এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২ #লেখিকা – কায়ানাত আফরিন #পর্ব – ১৮

#এক_শ্রাবণ_হাওয়ায়-২
#লেখিকা – কায়ানাত আফরিন
#পর্ব – ১৮
আনভীরকে ইগ্নোর করার জন্য আমার যা করা দরকার তাই করেছি আমি। আজকে হসপিটালের ম্যানেজিং ডিরেক্টরের সাথে খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি মিটিং ছিলো এখানকার সকল ইমপ্লয়িদের। মূলত এখানকার কিছু ফ্যাসিলিটি বাড়ানোর চিন্তা নিয়েই এই মিটিংটা করা। প্রায় তিনঘন্টার এই মিটিংয়ে আমাদের ইন্টার্নশিপ কমপ্লিট ট্রেনিংপ্রাপ্ত মেডিক্যাল স্টুডেন্টদের আর কতদিন এভাবে কাজ করতে হবে সে ব্যাপারলেও কিছু আলাপচারিতা হচ্ছিলো। মিটিং শেষে আমি ক্লান্তি নিয়ে কেবিনে আসলাম।
ধ্রুব স্যারের অন্তর্ভুক্ত হয়ে কাজ করছি বলে আমার টেবিলটা উনার কেবিনেই ছিলো। আর আমার কাজ হচ্ছে সব পেশেন্টদের রিপোর্ট চেক করে সেটার কন্ডিশন স্যারকে বলা।

টাইম ট্যাবেল চেক করে আরও একদফা হতাশ হলাম আমি। সচরাচর আমার ডিউটি দুপুরে পড়ে কিন্ত আজ পড়েছে সকালে। পরক্ষণে ভাবলাম ভালোই হয়েছে। এতে মোবাইলে এত এটেনশনও থাকবে না আবার আনভীর কল দিলেও মাথা ঘামাতে পারবো না।
উনার নির্বিকার ভাবের কথা স্মৃতিচারণ করেই রাগে গা শিরশির করে আমার। নিজেকে কি ভাবে মানুষটা? কই আমার কেয়ার করবে সেটা না করে নিজের মতো হেসে খেলে বেড়াচ্ছে৷ আজ আর যাই হোক, মোবাইল যেহেতু অফ করেছি সেটা আর খুলবো না। কল করতে থাকলে করুক। উনাকেও বুঝতে হবে ইগ্নোর জিনিসটা কত বিচ্ছিরি ব্যাপার।

ডিউটি শেষে আমি হসপিটালের ক্যান্টিনে বসে ছিলাম চুপচাপ। টেবিলে রাখা ক্লিপ বোর্ডের কাগজগুলোতে মনোযোগ দিয়ে নিজের শিডিউল দেখতে ব্যাস্ত। আমায় এভাবে বসে থাকতে দেখে আমার মেডিকেল ব্যাচমেট ধারা আর ইশা এসে বসলো আমার পাশে। ওরা নিজেদরে মধ্যে আলাপচারিতা চালালেও আমার ওদিকে মন নেই। হুট করে কেউ বললো,

‘ এখন লাঞ্চ টাইম আহি! এসব কাজ তো তোমায় আমি লাঞ্চ টাইমে করতে বলিনি।’

আমি মাথা উচিয়ে দেখলাম ধ্রুব স্যার দাঁড়িয়ে আছেন। এপ্রোনটা এখনও খুলেননি। আমি মিহি হেসে বললাম,

‘ ওমন কিছু না স্যার। আমি লাঞ্চ করবো না। আপনি কেবিনে প্রফেসরের সাথে ব্যাস্ত ছিলেন বলে এখানে এসেছি।’

‘ তাই বলে লাঞ্চ করবে না?’

‘ পরে করবো।’

ধারা পাশ কেটে বলে ফেললো,

‘ আপনি আমাদের সাথে লাঞ্চ করুন স্যার। আহি নাহয় পরে করবেনে। ডক্টর সিনথি এখনি এসে পড়বে।’

‘ ওয়েট আমি কফি নিয়ে আসি আহির জন্য!’

স্যার একথা বলে যাওয়া মাত্রই ধারা আর ইশা দুষ্টু হেসে বলে উঠলো,

‘ কেয়া বাত হে মেরি জান, তুই দেখি স্যার এর ‘দিল কা টুকরা’ হয়ে গিয়েছিস!’

আমি আড়চোখে তাকিয়ে বললাম,

‘ সবসময়ই ফাজলামো না করলে হয়না বুঝি?’

‘ আরেএএ, বুঝবি বুঝবি। পরে নাহয় টের পাবি। আচ্ছা শোন তো আহি! তোর কাছে ধ্রুব স্যারের নাম্বার আছে?’

‘ হ…হ্যা কেনো?’

ধারার এ কথায় আমি জিজ্ঞেস করলাম ওকে। ধারা এবার বললো,

‘ আরে তুই দে তো! এত কিছু জানতে হবে না।’

এদিকে আমি ভাবছি অন্যকিছু। কারন আমার ফোন বন্ধ। যদি আনভীর আগে ফোন দিয়ে থাকে আর মোবাইল বন্ধ পায় তবে সুইচ অন করলেই উনার কাছে এসএমএস যাবে যেটা সচরাচর সকল সিম কোম্পানিতেই হয়ে থাকে।

‘ কি হলো দে?’

ধারার কথায় আমার ধ্যান ভাঙলো। সুইচ অন করে কল লিস্ট থেকে এবার স্যারের নাম্বারটা দিতেই হুট করে কল আসলো কারও। স্ক্রিনে ‘চাশমিশ বিলাই’ নামটা দেখেই রুহু কেপে উঠলো আমার। ইশা স্ক্রিনে এমন অদ্ভুত নাম দেখে বললো,

‘ চাশমিশ বিলাইটা আবার কে?’

‘ তুই যদি জানতি এটা কে তাইলে এখানেই খুশিতে মরে যেতি!’

বিড়বিড়িয়ে কথাটি বললাম আমি। ধারা এবার বললো,

‘ কি হলো? কল রিসিভ কর!’

আমায় এভাবে বসে থাকতে দেখে ধারাই মাতব্বরি করে কল রিসিভ করে আমার কানে ধরিয়ে দিলো। ওপর পাশ থেকে বলে উঠলো,

‘ হোয়ার আর ইউ আহি?’

এই চারটা গম্ভীর শব্দ আমার নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিলো। আমি প্রতিক্রিয়াহীন ভাবে বসে রইলাম। কানের কেবল শুনতে পাচ্ছি অপর মানুষটার নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ। এর মধ্যে কফির কাপ নিয়ে এলো ধ্রুব স্যার। সেটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘ কফিটা খেয়ে নাও।’

কথায় আছে না,’যেখানে বাঘের ভয়; সেখানেই সন্ধ্যা হয়’, আমার সাথে এরকমই কিছু হয়েছে। ধ্রুব স্যারের কন্ঠ শুনে অপরপাশে মিহিয়ে গেলেন আনভীর। বুঝলাম এই মিহিয়ে যাওয়াটা খুব ভালো একটা লক্ষণ নয়। আমি মোবাইলটা কানে ধরেই ধ্রুব স্যারের দিকে হেসে বললাম,

‘ ধন্যবাদ স্যার!’

‘ ইটস ওকে! আফটার অল আমরা একসাথে কাজ করি, ছোট খাটো ক্ষেত্রে এসব তো চলেই।’

ফট করে অপরপাশে কল কেটে দিলেন আনভীর৷ আমি পরপর দু’বার শুকনো ঢোক গিলে তাকিয়ে থাকলাম মোবাইল টার দিকে। এতক্ষণ আমি রেগে থাকলেও এখন ভয় হচ্ছে রীতিমতো। লাঞ্চ টাইম শেষ বলে আর না ভেবে লিফটের দিকে চলে গেলাম।

_________

ঘড়ির কাটায় তাকিয়ে দেখি সাড়ে চারটা বাজে। আজকের জন্য কাজ প্রায় শেষ আমার। আজকে হুট করে শিউলি ভাবি কল দিয়েছিলো৷ বলেছিলো আগামীকাল আঙ্কেল-আন্টির বিবাহবার্ষিকী তাই আসতে বলেছিলো আমাদের৷ আমি মিহিয়ে গেলাম। ভাবি হয়তো ভাবে যে আমাদের ব্যাপারটা অন্য চারপাঁচ জনের মতোই স্বাভাবিক কিন্ত ব্যাপারটা আপাতদৃষ্টিতে এমন না। আনভীর সবসময় আমায় নিয়ে একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করেন। সবকিছুতেই আমার বাঁধা। এদিকে আমি যতটুকু জানি আনভীর যাবেন না এই ছোট্ট প্রোগামটিতে যতই এটা উনার বাবা-মাকে ঘিরেই হোক না কেন। তবুও আমি আশ্বস্ত করলাম ভাবিকে। বললাম, চেষ্টা করে দেখবো উনাকে মানানোর।

কল কাটার পর ইশা জিজ্ঞেস করলো,

‘ কার সাথে কথা বলছিলি?’

অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম আমি। কেননা আনভীরের কথামতো আমি কাউকেই কিছু বলিনি এ ব্যাপারে৷ তাই মিনমিনিয়ে বললাম,

‘ আমার দূরসম্পর্কের এক ভাবি। দাওয়াত দিয়েছিলো আমায়!’

‘ ওহ! তুই কি তাহলে মিরপুরের ওই আগের ফ্ল্যাটেই থাকিস যেটা তোর ওই কাজিন ব্রাদার দিয়েছিলো? ‘

ইশা অপূর্ব ভাইয়ার কথা বলতেই আমি তৎক্ষনাৎ বললাম,

‘ না, অন্যজায়গায় থাকি এখন।’

‘ একদিন পারলে নিয়ে যাস তোর নতুন বাসায়।’

ইশার কথায় সম্মতি জানালাম আমি। যদিও তা হয়তো সম্ভব না। তখনই এক পিয়ন এসে আমায় বললো,

‘ মিস আহি! আপনাকে ডক্টর ধ্রুব ডাকছে।’

ঘড়ির কাটায় তাকিয়ে একটু অবাক হলাম। যতটুকু জানি এসময় তো উনার হসপিটালে থাকার কথা না। কারন সন্ধ্যার সময় উনি পুরান ঢাকার সুমনা হসপিটালে বসেন। যার জন্য আগেভাগেই বের হতে হয়৷ তাহলে এখন এখানে আছে কেন? এসব ভাবতে ভাবতেই আমি দরজা খুলে বললাম,

‘ স্যার আসবো?’

‘ হ্যাঁ আসো।’

স্যারের অপরপাশে একজন বসে আছে আমার দিকে পিঠ দিয়ে। আমি সেখানে খেয়াল না করেই বললাম,

‘ ডেকেছিলেন স্যার?’

‘ হ্যাঁ! আমি তোমায় একজনের এক্স-রে রিপোর্ট রাখতে দিয়েছিলাম না? তুমি তো আমায় ওটা দিয়ে যাওনি।’

‘ ওহ! ভুলে গিয়েছিলাম। এখনি দিচ্ছি। ‘

বলেই আমি উনার পাশে আমার ডেক্সটার ড্রয়ার খুলে সেই রিপোর্ট দিলাম। আমি জানতাম না কার রিপোর্ট ছিলো এটা। কিন্ত সেটা স্যারের কাছে দেওয়ার সময় যাকে দেখলাম তাকে দেখে কয়েক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে ছিলাম আমি। আচমকা বলে উঠি,

‘ আপনি?’

ধ্রুব স্যারের অপজিটে আনভীর বসে ছিলেন। ক্যাপ, সানগ্লাস আর মাক্স পড়ে থাকায় হয়তো দূর থেকে কেউ ভালোভাবে খেয়াল করেনি উনাকে। আর এই হাসপাতালে কম বেশি অনেক বিজনেসম্যান, সেলিব্রেটি, পলিটিশিয়ানরা আসে। এর একটি কারন দেশের বেসরকারি হাসাপাতালে মধ্যে এটা আপাদত প্রথম সারিতে আছে। আর দ্বিতীয় কারন এর সুযোগ-সুবিধা। আনভীর মিহি হেসে বললেন,

‘ কেমন আছো আহি?’

বিস্মিত হলেন ধ্রুব স্যার। সেই সাথে আমিও। কেননা আমাদের মধ্যে কথা হয়েছিলো আমাদের পরিচয় কিছুতেই যেম প্রকাশ না পায়। তাহলে! ধ্রুব স্যার এবার জিজ্ঞেস করলেন,

‘ আহিকে চিনিস তুই?’

ধ্রুব স্যার যে আনভীরের স্কুল ব্যাচমেট, সেটা জানতাম। এই কথাটি উনি প্রথমদিনই বলেছিলেন। তবে ধ্রুব স্যারের কথা শুনে এক গাল হাসলেন আনভীর৷ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ চিনি তো! সি ইজ মাই বেবিগার্ল। ‘

বুকে কেউ এক কেজি পাথর বসিয়ে দিলো আমার। ধ্রুব স্যার বললেন, ‘ কি?’

‘ আই মিন, আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে। সবসময় বেবিগার্ল বলেই ডাকতাম। এখনও তাই ডাকি৷ তাই না?’

বলেই আমার দিকে তাকিয়ে চশমার আড়ালেই চোখ টিপ মারলেন উনি। আমি তাজ্জব না হয়ে পারলাম না৷ একটা মানুষ যে কতটা লু/ই/চ্চা হতে পারে এই চাশমিশ বিলাইরে না দেখলে আমি হয়তো জানতেই পারতাম না। হেসে দিলেন ধ্রুব স্যার। চুলগুলোতে আঙুল চালিয়ে বললেন,

‘ আমিও কি ভাবলাম!’

আনভীর কিছু বললেন না আর। এক্স-রে রিপোর্টটা আসলে ছিলো আনভীর যার আন্ডারে এবার সং কভার করছেন তার। আর উনি যে কেন এখানে এসেছেন সেটা ভালোমতোই জানি আমি। আমি এবার অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,

‘ আমার দেরি হচ্ছে। আমি গেলাম তাহলে।’

বলে দ্রুতই বেরোলাম আমি। নাহিদ ভাইয়া নিচে আছেন আমি জানি। তাই এখানে আনভীরের সাথে কথা না বলাটাই ভালো হবে। অন্যথায় কেউ দেখলে হিতে বিপরীত হয়ে যাবে৷ লিফটে ঢুকে সুইচে চাপ দিতেই ঝড়ের গতিতে লিফটে ঢুকলেন আনভীর। দটজাটা বন্ধ হওয়া মাত্র একেবারে ঘেষেই দাঁড়ালেন আমার সাথে। আমি নিশ্চল হয়ে গেলাম। ক্রমেই টের পেলাম বুকে দুড়ুম দুড়ুম শব্দ হচ্ছে। আমি আমতা আমতা করে বললাম,

‘ ক…কি হয়েছে?’

আমায় এতটা অপ্রস্তুত হতে দেখে তৃপ্তির হাসি দিলেন আনভীর৷ কালো চুল, চিকন ফ্রেমের গ্লাস, ব্লু ডেনিম আর মুখের বাকা হাসি তোলপাড় লাগিয়ে দিয়েছে আমার হৃদয়ে। আনভীর ঝুঁকে এলেন আমার দিকে। ফিসফিসিয়ে বললেন,

‘ অনেক জ্বালিয়েছো আজ আমায় বেবিগার্ল। এর শোধ ডিরেক্ট বাসায় গিয়ে তুলবো। ‘

লিফট খুলতেই উনি বেরিয়ে গেলেন এবার। সাথে উনার সেই বডিগার্ডটা বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আমায় অবাক করে দিয়ে উনি গাড়ি নিয়ে চলে গেলেন সেখান থেকে। ইশারায় বললেন নাহিদ ভাইয়া কাউন্টারে আছে। আর উনি রাতে আসবেন। এগুলোর কোনো কিছুতেই মন নেই আমার৷ এখন বড়ই আফসোস হচ্ছে কেন যে মোবাইল সুইচ অফ করতে গেলাম! একটু আগের বলা কথাগুলো আবারও স্মৃতিচারিত হতে থাকলো,
‘ অনেক জ্বালিয়েছো আজ আমায় বেবিগার্ল। এর শোধ ডিরেক্ট বাসায় গিয়ে তুলবো। ‘
.
.
.
.
.
~চলবে ইনশাআল্লাহ

কাজিনের বিয়ে উপলক্ষে দাদুবাড়ি যাচ্ছি আগামীকাল। আর বিয়ে বাড়ি মানে তো বুঝেনই, হয়তো কিছুদিন গল্প অনিয়মিতভাবে দিতে হবে। তাই কিছুদিন কম্প্রোমাইজ করার জন্য অনুরোধ রইলো৷ ঢাকায় এসে আবার আগের মতো নিয়মিত দেওয়া শুরু করবো।

কেমন হয়েছে জানাবেন। ভুলক্রুটি মার্জনীয়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here