একের পর এক যা ঘটনা ঘটে যাচ্ছে তা কিন্তু বারবরই আপনাদের প্রতিই সন্দেহের সৃষ্টি করছে। আচ্ছা, একবার ভেবে দেখুন তো, ঐ ক*ঙ্কা*ল টা যদি সত্যি সত্যিই সুজানার হয়, তখন কী হবে? তখন কি ধরে নিব, আপনারাই সুজানাকে মে*রেছেন? আর মা*রার পর এখানে লুকিয়ে রেখেছেন। কী, এই সন্দেহটা তো তখন হবেই, তাই না? সুজানা, আপনাদের বাড়িতেই মা*রা গিয়েছে। ও লাস্ট আপনাদের বাড়িতেই গিয়েছিল। তারপর আর সেখান থেকে বের হয়নি। আমরা কিন্তু আপনাদের বাড়ির সি সি ক্যামেরা চেক করেছিলাম। কাউকে আমরা বেরুতে দেখেনি। তারমানে ও ঐ বাড়িতেই ছিল। আর আজ ঐ বাড়ি থেকেই এই ক*ঙ্কা*ল টা পাওয়া গিয়েছে। আর আমরা ডেফিনেটলি সিউর যে ঐ টা সুজানারই ক*ঙ্কা*ল। কারণ এছাড়াও সেখান থেকে সুজানার জামা, আর তার লেখা একটা ছবিও পাওয়া গিয়েছে। যেটাতে লেখা ছিল, ওকে কেউ খুব কষ্ট দিচ্ছে। আর ও হয়তো তার কথা আদিদ-কে বলতেও চাইছিল কিন্তু পারেনি। পারেনি এই জন্য যে ঐ মানুষটা হয়তো আদিদের খুব কাছের কেউ। আদিদ শুনলে খুব কষ্ট পাবে তাই সুজানা ওকে কিছু বলেনি বা বলতে চেয়েও বলতে পারেনি। এই এত সবকিছু ঘটনা কী ইঙ্গিত করছে মিসেস এবং মিস্টার হোসেন? আপনারাই বলুন, কী মনে হচ্ছে কে সেই মানুষ যার কথা সুজানা আদিদ-কে বলতে চাইছিল? কে সে…আচ্ছা আকবর সাহেব, আপনি নন তো?’
‘কী যা তা বলছেন? আমি কেন হতে যাবো? আমি সুজানাকে আমার নিজের মেয়ের মতো ভালোবাসতাম। আমি কেন সুজানাকে মা*রতে যাবো?’
অফিসার বাঁকা হেসে বললেন,
‘মেয়ের মতো ভালো তো আপনি পদ্ম-কেও বাসতেন, তাই না আকবর সাহেব। এত ভালোবাসতেন যে সময় পেলেই ওকে ছোঁয়ার চেষ্টা করতেন, ওর কাছে যেতে চাইতেন, তাছাড়া ইশারা ইঙ্গিতে অনেক কিছু বোঝাতেও চাইতেন, তাই না?’
আকবর সাহেব চুপ হয়ে গেলেন। কপালের ঘাম মুছে বললেন,
‘এসব কী বলছেন, অফিসার? আমি এসব কিছুই করিনি।’
অফিসার দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
‘পদ্ম আমাকে সব বলেছে মি. , তাই এসব নাটক এখন বন্ধ করুন। আর ভালো ভালোই সবকিছু স্বীকার করুন। নয়তো, অন্য ব্যবস্থা করতে আমি বাধ্য হবো।’
আদিদ ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল। মাথার ভেতরটা ভো ভো করছে তার। আর কিছু শুনতে পারছে না। শুনতে শুনতে মস্তিষ্কের নিউরনগুলো এবার কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। মেনে নিতে পারছে না। মেনে নিবেই বা কীভাবে? মা বাবাকে কখনো অবিশ্বাস করা যায়? যাদেরকে সে এতদিন ফেরেশতা ভেবে এসেছে তারা তার সাথে এত বড়ো অন্যায় কীভাবে করতে পারলো? কীভাবে? আদিদ ছটফট করতে থাকে। সে বুঝতে পারছে তার প্রেশার কমে যাচ্ছে। মাথা ঘুরাচ্ছে খুব। চোখে ঝাপসা দেখছে। অভিকে ডেকে হাঁপাতে হাঁপাতে সে বললো,
‘অ-অভি, আমাক-কে একটু বেডে নিয়ে যা না। আমার শ্বাস ফেলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি আর এসব নিতে পারছি না। আমাকে এখান থেকে নিয়ে চল।’
ছেলের এই অবস্থা দেখে রুবি হোসেন তার কাছে যেতে চাইলে আদিদ চেঁচিয়ে উঠে,
‘খবরদার…খবরদার আমার কাছে আসবে না। ত-তোমাকে আমার ঘৃণা হচ্ছে। তোমরা কেউ আমার কাছে আসবে না। অভি আমাকে নিয়ে চল। আমার বুকে খুব ব্যথা করছে। আমি আর সহ্য করতে পারছি না।’
অভি আদিদ-কে তার কেবিনে নিয়ে গিয়ে বেডে শুইয়ে দিল। আদিদ ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলছে। অভি বিচলিত কন্ঠে বললো,
‘তুই এত দুর্বল কেন বলতো? আমি তো জানতাম, ডক্টর’রা খুব স্ট্রং হয়। তারা যেকোনো পরিস্থিতিতে নিজেদের সামলে নিতে পারে। কিন্তু তুই হয়েছিস পুরো উল্টো। একটু কিছু হলেই ভেঙ্গে পড়িস। এমন হলে কী করে হবে বলতো? মেনে নিতে হবে তো সবকিছু। যত ভেঙ্গে পড়বি ততই তোর কষ্ট পারবে। নিজেকে শক্ত কর, ভেবে নে এটাই ভাগ্য।’
আদিদ অভির দিকে তাকাল। চোখগুলো লাল হয়ে আছে তার। হয়তো সে এক্ষুণি কেঁদে ফেলবে। জড়ানো গলায় আদিদ বললো,
‘উনারা আমার মা বাবা, আমি কীভাবে মেনে নিব অভি? পারছি না তো। আমি নিজের চেয়ে বেশি উনাদের বিশ্বাস করি। আর তুই বলছিস আমি সবকিছু সহজ ভাবে মেনে নিব? এটা কি সম্ভব? আমি তো পারছি না। যতবারই ভাবছি আমার নিজের মা বাবা এই জঘন্য কাজগুলো করেছে ততবারই আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা অভি, এসব কিছু মিথ্যে হতে পারে না? আমার মা বাবা নির্দোষ হতে পারে না? আমার যে উনাদের অপ*রাধী ভাবতে ইচ্ছে করছে না। উনারা যে আমার মা বাবা। আমি পারছি না অভি, সত্যিই পারছি না। কষ্ট হচ্ছে খুব। সুজানাকে হারিয়ে যতটা না কষ্ট হয়েছে আজকে তার থেকে অনেক বেশি কষ্ট হচ্ছে। আহ, এখানটাই কষ্ট হচ্ছে। ডাক্তারদের কেন কষ্ট হয় বলতো? ওরা তো মানুষ না, ওরা তো রোবট। তাহলে ওদের কেন এত কষ্ট হয়?’
আদিদ চোখ বুজে বলেই যাচ্ছে। কী বলছে নিজেও হয়তো বুঝতে পারছে না। অভি জানতো সত্যটা আদিদ সহজ ভাবে নিতে পারবে না। যতই হোক মা বাবা তো মা বাবাই হয়…
.
.
‘আপনাদের এখন আমার সাথে থানায় যেতে হবে। সেখানে গিয়ে সুন্দর ভাবে সব সত্যি কথা আমাদের বলে দিবেন। কোথায় কোথায় আপনার এই ব্যবসার ঘাঁটি গেরেছেন, কে কে আপনাদের সাহায্য করেছে, এভ্রিথিং। যত বেশি কথা লুকাবেন, তত বেশিই আপনাদের বিপদ বাড়বে। তাই সহজ ভাবে সবকিছু বলে দিবেন তাহলে আপনাদের শাস্তিটাও সহজ হয়ে যাবে।’
‘শুধুমাত্র একটা মেয়ের কথার ভিত্তিতে আপনারা আমাদের জেলে নিতে পারেন না। আপনাদের কাছে উপযুক্ত কোনো প্রমাণ আছে? নেই। আগে উপযুক্ত প্রমাণ যোগার করুন, তারপর আমাদের জেলে নেওয়ার কথা ভাববেন।’
অফিসার হাসলেন। তারপর তিনি তার পকেট থেকে ফোন বের করে উনাদের একটা ভিডিও দেখালেন। ভিডিও দেখে দুজনেরই গলা শুকিয়ে উঠল। এগুলো কখন হলো?
‘আপনারা এত বোকা! থানায় বসে কেউ এসব আলোচনা করে? রুবি হোসেন যেই রেস্ট রুমে ছিলেন সেটাতে একটা হিডেন ক্যামেরাও ছিল। আর সেই ক্যামেরাতে আপনাদের সমস্ত কথোপকথন ধরা পড়েছে। এখন বলুন, আরো কি প্রমাণ লাগবে আপনাদের?’
রুবি হোসেন দাঁতে দাঁত পিষছেন। শেষ পর্যন্ত এভাবে তাকে হারতে হলো। না, এত সহজে সে হার মানবে না। প্রথমে সুজানা তার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল বলে তিনি তাকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। এখন আবার এই পদ্ম। এই মেয়ের জন্য আজ তাকে জেলে যেতে হচ্ছে। এই মেয়েকে তো তিনি এত সহজে ছেড়ে দিবেন না।
‘ঠিক আছে, সবকিছু মেনে নিলাম। কিন্তু, আমাকে একবার শেষ বারের মতো পদ্ম’র সাথে কথা বলতে দিন। আমি ওর কাছে ক্ষমা চাইবো। ওর সাথে আমি অনেক অন্যায় করেছি। তাই জেলে যাওয়ার আগে আমি ওর কাছে একবার ক্ষমা চেয়ে যেতে চাই। নয়তো আমি শান্তিতে থাকতে পারবো। প্লীজ অফিসার, আমাকে পদ্ম’র কাছে নিয়ে চলুন।’
রুবি হোসেনের জোরাজুরিতে অফিসার শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন। তিনি আকবর সাহেব আর রুবি হোসেনকে নিয়ে পদ্ম’র কেবিনে দিকে গেলেন। তবে কেবিনে যাওয়ার আগে রুবি হোসেন অফিসারের চোখের আড়ালে স্ট্রে থেকে একটা ছু*রি নিজের কোমরে গুঁজে নিলেন। মনে মনে বললেন,
“আমি ভালো না থাকতে পারলে অন্য কাউকেও ভালো থাকতে দিবো না।”
চলবে…