কৃষ্ণগোলাপ লেখিকা- জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা ১৩.

#কৃষ্ণগোলাপ
লেখিকা- জান্নাতুল ফারিয়া প্রত্যাশা

১৩.
এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়
একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু
এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়
একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু।
কোন রক্তিমা পলাশের স্বপ্ন
মোর অন্তরে ছড়ালে গো বন্ধু
এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়
একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু।
আমলকি পেয়ালের কুঞ্জে
কিছু মৌমাছি এখনো যে গুঞ্জে।
আমলকি পেয়ালের কুঞ্জে
কিছু মৌমাছি এখনো যে গুঞ্জে
বুঝি সেই সুরে আমারে বরালেত বন্ধু
এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়
একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু।

নীরবতার মাঝে এ যেনো এক খন্ড ভালোবাসা। মনের তিক্ততার দেয়াল ভেঙে গুড়িয়ে দিবে এই ভালোবাসা। সত্যিই আজ এই সন্ধ্যেটা স্বর্ণালী। আর এই স্বর্ণালী সন্ধ্যায় ভালোবাসার সুপ্ত এক বেড়াজালে আটকে গেছে দুটি মন। সঙ্গীতের এই সুর আলোড়ন জাগাচ্ছে দুটি প্রাণে। এই তো তবে শুরু নতুন কিছুর। সব বিষাদের সুর ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে এক নতুন অধ্যায়। যে অধ্যায় শুরু হবে এক প্রনয় মালা দিয়ে।

ঐচ্ছি খুব মনোযোগ দিয়ে গানটা শুনছে। রাফসান হঠাৎই গলা ঝেরে স্মিত হেসে বলে,

‘ এবার আমাদের উঠা উচিত, ঐচ্ছি।’

ঐচ্ছি খানিকটা বিব্রত দৃষ্টিতে রাফসানের দিকে তাকায়। এতক্ষণ সে এই গানের সুরে হারিয়ে গিয়েছিল। ঐচ্ছি অধর জোড়া প্রসারিত করে মৃদু হাসলো। বললো,

‘হ্যাঁ, চলুন।’

বেড়িয়ে পড়ল দুজন। নীরবে কেটে গেল অনেকটা সময়। বাসায় এসে পৌঁছল ঐচ্ছি। গাড়ি থেকে নেমে রাফসানের দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বললো,

‘আসছি তাহলে।’

প্রতিউত্তরে রাফসানও মিষ্টি হাসল। তারপর সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

_____________________

কপালের উপর ভাজটা আরো খানিকটা চওড়া হলো সায়মার কল দেখে। মাত্রই খাওয়া শেষ করে রুমে এসেছে ঐচ্ছি। বাবার কথা শুনে এমনিতেই তার মেজাজ ফরটি ফাইভ হয়ে আছে। সামনের শুক্রবারে নাকি ঐচ্ছি আর রাফসানের এংগেজমেন্টের ডেইট ঠিক করেছে তারা। তাকে একবার জিগ্যেস করার প্রয়োজন বোধ করলো না? কি অদ্ভুত! তার বিয়ে তার এংগেজমেন্ট অথচ তাকে কেউ কিছু জিগ্যেসই করে না। চরম মাত্রায় বিরক্ত সে। মাথার ভেতরটা ধপ ধপ করে লাফাচ্ছে। আর তার মাঝেই এই সায়মার কল ঐচ্ছির বিরক্তটাকে চরম পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে। মেয়েটাকে সামনে পেলে এখন নির্ঘাত ঐচ্ছি তাকে মাথায় তুলে আছাড় দিত। অপদার্থ একটা। চোখ মুখ কুঁচকে ফোনটা রিসিভ করে ঐচ্ছি। সায়মাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে তিক্ত সুরে বলে উঠে,

‘মরি নাই বেঁচে আছি। এমনে ফোন দিয়ে আমার খবর নিতে হবে না হারামী।’

সায়মা ফুঁসে উঠে। তেজি কন্ঠে বলে উঠে,

‘ঐ কুত্তি, তুই কাকে হারামী বলছ? হারামী তো তুই শালী। ফালতু কুত্তা একটা। তোর কারণে সবার কাছে আমাকে কথা শুনতে হয়। সামনে পাইলে থাপ্রাইতাম তোরে আমি।’

ঐচ্ছি বোকা বনে গেল। কই ভাবলো সে একটু রাগ দেখাবে তা না এখন কিনা তাকেই এই সায়মা পেতনির ত্রোপের মুখে পড়তে হলো! বুক চিরে বেরিয়ে আসে এক দীর্ঘশ্বাস। মলিন সুরে ঐচ্ছি বলে,

‘কি হয়েছে সামু বেবি? এত রেগে আছিস কেন?’

সামু আরো খানিকটা তেজ দেখিয়ে বলে,

‘ঐ কুত্তা তুই আমারে মিথ্যে বললি কেন? রাফসান ভাই জ্বীন? তোর কথায় বিশ্বাস করে আমি তোর ভাই সাইভিদরেও বলছি যে রাফসান ভাই জ্বীন তাই তুই উনাকে বিয়ে করতে চাস না। আন্টি আংকেল জোর করে তোকে বিয়ে দিচ্ছে। আর ঐ বেটা সাইভিদ একটু আগে আমাকে কল দিয়ে ইচ্ছামতো ঝাড়ছে। আমি নাকি উনার সাথে মজা করছি। প্র্যাংক করছি। এত সাহস আমার কি করে হলো। আরো কত কথা। ঐ কুত্তা তুই এমন পল্টি মারলি কেন? আমারে বলছস এক কথা আর সাইভিদ ভাইরে বলছস আরেক কথা। ক্যান? আমারে ঐ সাইভিদ বদমেজাজী হনুমানটার ধমক খাওয়ানোর জন্য ইচ্ছে করে এমন করছোস তাই না?’

এইটুকু বলে জোরে নাক টানে সায়মা। ঐচ্ছি ফুস করে একটা নিশ্বাস ছাড়ে। মিথ্যা বললে ঝামেলায় যে পড়তে হবে এটাই স্বাভাবিক। ঐচ্ছি ক্ষীণ সুরে বলে উঠে,

‘সরি রে দোস্ত।’

সায়মা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলে,

‘তোর সরির গোষ্ঠী কিলাই।’

ঐচ্ছি ভেজা গলায় বলে,

‘আমি সত্যিই সরি। আমার জন্য তোকে সাইভিদ ভাইয়ার কাছে ধমক খেতে হয়েছে। সাইভিদ ভাইয়াকে মিথ্যা বলা ছাড়া আমার কাছে আর কোনো উপায় ছিল না রে দোস্ত।’

সায়মা কিছুটা ধাতস্থ হয়। গলার স্বর খানিকটা নামিয়ে বললো,

‘মানে? সবটা ডিটেইলসে বল।’

বিষদ ব্যাখ্যা দিয়ে সায়মাকে সবকিছু বুঝিয়ে বললো ঐচ্ছি। কেন সে সাইভিদকে মিথ্যে বলেছে, সাইভিদ সত্যিটা জানলে কতটা ঝামেলা হতে পারতো, মিথ্যে বলা ছাড়া তার যে আর কোনো উপায় ছিল না সেটা সে খুব ভালো ভাবেই সায়মার মাথায় ঢুকিয়ে দেয়। অল্পতে নাক ফোলানো এই মেয়েটাকে ভীষণ ভালোবাসে ঐচ্ছি। এই তো তিন বছর আগে ভার্সিটির ফ্রেশারস প্রোগ্রামে মেয়েটার সাথে প্রথম পরিচয় হয় তার। আর তারপর বন্ধুত্ব। এই তো সবে তিন বছর পার হলো। অথচ তাদের বন্ধুত্ব দেখলে মনে হয় যেন তিন না সম্পর্কটা ত্রিশ বছরের। সায়মা যেমন ঐচ্ছি বলতে অজ্ঞান, ঐচ্ছিও তাই। সায়মার এই ছোট খাটো অভিমানগুলো যেন তাদের বন্ধুত্বটাকে আরো মজবুত করে তোলে। থাকটা কিছু বন্ধুত্ব, কিছু সম্পর্ক, কিছু ভালোবাসা এমন অভিমানে ঘেরা।

‘তুই কি তবে রাফসান ভাইকে বিয়ে করছিস?’

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঐচ্ছি। এই প্রশ্নের সঠিক কোনো উত্তর তো তারও জানা নেই। রাফসানের প্রতি সে কিছুটা হলেও দূর্বল সেটা সে খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। কিন্তু এই দূর্বলতা কি আদৌ কখনো ভালোবাসার রূপ নিবে? নাকি সময়ের স্রোতে এই দূর্বলতাটাও বিলিন হয়ে যাবে? ঐচ্ছির জানা নেই সেই উত্তর। ক্ষীণ সুরে বলে উঠে,

‘জানি না রে দোস্ত। আমি আর এসব নিয়ে ভাবতে চাই না। সব কিছু এখন ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। এখন ভাগ্য যা চাইবে তাই হবে।’

ওদিক থেকে সায়মাও দৃঢ় গলায় বলে উঠে,

‘হুম সেটাই ভালো। রাফসান ভাই যদি তোর ভাগ্যে থেকে থাকে তাহলে তুই হাজার চেষ্টা করেও এই বিয়ে আটকাতে পারবি না। আর যদি তোর ভাগ্যে রাফসান ভাইয়া না থাকে তবে রাফসান ভাইয়াও হাজার চেষ্টা করে তোকে পাবে না। এত টেনশন করিস না। দেখবি পরিশেষে সবকিছু ভালোই হবে।’

ঐচ্ছি শুকনো হাসি দেয়। কি জানি পরিশেষে আদৌ সবটা ভালো হবে কিনা?

__________________

সকালে ঘুম ভাঙলো তাহেরা বেগমের কর্কশ গলার স্বরে। সকাল সকাল এমন হইচই এ ঐচ্ছির মেজাজ বিগড়ে যায়। মাথার পাশ থেকে ওড়নাটা গায়ে জড়িয়ে বাইরে বের হয় সে। একরাশ বিরক্ত নিয়ে রান্নাঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। খিটখিটে মেজাজে বলে উঠে,

‘কি হয়েছে মা? সকালে সকালে এমন ভাষণ শুরু করেছো কেন?’

তাহেরা বেগম চোখ মুখ খিঁচে কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

‘ভাষণ কি আর আমি এমনি এমনি দিচ্ছি? দুদিন পর তার বিয়ে আর এখনো ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠার অভ্যাসটা করতে পারলো না। আল্লাহই জানে বিয়ের পর শাশুড়ির কাছ থেকে আমাকে কত কথা শুনতে হয়!’

কথাটুক বলে ঠোঁট গুঁজ করলেন তিনি। ঐচ্ছির বিক্ষিপ্ত নয়নে কিচ্ছুক্ষন মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে তেতো মুখে বলে উঠে,

‘এতই যদি দুশ্চিন্তা তাহলে বিয়ে দিচ্ছি কেন? তাও আবার একটা জ্বীনের সঙ্গে।’

তাহেরা বেগম কপালের ভাজটাকে লম্বা করলেন, গলার স্বর চওড়া করে বললেন,

‘থাপ্পড় খেতে না চাইলে এখন থেকে যা। আর পারলে গিয়ে কোনো সাইক্রেটিস্টকে মাথাটা দেখা। মাথায় বেমো হয়েছে তোর তাই এমন উল্টা পাল্টা বকছিস।’

ঐচ্ছি কাতর চোখে মায়ের দিকে তাকায়। অসহায় কণ্ঠে বলে উঠে,

‘মা আমি উল্টা পাল্টা কিছু বলছি না। রাফসান সত্যিই একটা জীন। বিশ্বাস করো।’

তাহেরা বেগম চুলার আঁচটা কমিয়ে দিলেন। ঐচ্ছির মুখের দিকে গম্ভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,

‘তো?’

ঐচ্ছি বিব্রত কণ্ঠে বললো,

‘তো মানে?’

তাহেরা বেগম ফিচেল গলায় বললেন,

‘তো মানে কিছু না। রাফসান জ্বীন হোক আর মানুষ তাতে আমাদের কারো কোনো আপত্তি নেই। তুমি রাফসানকে বিয়ে করছো এটাই লাস্ট ডিসিশন। এই নিয়ে আর কোনো কথা যেন না হয়।’

ঐচ্ছি রাগে ফুঁসে উঠে। ঐ জ্বীনটা খুব ভালো করেই তার মা বাবার মাথা খেয়েছে। ঐচ্ছির তো এখন ইচ্ছে করছে ঐ জ্বীনটাকেই আস্ত গিলে ফেলতে। হু, সামনে থাকলে এমন একটা ভাব দেখায় যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেনা, আর তলে তলে তার এত শয়তানি। ঐচ্ছিও মনে মনে ঠিক করে নেয় এত সহজে সে ঐ জ্বীনের কাছে ধরা দিবে না, আগে ঐ জ্বীনটাকে ইচ্ছে মতো নাকে দড়ি দিতে ঘুরাবে তারপর বাকিসব। ঐচ্ছি মনে মনে শয়তানি হাসি দিয়ে বলে,

‘রেডি থেকো মি. জ্বীন, এই ঐচ্ছিকে পেতে হলে তোমাকে অনেক পরিশ্রম করতে হবে। আমিও দেখে নিব তুমি কত আমার জ্বালানো সহ্য করতে পারো। তোমাকে আমি এত এত জ্বালাবো যে তুমি নিজে থেকেই এসে এই বিয়ে ভেঙে দিয়ে যাবে। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।’

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here