গল্পঃ প্রেমমোহ লেখিকাঃ ফারজানা আফরোজ পর্বঃ ১৬

গল্পঃ প্রেমমোহ
লেখিকাঃ ফারজানা আফরোজ
পর্বঃ ১৬

শুভ্রতা সাকিবের একটি হাত ধরে কিসব বলছে আর হাসছে। স্পন্দনের ইচ্ছা করছে এক্ষুনি গিয়ে শুভ্রতাকে খুন করে ফেলতে। রাগে গজগজ করতে করতে দ্রুত পা চালিয়ে সেখানে যেতেই শুনলো,

–” খুব তাড়াতাড়ি বিয়ের ব্যাবস্থা করতে হবে। এতদিন ভেবেছিলাম আমার ভালোবাসা একতরফা কিন্তু আজ বুঝলাম আমার ভালোবাসা দু’তরফা থেকেই।”

সাকিবের কথা শোনে স্পন্দনের মাথা রাগে টগবগ করে ফুটছে। বড় ভাই হিসেবে সে এখনও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু অন্য কেউ হলে হয়তো এক্ষুনি মেরে হসপিটালে পাঠিয়ে দিতো। শুভ্রতা হাসছে সাকিবের কথা শোনে। স্পন্দন বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,

–” আমি কিছু বললেই তো একদম চুপ করে থাকো তখন কই থাকে এই হাসি? তখন তো দেখি চোখে মুখে কান্না কান্না ভাব। ইচ্ছা করতেছে আজ সারাদিন তোমাকে টমির সাথে বেঁধে রাখতে। টমিকে তো বড্ড ভয় পাও। আমি টমিকে শিখিয়ে দিব ভয় দেখানোর জন্য তখন বুঝবে ভয় কিংবা কষ্ট কি মিসেস চাচাতো বোন।”

সাকিব নীলুকে কিছু বলতে যাবে তখনই তার চোখ পড়ল স্পন্দনের উপর। শুভ্রতার হাত ছেড়ে দিয়ে মুখে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলিয়ে বলতে লাগলো,

–” কখন আসলি তুই?”

–” অনেক্ষন ধরে।”

–” তাহলে দাঁড়িয়ে কেন আছিস? আয় বোস এসে।”

স্পন্দন গিয়ে একদম সাকিব এবং শুভ্রতার মাঝে বসলো। শুভ্রতা বড় বড় চোখ করে তাকালো স্পন্দনের দিকে। সামনে জায়গা থাকতে সে গিয়ে তাদের মাঝখানে কেন বসেছে সেই সাইন্স ফিকশন বুঝলো না শুভ্রতা। স্পন্দন খেয়াল করলো আসু তাকে দেখে পালাচ্ছে তাই ধমকের সুরে বলল,

–” ওই মেয়ে পালাচ্ছ কেন? আমি কি বাঘ নাকি ভাল্লুক যে খেয়ে ফেলবো। আরেকবার যদি দেখেছি আমাকে দেখে পালাচ্ছ কিংবা ভয় পাচ্ছো তাহলে আগের বার দিয়েছিলাম দুটো থাপ্পড় এখন দিবো দশটা থাপ্পড়। বুঝতে পেরেছো আমার কথা?”

আসু মাথা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে বুঝালো সে বুঝতে পারছে। স্পন্দনের দিকে চোখ যেতেই আবারো আগের মত নর্মাল হয়ে বসে পড়লো। শুভ্রতা তখন রাজ্যর বিরক্তি নিয়ে বলতে লাগলো,

–” ভয় পাচ্ছে বলেই তো পালাচ্ছে। এই যে এসেই ধমকাধমকি শুরু করে দিয়েছেন তো আপনাকে ভয় পাবে না তো মিশা সওদাগরকে ভয় পাবে ? জন্মের সময় আন্টি আপনার মুখে মধু দেয় নাই বুঝায় যায়।”

সাকিব তখন স্পন্দনকে আরেকটু রাগানোর জন্য বলল,

–” আরেহ ওকে তো আমরা হসপিটাল থেকে কুড়িয়ে আনছি। আমার যে ভাই হইছিল তার সাথে একে বদলে দেওয়া হইছিল তাই তো দেখো না ওর বিহেভ আমাদের মতন না।”

সাকিবের কথায় স্পন্দনের কিছুই হলো না। সে ঘাসের উপর এক পা রেখে অন্য পা হাঁটুর উপরে তুলে আড়ামছে অর্ধেক শুয়ে থাকা অবস্থায় সবার দিকে এক পলক তাকিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলতে লাগলো,

–” আজ একটা প্রেমিকা থাকলে খুব ভালো হতো। কত আরামে শুয়ে আছি সে তো বাদাম মুখে তুলে খাইয়ে দিতে পারতো।”

স্পন্দনের এই ধরনের কথা শোনে অবাক সবাই বিশেষ করে সাকিব। চোখ দুটো রসগোল্লার মত বড় বড় করে তাকিয়ে রইল বেশ কিছুক্ষণ। নীলু অবাক হয়ে বলতে লাগলো,

–” এই তোমরা না বলেছিলে এই ছেলে নিমপাতা। মুখে কোনো রস নেই। সব সময় ছাগলের তিন নাম্বার বাচ্চার মত বকা ঝকা করে তাহলে আজ এইসব কথা কেন বলছে। শুভ্রতা তুই তো বলিসনি স্পন্দন ভাইয়ার যে একটা যমজ ভাই আছে। আর সাকিব তুমিও তো বলনি।”

সাকিব নীলুর কথা শোনে তার দিকে তাকিয়ে পরে স্পন্দনের দিকে তাকালো। নাহ স্পন্দন এখনও আগের মতই আছে। নিঃশ্বাস ছেড়ে মৃদু স্বরে বলল সাকিব,

–” আমিও জানতাম না নীলু। আজকেই জানলাম আমরা দুই ভাই না তিন ভাই।”

বড় ভাইয়ের কথা শোনে আধশোয়া থেকে বসলো স্পন্দন। ভাইয়ের চুলগুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিয়ে বলল,

–” ওভার অ্যাক্টিংয়ের দোকান একটা। নিজের ওনলি ওয়ান ভাইটাকে এখন চিনছে না। প্লিজ এক গ্লাস পানি আনো আজ আমি আমার একমাত্র বড় ভাইকে এক গ্লাস পানিতে ডুবিয়ে মারবো। এমন মীরজাফর ভাই আমার লাগবে না।”

স্পন্দনের কথা শোনে শুভ্রতা নিজের হাসি দমিয়ে রাখতে না পেরে জোরে জোরে হাসতে লাগলো। শুভ্রতার হাসি দেখে নীলু এবং আসুও হাসা শুরু করলো। সত্যি বলতে তাদেরও ভীষণ হাসি পাচ্ছিল স্পন্দনের কথা শোনে কিন্তু ভয়ে হাসেনি যখন দেখলো শুভ্রতা হাসছে তখন তারাও হাসি কন্ট্রোল করা থেকে বিরত হয়ে হাসতে লাগলো।

স্পন্দন অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। এই প্রথম সে নিজের মাধ্যমে শুভ্রতাকে হাসাতে পেরেছে। ভাবলেই তার মন বারবার নেচে উঠছে। প্রিয় জনের হাসি মাখা মুখটা কতখানি সুন্দর হতে পারে স্পন্দনের জানা ছিল না। সে তো এখন শুভ্রতার হাসি দেখার জন্য সবকিছু করতে পারবে। প্রেমমোহ শব্দটির মানে সে এতদিন বুঝেনি কিন্তু আজকে বুঝলো। তার মন থেকে কেউ যেন বলছে,

কিরে স্পন্দন শুভ্রতার প্রেমমোহে পরে গেছিস বুঝি? চোখের প্রেম? সৌন্দর্যের প্রেম? রাগের প্রেম নাকি হাসির প্রেম??

স্পন্দন মুচকি হেসে নিজের মনকে উত্তর দিল,

–” শুভ্রতা নামক মানুষটির প্রেমে পড়েছি আমি। যখন তাকে যে রূপে দেখি সেই রূপের মোহে পরে যাই আমি।”

স্পন্দনের মুচকি হাসি দিকে সবাই সন্দেহজনক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। স্পন্দনের সেদিকে খেয়াল নেই। সাকিব হঠাৎ স্পন্দনের কাঁধে হাত রাখতেই স্পন্দন বাস্তবে ফিরে আসলো। চারজন মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে সন্দিহান নজরে। স্পন্দন মুখটা গম্ভীর করে বলতে লাগলো,

–” এতক্ষণ ফানি মুডে ছিলাম বলে কেউ আমাকে সেরকম ভেবো না আমি যেমন আগে ছিলাম ভবিষতে তেমনই থাকবো আশা করি বেশি কিছু ভাববে না আমাকে নিয়ে।”

স্পন্দনের এমন কথা শোনে মন খারাপ হয়ে গেল সবার। স্পন্দন নিজের ভিতরের অনুভূতি বাহিরে প্রকাশ করতে চায় না বলেই এই ব্যবহারটা করলো। শুভ্রতা ছোট্ট একটা শ্বাস বের করে বলল,

–” এইবার আমাদের বাসায় ফিরতে হবে। অনেক্ষন ধরে আড্ডা দেওয়া হচ্ছে। বাকি কথা আগামীকাল হবে।”

শুভ্রতার কথা সবাই সায় দিল। একে একে সবাই নিজেদের বাসায় চলে গেলো।

_________________

জীবন আর প্রকৃতির গোধূলী বেলা সূর্যের আলো অস্ত যাবার মধ্য দিয়ে একটি দিনের ইতি ঘটে।
আলোকিতময় পৃথিবীর সব কিছু যেনো বিলীন হয়ে হারিয়ে যায় নিভে যায় আলোকিত সূর্যের অলোকিত প্রদীপ শিখা। পরিশেষে গোধূলি পেরিয়ে দেখা মিলে সন্ধ্যা। বেলা শেষে জীবন থেকে কমে যায় একটি দিন। চলে যাওয়া দিনগুলো কখনো ফিরে আসবে না। শুভ্রতা এক মনে তাকিয়ে আছে গোধূলী বেলা সূর্যের পানে। তার ইচ্ছা ছিল কোনো একদিন তার ভালোবাসার মানুষের সাথে ভোরের সূর্য ওঠা দেখবে, সন্ধ্যার সূর্য অস্ত যাওয়া দেখবে, গোলাকার চাঁদের আলোতে দুজন রাত বেরাতে ঘুরতে যাবে, শীতের সময় মাঝ রাতে দুজন এক চাদরে গা মোড়ে কফি নিয়ে ছাদে আড্ডা দিবে। শীতে যখন সে খনখন করে কাঁপতে থাকবে তখনই তার প্রিয় মানুষটি তাকে কোলে উঠিয়ে রুমে নিয়ে যাবে।

–” শুভ্রতা?”

মিসেস সাবিনা বেগমের কথায় কল্পনা জগৎকে বিদায় জানিয়ে বাস্তবে ফিরলো শুভ্রতা। মিসেস সাবিনা বেগমের খুব কষ্ট হচ্ছে কিভাবে উনি এই বিয়ে বিষয়ক কথা শুভ্রতার সামনে বলবে। মেয়েটার চোখ বলে দিচ্ছে সে আকাশকে কত ভালোবাসে। মেয়েটার উপরে জোর করা কি ঠিক হবে? কিন্তু স্বামীর কথা মনে করে শুভ্রতার পিছুটানকে সরাতে তো হবেই। যে নেই তার কথা ভেবে বাকি জীবন নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না। এই না যে একটা বাচ্চা আছে। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে বাকি জীবন হাসি খুশি মনে পার করে দিতে পারবে। গভীর শ্বাস ছেড়ে শুভ্রতার মাথায় হাত বুলালেন। শুভ্রতা নিমিশিয়েই জড়িয়ে ধরলো স্পন্দনের মাকে।

–” ভীষণ ক্লান্ত লাগছে তোর?”

–” উহু।”

–” তাহলে মন খারাপ কেন?”😞

–” পিছুটান পিছু ছাড়ছে না আন্টি। যতই তাকে দূরে সরাতে চাই কিন্তু বেলা শেষে ঠিকই সে সামনে আসে।”

–” একটা কথা বলব। কথাটা আমার নয় তোর বড় আব্বুর। জানিস উনি তোকে মেনে নিয়েছেন। তোর আব্বুর সমস্ত অন্যায় উনি ক্ষমা করে দিয়েছেন। তোর জন্য ভীষণ চিন্তা উনার।”

শুভ্রতা খুব খুশি হলো। কোনোদিন বাবা মায়ের আদর সে পায়নি। এইখানে এসে একজন মা পেয়েছে এইবার বুঝি বাবাও পেয়ে যাবে। নিমিষেই মনের ভিতরে জমে থাকা কষ্ট একেবারেই উধাও হয়ে গেল।

–” সত্যিই আন্টি? আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না।”

–” হুম। তবে উনি তোর জন্য একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বলেছে যদি উনাকে বাবার মত মনে করিস তাহলে উনার সিদ্ধান্তে যেন রাজি হয়ে যাস।”

–” বড় আব্বু আমার জন্য যা সিদ্ধান্ত নিবে তা আমার ভালোর জন্যই নিবে। তুমি বড় আব্বুকে বলে দিও উনার সব কথাতেই রাজি আমি। উনি আমাকে মেনে নিয়েছেন এইটাই আমার জন্য অনেক।”

–” ভেবে বলছিস তো?”

–” হুম।”

–” খুশি হলাম। তাহলে আমি তোর বড় আব্বুকে বলে আসছি তুই এই বিয়েতে রাজি। আশা করি আমাদের কথার মান তুই রাখবি।”

বিয়ে নামক শব্দটা শোনে শুভ্রতা থেমে গেলো। সে ভাবেনি এমন কিছু হবে কিন্তু কি করবে সে এখন। সে তো বলেই দিয়েছে সে রাজি। তাহলে এখন আকাশের মৃত্যুর মাস না যেতেই তাকে বসতে হবে বিয়ের পিঁড়িতে?

চলবে.?

বানান ভুল ক্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। রি-চেইক করা হয়নি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here