ইফতার (শেষ অংশ) লেখা: সেলিনা রহমান শেলী (৩)

0
328

ছোটগল্প: ইফতার (শেষ অংশ)
লেখা: সেলিনা রহমান শেলী
(৩)
আছিয়া প্রতিদিনের মত মেমসাহেবের বাসায় ইফতারি বানিয়ে টেবিলে সাজিয়ে রাখে। রোজ রোজ কত পদের যে ইফতারি এরা খায়। বড়লোকদের বড়লোকি কারবার আরকি। আযানের সময় রান্না ঘরে ইফতারি নিয়ে বসে আছিয়া। রোজ একা রান্না ঘরেই তাকে ইফতারি করতে হয়।

একদিন সাহস করে মেম সাহেবকে বলেছিল,” আফা, সন্ধ্যায় ইফতারি আমার বাড়িত কইরা আসি। সব কাজ শেষ কইরা যামু। ইফতারির পর আইসা রাতের রান্না কইরা দিয়া যামু। আমার বাসা রাস্তার ওপাশের বস্তিতে। সময় লাগতো না। আযানের পরেই চলে আসতাম।”

মেম সাহেব বিরক্ত হয়ে বলেছিল, ” তোমাকে একবার ছাড়লে আর পাওয়া যাবে? ও সব আমাকে বলতে আসবা না। আর ইফতারির পরপরই তোমার স্যার চা খায়। বুবুন এটা ওটা করে দিতে বলে। ওসব কে করবে? সারাক্ষণ কাজে ফাঁকি দেবার চিন্তা। আমার বাসায় কাজ করলে ও সব হবে না। ”

আছিয়া জোর গলায় কিছু বলতে পারে না। কাজ করেই তো খেতে হবে।

ইফতারির প্লেটের অল্প যেটুকু খাবার দেয় তাও লুকিয়ে বাসার জন্য নিতে হয়। বাসায় কিছু নিতে দেখলে বকাবকি করে মেম সাহেব। পোলাপানগুলো একা বাড়িতে ইফতারি করে। তাদের বাপ বাসের হেল্পার। আজ এখানে কাল ওখানে ইফতারি করে।

যে দিন এলাকার আশপাশে থাকে নুরু টিফিন বক্সে ইফতারি দিয়ে আসে। মুড়ি, গুড় , কখনো ভাত।

আছিয়া বড়লোকদের ইফতারি তৈরি করে দেয়। কিন্তু নিজের ছেলেমেয়ের জন্য ইফতারি বানাতে পারে না। “এর নামই কপাল” দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আছিয়া নিজের অজান্তেই।

এভাবেই এক রমজান গিয়ে বছর ঘুরে আবার রমজান আসে। কিন্তু আছিয়া, নুরুদের জীবনের পরিবর্তন আসে না।

(গল্পের দৃশ্যগুলো আমরা চাইলে অন্য রকমও হতে পারতো বা পারে। তাই না? আসুন দেখি, কেমন হতে পারতো বা কেমন হতে পারে যদি আমরা চাই ।)
৪.
নুরু অন্য দিনের মতই ইফতারির বাজার ঘুরে ঘুরে মুগ্ধ হয়ে ইফতারি বানানো দেখছে। একেক দোকানের সামনে একেক রকম সুবাস বাতাসে ভাসছে। এদিকে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিলেই পিঁয়াজু, বেগুনির ভাজাপোড়া ঘ্রান পাওয়া যায়। আবার অন্য পাশে জিলাপি, বুন্তিয়ার দোকানে মিষ্টি এক সুবাস। ফলের দোকানে তেমন সুবাস ছোটে না সত্য কিন্তু ডাঁশা ডাঁশা আপেল, আঙ্গুর, বেদানা মুখ ভরা হাসি নিয়া তাকাইয়া থাকে। নিজের উপমায় নিজেই হেসে উঠে নুরু।

ভীড়ের মধ্যে তো দম নেওয়া দায়। এত মানুষ। আর মানুষের এত টাকা। কত কত ইফতারি সব চোখের পলকে বিক্রি হইয়া যায়।

নুরুর দাদি মাঝে মাঝে আফসোস করে বলে,” দুনিয়ার হগগোল লোকের টাকা আছে, আমাগো ছাড়া। ”

নুরুর কথাটা মিথ্যা মনে হয় না। পেছন থেকে কেউ একজন নুরুর শার্টের কোনা ধরে টানছে। পেছন ফিরে নুরু ভ্রু কুঁচকে তাকায়। বদু মাথার ওপর সব্জির ডালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে বাজারে টুকটাক সব্জি বিক্রি করে।

নুরুকে ইশারা করে বলে,” নুরু আজ বড় মাঠে ইফতারি দিবো, যাবি?”

নুরুর চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। ” সত্যি? কে কইছে?”

বদু চোখ বড় বড় করে বলে,” আমি মিথ্যা কই কোন দিন? নিজের চোখে দেইখা আসছি। বিশাল ট্রাকে ইফতারি আনছে। ”

নুরু ইতস্তত করে বলে,” তুই যাহ্, ওসব জায়গায় ইফতারি নিতে গেলে হেরা কেমন গালি দেয়। বকাবকি করে। ”

বদু বিরক্ত কন্ঠে বলে,” গালি দেয় তো কি হইছে। খাবারও তো দেয়। সবাই কাড়াকাড়ি করলে গালি দিবো না? তুই না গেলে নাই, আমি গেলাম।”

বদু রাগ করে চলে যায়। নুরু যাবে কি যাবে না সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। আজ বাপের খাওন দিতে যাওয়া লাগবে না। গ্যারেজের মালিকও কইছে ইফতারি বাড়িতে কইরা পরে যাইতে। হাতে যখন সময় আছে একবার বড় মাঠে যাওন যায়।

নুরু গভীর চিন্তায় পড়ে গেছে। পৃথিবীর বড় বড় ব্যক্তিরাও জাতীয় বা আন্তর্জাতিক কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে এত চিন্তা করে কি না কে জানে।

৫.
আছিয়া বানু শেষ কোন রোজায় পোলাপান নিয়ে ইফতারি করেছে তার মনে নাই। তবে আজ সে নিজের ঘরে ইফতারি বানিয়েছে। নতুন যে বাড়িতে কাজ নিয়েছে, সেই মেম সাহেব অন্য রকম ভালো একজন মানুষ। তার দিলে মায়া মমতা অনেক।

আছিয়া তার বাপের জন্মেও এমন মানুষের কথা শুনে নাই, দেখেও নাই । মেম সাহেব আছিয়াকে রোজার বাজার করে দিয়েছে। আজ দুপুরে আছিয়াকে ডেকে বলেছে, ” তুমি আমাদের ইফতারি একটু আগে তৈরি করে বাড়ি যেও। বাচ্চাদের সাথে ইফতারি করো। ইফতার শেষে এসে বাকি কাজ করে দিয়ে যেতে পারবা না?”

আছিয়া বানু বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিল। কৃতজ্ঞতায় তার চোখে পানি চলে এসেছে। এমন মানুষও হয়।

আছিয়া দ্রুত হাতে ইফতারি বানায়। তার ছোট ছেলেমেয়ে দুই জন চুলার পাশে বসে আছে। মা ইফতারি বানাচ্ছে এই খুশি তাদের চোখেমুখে।

আছিয়ার শাশুড়ীও লাঠিতে ভর দিয়ে চুলার পাশে পিঁড়িতে এসে বসে। একটা সময় তিনি দশ বাড়িতে ইফতারি বানিয়ে পাঠাতেন। তখন সহায় সম্পদ ছিল। এলাকায় সম্মান ছিল। আজ সম্পদও নাই। সম্মানও নাই। আল্লাহ কারে কিভাবে পরিক্ষা করে কে জানে।

আছিয়ার শাশুড়ী নরম গলায় জানতে চায়,” ও বউ বেগুনি করবা? তেলে ভাঁজা ভাঁজা বেগুনির স্বাদই অন্য রকম। কি কও মা?”

আছিয়া অন্ধ শাশুড়ীকে বলে,” সব হইব আম্মা। আপনি এত হাঁটাহাঁটি কইরেন না তো রোজা রাইখা। নুরু গেলো কই? পোলাডা কই না জানি ঘুরে সারাদিন।”

আছিয়ার কপালে ছেলের জন্য চিন্তার ভাঁজ পড়ে। ইফতারির সময় হয়ে এসেছে পোলার দেখা নাই।

৬.
“চাঁদের হাট” বাগধারা প্রচলিত আছে আমাদের বাংলা প্রবাদ প্রবচণে। মাঝে মাঝে আমাদের জীবনেও চাঁদের হাট নেমে আসে।

তেমনই কোন কোন দিন চাঁদের হাটের দেখা মেলে আছিয়া বানুর সংসারে ইফতারির সময়।

নুরু বড় মাঠে গিয়েছিল শেষ পর্যন্ত। ধাক্কাধাক্কি করতে হয়নি। লাইনে দাঁড়িয়েই দু’প্যাকেট বিরিয়ানি পেয়েছে। বাড়িতে এসে অবাক হয়ে যায় ইফতারির আয়োজন দেখে। নুরুর বাপও টুপি মাথায় ওদের সাথে ইফতারিতে বসেন। আজ গাড়ির ইঞ্জিন নষ্ট। তাই ছুটি। আছিয়া সবার প্লেটে ইফতারি তুলে দেয় পরম মমতায়।

পরী আব্দারের স্বরে বলে,” ও মা, আমারে একটা পিয়াজু বেশি দিবা। ”

রতন সাথে সাথে বলে,” আমাকেও দিতে হইব।” আছিয়া হাসিমুখে ছেলেমেয়ের আবদার পূরণ করে।

আছিয়ার শাশুড়ী বলেন,” আল্লাহর কাছে দোয়া করো সবাই। ইফতারির সময় আল্লাহ দোয়া কবুল করেন। ”

আছিয়া মনে মনে প্রার্থনা করেন, ” রোজ না হইলেও হইব। মাঝে মাঝে যেনো তার ঘরে এমন ঈদ আসে। পোলাপান,স্বামী, শাশুড়ী সবাইকে নিয়ে একসাথে ইফতারি করতে পারে। ”

আল্লাহর কাছে তার চাওয়া এতটুকুই।

# সমাপ্ত #

#coyright_reserved

(প্রথম পর্ব যারা মিস করেছেন তাদের জন্য কমেন্টে লিংক দিওয়া আছে। গল্প কেমন লাগলো অবশ্যই জানাবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here