চোখের আরশিতে সমুদ্দুর |১০
আমাকে দূর হতে দেখেই আমার দুই মেয়ে এলোমেলো পা ফেলে “পাপা পাপা” বলে ছুটে আসছে। সী-বীচের আলো আঁধার সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতে এতদূর হতে কীভাবে চিনল আমাকে আমার বাচ্চাগুলো, অবিশ্বাস্য!
আমার আগেই শবনম শাওকাতের বাহুডোর থেকে মুক্ত হয়ে ছুটল ওদের দিকে। ওহ শবনম আপনি মাত্রাতিরিক্ত ভাল একটি মেয়ে, কেন আপনি আমার বাচ্চাদের মা হননি এ আফসোস এখন হতে সারাজীবন থাকবে আমার। আপনারই মত মায়াবী আদুরে একটা বউ চেয়েছিলাম যে আমার সংসার সন্তান যত্নে মুড়ে নিজের করে নেবে।
শাওকাত শবনমের পিছু নিল ধীর পায়ে। আমি আর যাইনি জায়গায় দাঁড়িয়ে দেখছি দুটো বাচ্চাই ‘আন্টি’ বলে শবনমের কোমড় জড়িয়ে ধরল। দুটোকে একসঙ্গে কোলে নিতে শবনম কসরত করছে ততক্ষণে শাওকাত পৌঁছে গেছে, সে নিজেই দু’হাতে আমার মেয়ে দুটোকে তুলোর পলকার মত কোলে তুলে নিয়েছে।
অপরিচিত কারও ধারেকাছে ঘেঁষে না আমার মেয়ে দুটো অথচ কী সুন্দর করেই না শাওকাতের গলা চারটি কচি হাতে পেঁচিয়ে ধরে খিলখিল হাসছে, শবনম নিজেও শাওকাতকে সামনে থেকে ধরে রইল কানেকানে শাওকাত কী যেন বলল ওকে, দুম্ করে ছোট্ট বক্সিং দিল শাওকাতের বুকে শবনম।
বেশিকিছু ভাববার অবকাশ হল না ওরা এগিয়ে এল বাচ্চাদের নিয়ে কেক কাটল খেল খাওয়ালো এবং আশ্চর্যের বিষয় হল বাচ্চা দুটো যে ওদের বন্ধুদের দল থেকে নেই হয়ে গেছে সেটা মা হিসেবে মৃন্ময়ীর নজরে পড়লই না।
নামীদামী হোটেল সায়মনের সামনে থেকে বাচ্চারা গায়েব হবার সম্ভবনা কম সিকিউরিটি সিস্টেম হাই সেকারণে হয়ত চিন্তায় এল না বাচ্চারা কোথায়।
আমার ফ্লাইটের সময় হয়ে এসেছে।
মেয়েদের নিয়ে শবনম শাওকাতের কাছথেকে বিদায় নিতে বললাম,
— এখন তাহলে আসি কেমন?
শাওকাত হাত বাড়িয়ে শেকহ্যান্ড করে হাতটি ধরেই বলল,
— মিস করব আপনাকে কায়সায় ভাই।
— আমিও মনে করব আপনাকে শাওকাত। ফোন নাম্বার নিয়ে গেলাম বিরক্ত করতে পারি আমার নিঃসঙ্গ সময়ে।
— এনিটাইম ভাই
আই’ল ওয়েটিং ফর ইওর ফোনকল। আমার বোনদের বিয়ে কিছুদিন পর, খুব চাই আপনি আসবেন।
— নিশ্চয়ই আসব।
শবনম আর আপনাকে একসঙ্গে দেখার লোভ আমি কখনই মিস করব না ইন শা আল্লাহ!
শবনমের দিকে চেয়ে বিষন্ন হাসল শাওকাত, চোখ দুটো লাল হয়ে চিক চিক করছে ওর।
বলল,
— সুখ
এই অধমের কপালে ধরা দেয়নি আজও। তবে কারও সংসার ভেঙে সুখ চাই না নিয়তিতে বিশ্বাসী মানুষ আমি নিশ্চয়ই সুখ বলে কিছু থাকলে, পাব একদিন।
হাসি হাসি মুখে বাচ্চাদের দিকে মনযোগী শবনম কথাগুলো শুনল শাওকাতের, কিছু বলল না শুধু হাসি মিলিয়ে চেহারায় কাঠিন্য টেনে নিল। ওদের দু’জনকে রেখে মেয়েদের নিয়ে সৈকত থেকে চলে আসার মুহূর্তে বললাম,
— ঢাকায় থাকলে হয়ত আমার মায়ের কুলখানিতে দাওয়াত দিতাম আপনাদের।
শবনম চটজলদি বলল,
— না দিতেই দাওয়াত গ্রহণ করে নিচ্ছি কায়সার ভাই, বলা যায় না যদি চলে আসি।
— এই সত্যি!
আমার চেয়ে খুশী কেউ হবে না, আমি বন্ধুহীন মানুষ এমুহূর্তে। স্বপ্নে দেখছি, আপনারা দু’জন আমার মায়ের কুলখানির দু’আয় শরীক হয়েছেন।
— প্লেনে উঠে
কল দেবেন ভাইয়া, অপেক্ষায় থাকব। শবনম একটু পরে যাবে ওর স্যুইটে, আপনি মাইন্ড করবেন না প্লীজ।
— আরে না শাওকাত কী বলেন!
এনজয় ইওর ডিনার ডেট উইথ ইওর স্পেশ্যাল ওয়ান। বাই।
…
সবাই একসঙ্গে ফ্রিজ হয়ে গিয়েছি কায়সার ভাইয়ের কোলে তার দুই মেয়েকে নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখে, উনি বাচ্চাদের কোথায় পেলেন! ভয়ে মৃন্ময়ীর চেহারা দেখার মত হল। রেবেকা বিড়বিড় করছে,
— এইবার বুঝুক মিনু বেগম।
— এই মিনু কে?
— কে আবার, তোমাদের সব বন্ধুদের ক্রাশ মৃন্ময়ী।
— কিউট একটা নামের এ কী হাল করেছ রেবু।
— ও কিউট বুঝি, তাই?
মিস্টার নজরুলের কাছেও মিনু বেগম কিউট লাগে বাঃ জানতাম নাতো! রেখে দাও এই কিউটি বেগমকে আমার রাস্তাটা পরিষ্কার হোক।
— শুরু হল বকওয়াজ! বল তো কী চাইছ রাস্তায় দাঁড়িয়েই, চুমুটুমু খাব নাকি।
— নিজের বউ
খাও, কে বারণ করেছে।
বউ আমার মহা তেতে উঠেছে বোঝাই গেল। ওকে না ঘাটিয়ে মৃন্ময়ীর সাথে কায়সার ভাইয়ের কোল্ড ফাইট দেখছি।
কথার কাটাকাটি তেমন একটা হইনি। কায়সার ভাই সিদ্ধান্ত দিয়েছে মৃন্ময়ী মানতে বাধ্য হল কিন্তু আমরা বন্ধুরা মৃন্ময়ীকে প্রেশার দিলাম ওর হাজব্যান্ডের সাথে চলে যেতে, গেল না ও। রবিনটা খেপল এতে।
বাচ্চাদের লাগেজ না নিয়ে “এনাফ আছে” এইব’লে কায়সার ভাই হোটেল ট্রান্সপোর্ট কারে চড়ে মেয়েদের নিয়ে চলে গেলেন।
আমরা সী প্যালেসে রওনা হতে চাইলে মৃন্ময়ী বলল,
— এই চল্ ডিনার টাইম আরেকটু পরেই শুরু রবিনের এখানেই থাকি আমরা, একসঙ্গে ডিনার করে তারপর না’হয় ফিরি।
আইডিয়াটা মন্দ না সায় দিল সবাই। আমাদেরকে লবিতে বসিয়ে রবিন গেল শবনমকে আনতে ওর স্যুইটে।
…
কেক, কফি আর ফ্রুটস সালাদ একই প্লেট মগে খেলাম আমরা দু’জন। খেলাম বললে ভুল হবে শাওকাত খাইয়ে দিল আমাকে, সে এখনও মুড অফ করে আছে। ফোনে বিশ মিনিট পর ডিনার সার্ভ করতে বলে আমাকে নিয়ে সমুদ্রের কাছে এল শাওকাত।
আমার হাত ধরে সমুদ্রের পানিতে পা ডোবাল। শাওকাতকে অদ্ভুত আকর্ষণীয় লাগছে এ মোহনীয় সন্ধ্যা রাতে চাঁদের আলোয়।
মনের অবাধ্য ইচ্ছেগুলো
যা একটি মেয়ে একান্তই নিজের স্বামীর জন্য পুষে রাখে দাবী রাখে চাওয়ার সেই ইচ্ছেগুলো সব শাওকাতকে ঘিরে জেগে উঠছে।
অভিমানের জমাট কলিজা নামক প্রবাল পাথরের খাঁজে খাঁজে লুকিয়ে থাকা কষ্টরা বলছে, মানুষটিকে জড়িয়ে ধরো আমরা একটু ঝরে পড়ি। আমি ব্যর্থ।
— পর পর দুটো ভুল করেছ তুমি শবনম।
শাওকাতের আনমনে বলা বাক্য ঈষৎ চমকে দিয়েছে আমার ভেতরটা। যদিও জানি কী ভুল।
— আমার ইচ্ছে করছে না রবিনের সাথে একই রুমে রাত কাটাতে এখানে থাকলে বাধ্য হয়ে থাকতে হবে, কায়সার ভাইয়ার সাথে চলে যেতে চেয়েছি একারণে।
— আমাকে বলতে পারতে। নয়?
— আপনার পরিবার আছে সঙ্গে কীভাবে বলি, বলুন তো!
— আমার সঙ্গে আমার ভাইবোনরাও আছে ভুলে গিয়েছ? যে কাউকে দায়িত্ব দেয়া যায় সবাই এডাল্ট, তোমাকে চেনে।
— বিরক্ত করতে চাইনি
বিশ্বাস করুন ট্রিপটা নষ্ট হোক চাই না।
— শবনম!
রেগে ধমক দিলেন শাওকাত। খুব রূঢ় স্বরে বললেন,
— আমি সত্যিই বিরক্তি হচ্ছি এবার। মাত্রাতিরিক্ত সৌজন্যতা আমার ধাঁচে সয় না, সীমার মধ্যে থাকো।
— আমি চলে যাব?
রবিন ফিরে এসেছে স্যুইটে না পেলে, খুঁজবে।
অবাক বা ব্যথিত হবার ধার দিয়েও যায়নি শাওকাত, হাসল কেবল। চাইলে অপমানজনক বিদ্বেষপূর্ণ কিছু শুনিয়ে দিতে পারত, আমার কথার পিঠে। কিছুই বলল না সে।
সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে শুধু ছোট্ট করে জবাব দিল,
— যাও।
আমাদের ডিনার হল না।
কেঁদে ফেলার ভয়ে হাতে জুতো নিয়ে খালি পায়ে বালুর ওপর পা ফেলে দৌড়ে চলে আসছি, পেছনে শাওকাত নিঃসঙ্গ দাঁড়িয়ে। আমাকে একবারও ডাকল না সে, ভুল করেও ডাকল না পিছু।
(চলবে)
©মাহমুদা সুলতানা মবিন একা