#ধারাবাহিক
#ধূসর_রঙের_জলছবি
#অস্মিতা_রায়
(এগারো )
পুজোর দিনগুলো এবার খুব হইহই করে কাটলো। বিশেষ করে অনেকদিন পরে মা’কে এত আনন্দ পেতে দেখলো কৌস্তভ। সংসারের হাঁড়ি ঠেলতে ঠেলতে ক্লান্ত সেই মধ্যবয়স্কা মহিলাটি কয়েকদিনের জন্য যেন হয়ে উঠেছে এক দামাল যুবতী। তরতর করে মনের বয়স কমে গিয়ে মা যেন ফিরে গেছে তার কলেজের দিনগুলোতে।
মা’কে কৌস্তভ বলেছিল বিদিশার মায়ের কথা। চিনতে পেরে মা কী খুশি! দুই বান্ধবীতে এখন দুপুরবেলা করে মাঝে মাঝেই খুব গল্প হয়। এবার পুজোয় বিদিশা আর ওর মা মালদায় এসেছে। একসঙ্গে ঠাকুর দেখা, মালদা শহর দেখা.. সব মিলিয়ে কয়েকটা দিন সবার খুব আনন্দ হল।এই ক’দিনে কৌস্তভ দেখল, বিদিশা মেয়েটা বেশ হাসিখুশি। বাবা মায়ের সঙ্গে দিব্যি ভাব জমিয়ে ফেলল।গত কয়েকমাস ধরে মালবিকা, মালবিকা করে কৌস্তভ জাস্ট পাগল হয়ে উঠছিল। এড়িয়ে যাচ্ছিল নিজের বাবা মা’কেও।তবে এই কদিনে ওর বাবা মা ওকে আর মালবিকার ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন করে নি। কৌস্তভের খুব ভালো লাগছিল। জীবনটা তো কতো দিক থেকে কত সুন্দর! ও শুধু একজনের মধ্যেই নিজের সুখ কেন খুঁজে চলেছে! নিজের বাবা মায়ের সান্নিধ্য, তাঁদের মুখের হাসি, এক সঙ্গে সবাই মিলে হইহই…এগুলোই তো জীবনের আসল আনন্দ।
আদিনা ফরেস্টে হরিণগুলোর দিকে তাকিয়ে বিদিশা কৌস্তভকে বলল, “খুব সুন্দর আপনাদের শহরটা।তবে আমার একটা অভিযোগ আছে।গৌড়, পাণ্ডুয়া, আদিনা সব দেখলাম। মালদা শহর দেখলাম। তবে একটা জিনিস কিন্তু দেখা হল না।“ কৌস্তভ বলল, “কী?” বিদিশা বলল, “মালদার আমবাগান দেখলাম। তবে সেই গাছভর্তি আম দেখা হল না।“ কৌস্তভ বলল, “এখন তো অফ সিজন। সিজন টাইমে এলে দেখতে পাবেন গাছভর্তি কত আম! এটা তাহলে ডিউ রইলো। পরেরবার অবশ্যই আসবেন।” বিদিশা বলল, “বলছেন আবার আসতে? আবার উৎপাত সহ্য করবেন তাহলে?” কৌস্তভ বলল, “যে উৎপাত সবাইকে এত আনন্দ দেয়, তেমন উৎপাত বারবার মাথা পেতে নিতে রাজি আছি।”
যাওয়ার দিন কৌস্তভের মা কৌস্তভকে আলাদা করে ডেকে কথা বললেন, “তাহলে তুই এবার বিয়ে থা নিয়ে কী ভাবছিস?”
-“কী আর ভাববো!”
-“কাউকে পছন্দ করা আছে?”
কৌস্তভের মনে তিন সেকেন্ডের জন্য মালবিকার মুখটা ভেসে উঠল।তারপর ও বলল, “নাহ!”
-“বিদিশা মেয়েটা কেমন?”
-“মানে? ভালোই তো!”
-“শিখা আর আমার দুজনেরই ইচ্ছে তোদের দুজনের বিয়ে হোক। তাহলে আমরা বন্ধু থেকে আত্মীয় হবো।”
এই প্রস্তাব এতই আকস্মিক আর অদ্ভুত যে কৌস্তভ চট করে কিছুই বলতে পারলো না। এই কয়দিনে কৌস্তভ যা বুঝেছে, বিদিশা একটা হাসিখুশি প্রানবন্ত মেয়ে। সবার সাথে মিলেমিশে থাকতে ভালোবাসে। তা’বলে ওকে নিজের বৌ হিসেবে.. কৌস্তভ কল্পনা করল মনে মনে।
এত বছর ধরে এতোভাবে চেয়েও ও মালবিকার মন পেলো না।একত্রিশ বছর বয়স হয়ে গেল ওর। সব বন্ধুদের আস্তে আস্তে বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ও নিজে পড়ে আছে এক অদ্ভুত পরিস্থিতিতে। মালবিকা শুধুই ব্যস্ত নিজের গান নিয়ে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গানের ডাক পায় ও। ক্রমশ গানের জগতে ওর যোগাযোগ বাড়ছে। একটা কোম্পানি সম্ভবত ওর সঙ্গে ক্যাসেট তৈরি করার কথাও বলেছে। এর মধ্যেই মালবিকা আরো ভালো করে গান শেখার দিকেও মন দিয়েছে। এসবের মাঝে কৌস্তভের কোনো জায়গাই নেই ওর জীবনে।
কৌস্তভ বলল, “বিদিশা কী রাজি হবে?”
-“তুই রাজি?” কৌস্তভের মা সুজাতা ভালো করে কৌস্তভের মুখের দিকে তাকালো। কৌস্তভ বলল, “আমি জানি না, আমি আদৌ কাউকে বিয়ে করতে প্রস্তুত কিনা!”
-“তুই কি মালবিকার কথা ভাবছিস? কিছুই তো আমাদের বলিস না!”
-“বলার মতো কিছু আমি জানলে তো বলব।”
-“আর কতোদিন ধোয়াশায় রাখবি আমাদের? মালবিকা কেমন আছে? নিজের শ্বশুরবাড়ি ছাড়ল। বাপের বাড়িতেও আসে না। শুনেছিলাম তোদের মধ্যে নাকি সম্পর্ক আছে, তুই ওকে নিয়ে কলকাতা চলে গেছিস… ”
-“মালবিকা বলেছিল, ও ভালো নেই বিয়ে করে। তবে এখন মালবিকা হয় তো নিজের জীবনে খুব ভালো আছে।”
-“হয় তো কেন? তোর সঙ্গে যোগাযোগ নেই?”
-“মালবিকার মতো মেয়েরা যোগাযোগ রাখে না কারোর সাথে… ” বলতে বলতে কৌস্তভ খেয়াল করল, কখন বিদিশা এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়।
**********************************
“নাম কী তোমার?” সেলিব্রিটি মালবিকা দাশগুপ্ত নিজে থেকে ওর সঙ্গে কথা বলছে দেখে দিয়া একটু অবাকই হল। দিয়া উত্তর দিল, “দেবাংশী রায়চৌধুরী।“ মালবিকা আবার বলল, “নাচের ড্রেস পরে মুখ ভার থাকলে চলে! হাসিমুখে থাকো।” দিয়া হাসল। বলল, “না না ম্যাডাম, আসলে ওই অরণ্যদা হুট করে কেমন রাগ দেখিয়ে চলে গেল… ঠিক আছে, ও কোনো ব্যাপার না। আপনি বসুন। খেয়েছেন তো?”
-“হ্যাঁ, এই খাচ্ছি।“ মালবিকা গিয়ে বসল। টুবলু এখানে কী করছে! শুভেন্দুও কী এখানে আছে! অনেক প্রশ্ন ভিড় করছে মালবিকার মাথায়। টুবলুর ব্যাপারে আরো জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছে এই মেয়েটিকে। তবে সেটা ভালো দেখায় না। মালবিকা চুপচাপ কফিতে চুমুক দিল।
অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হয়ে যাওয়ার পরে মেইন অনুষ্ঠান শুরু হল। উদ্বোধনী সংগীত, তারপর বাচ্চাদের গ্ৰুপের নাচ, একটা আবৃত্তি, দুটো সোলো গানের পর দিয়াদের গ্ৰুপটা স্টেজে উঠল। অরণ্য দেখছিল নাচটা । অরণ্য এমনিতে শান্ত স্বভাবের। ঝট করে কারোর সাথে দুর্ব্যবহার করে না। একটু আগে দিয়াকে মুখ ঝামটা দিয়ে আসার জন্য ওর খারাপই লাগছিল। ও এমনটা করতো না। ওই মালবিকা দাশগুপ্তর সঙ্গে কথা বলতে গিয়েই ওর মাথাটা বিগড়ে গেল। মহিলা কী ওকে চিনেছেন নাকি! সবাই বলে ওর সঙ্গে ওর বাবার চেহারার খুব মিল। সেই দেখেই কী মহিলা কিছু আন্দাজ করে ওকে ডাকলেন, কথা বলার জন্য! অরণ্যর মাথাটা আবার গরম হল। কী জন্য ডেকে কথা বললেন ওই মহিলা! কী বলতে চাইছিলেন!ওনার জন্যই স্নেহা ওকে কথা শুনিয়ে চলে গেছে।
দিয়ার নাচ চলছে। অরণ্য ওর ক্যামেরা নিয়ে সামনে এগোলো। বেশ কয়েকটা ফটো তুললো ও। এমন সময়ে খেয়াল করল, প্রধান অতিথির চেয়ার থেকে মালবিকা দাশগুপ্ত উদগ্রীব হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছেন। তিনি কি ওকে কিছু বলতে চান! অরণ্য বুঝে পেলো না, এতজনের মধ্যে ওর কী করা উচিত! ঠিক কবে থেকে মনে নেই, ওর মনে তো একটা সুপ্ত ইচ্ছে ছিলই ওর মায়ের মুখোমুখি দাঁড়ানোর। আজ সেই সুযোগ এসেছে যখন, ওর কি একবার কথা বলার চেষ্টা করা উচিত? যদিও ও জানে না, ও কী জিজ্ঞেস করবে! এতজনের ভিড়ে ও কথা বলবেই বা কিভাবে! অরণ্যর মনে হল দিয়ার কথা। মেয়েটা হয় তো বিশ্বাসী। আজ অবধি সেই দুপুরের গল্প কাউকে বলে নি খুলে। দিয়াকে যদি একবার অরণ্য বলে, মালবিকা দাশগুপ্তের সঙ্গে কথা বলার ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য, ও নিশ্চয়ই চেষ্টা করবে।
গ্রিনরুমের কাছে গেল অরণ্য। দিয়া ওর নাচ শেষ করে নেমে আসছে, এরপরও ওর নাচ আছে। ড্রেস চেঞ্জ করবে। “দিয়া শোন।” দিয়া ফিরে তাকালো। অরণ্য ইতস্তত করে বলল, “আমার জন্য একটা কাজ করে দিতে পারবি?” দিয়া বলল, “কী বলো?”
-“মালবিকা দাশগুপ্তর ফোন নম্বরটা আমাকে জোগাড় করে দিতে পারবি?”
-“মালবিকা দাশগুপ্তর নম্বর!”
-“হ্যাঁ, আমার একটু দরকার আছে। তোদের ক্লাবের যিনি সেক্রেটারি, তাঁর কাছে নিশ্চ্য়ই আছে। আজ ওনাকে ইনভাইট করা হয়েছে যে!”
-“ত্রিদিবকাকু তো ওনার পিএ-এর নম্বরে ফোন করেছিলেন। ওনার নিজের নম্বর তো সম্ভবত নেই। ঠিক আছে, তুমি ত্রিদিবকাকুকে জিজ্ঞেস করে নাও না।”
-“নাহ, থাক!” অরণ্য একটু ভাবলো। “তুই এই কাগজটা কোনোভাবে মালবিকা দাশগুপ্তর হাতে দিতে পারবি? এটার কথা কাউকে বললে চলবে না।” দিয়া ভুরু তুলল, “এত গোপনীয়তা!” অরণ্য বলল, “পারবি কী না বল! দেখ, তোর কত ভালো ভালো ছবি তুলেছি! আরো তুলে দেবো।” দিয়া হাসল। বলল, “থাক! তোমার কোনো কাজ করে দেওয়ার জন্য আমাকে কোনো ঘুষ দিতে হবে না! এটা তোমার সেফটিপিন এনে দেওয়ার জন্য আমার তরফ থেকে রিটার্ন হেল্প। সারাক্ষন তো আমি তোমার পেছনে ঘুরি। এটার জন্য অন্তত তুমি নিজে থেকে এলে।”
-“ওই কথাটার জন্য এত অভিমান!”
-“আমার কী তোমার উপর অভিমান করা চলে!” দিয়া ওর কাজল পরা বড়ো বড়ো চোখগুলো মেলে অরণ্যর মুখের দিকে তাকালো।
(ক্রমশ)
© Asmita Roy