গল্পঃ প্রেমমোহ
লেখিকাঃ ফারজানা আফরোজ
পর্বঃ ১৭
বিয়ে নামক শব্দটা শোনে শুভ্রতা থেমে গেলো। সে ভাবেনি এমন কিছু হবে কিন্তু কি করবে সে এখন। সে তো বলেই দিয়েছে সে রাজি। তাহলে এখন আকাশের মৃত্যুর মাস না যেতেই তাকে বসতে হবে বিয়ের পিঁড়িতে?
আজকের আকাশটা অন্ধকার হয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর হয়তো প্রচুর বৃষ্টি হবে। ছন্নছাড়া ছন্নছাড়া ভাব আছে আকাশের মাঝে। শুভ্রতার কষ্টে আজকের আকাশও কষ্টে বিভোর।
আমার একলা আকাশ
থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালবেসে।
আমার দিনগুলো সব
রঙ চিনেছে তোমার কাছে এসে,
শুধু তোমায় ভালবেসে।
তুমি চোখ মেললেই
ফুল ফুটেছে আমার ছাদে এসে,
ভোরের শিশির ঠোট ছুঁয়ে যায়
তোমার ভালবেসে।
আমার একলা আকাশ
থমকে গেছে রাতের স্রোতে ভেসে,
শুধু তোমায় ভালবেসে।
নিজের রুমের এক কোণে দাঁড়িয়ে গান গাইছে শুভ্রতা। কিছুতেই আজ তার মন ভালো হচ্ছে না। ভার্সিটি যাবার জন্য নীলু বেশ কয়েকবার ফোন দিয়েছে কিন্তু সে যায়নি। একা থাকতে ইচ্ছা করছে তার। সকালে শুভ্রতাকে দেখতে না পেয়ে স্পন্দন আসলো শুভ্রতার রুমে। শুভ্রতার মলিন মুখটা দেখে তার বুক কেঁপে উঠলো। চুপিচুপি শুভ্রতার পিছু দাঁড়ালো সে,
–” হঠাৎ কি হলো?”
শুভ্রতা পিছনে ফিরে স্পন্দনকে দেখে চমকে উঠলো। চোখে পানি মুছে মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে বলল,
–” আপনি এইখানে হঠাৎ? কিছু লাগবে?”
–” প্রশ্নের বিপরীতে উত্তর দিতে হয়। উল্টো প্রশ্ন করা সাজে না।”
শুভ্রতা আবারও মুখ নিচু করে ফেললো। তার কথা বলতে ইচ্ছা করছে না একদম।
–” আকাশ বাতাসের কথা মনে পড়লো বুঝি?”
শুভ্রতার উত্তর না পেয়ে নিজেই বলতে লাগলো স্পন্দন। আকাশের নামটা তার শুনতে একটুও ভালো লাগে না। এই আকাশের কারণেই শুভ্রতার এই অবস্থা। আজ আকাশ বেঁচে থাকলে নিজ দায়িত্বে খুন করে ফেলত সে।
–” ওর নাম আকাশ। বাতাস কেন বলেন আজব।”
–” ও আমার কাছে বাতাস। ওই বাতাস না বাতাসা।”
বলেই স্পন্দন হাসতে লাগলো কিন্তু শুভ্রতার মুখে হাসি নেই। স্পন্দন সন্দিহান নজরে তাকালো শুভ্রতার দিকে। সে বুঝতে পেরেছে কিছু একটা হয়েছে কিন্তু সেই কিছু একটা যে কি তার কাছে অজানা।
–” শুভ্রতা?”
–” হুম।”
–” তুমি ঠিক আছো তো?”
–” হুম।”
–” আমার তো মনে হচ্ছে না। সত্যি করে বলো।”
–” আমাকে একটু একা থাকতে দিবেন প্লিজ? আর যা ঘটেছে পরে এমনিই বুঝতে পারবেন আমার কিছু বলতে হবে না।”
স্পন্দন আর কথা বাড়ালো না। চুপচাপ শুভ্রতার রুম থেকে বের হয়ে গেল।
পরের দিন সকালে,
শুভ্রতা ভার্সিটির মাঠে সবে মাত্র পা দিয়েছে তখনই ঝড়ের বেগে নীলু এবং আসু দৌঁড়ে ছুটে আসলো। শুভ্রতা ভয় পেয়ে চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলল। শুভ্রতার ভয়ার্ত মুখ দেখে হাসতে হাসতে শেষ দুজন। শুভ্রতা চোখ খুলে নীলু এবং আসুকে দেখে রাগী কণ্ঠে বলল,
–” এইভাবে কেউ ভয় দেখায় যদি হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত তখন?”
নীলু ভ্রু নাচিয়ে বলল,
–” কিছু হবে না। আমার নাতি নাতনির বিয়ের আগে তোর কিছু হবে না কিন্তু আজ আমাদের কথা না শুনলে তোর মাথা ফাটিয়ে ফেলবো।”
শুভ্রতা অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
–” কি কথা?”
আসু খুশি হয়ে বলল,
–” আমরা আগামীকাল পিকনিকে যাচ্ছি বাবু। জানিস আমাদের বাসে কে থাকবে? অন্তু স্যার। তুই তো গতকাল আছিস নাই তাই নীলু তোর নামও দিয়েছে তা অবশ্য সাকিব ভাইয়ের অনুমতি নিয়ে। আমরা কিন্তু কোনো না শুনবো না।”
শুভ্রতা চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
–” আমি কোথাও যাচ্ছি না। তোরা যেতে চাইলে যা আমাকে টানছিস কেন?”
নীলু ইমোশনাল নাটক করতে লাগলো সাথে আসুকেও বলল অভিনয় করতে। দুজনের অভিনয়ের জন্য শুভ্রতাকে হার মানতেই হলো। নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে বান্ধুবিদের হাসি খুশির রাখার জন্য শেষ পর্যায়ে সেও রাজি হলো। তবে আসুর একটা শর্ত। এই পিকনিকের উদ্দেশ্য হলেও অন্তু স্যারকে পটাতে হবে। যেকোনো উপায়েই হোক।
______________
সাকিবকে এখনও বিয়ের কথা বলা হয়নি। মিসেস সাবিনা বেগম ভেবেছেন বড় ছেলেকে বিয়ের কথা বলে সারপ্রাইজ দিবেন উনি। এমনিতেই কিছুদিন আগে এক ভিন্ন ধর্মের মেয়ের প্রতি আসক্ত ছিলে সে। তবে ভালোই হয়েছে সেই মেয়ের থেকে দূরে সরে গিয়ে শুভ্রতাকে পছন্দ করেছে তাছাড়া মিসেস সাবিনা বেগমেরও ভীষণ পছন্দ শুভ্রতাকে। হাসি খুশি ভাবেই উনি নিরবে বিয়ের আয়োজন করছেন। বিয়ের দুদিন আগে জানাবে সবাইকে। সবাই তো তখন চমকে উঠবে। সারপ্রাইজের কারণেই শুভ্রতাকে বলা হয়নি বরের নাম অর্থাৎ সাকিবের নাম। মনে মনে কত আশা নিয়ে তিনি বুনছেন স্বপ্ন।
রাতে খাবার টেবিলে,
এই প্রথম স্পন্দনের বাবা এসেছে একত্রে রাতের খাবার খাওয়ার জন্য। পরিবেশ খুব নিরব। কেউ কথা বলছে না চুপচাপ করে খেয়ে যাচ্ছে। মিসেস সাবিনা বেগম আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন বিয়ে বিষয় নিয়ে যেন তিনি কাউকে কিছু না বলে তাই উনিও কিছু বললেন না। হঠাৎ খাবার মাঝেই দিয়া বলতে লাগলো,
–” শুভ্রতা আপু?”
–” হুম।”
–” তুমি নাকি পিকনিকে যাচ্ছো?”
মুখটা কাঁদো কাঁদো করে বলল দিয়া। শুভ্রতা সবার মুখের দিকে তাকিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
–” হুম। সাকিব ভাইয়া যেতে বলেছে।”
সাকিবের নাম শোনে স্পন্দনের মুখে আর খাবার উঠলো না। তার ইচ্ছা করছে টেবিলে থাকা যাবতীয় জিনিস শুভ্রতার মাথায় ঢালতে। সব জায়গাতে কেন সাকিব থাকবে? স্পন্দন থাকলে দোষ কোথায়? স্পন্দনের নাম আনকমন বলে কি তাকে আড়ালে রাখবে সবাই?
সাকিবের বাবা মাথা তোলে তাকালেন শুভ্রতার উপরে। মুখটা দেখেই তিনি চমকে গেলেন। আসলেই তো একদম তার ছোট ভাইয়ের আদুরী মুখ। মা বাবা মারা যাবার পর যাকে নিয়ে উনি স্বপ্ন দেখেছিলেন। ছোট থেকে যাকে নিজের হাতে বড় করেছেন সেই প্রাণ প্রিয় ছোট ভাইয়ের অস্তিত্বকে দেখে প্রাণটা তার নিমিষেই হালকা হয়ে গেলো। তবে মুখে গম্ভীর ভাবটা টেনে বললেন,
–” তুমি যাবে আমাকে কেন বলনি? নাকি সেই অধিকার আমার নেই?”
–” না না তা নয়। আসলে আমি নিজেই জানতাম না। ভার্সিটি গিয়ে শুনি সাকিব ভাইয়া আমার পিকনিকে যাবার প্ল্যান করেছে। আমি তো যেতে চাইনি। এখন আপনি যদি বারণ করেন তাহলে আমি যাবো না বড় আব্বু।”
বড় আব্বু ডাকটা শোনে চোখের কোনে পানি জমে গেলো সাকিবের বাবার কিন্তু নিজেকে সামলিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বললেন,
–” সমস্যা নেই যেতে পারো। ঘুরাঘুরি করলে মন সজীব হয়ে উঠে। তাছাড়া তোমার মনের ও অবস্থা ভালো নয় ঘুরাঘুরি করলে বন্ধুদের সাথে আড্ডায় মেতে থাকলে শরীর মন দুটোই ভালো থাকবে। এই প্রথম সাকিব একটা ভালো কাজ করেছে তার জন্য সাকিবকে আমার ব্যাবসায়ের এক্সট্রা কাজ দিতে হবে যাতে সে ভবিষ্যতে আমার ব্যাবসা সামাল দিতে পারে। তো সাকিব আগামীকাল থেকে আমার যা কাজ তুমি সেসব করবে ওকে।”
সাকিবের কান্না পাচ্ছে এখন। সে চাইছিল নীলুর সাথে ঘুরতে। যেহেতু পুরাতন স্টুডেন্ট সেই হিসেবে যে যেতেই পারতো কিন্তু এখন বাবার জন্য যেতে পারবে না মনে মনে বাবার প্রতি ভীষণ বিরক্ত সে। অন্য দিকে সাকিবের বাবা ভাবছে, শুভ্রতা তিনদিনের জন্য ঘুরতে গেলে এই ফাঁকে সাকিবকে দিয়ে অফিসের কাজ সামলিয়ে উনি আর মিসেস সাবিনা বেগম চুপিচুপি বিয়ের সব আয়োজন করবেন। সেদিন শুভ্রতা ফিরে আসবে সেদিন সবাইকে বলবে বিয়ের কথা। অন্যদিকে স্পন্দন খাবার খাওয়া বাদ দিয়ে নিজের রুমে আসলো। এসেই অন্তুকে ফোন দিল,
–” আরেহ মামা অসময়ে ফোন কেন?”
–” শালা, শুভ্রতা যে স্টাডি ট্যুরে যাচ্ছে বললি না কেন?
–” ও গেলে তোর কি? তাছাড়া আজ তোর ভাষা এমন কেন রে? আমরা বললে বলতি থার্ড ক্লাস তো তুই এখন থার্ড ক্লাস কেন হলি?”
–” বালের কথা কম বল। আমার জন্য সিট রাখ অবশ্য শুভ্রতার পাশে যেন বসতে পারি।”
–” ছিঃ মামা ছিঃ। কিসব বলছিস তুই। ওই তুই ইন্ডিয়া নাকি এখন?”
–” বাল।”
স্পন্দন রাগে ফোন কেটে দিলো। এই ধরনের ভাষা সে কখনোই বলতো না কিন্তু আজকে কি হলো। বাজে গালি কেন ইউজ করলো? মনে মনে শুভ্রতাকে দোষারোপ করছে। আজ তার মুখে বাজে শব্দ ইউজ করেছে শুধু মাত্র শুভ্রতার কারণে।😒
অন্যদিকে অন্তু পড়েছে মহা চিন্তায়। সে এখন কিভাবে স্পন্দনের জন্য সিট রাখবে। আসু যে তার সাথে বসবে সে জানে, নীলাভি আর শুভ্রতা একত্রে বসবে তাছাড়া সিট ফিলাপ হয়ে গেছে। সকালে বললেও হয়তো কিছু করা যেত। মনে মনে ভাবছে,
–” আমি যদি ওর জন্য একটা সিট না রাখি তাহলে আমার মান সম্মান দিয়ে ও হারিকেন জ্বালাবে ভবিষ্যতে আমার বাচ্চা কাচ্চা না হওয়ার কারণও হতে পারে ও। আজ যে হারে গালিগালাজ করেছে আগামীকাল মারতে পারে। রাগের বশে যদি আমার….. এই না না আগামীকাল আমি ভার্সিটি গিয়ে লুকিয়ে থাকবো। আমার সিট ওকে দিয়ে দিবো তবুও ভাই বাচ্চার বাপ হতে চাই আমি।”
চলবে,
বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ১১০০+ শব্দ আজ।