নীল চিরকুট পাঠ-২৭

# নীল চিরকুট
# লেখনীতে- নৌশিন আহমেদ রোদেলা

২৭.

প্রকৃতিতে শরৎের ছোঁয়া লেগেছে মাত্র। নিকষকালো আকাশে এখন শুভ্র মেঘের খেলা। চারপাশে ফুরফুরে বাতাস থাকলেও ভ্যাপসা গরম অস্থির করে তুলছে জীবন। আরফান বারান্দায় রাখা বেতের সোফায় বসে আছে। গায়ে পাতলা টি-শার্ট আর টাউজার। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। পা-দুটো টি-টেবিলে রেখে কোলের উপর ল্যাপটপ। কপালে হালকা ভাজ। হাতের দশ আঙ্গুল কী-বোর্ডে নিরন্তর ছুটে চললেও মস্তিষ্কে ঘুরে বেড়াচ্ছে জটিল এক প্রশ্ন। মেয়েটি কি সত্যিই শ্যামলতা? এক ঝলক দেখেই এমন কিছু ভেবে নেওয়া কি ঠিক হচ্ছে আরফানের? শ্যামলতার পা দুটো যে আরফানের ভীষণ পরিচিত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এতোগুলো বছরে পায়ের আঙ্গুলগুলোর দৈর্ঘ্য-প্রস্থ পর্যন্ত মুখস্থ করে ফেলেছে আরফান। তবুও কোথাও যেন একটা কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। এক পলকের দৃষ্টিকে ততটা বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। মেয়েটাও তো স্পষ্ট কিছু বলছে না। বারবার ফোন বা ম্যাসেজ দেওয়াটাও অস্বস্তির। সেদিন যদিও নিজের অস্বস্তি, আত্মসম্মান পাশে রেখে রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসেছিল দু’জন কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না। গোটা দুই ঘন্টা বসে থেকে দুই থেকে তিনটি কথা বলতে পেরেছিল আরফান। তারওপর মেয়েটি কেমন উদ্ভট কাজ করে বসল। হুট করেই উঠে চলে গেল। কি আশ্চর্য! মেয়েটাকে মাঝে মাঝে পাগল মনে হয় আরফানের। কিন্তু পরমুহূর্তেই তার নিবিড় চোখদুটোর কথা মনে পড়ে। মেয়েটির চোখে কি সত্যিই অন্যরকম কিছু ছিল না? একদম অন্যরকম কিছু অনুভূতি? দরজা খোলার শব্দে বারান্দা থেকে রুমের ভেতর উঁকি দিল আরফান। আগুন্তককে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ল্যাপটপের স্যাটার নামিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। প্রায় সাথে সাথেই ছোটখাটো, সুন্দরী এক তরুণী এসে বসল সোফায়। সারা শরীরে তার শিশুসুলভ চঞ্চলতা। চোখে-মুখে স্বভাবসুলভ হাসি। হাতে দুই কাপ কফি। আরফান চশমাটা খুলে মনোযোগী চোখে তাকাল। মেয়েটি একটা কাপ এগিয়ে দিতেই মৃদু হাসল আরফান। কফি কাপ হাতে নিতে নিতে বলল,

‘ তোমার কফির হাত আগের থেকে ভালো হয়েছে। গুড। আই এম ইম্প্রেস।’

মেয়েটি হাসল না। চোখদুটোতে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বলল,

‘ তুমি বিয়ে কবে করছ? তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছ। সাথে আমিও বুড়ি হয়ে যাচ্ছি।’

আরফান হেসে বলল,

‘ তোমার বয়স কত? তেইশ অথবা চব্বিশ? তেইশ-চব্বিশ বছরে কেউ বুড়ি হয় না।’

‘ মেয়েরা পঁচিশ বছরেই বুড়ি হয়ে যায়। তুমি বুঝবে না। যারা সারাদিন পড়াশোনা করে তাদের এসব বুঝার কথা নয়। এখন বলো বিয়ে কবে করছ?’

আরফান হাসল তবে প্রত্যুত্তর করার চেষ্টা করল না। ল্যাপটপটা টি-টেবিলের উপর রেখে পা নামিয়ে বসল। মেয়েটি কৌতূহলী কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘ কাজ করছিলে? সারাদিন এতো কী কাজ করো? খুব ইম্পোর্টেন্ট নাকি অল্প ইম্পোর্টেন্ট?’

‘ খুব ইম্পোর্টেন্ট। রিসার্চের রিপোর্ট লিখছিলাম। আগেরবার ল্যাপটপটাই তো গেল।’

‘ গেল! কই গেল?’

আরফানের সাবলীল জবাব,

‘ একজন নদীতে ছুঁড়ে ফেলেছে। এখন নদীর তলদেশে থাকলে থাকতে পারে। একজেক্ট বলতে পারছি না।’

মেয়েটি আঁতকে উঠে বলল,

‘ কি সাংঘাতিক! তোমার রাগ হচ্ছে না? আমি হলে ল্যাপটপের সাথে সাথে তাকেও ধাক্কা দিয়ে নদীতে ফেলে দিতাম।’

আরফান শব্দ করে হাসল। কাপে চুমুক দিয়ে বলল,

‘ তখন রাগ হয়েছিল।’

‘ মারাত্মক রাগ হয়েছিল?’

‘ হ্যাঁ। মারাত্মক রাগ হয়েছিল কিন্তু এখন সেই রাগ মোটামুটিতে নেমে এসেছে। কিছুদিন পর মোটামুটি থেকে শূন্যতে নেমে আসতে পারে। এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না।’

মেয়েটি সোফায় আয়েশ করে বসল। চোখ ছোট ছোট করে কৌতূহল নিয়ে বলল,

‘ কিন্তু সব রেখে ল্যাপটপটাই নদীতে ফেলল কেন? আর ঢাকা শহরে নদী কোথায়?’

‘ কক্সবাজারে গেলাম যখন, তখন ফেলেছে। কেন ফেলেছে, জানি না। ল্যাপটপ ফেলে দেওয়ার মতো আহামরি কোনো কারণ আমি খুঁজে পাইনি। আমার তখন মনে হয়েছিল মেয়েটি বদ্ধ পাগল। এখনও অবশ্য তাই মনে হয়। তবে সেই ভাবনাটা পরিবর্তন হলেও হতে পারে। হুট করেই মনে হচ্ছে, মেয়েটা আসলে বদ্ধ পাগল নয়। মাথায় একটু সমস্যা আছে মাত্র।’

কথাটা বলে হেসে ফেলল আরফান। মেয়েটি চোখ বড় বড় করে বলল,

‘ কি বলছ! ওটা একটা মেয়ে ছিল?’

আরফান মাথা নাড়ল। মেয়েটি চোখ দুটো ছোট ছোট করে সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ল,

‘ সুন্দরী ছিল?’

আরফান কফি কাপটা টেবিলের উপর রেখে হাসল। মেয়েটির দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

‘ সুন্দরীই বলা যায় বোধহয়। তেমন খেয়াল করে দেখিনি কখনও। পরের বার দেখা হলে খেয়াল করে দেখব বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। পুরো এক ঘন্টা মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বুঝার চেষ্টা করব মেয়েটি আসলেই সুন্দরী কি-না। তারপর তোমায় এসে অপিনিয়ন জানাব। আপাতত আমার শার্টটা চট করে ইস্ত্রি করে দাও তো নিদু। ফ্যাস্ট, আমি বেরুব।’

রুমের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত ক্রমাগত পায়চারী করছে নম্রতা। হাতে বই। পড়ায় মনোযোগ আসছে না। বিছানায় বেশ আয়েশ করে বসে আছে নীরা। সেকেন্ডর জন্য বিরতি না নিয়ে নিরন্তর পড়া মুখস্থ করছে সে। নম্রতা পায়চারী থামিয়ে বিরক্ত চোখে তাকাল। প্রচন্ড অভিমান নিয়ে নীরার পাশে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ল। পুরো বিছানা হঠাৎ কেঁপে উঠাই চমকে উঠল নীরা। অবাক চোখে নম্রতার দিকে তাকিয়ে থেকে বুকে ফু দিল। বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করল,

‘ কি হলো? এমন ডাইনোসরের মতো লাফাচ্ছিস কেন?’

‘ ডাইনোসর? আমাকে তোর ডাইনোসর মনে হচ্ছে? আমি যে টেনশনে টেনশনে মরে যাচ্ছি সেদিকে তোর কোনো দৃষ্টি নেই? তুই আমার এমন বান্ধবী?’

‘ পরীক্ষার সময় টেনশনে থাকবি এটাই স্বাভাবিক। টেনশনে না থাকলে না-হয় ভিন্ন কিছু হতো।’

নম্রতা বিরক্ত হয়ে বলল,

‘ আরে বাপ! এই টেনশন সেই টেনশন নয়। এটা হলো হৃদয় ঘটিত টেনশন।’

নীরা সরু চোখে তাকাল। সন্দিহান কন্ঠে বলল,

‘ কেন? হৃদয়ে আবার কি হলো? প্রেমিক পুরুষ তো পেয়েই গেলি। এখন তো তোর খুশিতে মরে যাওয়া উচিত। খুশি না হয়ে এতো টেনশন কেন?’

নম্রতা বিছানায় এক পা তুলে নীরার দিকে ঘুরে বসল। ঠোঁট উল্টে বলল,

‘ এখানেই আসল সমস্যা। ওই প্রেমিক পুরুষই সব সমস্যা। ওই ডক্টর আসলেই ‘সে’ কি-না সেই কনফিউশানটা নাহয় আমার পায়ের ছবিতে অনেকাংশ ক্লিয়ার হয়েছে। কিন্তু ডক্টর আর ‘সে’ কে মেলাতে গেলেই কেমন হেঁচকি উঠে যাচ্ছে আমার। দ্বিতীয়ত, লাস্ট উইকে পরীক্ষার জন্য ফোন ধরা ছোঁয়ার বাইরে ছিল। ডক্টর অসংখ্যবার ফোন দিয়েছে, আমি ধরিনি। এখন এক সপ্তাহ হয়ে গেল সে ফোন টোন কিছু দিচ্ছে না। আমি নিজে থেকে ফোন দিব কি-না সেটাও বুঝতে পারছি না। প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছে।’

এটুকু বলে থামল নম্রতা। তারপর প্রচন্ড অভিমান নিয়ে বলল,

‘ আমি নিজে থেকে কখনই যোগাযোগ করব না। এতোদিন আমি চেষ্টা করেছি, কষ্ট করেছি, বেহায়া হয়েছি। এবার কি ওর চেষ্টা করা উচিত নয়? এবার সে যোগাযোগ না করলে আমি সত্যি সত্যিই বিয়ে করে ফেলব নীরু। আমার আর ভালো লাগছে না।’

নীরা হেসে ফেলল। বইটা উল্টে রেখে বলল,

‘ বিয়ে করলে সাফার সবচেয়ে বেশি তুই-ই করবি। পত্রপ্রেমিক নিয়ে তুই যে পরিমাণ পসিসিভ। তাতে দেখা গেল, বিয়ে করলি ঠিক আছে কিন্তু বাসর ঘরে বসে ফোন দিয়ে ন্যাকামো শুরু করে দিবি। “দোস্ত! আমি এই ব্যাটার সাথে বাসর টাসর কিছু করব না। আমার দমবন্ধ লাগছে। আমি এই ব্যাটাকে স্বামী হিসেবে মানি না, মানব না। আমার ডাক্তার আমাকে এনে দে ব্যস!” তখন যত প্যারা আমাদের। তোর কান্নাকাটি দেখে নাদিম, অন্তুরা সত্যি সত্যিই তোকে বাসর ঘর থেকে ভাগিয়ে আনতে পারে। এদেরও বিশ্বাস নেই। পরের দিন খবরের কাগজে আমাদের ছবি। আহ! হিট! হিট।’

নীরার বলার ভঙ্গিতে হেসে ফেলল নম্রতা। নীরা হেসে বলল,

‘ হাসিস না। সিরিয়াসলি বলছি। তুই যদি অতো কান্ড করিস তাহলে নাদিম নির্ঘাত মধ্যরাতে তোর জামাইকে গিয়ে বলবে, আরে! এতো চাপ নিতাছ কেন মাইরি? বাংলাদেশে কি বউয়ের অভাব পড়ছে নাকি? এক বউ গেলে আরেকটা আসবে। আরেকটা গেলে আরোও একটা আসবে। আসতেই থাকবে।টেনশন করে চান্দি গরম কইরো না। তোমাকে আমরা আরেকটা বউ এনে দেব। দরকার পড়লে বউয়ের বাজার বানাই দেব। কিন্তু আমার বন্ধবীরে দেব না মামা। বান্ধবীর জামাই পছন্দ হয় নাই। সো, জামাই চেঞ্জ।’

নীরা এটুকু বলতেই হুহা করে হেসে উঠল নম্রতা। নীরাও খুব হাসল। নম্রতা হাসতে হাসতে বলল,

‘ হতেই পারে। নাদিমের পক্ষে সব সম্ভব।’

তারপর হঠাৎ-ই গম্ভীর হয়ে বলল,

‘ তাহলে তুই কিভাবে পারবি? তোর দমবন্ধ লাগবে না নীরু?’

নীরার মুখের ভাব পরিবর্তন হলো না,

‘ আমার কেন দমবন্ধ লাগবে?’

‘ তুই অন্তুকে ভালোবাসিস। অন্তুকে ভালোবেসে অন্যজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছিস। তবু বলছিস দমবন্ধ কেন লাগবে?’

নীরা হেসে বলল,

‘ ছোটবেলা এঞ্জেল হওয়ার স্বপ্ন দেখতি না নমু? সুন্দর দুটো ডানা মেলে পরীদের মতো উড়ে বেড়ানোর স্বপ্নটা কোন মেয়ের ছিল না বলত? অথবা বিশাল রাজ্যের রাজকুমারী হয়ে যাওয়া। গা ভর্তি গহনা। ঘোড়ায় চড়া রাজপুত্র। এতো এতো দাসীর স্বপ্ন তো সবাই দেখতো। সেই স্বপ্ন পূরণ না-হওয়াতে কি দমবন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছিস? ভালো আছিস। নতুন নতুন স্বপ্ন দেখছিস। চোখে অসংখ্য স্বপ্ন থাকলে দু-একটা অসম্ভব স্বপ্ন ভুলে থাকা যায় নমু। অসম্ভব স্বপ্নগুলো অবসরে অনুভব করে আনন্দ পাওয়ার জন্যই হয়। বাস্তবে পাওয়ার জন্য নয়।’

নম্রতা হঠাৎ কোনো কথা খুঁজে পেল না। কয়েক সেকেন্ড অপলক চেয়ে থেকে বলল,

‘ অন্তুকে এটলিস্ট জানাতে তো পারিস। অথবা নাদিম বা রঞ্জন?’

‘ অন্তুকে বলার প্রশ্নই আসে না। আর নাদিম – রঞ্জনকেই বা কি বলব? এটা কি বলার মতো কিছু হলো? আমার আবেগ, আমার অনুভূতি আমার মধ্যে আবদ্ধ থাকাটাই কি ভালো নয়? তুই শুধু শুধু এতো ভাবছিস। বাদ দে তো।’

নম্রতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই মেয়েটাকে সে বুঝে না। কিচ্ছু বুঝে না।

নাদিম ভ্রু কুঁচকে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। ঘড়িতে তিনটা বাজতে আর তিন মিনিট বাকি। মৌশিকে পড়ানোর কথা দুইটা ত্রিশে। অথচ তার খবর নেই। মৌশির সময় জ্ঞানহীনতাই নাদিম বিরক্ত। চরম বিরক্ত। ঘড়ির কাঁটা যখন তিনটা দুইয়ের ঘরে গেল ঠিক তখনই মৌশির আগমন ঘটলো। ব্যস্ত ভঙ্গিতে বই-খাতা বের করতে করতে বলল,

‘ সরি, স্যার।’

নাদিম জবাব দিল না। মৌশিকে আজ স্বাভাবিক লাগছে। মুখে বা শরীরে আলাদা কোনো সাজগোজ নেই। সাদা রঙের একটা টপের ওপর লাল রঙের স্কার্ফ ঝুলছে। চোখদুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। মৌশি কাঁদছিল? কাঁদলে কাঁদতে পারে। এই বয়সী মেয়েদের কান্নাকাটি করা আহামরি বড় কোনো বিষয় নয়। এরা কথায় কথায় ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কেঁদে ফেলবে, এটাই স্বাভাবিক। নাদিম গম্ভীর মুখে পড়ানো শুরু করল। মৌশি হঠাৎ-ই প্রশ্ন করল,

‘ আপনার বন্ধু এখন কেমন আছে, স্যার?’

নাদিম জানাল, ‘ ভালো আছে।’

‘ উনি কি শেষমেশ পরীক্ষাগুলো দিচ্ছেন?’

নাদিম ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল। কপাল কুঁচকে বলল,

‘ আমার বন্ধুর যে পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল না সেটা তুমি কি করে জানলে?’

মৌশি হেসে বলল,

‘ আমি জানি। আমি অনেক কিছুই বুঝে ফেলতে পারি।’

নাদিম বিরস কন্ঠে বলল,

‘ ও আচ্ছা।’

মৌশি বোধহয় খানিক হতাশ হলো। নাদিম প্রত্যুত্তরে কিছু জিগ্যেস করবে, সামান্য কৌতূহল দেখাবে এমনটাই হয়ত আশা করেছিল মৌশি। মৌশি মৃদু কন্ঠে বলল,

‘ আমি আরেকটা বিষয় বুঝে ফেলেছি।’

‘ কি বিষয় বুঝে ফেললে?’

‘ আপনি অতিশীঘ্রই আমাদের বাড়িতে আসা বন্ধ করে দিবেন। মৌশি নামের একটা মেয়েকে যে পড়াতেন সেটাও ভুলে যাবেন। আমি ঠিক বলছি না স্যার?’

নাদিম হাসল, ‘ আমি তোমার মতো আগাম বুঝে ফেলতে পারি না মৌশি। আমার মনের কোনো ঠিক-ঠাকানা নেই। সকালে নেওয়া সিদ্ধান্ত বিকেলে এসেই বদলে যেতে পারে। তুমি তোমার পড়ায় মনোযোগ দাও। আমার তোমার বাড়ি আসা বন্ধ করে দেওয়াটা কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়।’

মৌশি কৌতুহল নিয়ে বলল,

‘ আগে আপনি মাঝে মাঝেই অন্যরকম করে কথা বলতেন। এখন কেন বলেন না?’

‘ ইচ্ছে করে না তাই।’

‘ এখন আমাকে পড়াতেও ইচ্ছে করে না, তাই না?’

নাদিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে মৌশির দিকে তাকাল। মেয়েটির বুকে কান্না। কন্ঠটা কি একটু কাঁপল? কিন্তু সেই কাঁপা কন্ঠটা অগোছালো নাদিমকে ছুঁয়ে দিতে পারল না। সে শান্ত কন্ঠে বলল,

‘ হুম, ইচ্ছে করে না।’

মৌশি কিছু বলল না। মাথা নিচু করে গ্রামারটিক্যাল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নাদিম আগের মতোই নিরুদ্বেগ বসে রইল। মৌশির খাতা চেইক করতে করতে হঠাৎ মনে পড়ল, অন্তুর আজ ড্রেসিং করার ডেইট। ঠিক পাঁচটায় হাসপাতালে যেতে হবে। নাদিম তাড়াহুড়ো করে ঘড়ির দিকে তাকাল। ব্যস্ত ঘড়ির কাটা এখন চারটার গড়দোড়ায়।

বিকেল পাঁচটা। চেম্বার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার তোড়জোড় করছে আরফান। কালো চামড়ার ব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে চেম্বার থেকে বেরুতেই নম্রতাকে চোখে পড়ল তার। নম্রতা নাদিম আর অন্তুর সাথে ড্রেসিংরুমের দিকে যাচ্ছে। নম্রতাকে দেখে কয়েক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল আরফান। গরমে ত্যক্ত-বিরক্ত নাদিমের চোখ এড়াল না আরফান। আরফানকে এদিকে আসতে দেখেই নম্রতার মাথায় চাটি মারল সে। ফিসফিস করে বলল,

‘ তোমার পিরিতি থুক্কু পত্রপ্রেমিক চইলা আসছে, মামা। ডাক্তাররে ফান্দে যেহেতু ফালাইছস কড়ায় গন্ডায় শোধ করুন লাগব। ডাক্তার প্রেমিক হওয়া সত্ত্বেও যদি হাসপাতালের ঔষধপত্র কিনে খাওয়া লাগে তাইলে তো যন্ত্রণা। ব্যাটাকে বল, আমাগো ঔষধের টাকা ফিরাই দিতে। নয়তো হাত, পা কিচ্ছু ধরতে দিবি না। তোরে আমরা ক্যাশ অন ডেলিভারি দিমু। ক্যাশ বন্ধ তো ডেলিভারিও বন্ধ।’

নাদিমের কথায় হেসে ফেলল অন্তু। নম্রতা গরম চোখে তাকাল। ততক্ষণে বেশ খানিকটা কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়েছে আরফান। আরফানকে কাছাকাছি এসে দাঁড়াতে দেখেই হেসে হাত বাড়াল নাদিম,

‘ আসসালামু আলাইকুম, আরফান ভাই। কেমন আছেন?’

নম্রতা অবাক হলো। এই অল্পদিনে নাদিম আরফানের সাথেও বন্ধুত্ব করে নিয়েছে নাকি? আশ্চর্য! কিন্তু কিভাবে? আরফান হাত মিলিয়ে হাতটা বুকে ছুঁইয়ে হাসল। মোলায়েম কন্ঠে বলল,

‘ আলহামদুলিল্লাহ। তোমরা?’

‘ ভালোই আছি। একটা মাথা পাগল আরেকটা হাত ভাঙা নিয়ে ঘুরলে যতটা ভালো থাকা যায় ঠিক ততটা। আপনি একটু মাথা পাগলটাকে পাহাড়া দেন ভাই। আমি আর অন্তু পাঁচ মিনিটে আসছি।’

আরফান যেন সুযোগটা লুফে নিল। হাস্যোজ্জল কন্ঠে বলল,

‘ শিওর।’

নম্রতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই জায়গাটা থেকে সরে পড়ল অন্তু-নাদিম। আরফান এদিক-ওদিক তাকিয়ে এক হাতে পকেটে ঢুকিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। নম্রতার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

‘ কেমন আছেন?’

নম্রতা আরফানের দিকে তাকাল। আরফানের ঠোঁটের কোণে হাসি। নম্রতা নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল,

‘ ভালো। আপনি?’

‘ আমিও আলহামদুলিল্লাহ।’

কথাটা বলে নম্রতার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল আরফান। আরফানের কথার প্রেক্ষিতে আর কোনো কথা খুঁজে পেল না নম্রতা। আরফানকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বার কয়েক এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করল। কিন্তু লাভ বিশেষ হলো না। সময়ের সাথে সাথে অস্বস্তিটা আরও বেড়ে যাচ্ছে। নম্রতা অতিষ্ঠ হয়ে আরফানের দিকে তাকাল। আরফান মাথাটা একটু উঁচু করে অনেকটা ড্যাম কেয়ার ভাব নিয়ে তাকিয়ে আছে। দৃষ্টি ফেরাচ্ছে না। পলক পড়ছে না। গম্ভীর, বিষণ্ন চোখজোড়ার উপর পুরু ভ্রু’জোড়া হালকা কুঁচকে আছে। নম্রতা বিরক্ত কন্ঠে বলল,

‘ সব ঠিকঠাক? এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? কি দেখছেন?’

আরফান হাসল। সরল কন্ঠে বলল,

‘ আপনাকে দেখছিলাম। আপনি বোধহয় একটু বেশিই সুন্দর, তাই না?’

আরফানের স্পষ্ট, সাবলীল কথাটা কানে যেতেই বিস্ফারিত চোখে তাকাল নম্রতা। চোখ ভরা বিস্ময় নিয়ে কিছু কড়া কথা বলার প্রস্তুতিও নিয়ে ফেলল। কিন্তু হায়! ওই বিষণ্ন, শিশুসুলভ চোখদুটোর দিকে তাকিয়ে পৃথিবীটাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল নম্রতার। তার বিষণ্ন চোখ আর ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসি দেখতে দেখতে নম্রতা হঠাৎ-ই উপলব্ধি করল, তার লজ্জা লাগছে। ভীষণ লজ্জা লাগছে। নম্রতা মুখ ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। সাথে সাথেই ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল অপ্রতিরোধ্য লাজুক হাসি।

#চলবে…..

[ সার্ভার ডাউন হয়ে যাওয়ায় পোস্ট করতে দেরী হলো। নয়তো অনেক আগেই পৌঁছে যেত গল্প। আমার কোনো দোষ নেই। আমি ভুক্তভোগী। ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here