#সিন্ধুর_নীল (পর্ব-৩৭)
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
৬৫.
বিয়ের পর সিন্ধুকে জমিদার তার অন্য একটি বাড়িতে নিয়ে যায়, যা শহরেই অবস্থিত। সিন্ধুর বিয়ের ব্যাপারে সিন্ধুর বাবা ছাড়া আর কোনো আত্মীয়, কাছের মানুষ কেউই জানেনা। যেহেতু জমিদারের জমিদারি কাজ কর্ম আছে তাই তার এই বাড়িতে প্রতিদিন আসা হয়না। তাছাড়া বড় বেগমের ও শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা। সব কিছু বিবেচনা করেই সিন্ধুকে একা ছাড়তে হলো। সিন্ধুও এতে কিছু মনে করল না। তার নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগে ভীষণ!
গ্রাম থেকে মুন্নাকে নিয়ে এসেছে শাহনেওয়াজ। সে সিন্ধুর পরিচিত তাই সিন্ধু তাকে আপদে বিপদে ডাকতে সাহস পাবে তাই। প্রত্যয় শাহ্ শাহনেওয়াজ এর এই গোপন বিয়েতে বেশ রাগ করেছেন। তবে সিন্ধুর সাথে নমনীয় ব্যবহার করেছে। শেখ মৃত্যুঞ্জয়কে দেখে সিন্ধু যা বুঝল, তিনি সারাক্ষণ একটা খাতা নিয়ে ঘুরেন। হুটহাট লেখালেখি করে, চিত্র আঁকে। বেশ ভালো কবিতা আবৃত্তি করে। প্রতিদিন বৈকেলে এসে সে সিন্ধুর হাতে বানানো শরবত খেয়ে যায়। তার নাকি এই শরবতটি ভীষণ প্রিয়! আর কিছু খায়না। শুধু এই শরবত টুকুই খায়। একদিন সিন্ধু জিজ্ঞেস করল,
-‘আপনি কবিতা লিখতে পারেন!’
ওমনি মৃত্যুঞ্জয় হেসে বলল,
-‘আমি তো সব নিজের লেখা কবিতাই আবৃত্তি করি।’
-‘কী বলছেন! এত সুন্দর কবিতা লেখেন আপনি?’
মৃত্যুঞ্জয় মুঁচকি হাসে। সিন্ধু ক্ষানিকটা লজ্জা নিয়ে বলল,
-‘আমাকে একটা কবিতা লিখে দিবেন?’
এবারও ঠোঁটে হাসি বজায় রেখে মৃত্যুঞ্জয় জানতে চাইল,
-‘জমিদারের জন্য বুঝি!’
লজ্জিত নয়ন নিচু করে সম্মতির সুরে মাথা ঝাকায় সিন্ধু। মৃত্যুঞ্জয় বলল,
-‘বেশ! তবে আগামীকাল লিখে আনব। তবে সুর দিয়ে গান বা আবৃত্তি যা-ই করার সেটা আপনি করবেন। ঠিক আছে?’
-‘গানও গাইতে পারব? সেটাও হয়!’
-‘অবশ্যই হয়। আমার কাজ হলো লিখা। এবার সেটা আপনি গলগল করে পড়ে যেতে পারেন কিংবা কবিতা আবৃত্তিও করতে পারেন চাইলে গানও গাইতে পারেন। সবটা আপনার হাতে। তবে এখানে বিশেষ একটি ব্যাপারও আছে। আমি যদি এটার ধরণ কেবলই কবিতার জন্য লিখি তো কেবলই কবিতাই হবে। এর বেশি কিছু করা অসম্ভব ব্যাপার। এখন আপনি বলুন আপনি কোনটা চান?’
-‘তবে আমাকে শুধুই কবিতা দিবেন। আমি গান গাইতে পারিনা।’
-‘জমিদার মশাই কিন্তু দারুন গান গাইতে পারে। প্রত্যয় শাহ্ চমৎকার তবলা বাজায়।’
-‘বাহ! আপনাদের সবারই এত গুণ!’
-‘এত আর কোথায়? তাছাড়া তথাকথিত এই এত গুণ থেকে লাভ হলো কী? যার পাত্তা পাওয়ার কথা ছিল তারই কোনো পাত্তা পেলাম না। যাই হোক! আপনি ইংরেজি পড়েন তো?’
-‘হ্যাঁ পড়ি। মাস্টারমশাই বলে আমার ইংরেজি ভালো হয়।’
-‘তবে আপনাকে একটা উক্তি বলা যায়। বলব?’
-‘বলুন!’
কিছুক্ষণ ভেবে মৃত্যুঞ্জয় বলল,
-‘না থাক! আজ নয়। আমি বরং আপনাকে পরে বলব।’
-‘ভুলে গেছেন?’
-‘ভুলব কেন? আমার প্রিয় উক্তি আমি কখনো ভুলিনা। আসলে সময়টা সঠিক নয়। আমার যখন মনে হবে সময়টা সঠিক তখনিই বলব।’
-‘আপনি সারাক্ষণ কী লেখালেখি করেন দেখি। আসলে কী লেখেন!’
-‘আমি দৈনন্দিন জীবনে ঘটা সবই লিখি আমার ডায়েরীতে। সারাক্ষণ সেটাতে ব্যস্ত থাকি। আমার শখের কাজ বলতে পারেন।’
-‘বিরক্ত হোন না?’
-‘বিরক্ত হবো কেন? আমরা যা ভালোবাসি তা সারা জনম ভরে করে যেতেও বিরক্তি আসবেনা।’
-‘আপনি খুব সুন্দর করে কথা বলেন।’
-‘আপনার শোনার কানটা সুন্দর বুঝলেন! তাই আমার কথা সুন্দর লাগে। প্রত্যয় শাহ্ মজা করে বলে আমার এসব কাব্যিক কথা, সাহিত্যিক কথা নাকি সে আ’ফি’মের সাথে গুলে খাইয়ে দিবে ইংরেজদের। তারপর তাদের মুখ থেকেও এসব বের হবে। হুকুম দারি ভুলে তারা এমন ভবঘুরে মশাই হবে আমার মতো।’
সিন্ধু হেসে দিল। সন্ধ্যার আগেই মৃত্যুঞ্জয় বিদায় নিলেন। রাতে সিন্ধুর শরীর খারাপ করলে মুন্না বৈদ্য নিয়ে আসে। তিনি দেখে জানালেন সিন্ধু সন্তানসম্ভবা। বেগম সুগন্ধ্যার কানে যখন কথাটা গেল সে বিছানা আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদলেন। ভোরের আলো ফুটবার আগেই সিন্ধুর কাছে হাজির হয় শাহনেওয়াজ। স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরেন পরম আবেশে। এই সুখবর তার সবকিছু কেমন শান্তিতে ভরিয়ে তুলেছে যেন।
দিন পার হয়, সময় যায়, তারই সাথে নতুন কিছু সংযোজন হয় কিছু বিয়োজন। বেগম সুগন্ধ্যার কোল আলো করে এক পুত্র সন্তানের জন্ম হলো। এদিকে সিন্ধুও পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। জমিদার পড়েছে দ্বিধায়। এখন কোন দিকে যাবে, কার দিকে খেয়াল দিবে! সিন্ধু বলল তার এখন নিজ পুত্রের কাছে থাকা আবশ্যক। সিন্ধুর দেখভাল করার অনেক মানুষ আছে। শাহনেওয়াজ কিছুটা স্বস্তি পেয়ে মূল ভবনে থাকা শুরু করল। দিন গেল মাস গেল তার হদিশ মিলে না সহজে। দু এক বার এসে আর আসেনা আবার আসলে দু ঘন্টার বেশি থাকেনা। এদিকে সিন্ধুর গর্ভাবস্থার আটমাস চলছে। রোজ রোজ মৃত্যুঞ্জয় ঠিকই আসে কথা বলে তবে সিন্ধুর মন পড়ে থাকে কেবল জমিদারের দিকে। সে মন প্রাণ দিয়ে চাইতে থাকে জমিদার যেন মৃত্যুঞ্জয়ের মতো রোজ রোজ তার এই বাড়িতে আসে। মৃত্যুঞ্জয় বলেছিল কবিতা লিখে দিবে। দিয়েওছে, কিন্তু কবিতা শোনানোর মানুষটি নেই বলে সেই কাগজটি আলমারির ভেতর সিন্ধুর লাল রঙা শাড়ির ভাজে পড়ে আছে।
এদিকে খবর এসেছে ইংরেজ নাকি জমিদারের উপরে চটেছে। তারা নাকি কিছুতেই জমিদারের ক্ষ’ম’তা টি’ক’তে দিবেনা। কারণ জমিদার এখনও আফিম চাষের অনুমতি দেয়নি। এবং সে কোনো ইংরেজকে তার সীমানায় না আসার জন্য কঠোর ভাবে মানা করেছে। রাজা মশাইও এখন দুই নৌকায় পা দিয়ে চলতে হিমশিম খাচ্ছে। সে নাকি শাহনেওয়াজকে বলেছেন ইংরেজদের সাথে শুধু শুধু লেগে লাভ নেই। তার থেকে ভালো ক’বিঘা জমিই তো! ছেড়ে দিলে আর কী ক্ষতি হবে! শাহনেওয়াজেরও কথা এসব হা’রা’মখোরের হা’রা’ম চাষাবাদ সে তার দেশের মাটিতে করতেই দিবেনা। ব্যাস! দুজনের একটা অদৃশ্য দ্বন্দ শুরু হলো। এই সব সিন্ধু প্রত্যয় শাহ্ এর কাছে থেকে জেনেছে। কেননা মৃত্যুঞ্জয় কখনো বাহিরের কথা এসে বলেন না। কোলাহল এড়িয়ে চলা মানুষ তাই সে চুপচাপ থাকে এসব ব্যাপারে। তবে তাকে জড়িয়ে ফেলে যদি সেদিনই হবে আসল সর্বনা’শ। তার ভেতরের লুকায়িত সেই ভয়ঙ্কর, হিংস্র সত্তা দেখেনি এমন প্রতিপক্ষ তার বিরল। সে শান্ত তো সব শান্ত! তাই অনেকে তার থেকে অনেক কিছু লুকিয়ে ফেলে। বদরাগী না হলেও সে ভীষণ রাগী। বদ’টা বাদ কেবল।
এসবের চিন্তায় সিন্ধুর শরীর খা’রা’প করল। মুন্নাকে শত বারণ করার পরেও সে শাহনেওয়াজ এর কাছে বার্তা পাঠায়। সেই দিনই ছুটে আসে শাহনেওয়াজ। নিজের এমন ভুলের জন্য শতবার মাফ চায়। সিন্ধুর একটাই কথা! সে কী তার মাফ চেয়েছে?
৬৬.
রাতের পরিবেশ খুব ঠান্ডা থাকে। চারিদিকে বিরাজ করে শুনশান নিরবতা। সিন্ধু দাঁড়িয়ে আছে বারান্দার রেলিং ধরে। সে নিজের জীবনের চক্র নিয়ে ভাবছে। এত কিছুর মধ্যে তার খেয়াল হলো না কখন শাহনেওয়াজ তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। যখন শাহনেয়াজ তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে তখন সে হুশে আসে। বলে,
-‘আজকে ফিরবেন না?’
-‘উহু। আজকে থাকব।’
-‘শুধু আজকেই?’
-‘তুমি বলো তো! কতদিন থাকা যায়!’
-‘আপনি বলতে পারবেন না?’
-‘না।’
-‘তাহলে তো আমি জানিনা কতদিন থাকা যায়। তবে ভালো হয় আপনি ফিরে গেলে। শুনেছি আম্মাজান এখনও রেগে আছেন আপনার উপর। এই সময় আর তার বদ দোয়া নিতে চাইনা। এতে আমার বাচ্চাটার যদি কোন ক্ষ’তি হয়? দরকার নেই। আমি কারো মনে কষ্ট দিতে চাইনা ফিরে যান আপনি।’
-‘আমি যে তোমার আর আমার অনাগত সন্তানের মনে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি! তার বেলায়?’
-‘সে আপনি জমিদার মানুষ। দিতেই পারেন। আপনার আবার অ’প’রা’ধ হয় নাকি?’
-‘আমি কী রক্তে মাংসে গড়া মানুষ নই?’
-‘আমি সেটা বলছিনা। আপনি এখন আসুন। অনেক রাত হলো। আর কত?’
-‘কীসের আর কত! তুমি বোঝো না! এই, তুমি সত্যিই বোঝোনা?’
-‘কী বুঝব?’ আহ! কেমন অভিমানি গলা। শাহনেওয়াজ একটু তেজ কমায়। বলে,
-‘আমি তোমাকে ভালোবাসি যে বেগম!’
-‘কেন বাসলেন?’
-‘জানিনা।’
-‘আগে জেনে আসুন। তারপর ভেবে দেখল আপনার ভালোবাসা বোঝার দরকার আছে কী নেই।’
-‘এত পা’ষা’ণ কেন তুমি?’
-‘হতে হয়। সেটা আপনি বুঝবেন না।’
সিন্ধু চলে আসতে নিলেই শাহনেওয়াজ তার হাত ধরে আটকায়। ছোট্ট টুলের উপর যে একটা বাক্স ছিল সেটা এতক্ষণে সিন্ধুর নজরে এলো, যখন শাহনেওয়াজ সেটা হাতে নিল। সিন্ধু ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই শাহনেওয়াজ বাক্স থেকে একটা আয়না বের করে। যে সে আয়না নয়! এ যে বিশ্বের নামি দামি কিছু রত্নদের মধ্যে সজ্জিত। গাঢ় নীল রঙের পাথর চিকচিক করছে, সাদা হীরের ঝলক দেখা যাচ্ছে। সিন্ধুর পেছনে দাঁড়িয়ে শাহনেওয়াজ দুই হাত দিয়ে আগলে ধরে আয়নাটা সিন্ধুর মুখের সামনে ধরে বলল,
-‘তোমার জন্য এই সিন্ধুর নীল।’
বিমোহিত নয়নে চেয়ে সিন্ধু বলল,
-‘মানে!’
-‘তোমার ঐ চোখটা নীল সমুদ্র আমার কাছে। এত গভীর যে আমি সেই গহ্বরে তলিয়ে যাই যাই কিন্তু শেষ পর্যন্ত যাওয়াই হয়না। এতটাই গভীর! ঐ দৃষ্টি আমার বুক কাঁপায়। সিন্ধু অর্থ সমুদ্র আর সেই সমুদ্রের নীল স্বচ্ছ পানি গুলো আমার ভীষণ প্রিয়। তাই আমি চাই সেই সিন্ধুর নীল যেন এই সিন্ধুটাও গভীর ভাবে দেখতে পারে, মন ভরে দেখতে পারে, তাই এই আয়না এনে দিলাম। এই আয়নার নামই আমি দিলাম সিন্ধুর নীল। দ্যাখো! খোদাই করা আছে পাথরে।’
সিন্ধু তাঁকিয়ে দেখে সত্যিই! খুশির চোটে সে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে।
-‘এই রত্নের কথা আমি শুনেছিলাম। এগুলো খুবই দামি। আপনি একটা সামান্য আয়না এনেছেন তাতে এই এত দামি পাথর কেন দিলেন!’
-‘আমি যখন নবাবের মহলে গিয়েছিলাম তখন নবাবের নাতি শেখ মৃত্যুঞ্জয়কে একটা ত’র’বা’রি প্রতিযোগিতায় হারিয়েছিলাম। নবাব আমার এই দূরদর্শিতা দেখে খুশি হয়ে এই রত্ন গলো দিয়েছিল। আমি নিতে যখন অস্বীকৃতি জানাই তখন তিনি বলেন এই রত্ন আমার নয়। আমি যখন আমার জীবনে এই রত্নের থেকেও বড় কোনো রত্ন পাবো তখন যেন তাকে এগুলো উপহার হিসেবে দেই। কারণ সেদিন আমি না বুঝলেও আজ বুঝতে পারছি ভালোবাসার থেকে বড় রত্ন আর হয়না। সেদিন নবাব এটাই বোঝাতে চেয়েছিল। আর তুমি আমার সেই ভালোবাসা যা আমার সবচেয়ে দামি বস্তু। এই আয়না কখনো সামান্য যেন না হয় তাই বিশেষ ভাবে তৈরি করলাম। যাতে লাখো সহস্র আয়নার মধ্যেও সিন্ধুর নীল থাকে সর্বদা প্রজ্জ্বলিত। এই সিন্ধুর নীল আমার ভালোবাসা, এই সিন্ধুর নীল আমার ভালোবাসার প্রতীক। ‘
ক্রন্দনরত সিন্ধু শাহনেওয়াজের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কী কান্নাটাই না করেছে সেদিন!
ভালোবাসা ময় দিনগুলো ভালোই যাচ্ছিল। সমস্যা আসে তখন, যখন শাহনেওয়াজ এর আম্মাজান সিন্ধুকে তা’লা’ক দেওয়ার হুকুম প্রদান করল। শাহনেওয়াজ এক বাক্যে অসম্মতি জানালে তিনি যেন আরো ক্ষে’পে যান। তার এই রকম মা’ন’সি’ক অবস্থায় কু মন্ত্রণা দেয় এক দল লোক! ইংরেজ পর্যন্ত খবর চলে যায় শাহনেওয়াজ এর দুর্বিষহ জীবনের ভেতরকার কথা। তারা গোপনে দেখা করার আমন্ত্রণ দেয় শাহনেওয়াজ এর মা মাশহুদা বেগমকে। তিনিও বোধ বুদ্ধি হারিয়ে তাদের আমন্ত্রণ গ্রহন করে সবার অলক্ষ্যে। তারপরই জমিদার বাড়িতে নেমে আসে ঘন, কালো, অন্ধকার এবং চরম বি’ভ’ৎস অধ্যায়। যা কখনো হওয়ার ছিল না!
#চলবে।