বিদায়_বরণ
পার্ট ২
লেখা- মেহরুন্নেছা সুরভী
প্রেমের আগুনে কে কখন পুড়ে ছাই হয়, সেটা যদি সবাই ভবিষ্যৎ বানী থেকে জেনেই যেত, তবে কী আর প্রেমের আগুনে পুড়া হতো?
ভালোবাসি না বলেও বছরের পর বছর নিভৃতে ভালোবেসে কাটিয়ে দেয়া মানুষগুলোর কষ্টটুকু সেই নিভৃতেই চাপা পরে রয়।
সয়ে যাওয়া কষ্টের থেকে তখন ভালোবাসাটাই অমূল্য হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু ভালোবাসা না পাওয়ার যে সহনীয় কষ্ট! সেটা ক’জনই বা সয়ে বেড়াতে পারে? বেশি ক্ষেত্রে সরেই আসে!
সে সয়ে বেড়ানোর ভিতর একজন মানুষ এই শিখিনী। ভালোবাসি, কথাটা না কখনো মুখ ফুটে বলেছে, আর ভবিষ্যতে বলবে কিনাও সন্দেহ।
শুধু মানুষটাকে জড়িয়ে ধরে চোখের জলে ভেসে বেড়ানো পর্যন্তই!
শহরে ভোর হয়েছে। যামিনীর কাছে ঢাকা শহরের ভোর হওয়া মানে নীরব এক শ্মশানের নীরবতার আর্তনাদ। কারণ, যে প্রতিটা দিন পাখির কিচিরমিচির শব্দধ্বনিতে, দেশী মোরগের লম্বা ডাকে যার ঘুম ভাঙে। সে এই ভোর হওয়াকে অবশ্যই সানন্দে গ্রহণ করে নিবে না!
ঢাকায় এখন প্রতিদিন এলার্মের শব্দেই যামিনীর ঘুম ভাঙে। এরপর সকালের নাস্তা সেরে ভার্সিটির উদ্দেশ্য রওনা হলে দেখতে পাবে শতশত মানুষের আহাজারি! তার থেকেও বেশি যানবাহনের কোলাহল দেখে কে বলবে, ঢাকা শহরে ভোর হয় কতটা নীরবে নিভৃতে!
যামিনীর গ্রামের বাড়ি ঢাকা বিভাগের একটি জেলা শহরের গ্রামে। গ্রামের মেয়ে, পড়াশোনায় পটু হলেও শহরে বসবাস করার মত পটুত্ব অর্জন করেনি এখনো। বেশ সহজ-সরল, ভদ্র, আবেগপ্রবণ, বন্ধুসুলভ চালচলন। দেখতে শুনতে শিখিনীর চেয়ে কম যায় না অবশ্য, তবে চিকন শরীর, কোমর ছাড়িয়ে চুল। মুখের আকৃতিও লম্বাটে একটু।
শিখিনীর মা মাঝে মাঝে মাথায় হাত বুলিয়ে বলত,” মেয়েটা পড়াশোনার টেনশনে এমন হয়ে যাচ্ছে! দিন যেতে যেতে একদিন আরো সুন্দর গড়ন হবে দেখিস।
মাতৃস্নেহের মত এমন আদুরে কথা শুনলে যামিনীর মন পুলকিত হয়ে উঠত। তখন নিজেকে সুন্দর এক রুপে কল্পনা করে মুচকি হাসত।
প্রতিদিনের মত একই সময়ে যামিনীর ঘুম ভাঙল। কিন্তু আজ সে বিছানা ছেড়ে উঠল না। অলস সেজে ঘুম ঘুম চোখে শুয়ে রইল। আজ তার বড় ভাই আসবে। তাই ভার্সিটি যাওয়ারও তাড়া নেই। আজ একটু আরাম করা হোক না, প্রতিদিনই তো বোঝা বোঝা পড়া নিয়ে ভার্সিটিতে দৌড়াতে হয়। ভাই এলে তখনি সে ঘুম থেকে উঠবে।
থাই জানালা ভেদ করে ভোরের আলো রুমের ভিতর আলোকিত হতেই শিখিনীর ঘুম ভেঙে যায়। ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে দেখে ভোর হয়েছে।
নিজের অবস্থান বুঝতে সামান্য সময় লেগে যায় তার। সে কারো হাতের উপর শুয়ে আছে, হ্যাঁ হাতটা প্রেমের।
শিখিনীর পাশেই ঘুমিয়ে আছে প্রেম। প্রেমের ডান হাতের উপর শিখিনীর মাথা রাখা, বা-হাতটা তার বুকের উপর দিয়ে অন্যপাশের কাঁধের উপর রাখা।
শিখিনী লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যায়। গতকাল সন্ধ্যে থেকে সে প্রেমের সাথেই ছিল!
কাঁদতে কাঁদতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিল, সাধে কী আর তাকে সবাই হাবা ডাকে!
ধীরে প্রেমের বা-হাতটা সরিয়ে নিয়ে উঠে বসল শিখিনী। রুমের ওয়াশরুম থেকে হাত মুখে পানির ঝাঁপটা দিয়ে কয়েক মুহূর্ত নিজের দিকে নিজে তাকিয়ে রইল । গতকাল এই দু’চোখে কী প্রেমের প্রতি গভীর ভালোবাসা দেখতে পেয়েছিল প্রেম? একটু বাদেই নিজের বোকামির কার্যকলাপ ভেবে লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে করে। ছি!ছি! এরপর থেকে প্রেমের চোখের দিকে কীভাবে তাকাবে সে!
সেখানে আর অপেক্ষা না করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে। বাসায় গিয়ে কী বলবে সে! কোথায় ছিল সারারাত? অস্থিরতায় এতক্ষণে সে বুঝতে পারল, তার ভীষণ খিদে পেয়েছে। গতরাতে খাওয়া হয়নি যে!
নিজের প্রতি আরো বিরক্ত হয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগল। কেউ দেখে নেওয়ার আগেই তাকে বাসায় ঢুকতে হবে। এত জলদি নিশ্চয় তার মা ঘুম থেকে উঠেনি!
কিন্তু শিখিনীর শেষ রক্ষা আর হলো না! দেখতে পেল বাসায় সামনে একটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।
অচেনা একটি ছেলেকে বাসার নিচের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আচমকা দাঁড়িয়ে গেল শিখিনী।
প্রেমের মতই সোটাম দেহ, শ্যামলা চেহারা, চাপ দাড়ি, তীক্ষ্ণ নজরে তাকানোর দৃষ্টি। একবাক্যে সুদর্শন পুরুষই বলা চলে।
ছেলেটিও বিয়ের পোশাক পরিহিত শিখিনীর দিকে হা করে তাকিয়ে রইল। সেটা বুঝতে পেরেই শিখিনী আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে, ছো মেরে দরজা ঠেলে ভিতরে গিয়ে বন্ধ করে দিয়ে নিজের রুমে চলে গেল।
শাড়িটা পাল্টিয়ে সেভাবেই ভাজ করে নিজের ওয়ারড্রবে রেখে দিলো। কিছুক্ষণ সাওয়ার নিয়ে দরজা বন্ধ করে দিয়ে ফুল স্পিতে ফ্যান চালিয়ে লম্বা ঘুমানোর প্রস্তুতি নিলো। সবকিছু এত দ্রুত বেগে হচ্ছিল যে, শিখিনী খাওয়ার কথা প্রকপ্রকার ভুলেই গেল! শুধু সে মনে করছিল, একবার ঘুমিয়ে গেলেই জগতের সবকিছু থেকে মুক্তি পাওয়া য়ায়, মুক্ত থাকা যায়। আর এই মুহূর্তে শিখিনীর মুক্তির বড় প্রয়োজন!
দখিন পাশের একটি সাজানো গোছানো রুম। একপাশে বইয়ের তাক। একটি ঘাট, একটি ওয়ারড্রব,আর একটি টেবিল। আরো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র।
বিভাবরী বেগমের ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ। পাশে দেখলেন বড় ছড়ানো একটি সোফায় ছেলে সাখাওয়াত ঘুমিয়ে আছে।
মুচকি হেসে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। গতরাতে কলিগের বাসা থেকে ফিরতে রাত হওয়ায় শিখিনীর খোঁজ নিতে পারেননি! কিন্তু যামিনী বলেছিল, ঘুমিয়ে আছে নিজের রুমে। দরজা লক করায় আর ডাকেননি।
এখন উঠে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে রুম থেকে বাহিরে এলেন। ছেলে-মেয়ে দুটো একদম মা ঘেঁষা হয়েছে। বছর শেষেই ছেলেটা এসএসসি পরীক্ষা দিবে, তবুও মায়ের সাথে মায়ের রুমেই ঘুমাবে। মেয়েটাও মাঝে মাঝে মায়ের পাশে এসে ঘুমিয়ে থাকে। বড্ড মা ঘেঁষা, মা ছাড়া আছেই বা-কে!
বিভাবরী বেগমে মেয়ের রুমের সামনে এসে এসে দেখলেন এখনো দরজা লক। ফ্যানের শব্দ শুনতে পেলেন। তাই আর তিনি ডাকলেন না। কারণ, শিখিনীর এই এক অভ্যেস, সকাল বেলা সাওয়ার নিয়ে আবার ঘুমানো। ভার্সিটি ক্লাস না থাকলে দুপুরের আগে সে আর ঘুম থেকে উঠে না। আবার এমনো অনেক দিন যায়, পড়াশোনার চাপে একঘন্টাও ঘুমাতে পারে না মেয়েটা!
কেতলিতে চায়ের পানি বসিয়ে দিয়ে যামিনীর রুমে উঁকি দিলেন, যামিনীও ঘুমে।
তিনি ভাবলেন, যামিনীও আজ ভার্সিটি যাচ্ছে না তবে। তাহলে, একটু আগে তিনি দরজা খোলার শব্দ শুনেছিলেন মনে হলো। দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই কলিংবেল বেজে উঠল।
প্রেম আশেপাশে নড়তে চড়তে খেয়াল হলো শূন্যতা অনুভব করছে, শিখিনী নেই। চোখ মিলে তাকাল, শিখিনী সত্যিই নেই। চলে গেছে মেয়েটা, কতক্ষণ আগে গিয়েছে প্রেম বুঝতে পারল না।
গতকাল বিকেলে পারার দলের সাথে ফুটবল খেলেই ছাদে এসে বসে ছিল। ঘামিয়ে জুবুথুবু হয়ে ছিল, তার উপর হঠাৎ শিখিনীর আগমন, এরপর, চোখের জলে প্রেমের বুক ভেজে একাকার হলো।
পোশকটায় অস্থির ভাব আসতেই ওয়াশরুমে চলে গেল। সময় নিয়ে সাওয়ার নিলো। সারাটা সময় তখন শিখিনীকে নিয়েই ভাবতে লাগল।
মেয়েটা সব সময় এত লজ্জাবতী হয়ে থাকত যে, হঠাৎ গতকাল এসে জড়িয়ে ধরে কান্না করে বসল।
ভীষণ ধাক্কা লেগেছিল হৃদয়ে!
মনের ভিতর কত জমানো দুঃখ জমে ছিল, সেটা কী আদৌও দেখতে পেয়েছিল প্রেম!
ওয়াশরুম থেকে বাহিরে এসে দেখল ,বিছানার এক পাশে শিখিনীর পরা গহনাগুলো পরে আছে।
মেয়েটা গেল, অথচ গহনাগুলো নেওয়ার সময় পেলো না, নিশ্চয় ভুলে গিয়েছিল, হাবা একটা!
প্রেম মুচকি হাসতে হাসতে
নিজের রুমালে গহনাগুলো নিয়ে নিলো। এরপর নিচে নামতে লাগল, বাসায় ফিরে এগুলো শিখিনীকে ফেরত দিতে হবে!
চলবে…