মেঘবৃত্ত পর্ব_১৯

মেঘবৃত্ত
পর্ব_১৯
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

এক ফুরফুরে সকাল। আর কটা দিন পরেই পৌষ মাস। পরিবেশে শীতের আগমনী বার্তা। বিছানায় শুয়ে আছে সদ্য বিবাহিত একজোড়া কপোত-কপোতী।
ফোনের আওয়াজে ঘুম ভাঙলো বৃত্তের। আসন্ন শীতের দিনে ঘুমটা বেশ কড়া হয়। সে ঘুমের রেশ কাটিয়ে বৃত্ত চোখ খুললো। বালিশের কাছে থেকে ফোন নেওয়ার জন্যে হাত বাড়াতেই হাতে টান পড়লো। বৃত্ত চকিতে তাকালো নিজ হাতের দিকে। মেঘার কোমল হাতের ভাজে ডুবে আছে তার বলিষ্ট পুরুষালি হাত। বৃত্ত অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। মেঘার সাথে এভাবে এক বিছানায় ঘুমাতে কাল রাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তার। তবুও ঘুমিয়েছে। পাছে, মেঘা কষ্ট পায় যদি? বৃত্ত সাবধানী হাতে মেঘার হাতের থেকে নিজ হাত মুক্ত করলো। ঘুমন্ত মেঘা একটু নড়েচড়ে সেই হাতটা কানের নিচে দিয়ে আবারও ঘুমিয়ে গেলো। বৃত্ত হাফ ছাড়লো। বালিশের কাছে থেকে ফোন নিয়ে রিসিভ করলো। রাতুল কল দিয়েছে। ওপাশ থেকে রাতুলের কণ্ঠ এলো,
— বৃত্ত? আজ একবার আসতে পারবি? সিদ্ধার্থের পক্ষ থেকে একটা পার্টি আছে।
বৃত্ত একপলক মেঘার দিকে তাকালো। বেঘোরে ঘুমাচ্ছে মেয়েটা। বৃত্ত সেদিকে তাকিয়ে উত্তর করলো,
— কয়টায় পার্টি?
— বারোটায়।
— ওহ। আচ্ছা। আমি আসবো। রাখছি।
বৃত্ত ফোন কেটে দিলো। শরীর থেকে কম্বল সরিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। বাথরুমে থেকে হাত মুখ ধুয়ে বের হলো। শার্ট-প্যান্ট পড়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালো। পারফিউমের বোতল শরীরে স্প্রে করে, চুলগুলো ঠিক করে নিলো। মেঘার দিকে আরও একবার চোখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে।

বসার ঘরে বৃত্তের মা-বাবা একসাথে বসে গল্প করছেন। বৃত্ত সেদিকে এগিয়ে গেলো। মায়ের দিকে চেয়ে বললো,
— মা, আমি একটু বেরুচ্ছি। ফিরতে লেট হতে পারে।
বৃত্তের মা হতবাক হলেন। চোখ দুটো দ্বিগুণ মেলে বললেন,
— এখন বেরুবি? দুটোর দিকে তো বৌভাত।
— উফ, মা। আমি বৌভাতের আগেই এসে যাবো। ডোন্ট ওয়ারী!
বৃত্তের মা তবুও অবাক চোখে চেয়ে রইলেন ছেলের দিকে। বৃত্ত পরোয়া করলো না। ঝটপট গায়ে জ্যাকেট জড়িয়ে বেরিয়ে পড়লো ঘর থেকে। যাওয়ার আগে বলে গেলো,
— নাস্তা বাইরে করে নিবো। চিন্তা করো না।
বৃত্তের মা ছেলের পথের পানে চেয়ে রইলেন। ছেলেটা হয়েছে আস্ত এক বেপরোয়া! কারো কথা কখনো শোনার মত মানুষ সে নয়। ছোটবেলা থেকে একরোখা, জেদী বলে কত মার’ই না খেয়েছে সে। মাঝেমধ্যে স্বামীর কাছে ছেলের দোষ ডাকতে হওয়ার নিজেও চোখ রাঙানির স্বীকার হয়েছেন। তবুও, ছেলেকে প্রাণের চেয়েও বেশি আদর করতেন। হয়তো, মায়ের এই আকাশসম আদরের জন্যেই আজ বৃত্তের এই বেপরোয়া আচরন!
বৃত্তের বাবা কোনোকালেই ছেলের এই বেপরোয়া আচরন পছন্দ করতেন না। বৌভাতের দিন ছেলের এভাবে চলে যাওয়া তিনি মোটেও ভালো চোখে দেখলেন না। গম্ভীর সুরে বললেন,
— ফাহিমা, তোমার ছেলেকে সামলাও। বুঝাও ওকে। বিয়ে হয়েছে তার। এখন তার এসব বেপরোয়া ভাব আমি মোটেও সহ্য করবো না।
বৃত্তের মা এখনো করুন চোখে সদর দরজার পানে চেয়ে রইলেন। স্বামী আর ছেলের এই অলক্ষণীয় লড়াইয়ে তিনি হতভম্ব, ক্লান্ত! এর শেষ কোথায়?
__________________
শরীরে টনটনে ঠান্ডা ছুঁয়ে দিতেই মেঘা গুটিশুটি হয়ে পাশ ফিরে ঘুমালো। তবুও, ঠান্ডাটা যেনো বেড়েই চলছে। একসময় ঠান্ডা সহ্যসীমার মাত্রা ছাড়ালো। মেঘা নিভুনিভু চোখে তাকালো। মাথার উপরে সর্বোচ্চ মাত্রায় ফ্যান চলছে। ফ্যানের ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগতেই মেঘা শীতে কুঁকড়ে উঠলো। শরীরের কম্বলটা বিছানার একপাশে এলোমেলো হয়ে পড়ে আছে। হঠাৎ মেঘার হুশ এলো, বৃত্ত কই? মেঘা সারাটা রুম একবার জরিপ করে নিলো। নাহ, বৃত্ত কোথাও নেই। তাহলে, কোথায় সে? মেঘা হুড়মুড়িয়ে বিছানা ছাড়লো। ঘড়ির কাঁটা সবে দশটা। এত সকাল কোথায় যেতে পারে বৃত্ত? মেঘা বাথরুম থেকে গোসল সেরে বের হলো। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলের টাওয়াল খুলে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকালো। পরনের জর্জেটের পাতলা শাড়ির আঁচল মাথায় তুলে ঘর থেকে বের হলো।
রান্নাঘরে বৃত্তের মা কিছু একটা বানাচ্ছেন। মেঘা সেদিকেই এগিয়ে গেলো। চুলোয় চায়ের পাতিল বসানো। মেঘা তা দেখে তাড়াহুড়ো করে বললো,
— আমি বানাচ্ছি আন্টি! আপনি রুমে গিয়ে রেস্ট নিন।
বৃত্তের মা পাতিলে দু চামচ চা পাতা দিয়ে হড়হড় কণ্ঠে বললেন,
— বাহ! আমার বাড়ির বউ আমাকে আন্টি বলে ডাকে। এটাই শোনার বাকি ছিলো আমার।
মেঘা কথাটা শুনে হঠাৎ’ই অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আবার কিছুটা লজ্জাও পেলো। তাড়াতাড়ি নিজেকে শুধরে বলে উঠলো,
— আমি দুঃখিত মা। আর হবে না।
বৃত্তের মা মুখ নীরব থাকলেন। এক কাপ চা রেডি করে ট্রেতে সাজিয়ে নিলেন। বললেন,
— তোমার শ্বশুর অন্যের হাতের চা খান না। আমাদের দুজনের চা’টা তুমি বানিয়ে নাও।
বৃত্তের মা চা নিয়ে চলে গেলেন বসার ঘরে। মেঘা তরিগরি করে দুকাপ চা বানিয়ে নিলো। অতঃপর, বউ শাশুড়ি মিলে রান্নাঘরে বসে চা বিলাস করলো। কথার পিঠে বৃত্তের মা বলে উঠলেন,
— বৃত্তের সাথে তোমার কোনো সমস্যা হয়েছে? এভাবে সকাল সকাল ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলো যে?
‘ বৃত্ত বেরিয়ে গেছে ‘ শুনে মেঘা একটু কষ্ট পেলো। আজকের দিনটা তো সে মেঘাকে দিতেই পারতো! আজ বৃত্তের মা মেঘাকে প্রশ্ন করছেন, কাল আরো তিনজন প্রশ্ন করবে? তখন? মেঘা কি করে সামলাবে এসব? মেঘা বুকটা খা খা করতে লাগলো। বৃত্তের একটুখানি ভালোবাসার অভাবে তার ছোট্ট হৃদয়টা দুমড়ে মুচড়ে যেতে লাগলো। এত কেনো কষ্ট হচ্ছে তার?
________________________
একটু পরেই বৌভাতের অনুষ্ঠান শুরু হবে। মেঘাকে ঘরে সাজানো হচ্ছে। আর মেঘা? সে তো গোমড়া মুখে অপেক্ষা করছে বৃত্তের। বৃত্ত এখনও আসে নি। মেঘার হাতে মোবাইল। তবুও মেঘা একবারও বৃত্তকে কল দিলো না। কেনো দিবে? কাকে দিবে? বৃত্ত তো তার বাউন্ডুলে আচরনে বহাল! শুধু মেঘাই বদলে গেছে। পরিস্থিতি মেঘাকে বদলে যেতে বাধ্য করেছে। এসব ভেবে মেঘা এক অস্থির নিঃশ্বাস ফেললো।

খানিক পর দরজায় টোকা পড়লো। ওপাশে বৃত্তের কণ্ঠ,
— মেঘ, মেঘ? দরজা খোল। আমার ড্রেস নিতে হবে। মেঘ?
বৃত্তের কণ্ঠ শুনে মেঘার অভিমান আরো একটুখানি বেড়ে গেলো। পাশে বসে থাকা একটা মেয়েকে বললো,
— সৃষ্টি, দরজাটা খুলে দাও না প্লিজ।
সৃষ্টি মেয়েটা আলতো হাসলো। কি সুন্দর মুখখানা তার! যেনো আল্লাহর নিজ হাতে গড়া! সৃষ্টি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো। বৃত্ত ঘরে প্রবেশ করলো। বৃত্তকে দেখে ঘরের বাকি সবাই মেঘাকে চোখ টিপ্পনী দিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলো। বৃত্ত বিছানার দিকে এগিয়ে এলো। স্বভাবসুলভ মেঘার দিকে চোখ যেতেই এক ভ্রু উচুঁ করে বললো,
— তুই আবারও ওসব আউল ফাউল মেকআপ করেছিস?
মেঘা মুখ ফোলালো, কথা বললো না। বৃত্তও পরোয়া করলো না। হেসে বললো,
— পাক্কা ভূত লাগছে দেখতে।
মেঘার এবার চরম রাগ লাগলো। তেতে উঠে বললো,
— লাগল লাগুক। তোর কি? যা না। তোর সেই জানের জিগার বন্ধুদের কাছে যা। এখানে কি? বিরক্তিকর লোক!
মেঘার এমন আচমকা রাগ দেখে বৃত্ত হতবম্ব হয়ে গেলো। মেঘার এমন হঠাৎ রাগের কারণটা তার কাছে অস্পষ্ট! বৃত্ত এগিয়ে এলো মেঘার কাছে। মেঘার পাশের চেয়ারেটাতে বসে মেঘার চোখে চোখ রাখলো। আলতো গলায় প্রশ্ন করলো,
— কি হয়েছে তোর? এত রাগ কেনো? কেউ কিছু বলেছে?
বৃত্তের ওমন আহ্লাদী কথা দেখে মেঘা আর রেগে থাকতে পারলো না। মেয়েলি শক্ত রাগ এক নিমিষেই তরলে পরিণত হলো। চোখ থেকে দু ফোঁটা চোখের অশ্রু বিসর্জন দিয়ে বললো,
— তুই সবসময় এমন করিস বৃত্ত। সবসময় আমাকে সবার সামনে ছোট করিস। আজও করিস। আমার খুব খারাপ লেগেছে, জানিস। তুই এমন কেনো বৃত্ত? আমি তোকে কেনো বুঝে উঠতে পারছি না।
মেঘার ওমন আকস্মিক কান্না দেখে বৃত্ত কিংক্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। কি করবে ভেবে না পেয়ে মেঘার মাথাটা নিজের বুকের কাছে চেপে ধরলো। পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত সুরে বললো,
— রিলাক্স মেঘ, রিলাক্স। আরে, এখানে এত কান্না করার কি আছে? কি হয়েছে আমাকে খুলে বল। না বললে আমি বুঝব কি করে?

#চলবে

আগের পর্ব
https://www.facebook.com/105343271510242/posts/269484155096152/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here