#প্রেমমানিশা(১৮)
সানাহ্ তখন রেডি হচ্ছিল আর ফারহান ঘরের যেসব জিনিস ঢাকায় নিবে সেগুলো আরেকবার চেক করছিল । হঠাৎ ঘরের দরজায় মৃদু টোকা পড়তেই সানাহ্ গায়ে ওড়না জড়িয়ে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে দরজা খুলতে গেলো। দরজা খুলেই বাইরে হাসি মুখে দাড়িয়ে থাকা মিসেস জয়িতাকে চোখে পড়লো। ঘরের দরজায় নক করার শব্দ ফারহানও পেয়েছিল তাই কে এসেছে দেখতে সে ছুটে এলো। ঘরের দরজার কাছে আসতেই ফারহানের নজরে মিসেস জয়িতা পড়লেন।
হুট করে সকাল সকাল সানার বাড়িতে কোনো তাগড়া যুবককে দেখবেন সেটা মোটেও আশা করেননি মিসেস জয়িতা। ফারহানকে দেখে তার চোখ যেন বিস্ময়ে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। উনি নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না যে এটা উনি কি দেখলেন। চোখ বড় বড় করে অবাক হয়ে বললেন ‘ এই ছেলে তুমি কে ? ‘
মিসেস জয়িতাকে যদিও ফারহান আশা করেনি তবে সে এটা বুঝতে পারছে যে এখনই পরিস্থিতি সামলাতে হবে নাহলে পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে। তাই ফারহান মুচকি হেসে বলল ‘ আমি ফারহান ইমতিয়াজ…… এ প্রফেসর অফ বাংলা লিটারেচার ডিপার্টমেন্ট। আমি সানার ফিয়ন্সে…… ‘
এবার যেন মিসেস জয়িতা খানিকটা সস্তি পেলেন। নিজের বড় হয়ে যাওয়া চোখ দুটো তাদের স্বাভাবিক অবস্থায় এনে বললেন ‘ তুমি ওর ফিয়ন্সে হলে এতদিন আসোনি কেন ? আর সানার যে বিয়ে ঠিক হয়েছে সেটা তো জানতাম না। ‘
‘ আমিও জানতাম না সানাহ্ এখানে…… ‘ ফারহান স্মিত হেসে বললো।
এবার ফারহানের কথা শুনে ভ্রু কুচকালেন। ফারহানের কথা কেন যেন তার অদ্ভুত লাগছে। বিয়ে ঠিক হয়েছে অথচ হবু বউ কোথায় সেটাই জানে না। মিসেস জয়িতা তার কৌতুহল মেটাতে বললেন ‘ মানে ? তোমার হবু বউ অথচ তুমিই জানতে না ও কোথায় থাকে ? তুমি কি আদৌ ওর হবু বর ? সানাহ্ তুই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন ? কিছু বলছিস না কেন ? নাকি এই ছেলে তোকে ভয় দেখিয়েছে ? ‘
এবার বেশ ভালই ফ্যাসাদে পড়লো ফারহান। সে ভাবেনি ভদ্র মহিলা এভাবে তিলকে তাল বানিয়ে ফেলবে। অবশ্য আজকাল যা চলছে তারপর ভদ্র মহিলার কাছ থেকে এই ব্যবহারই প্রত্যাশিত। বরং এহেন ব্যবহার না করলে ফারহান আরও অবাক হতো। তবে মহিলার ভুল ধারণা তো ভাঙতে হবে। তাই ফারহান সপ্রতিভ হেসে বললো ‘ নাহ্ ম্যাডাম আপনার ভুল হচ্ছে। আপনি যেরকম ভাবছেন সেরকম কিছুই নয়। সানার সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়েছিল সেই ঝগড়ার এক পর্যায়ে আমি বলেছিলাম আমি তাকে বিয়ে করবো না। তাই সে অভিমানে রাগ করে ঘর ছেড়েছিল। সেই রাগের বশেই ঢাকা থেকে সিলেট পর্যন্ত একা এসেছে তাও আবার কাউকে কিছু না বলে। টানা সাত দিন খোঁজাখুঁজির পর অবশেষে ওর খোঁজ পেয়ে এখানে ছুটে এলাম। যেহেতু আমার সাথে রাগ করে এসেছিল তাই আমারই দায়িত্ত্ব রাগ ভাঙিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেই দায়িত্ত্বই এখন পালন করছি। ‘
ফারহানের এহেন গোছানো কথা এবার মিসেস জয়িতার মনে ধরলো। উনি সন্তুষ্ট হয়ে বললেন ‘ ওকে নিয়ে যাচ্ছ যাও কিন্তু আবার ওকে রাগাবে না। আর সানাহ্ তোর হবু বর যদি তোকে আবারও রাগায় তাহলে নিশ্চিন্তে তুই আমার কাছে চলে আসবি। আমি তোকে আমার কাছে রেখে দিবো। ‘
মিসেস জয়িতার কথা শুনে সানাহ্ হালকা মাথা নেড়ে সায় দিল যে সে মিসেস জয়িতার কথা মতই করবে। মিসেস জয়িতা সন্তুষ্ট বুঝতে পেরে ফারহান বললো ‘ তাহলে ম্যাডাম আপনার সঙ্গে যখন দেখা হয়েই গেছে তখন বিদায় বেলার বিদায় দিয়েই যান। স্যারকে কি পাওয়া যাবে ? সানাহ্ আপনাদের থেকে বিদায় নিয়ে যেতে চায়। ‘
ফারহানের এত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে মিসেস জয়িতা মুগ্ধ। এত সুন্দর করেও মানুষ কথা বলতে পারে সেটা তার জানা ছিলনা। কিন্তু এই ছেলেটার উপরই যে সানাহ্ রাগ করে বসে আছে সেটা আদৌ সম্ভব মনে হলো না। এত সুন্দর ছেলের উপর কেউ রাগ করে থাকতে পারে ? প্রশ্নটা মিসেস জয়িতার মগজে না ঢুকলেও উনি আর এ নিয়ে কিছু বললেন না।
মিসেস জয়িতা আর হরিহরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফারহান আর সানাহ্ তাদের গন্তব্যে রওনা দিলো। এতক্ষণ সব নীরব ছিল কিন্তু হঠাৎ সানাহ্ বললো ‘ আমাকে ঢাকায় আমাদের বাড়িতে পৌঁছে দিন। আপাতত আমি কোনো আত্মীয় স্বজনের প্রবলেম ফেস করতে রাজি না। যা দেখা করার সবার সঙ্গে ঢাকায়ই দেখা করবো। ‘
ফারহান সানার কথা শুনে আলতো করে মাথা নেড়ে সায় দিলো। সে গাড়ি ঢাকার দিকেই নিলো। এখন সিলেট থেকে গাড়িতে ঢাকা যেতে প্রায় ছয় ঘণ্টার কাছাকাছি সময় লাগবে। এই ছয় ঘণ্টায় বিরতি হিসেবে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য কোনো হোটেলে গাড়ি থামালেই চলবে। আর তখনই যদি সবাইকে ফোন করে দেওয়া যায় তাহলে আরও ভালো। এমনিতেও তো ওরা বের হয়েছেই দেরি করে। দুপুর সাড়ে বারোটায়। এটা ওটা গুছাতে গুছাতেই যত সময় লাগলো।
গাড়ি ছুটে চলেছে পাকা পিচ ঢালা রাস্তার উপর দিয়ে।
আশেপাশের পরিবেশ দেখে যে কারোর মন জুড়িয়ে যাবে।চারপাশে হাজার মানুষের আনাগোনা। কেউ ফেরিওয়ালা তো কেউ চা ওয়ালা। আবার ছোটো ছোট বাচ্চারা এই হালকা রোদে পানির বোতল নিয়েও ঘুরছে দুটো রোজগারের আশায়। বাচ্চাদের দেখে ফারহানের মায়া লাগলো। ইচ্ছা করলো বাচ্চাটার কাছ থেকে দুটো বোতল কিনে তাকে সাহায্য করতে।
ফারহান বরাবরই তার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেয় বেশি তাই আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। গাড়ি থামিয়ে গাড়ির জানালা নামিয়ে ইশারায় বাচ্চাটাকে ডাক দিল। বাচ্চাটা নতুন এক ক্রেতার ডাক পেয়ে স্বানন্দে চলে এলো। ফারহান বলল ‘ এক বোতল কত করে ? ‘
‘ তিরিশ টাকা সাহেব ‘
‘ তাহলে চারটা দাও ‘ বলে ফারহান তার ওয়ালেট বের করে তার থেকে একটা একশো টাকার নোট আর দুটো দশ টাকার নোট বের করে এগিয়ে দিল। টাকা হাতে নিয়ে বাচ্চাটা চারটা বোতল এগিয়ে দিলো। ফারহান মুচকি হেসে বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে আবারও গাড়ি স্টার্ট দিল।
সানাহ্ কানে ইয়ার পড গুঁজে চোখ বন্ধ করে গান শুনতে ব্যস্ত ছিল। কিন্তু হঠাৎ মনে হলো চলন্ত গাড়ি থেমে গেছে। সেই অনুভূতির জেরেই সানাহ্ চোখ খুলে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করলো। ফারহানকে বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দেখে আর কিছু বললো না। সিটের গায়ে আবারও গা এলিয়ে দিয়ে চোখ বুজলো।
ফারহান কিছু একটা মনে করে সানার দিকে তাকালো কিন্তু সে হতাশ হলো। তার মনে হয়েছিল সানাহ্ তাকে দেখছে কিন্তু তার ধারণা ভুল। সানাহ্ তাকে দেখা তো দূর সে তো চোখ বন্ধ করে গান শুনতে ব্যস্ত।
দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য পথেই কুকিস্তার সামনে গাড়ি দাঁড় করাতে হলো ফারহানকে। গাড়ি থামিয়ে যখন সানার দিকে চোখ দিল তখন দেখলো ঘন্টা দুয়েকের ব্যবধানেই সানাহ্ ঘুমিয়ে কাদা। যাকে বলে একেবারে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে । ঘুমন্ত সানার নিষ্পাপ মুখ দেখেও তার মনে এক অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করলো। ইচ্ছা করলো সানার ললাটে আবারও স্নেহ মাখা চুম্বন এঁকে দিতে কিন্তু কাল রাতে যেটা হয়েছে সেটা আজ আর সম্ভব না।
ঘুমের ঘোরেই সানার হঠাৎ মনে হলো কেউ তাকে দেখছে। ব্যপারটা সানার কাছে অদ্ভুত ঠেকলো তাই সে ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ে তার ঘুমন্ত চোখ জোড়া মেলে ধরলো। চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো তার ধারণাই সঠিক। ফারহান তাকে দেখছে এক দৃষ্টে। সানাহ্ যে ঘুম থেকে উঠেই এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে সেটা তার ভাবনায় ছিলনা। সে কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। গলা খাকারি দিয়ে বললো ‘ গাড়ি থামালেন যে ? ‘
সানার কথায় ফারহানের জ্ঞান হলো। ব্যস্ত হয়ে গাড়ি থেকে নেমে সানার সিটের দরজা খুলে বললো ‘ দুপুরের লাঞ্চটা করে নিলেই ভালো হয়। পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর পার হবে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়েছে বের হতে। ‘
সানাহ্ প্রতি উত্তরে আর কিছু বললো না। সোজা গাড়ি থেকে নেমে ফারহানকে অনুসরণ করল। ফারহান ধীর পায়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। রেস্টুরেন্টে ঢুকেই সানার হাত জোড়া নিজের আয়ত্বে এনে সানাহ্কে নিয়ে কনার দিকে টেবিলে বসলো। কোনার দিকে বসার কারণে কাচের স্লাইডের ঐপাশ থেকে কেউ আর এখন ওদের দেখতে পারবে না।
‘ এখন আমরা কোথায় আছি জানেন ? ‘ ফারহান সানাহ্কে জিজ্ঞেস করলো।
‘ মাধবপুর লেকের কাছাকাছি..… ঢুকতে সময় রেস্টুরেন্টের ব্যানারে দেখলাম। ‘ সানাহ্ মৃদু গলায় উত্তর দিলো।
‘ যাক চিনেছেন তাহলে। এক কাজ করি..… এখন আমরা খাওয়া দাওয়া শেষ করি তারপর আপনাকে নিয়ে মাধবপুর লেকে যাবো। সেখান থেকে আবার আপনাকে নিয়ে শ্রীমঙ্গলে যাবো। তারপর দুজনে মিলে আয়েশ করে শ্রীমঙ্গল খ্যাত সাত রঙের চা খাবো। কোনওদিন খেয়েছেন ? ‘ ফারহান খুশি হয়ে বললো।
‘ আপনি কি এখন আমাকে নিয়ে ঘুরে বেড়াবেন ? ‘ সানাহ্ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
‘ হুম, চিন্তা করবেন না। আপনাকে আজ যত রাতই হোক বাড়ি পৌঁছে দিবো। এখানে এসেছি ভাবলাম আর কবে আসি না আসি তার থেকে বউকে নিয়ে ঘোরাঘুরি করে যাই। ‘
‘ আমি আপনার বউ ? আমাদের তো বিয়ে এখনও হয়নি। ‘ সানাহ্ অবাক হয়ে বললো। তার কাছে ফারহানের ব্যবহার বড়ই অবাক লাগছে। এ কোন ফারহানকে দেখছে সে। ফারহান কখনোই এত মন খুলে কথা বলতো না। ওর সঙ্গে তো একেবারেই না। হ্যাঁ তবে ফারহান গম্ভীর প্রকৃতির নয়। সে খুবই সহজ সরল সাধাসিধা মানুষ। জগতের সবকিছু দেখে সরল চোখে।
‘ হন নি, হতে কতক্ষন ? আজ বাদে কাল আমাদের বিয়ে। দেখবেন চোখের পলকে দুই সপ্তাহ কেটে গেছে। তাছাড়া বাড়ি ফিরে তো অনেক কাজ করতে হবে। মা বলছিলো আপনার শাড়ি থেকে শুরু করে গয়না সব একদিন সময় করে কিনতে। ‘ ফারহান বললো।
‘ এতকিছুর পরও আপনার মনে হয় আন্টি আপনাকে আমাকে বিয়ে করতে দিবেন ? আর দিলেও উনি কি আমাকে ছেলের বউ হিসেবে মেনে নিবেন ! ‘ সানাহ্ দৃষ্টি নত রেখেই বললো।
‘ বিয়েটা আমাদের তাই সেখানে অন্য কারোর মতের প্রয়োজন নেই। আর একান্তই যদি মায়ের মত আপনার কাছে মেটার করে তাহলে আমি বলে দেই আমার মা সেরকম নয়। তার কাছে আমার খুশিটাই তার খুশি। এখন এসব কথা ছাড়ুন। আমি অর্ডার দিচ্ছি। তাড়াতাড়ি খাওয়ায় হাত লাগান। অনেক ঘোরাঘুরি বাকি। ‘ ফারহান মেনু কার্ড দেখতে দেখতে বললো।
ফারহানের কথা মেনে সানাহ্ও আর কিছু বললো না। আসলেই তারও এসব ব্যাপারে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। এখন এই মুহূর্ত উপভোগ করার সময়। ফারহান নিজে থেকে চাইছে তাকে নিয়ে ঘুরতে তাই এসব বলে সে ফারহানের মুড নষ্ট করতে চায় না। যা কথা বলার বাড়ি ফিরে ঠিক করবে।
ফারহান মেনু কার্ড দেখতে দেখতে বললো ‘ আপনি কি খাবেন ? ‘
‘ যা আপনি খাওয়াবেন তাই ‘
‘ কিন্তু খাবার তো পেটে আপনার যাবে আর আমি তো অন্তর্যামী নই যে আপনার পেটের খবর জানবো। সুতরাং আপনার পছন্দমত অর্ডার দেওয়াটাই যৌক্তিক। ‘ ফারহান মেনু কার্ডের দিকে চোখ রেখেই বললো।
‘ ব্রাউন রাইস অ্যান্ড চিকেন কারি উইথ লেস স্পাইস ‘
‘ তাহলে এটাই ফাইনাল করি। ‘ বলে ফারহান ওয়েটারকে ইশারায় ডেকে পাঠালো। ওয়েটার আসতেই ওয়েটারকে সানার বলা ডিশ আর নিজের পছন্দের রাইস বোল উইথ চিকেন এন্ড ভেজিটেবল অর্ডার দিলো।
মিনিট বিশেক পর ওয়েটার একে একে সব ডিশ প্রেজেন্ট করলো। ফারহান নিজ দায়িত্বে সানাহ্কে ডিশ সার্ভ করা থেকে শুরু করে তার ড্রিংকস গ্লাসে দেওয়া পর্যন্ত সবই করলো। সানাহ্কে সবকিছু পাস করে এবার নিজের খাওয়ায় মনযোগ দিল। ওদের খাওয়া দাওয়া শেষ হলো বেশ নির্বিঘ্নে,বিনা বাক্য ব্যয়ে….
~ চলবে ইনশাআল্লাহ্…..