মায়ায় ভরা সেই দিনে
পর্ব ৯
রোদ্র উজ্জল দিন। নীল সাদা রঙের আকাশটা যেন আজ নতুন রূপে সেজেছে।ফুলের বাগানে চেয়ার পেতে বসা রাজবীর তার বন্ধুরা। সাথে আছে বড় দুলাভাই আর ছোট দুলাভাই। দুই বোন তাদের স্বামী দের বাচ্চাদের নিয়ে কাল এসেছে বিয়ে উপলক্ষে। কিছুক্ষণ আগেই একটা ছোটখাটো সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল এইখানে। সামনে ইলেকশন নিয়ে। ভোটের সময় এগিয়ে আসছে। তাই এলাকার মুরব্বীদের নিয়ে অনেক আলোচনা পর্যালোচনা হলো। তাদের কথার বিষয় বস্তু ছিলো এই ইলেকশনে রাজবীর কে পার্থী হিসেবে দার করানো। রোমেল দেওয়ানের ও মত অনেকটা তাই। রাজবীরের রাজনীতি নিয়ে কোন আগ্রহ নেই। বাবা করে তাকে সাহায্য করে এই পর্যন্ত তো ঠিকই আছে। এখন আবার তাকে কেন টেনে এর ভিতরে ঢুকাচ্ছে। রাজবীরের চেহারায় বিরক্তিকর ভাব স্পষ্ট। কিন্তু তাতে কি তার বন্ধুরা হচ্ছে একেকটা বদের হাড্ডি। সেই কখন থেকেই ওকে খোঁচাচ্ছে ওরা। সাথে যোগ হয়েছে দুই দুলাভাই। ওকে পঁচিয়ে রীতিমতো বরফগলা বানিয়ে ছাড়ছে। উঠতে চাইছে তাও দিচ্ছে না কি মুশকিল।
সবার দিকে শেষ অস্ত্র হিসেবে কঠিন দৃষ্টি হানলো রাজবীর এতে কাজ হলো। সবাই একটু চুপ করে মিটমিট করে হাসতে লাগলো।
বড় দুলাভাই বহুু রসিক। সে গদগদে হাসি ঝুলিয়ে বললো বুঝলে রাজবীর বিয়ের পর পর কয়েকটা দিন থাকে মধুর রেশ। তখন কি যে স্বর্গীয় আনন্দ লাগে। আর কিছুদিন পরে মনে হয় ঘরে একটা ডিনামাইট এর বাস। একটু এদিক ওদিক হলেই লে বাস্ট। রাজবীর হতাশার শ্বাস ফেললো। নাহ্ এই লোক কে কিছু বলাই বেকার। ছোট দুলাভাই কিছুটা লাজুক গোছের। সে অস্থির দৃষ্টিতে এদিক ওদিক দেখছে।
বড় দুলাভাই করুণ সুরে বলে রাজবীরের জন্য আমার প্রচন্ড মায়া হচ্ছে। তার অভিনয় দেখে। রাজবীরের বন্ধুরা হো হো করে হাসতে লাগলো। রাজবীর সেদিকে গরম চোখে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো হারামীর দল। এতে যেন তারা আরো মজাই পেলো। সে কি হাসি তাদের।
একটু বাদেই বড় আপা ছোট আপা রেডি হয়ে বেরিয়ে আসলো। রাজবীর অবাক হয়ে তাকালো বললো তোমরা আবার কোথায় চললে??
এবার যেন হাসিরা বাঁধ ভাঙ্গলো। সবাই খলখলিয়ে হাসা শুরু করলো। রাজবীরের হুুট করে মনে পড়ে গেলো আজ আবার শপিং মলে যাবার কথা ছিলো। কাল এক দুপুর কিনে বাড়ি ফেরার পর আর অনেক জিনিস বাদ পড়ায় আজ যেতে হচ্ছে। রাজবীর লাফ মেরে উঠে দাঁড়ালো। কত বড় ষড়যন্ত্রকারী সবগুলো। ও শপিং মলে যাবেনা দেখে এই প্ল্যান করে ওকে বসিয়ে এখন সাথে নিয়ে যাওয়া হবে। হায় আল্লাহ্ আরো আগে কেন মনে হলো না।
রাজবীরের শেষ রক্ষা হলো না দুই বোন দই হাত ধরে গাড়ির দিকে হাঁটা দিলো। দুলাভাই আর বন্ধুদের মুখে বিশ্বজয়ী হাসি দেখে ওর গা জ্বলে উঠলো। কটমটিয়ে বললো অসভ্যর দল কোথাকার।
শপিং মলে এসে গরমে দম বের হবার যোগাড়। আইসক্রিম আর কোল ড্রিঙ্কস খেতে খেতে পেট ফুলে ঢোল। অথচ ওর আপাদের কোন থামাথামির লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না। কি করে এতো ধৈর্য্য পায় এরা? একটা কাজল পযর্ন্ত দামাদামি করে কিনছে এরা। উফফ্ বিয়ের মার্কেট করা এতো ঝামেলা আগে জানলে বাড়ি ছেড়ে পালাতো রাজবীর। বন্ধুদের দলটা ইনজয় করছে। ঘুরেফিরে দেখছে ছবি তুলছে। কি আনন্দ তাদের। রোমেল দেওয়ানের পক্ষ থেকে রাজবীরের বন্ধুদের জন্য গায়ে হলুদের সাথে বিয়ের দিনের জন্য আলাদা আলাদা পাঞ্জাবী সেট উপহার রয়েছে। টাকা বড় দুলাভাইয়ের কাছে দেয়া হয়েছে ওদের পছন্দ অনুযায়ী কিনে নেবে। রাজবীর চট করে উঠে গেলো মার্কেটে বসতে দেয়া টুল ছেড়ে। আপাদের কাছে গিয়ে বললো আর কতক্ষণ লাগবে তোমাদের? বোনেরা ফিরলো তার দিকে বললো এই আর অল্প কিছুক্ষণ সোনা ভাই আমার একটু সহ্য কর।
রাজবীর মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিলো রাগে মাথার রগ দপদপ করছে। আর জীবনেও সে কোন মেয়ের সাথে শপিংএ আসবে না তার ঢের শিক্ষা হয়েছে। বোনদের সাথে এসে।
______________________
বিকালের দিকে কেনাকাটা শেষ করে বাড়ি ফিরলো সবাই। রাজবীরের ক্লান্ত অবসন্ন চেহারা দেখে আফিয়া বেগম তার স্বরে চেঁচিয়ে উঠলেন বললেন। করেছো কি তোমরা? আমার ছেলেকে তো শুকিয়ে ফেলেছো। রাজবীর মায়ের আতঙ্কগ্রস্ত মুখ দেখে হেসে ফেললো বললো আম্মা অস্থির হয়ো না। ঠিক আছি আমি। গরম বেশি হবার কারণে একটু ক্লান্ত লাগছে। ঘুম দিলে ঠিক হয়ে যাবে।
আফিয়া বেগমের হায় হায় গেলো না। মেয়েদের দিকে কড়া চোখে চেয়ে শাসালেন। তবে মেয়েরা তা পাত্তা দিলো না। তারা জানে তাদের মা সবসময়ই এমন। রাজবীর সুন্দর সুদর্শন হবার কারনে রাজবীরকে কাজকর্ম কোন প্রকার প্রেশার এসব তার মা দিতে চান না। একটা মাত্র ছেলে হলে যেমন আদুরে হয় আরকি। আফিয়া বেগমের জান তার ছেলে। এ নিয়ে রাজবীর কে আগে কম পঁচায়নি বোনেরা। দুষ্টুমি করে দুধের শিশু বলে ডাকলেই আগুনের মতো জ্বলে উঠতো সে।
ঠাণ্ডা পানি দিয়ে অনেকটা সময় নিয়ে শাওয়ার সাড়লো রাজবীর। এখন শরীর টা বেশ লাগছে। খাবার মা উপরে পাঠিয়ে দিয়েছে। সামান্য কিছু মুখে দিয়েই বিছানায় ঘুমে কাঁদা হয়ে পড়লো সে।
বন্ধুদের দলটা ও থেমে নেই। ফ্লোর সোফা ডিভান সবটা জুড়েই তাদে রাজ্বত্ব চললো। শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লো।
_________________________
ইশিতা রাজবীরের ফোনে ফোন দিচ্ছে অনেকক্ষণ যাবত তবে নো রেসপন্স। বিরক্ত হয়ে এলো সে কি আজব কি রাজকর্ম করছে সে একটা ফোন রিসিভ করতে পারেনা । ইশিতার ফোন করার কারণ টা হচ্ছে মেকআপ বক্স কিনতে বারন করা। তার মেজো মামা দুবাই থেকে দামী দুটো মেকআপ বক্স পাঠিয়েছে তার জন্য গত মাসে। পুরোই ইনটেক। এখনও ইউস করা হয়নি তা। তাই এখন যেন ঐ বাড়ি থেকে মেকআপ বক্স না কেনে তাই বলতে চাচ্ছে সে। তবে হিরো মহাশয় ফোনই তোলছেন না। হাঁপিয়ে উঠে ফোনে ম্যাসাজ দিয়ে রাখলো সে।
__________________
দেওয়ান বাড়িতে আজ বহু হৈ হল্লা। বাড়িটাকে লাইটিং করা হয়েছে সুন্দর করে। নানান রঙের আলোতে ঝকমক করছে বাড়ি। মেহমানদের আনাগোনায় বাড়ি ভরপুর। নিত্য নতুন মুখ দেখা যাচ্ছে কেবলই। ফুলের বাগান কে সম্মুখে রেখে স্টেজ সাজানো হয়েছে। পার্টি লাইট গুলো ঘুরে ঘুরে আলো বিচ্ছুরিত করছে। বাচ্চারা সেখানে দাঁড়িয়ে নাচানাচি করছে। বন্ধুদের দলটা ভীষণ ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছে দৌড়ে দৌড়ে তারা স্টেজের কাজে ডোকোরেশন করা লোকদের সহযোগিতা করছে। রাজবীর স্টেজের সোফায় বসে সব কিছু অবলোকন করছে। আপা দুলাভাইদের হাসি। মা বাবার মুখে সুখের হাসি। বাবা মুরব্বীদের সামনে বুক ফুলিয়ে গর্বের হাসি দিচ্ছে। ছেলে যে তার কথা রেখেছে। পিতা কে সম্মান শ্রদ্ধা করেছে। পিতার সামনে চোখ নিচু রেখে নম্র ভদ্র আচরণ করছে এই বিষয় গুলো প্রতিটা পিতার ভিতর কি যে সুখের আনন্দ দেয় তা যদি প্রতিটা সন্তানের মন জানতো তবে তারা কখনোই পিতা মাতার অবাধ্য হতো না।
বিয়ে করা প্রয়োজন। অবশ্যই প্রয়োজন। মা বাবার চোখে আনন্দের জলটা মুছতে দেখতে হলেও প্রয়োজন। বড় বোনদের ঠোঁটে ভাই গর্বের হাসিটা দেখতে হলেও প্রয়োজন। বন্ধুদের মুখে ক্লান্ত হীণ নিখুঁত হাসিটা দেখতে হলেও প্রয়োজন। আত্বীয় স্বজনদের এই এতো এতো আনন্দ দেখতে হলেও বিয়েটা করা প্রয়োজন। গ্রামের হতদরিদ্র লোকের পেট ভরে খেয়ে দোয়া দিয়ে যাচ্ছে সে সব দেখতে হলেও খুবই প্রয়োজন বিয়েটা করা। হে প্রভু লাখো কোটি শুকরিয়া জানাই তোমার দরবারে। এতো নেয়ামত পূর্ণ একটা দিন দেখতে পাবার জন্য।
ইশিতাদের বাসায় হলুদের সারঞ্জামাদি নিয়ে। দুই দুলাভাই সাথে কিছু আত্বীয় গিয়েছিল। তারা ফিরে আসলে রাজবীরের হলুদ অনুষ্ঠান শুরু হয়। খুব সুন্দর নিয়ম কানুণ মেনে হলুদ অনুষ্ঠান শুরু হলো। মা বাবা, আপা দুলাভাই, বন্ধুরা, চাচা চাচী ফুপ্পিরা, মামা মামি কাজিনরা সবার পালা একে একে শেষ হলো। অবশেষে বন্ধুদের করা আজকের আয়োজন শুরু হলো। উরাধুরা নাচ গান কৌতুক অভিনয় সব রকম বিনোদন দিলো বন্ধুরা। সবাই ভীষণ উপভোগ করলো অনুষ্ঠান টা। শেষে বন্ধুদের আর বড় দুলাভাইয়ের পাগলা ডান্স দেখে হাসতে হাসতে আধমরা সবাই। রাত তিনটার দিকেই অনুষ্ঠান শেষ হলো। রাজবীর রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে মোবাইল হাতে নিলো। ইমু তে ইশিতার হলুদের শাড়ি পরার কয়েকটা ছবি দেখতে পেলো। মনটা খুশিতে নেচে উঠলো মৃদু আওয়াজে আওড়ালো সুবাহানাল্লাহ্। কি মিষ্টি দেখতে লাগছে মেয়েটাকে।
চোখ ভরে কিছুক্ষণ দেখে নিলো সে। বন্ধুদের দলটার হামলা খেয়ে মোবাইল রাখলো। রুমে শুরু হলো ওদের বিয়ের গীত গাওয়া। ছেলে মানুষ হয়ে মহিলাদের মতো গান গাওয়া বিরাট হাস্যকর ই বটে। হো হো করে সবগুলো হাসতে হাসতে একে অপরের উপর পরতে লাগলো। তাও হাসি থামেনা ইতরদের।
চলবে
জান্নাত রেশমি