#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা-জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা
১১.
এক পশলা রোধ চোখে এসে পড়তেই পিটপিট করে চোখ মেলে তাকায় ঐচ্ছি। মাথাটা খুব ভার ভার লাগছে। চোখগুলো কেমন জ্বলছে। হাত দিয়ে মাথাটা চেপে শোয়া থেকে উঠে বসে। কাল খুব কেঁদেছে সে। তার ফল আজকে সারাদিন মাথা ব্যাথা নিয়ে থাকতে হবে। উফফ! কেঁদেও একটু শান্তি নেই। ফ্রেশ হয়ে রুমের দরজা খুলে বাইরে বের হয় ঐচ্ছি। রান্নাঘরে তাহেরা বেগম নাস্তা বানাচ্ছেন। ঐচ্ছি কোনো কথা না বলেই বিড়াল পায়ে রান্নাঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো। কফি পাউডারটা তাক থেকে বের করে নিজের জন্য কফি বানাতে লাগল। তাহেরা বেগম আড়চোখে মেয়ের কান্ডগুলো দেখছে। ঐচ্ছির চোখ মুখ ভীষণ ফুলে আছে। ফর্সা গালগুলো লাল হয়ে আছে। চোখের নিচটা একটু বেশিই ফোলা। তা দেখে নিজের মনেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তাহেরা বেগম। ঐচ্ছির হাত থেকে কফি পাউডার নিয়ে নরম সুরে বললেন,
‘যা তুই গিয়ে ভার্সিটির জন্য রেডি হো। আমি কফি বানিয়ে দিচ্ছি।’
ঐচ্ছি নাক ফুলিয়ে অভিমানের সুরে বললো,
‘লাগবে না। আমার কফি আমি নিজে বানাতে পারবো।’
তাহেরা বেগম মেয়ের মাথায় হাত বুলালেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
‘চড় মেরেছিলাম বলে খুব কষ্ট পেয়েছিস তাই না?’
ঐচ্ছির কান্না পাচ্ছে। ঠোঁট চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করে বললো,
‘না কষ্ট পায়নি।’
তাহেরা বেগম চোখের কোণে চিকচিক করে উঠল বিন্দু বিন্দু জল। মেয়ের অভিমান হয়েছে। উনি মৃদু হেসে বললেন,
‘রোজ গার্ডেনে যাবি?’
ঐচ্ছি বিধ্বস্ত নয়নে মার দিকে তাকায়। ছোট বেলা থেকেই অভিমান হলেই ঐচ্ছিকে নিয়ে তার মা বাবা রোজ গার্ডেনে যেতেন। সেখানে গেলে মুহুর্তেই ঐচ্ছির মন ভালো হয়ে যেত। এখনো তাই। মিষ্টি হাসি ফোটে ঐচ্ছির অধর কোণে। মাথা দুলিয়ে বলে,
‘হ্যাঁ যাবো।’
তাহেরা বেগম গরম পানিতে কফি পাউডার মেশাতে মেশাতে বললেন,
‘ঠিক আছে। ভার্সিটি থেকে তাড়াতাড়ি ফিরিস। বিকেলে আমরা রোজ গার্ডেটে যাবো।’
নিমিষেই ভালো হয়ে যায় ঐচ্ছির বিষাদগ্রস্থ মন। আনন্দে লাফিয়ে উঠে সে। বুক ভরে নিশ্বাস নেই। এত এত কষ্টের মাঝে এই একটু সুখও অনেক বড় পাওয়া।
,
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামলো। পশ্চিম দিকে আকাশটা রক্তিম হয়ে আছে। যেন এক্ষুনি সেই রক্তিম চাদর থেকে টুপ টুপ করে তাজা রক্ত গড়িয়ে পড়বে। রাস্তার পাশের ফুচকার স্টলে ভিড় পড়েছে খুব। এই মামার ফুচকা দারুন মজা। ঐচ্ছি আর তার মা আটঘাট বেধে নেমেছে, ফুচকা খাওয়ার প্রতিযোগীতায়। সেখানে নাম মাত্র রেফারি হলো ঐচ্ছির বাবা। টপাটপ একের পর এক ফুচকা মুখে পুরে যাচ্ছে ঐচ্ছি। তাহেরা বেগমও কম যান না। মেয়েকে কোনোরকমেই জিততে দিবেন না তিনি। তিন প্লেট ফুচকা অলরেডি শেষ তার। ফুচকা স্টলে উপস্থিত বাকি মানুষগুলো বেশ উৎসাহ নিয়ে তাদের খেলা দেখছে। তাহেরা বেগম তৃতীয় প্লেট শেষ করে চতুর্থটাতে হাত দিতেই ঐচ্ছি ভজভজ কন্ঠে বলে উঠে,
‘মা এত খেও না তোমার শরীর খারাপ করবে।’
তাহেরা বেগম বাঁকা হেসে বলে,
‘যাই বলিস না কেন আজ আমিই জিতবো।’
ঐচ্ছি অবাক চোখে মাকে দেখছে। উনি পুরো দমে খেয়ে চলছেন। বিন্দুমাত্র ক্লান্তি আসছে না তার মাঝে। ঐচ্ছি চোখের পাতা প্রশ্বস্থ করে সেদিকেই তাকিয়ে রইল। এই ফুচকা খাওয়া চ্যালেঞ্জে প্রতিবার ঐচ্ছিই জেতে। কিন্তু আজ ঐচ্ছির ইচ্ছে হচ্ছে তার মা’ই জিতুক। জেতার আনন্দে মানুষটার মুখে যে অমায়িক হাসিটা ফুটবে সেটাইতেই তার প্রশান্তি। ঐচ্ছি জড়ানো গলায় বললো,
‘আমি আর পারছি না মা। আমি হার মেনে নিচ্ছি।’
সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসে মেতে উঠল বাকি জনতা। ঐচ্ছি অবাক চোখে চারপাশে চোখ বুলায়। এত মানুষ তাদের খেলা দেখছিল? ঐচ্ছি গোল গোল চোখ করে চেয়ে থাকে। তাহেরা বেগম হাতের প্লেটটা রেখে খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
‘ফাইনালি তোকে হারাতে পেরেছি। এবার তুই আমাকে কি দিবি বল? প্রতিবার তো নিজে জিতে আমার থেকে এটা ওটা চেয়ে নিস। এবার আমার চাওয়ার পালা। কি দিবি তো, যা চাইবো?’
ঐচ্ছি হাসি মুখে বলে,
‘অবশ্যই দিব। কি চাই তোমার, বলো?’
তাহেরা বেগম কপাল কুঁচকে কিছু একটা ভেবে বললেন,
‘তুই রাফসানকে কল করে এখানে ডাক।’
মিঁইয়ে যায় ঐচ্ছির মুখের হাসি। বিষাদে আধার হয়ে যায় মুখ। খসখসে গলায় বলে উঠে,
‘উনাকে কেন ডাকতে বলছো? উনার এখানে কি কাজ?’
তাহেরা বেগম অধৈর্যের সুরে বললো,
‘উফফ, এত কথা না বলে ডাকতো।’
‘কিন্তু মা..’
‘কোনো কিন্তু না। তুই না বলেছিস আমি যা চাইবো তাই দিবি? তাহলে এখন আমার কথা শুনছিস না কেন?’
ঐচ্ছি কপালে ভাঁজ পড়ে। বিরক্ত হয়ে বলে,
‘তাহলে তুমি কল দাও।’
তাহেরা বেগম তখন ধমকের সুরে ঐচ্ছিকে বললেন,
‘ঐচ্ছি, একটা কথা বারবার বলা আমার পছন্দ না। বলেছি না তোমাকে কল দিতে, এখন আর কোনো কথা না বলে জলদি কল দাও রাফসানকে।’
অগত্যায় রাফসানের নাম্বারে কল দিল ঐচ্ছি। রাগে ঠোঁট গুঁজে নাক ফুলাচ্ছে সে। কল রিসিভ হতেই ঐচ্ছি তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে উঠে,
‘রোজ গার্ডেনের বাইরে যে ফুচকা স্টলটা আছে, মা আপনাকে সেখানে আসতে বলেছে। জলদি চলে আসুন।’
ওপাশ থেকে কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই কলটা কেটে দিল ঐচ্ছি। মার মুখের দিকে তাকাতেই দেখলো তাহেরা বেগম ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, সঙ্গে বাবাও। ঐচ্ছি দীর্ঘশ্বাস ফেলে, জানে এখন তাকে এই মানুষগুলোর ক্রোধের স্বীকার হতে হবে।
__________
উত্তরের স্নিগ্ধ বাতাস পরম যত্নে রাফসানের চুললগুলোকে দোলা দিয়ে যাচ্ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বারবার হাত দিয়ে সেই চুলগুলো ঠিক করছে সে। রোজ গার্ডেনের পাশেই আছে ছোট্ট ছোট্ট কিছু বসার জায়গা। ঐচ্ছির মা বাবা আর রাফসান সেখানেই বসে কথা বলছে। ঐচ্ছি দূরে দাঁড়িয়ে। রাফসানের সামনে যেতে ইচ্ছে করছে না তার। কালকের রাতের কথাগুলো বার বার মনে পড়ছে। রাফসানের কন্ঠে ব্যাকুলতা ছিল, ঐচ্ছিকে পাওয়ার ব্যাকুলতা। ঐচ্ছির কোমল মন বলে রাফসানের এই ব্যাকুলতা মিথ্যে নয় সে সত্যিই ঐচ্ছিকে ভীষণ ভালোবাসে। কিন্তু ঐচ্ছি পারছেনা। কোনোভাবেই নিজের মনকে বোঝাতে পারছে না। রাফসানের প্রতি বিন্দুমাত্র অনুভূতি তার মনের দেয়ালে তৈরি হচ্ছে না। অথচ রাফসানের এই হাসি মুখটা দেখলে ঠিকই তার বুকের হৃৎস্পন্দন বাড়ে। এই লোকটা চমৎকার করে হাসতে পারে। হাসলে তার ডান গালটায় ছোট্ট একটা গর্ত পড়ে। ঐচ্ছির দৃষ্টি ক্ষণিকের জন্য আটকে যায় সেই গর্তে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঐচ্ছি। রাফসান জ্বীন না হয়ে মানুষ হলে কি ঐচ্ছি কখনো তাকে এইভাবে কষ্ট দিত? ঐচ্ছি মনে মনে ভাবে, না, সে ঠিক রাফসানকে ভালোবাসতে পারতো। কিন্তু জ্বীনের কথাটা মনে পড়তেই মন আর সায় দেয় না। বানোয়াট ভয়ে বিষাক্ত হয়ে উঠে মন। কোনো কারণ ছাড়াই রাফসানকে ঐচ্ছি ভয় পায়। অথচ রাফসান সবসময়ই তার সাথে স্বাভাবিক ব্যবহার করেই এসেছে। তাও সে ভয় পায়। ঐচ্ছির ধ্যান ভাঙে মোবাইলের রিংটোনের আওয়াজে। মোবাইলটা চোখের সামনে ধরতেই দেখে সাইভিদ কল দিচ্ছে। ঐচ্ছি ইতস্তত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মোবাইলটার দিকে তাকিয়ে থাকে। অনেক ভেবে কলটা সে রিসিভ করে। ঐচ্ছি কিছু বলার সুযোগ পাইনি তার আগেই সাইভিদ বলে উঠে,
‘রাফসান নাকি আমাদের মতো মানুষ না ঐচ্ছি, ও নাকি একটা জ্বীন, কথাটা কি সত্যি?’
ঐচ্ছি হতভম্ব। সাইভিদ এসব কি করে জানলো। সেদিন বিয়ের কথায় জিগ্যেস করায় ঐচ্ছি বলেছিল তার মত আছে। রাফসান যে জ্বীন সে ব্যাপারে সাইভিদকে একটুও বুঝতে দেয়নি। তবে সে কি করে জালনো? সাইভিদ তো এবার তুলকালাম কান্ড বাধাবে। জ্বীনের সাথে ঐচ্ছির বিয়ে, সাইভিদ কখনোই মেনে নিবে না। এই ভয়েই তো ঐচ্ছি সাইভিদকে রাফসানের ব্যাপারে কিচ্ছু বলেনি। তাহলে সাইভিদ জানলোটা কি করে? কে জানালো তাকে?
চলবে..