# ধ্রুব
অরিত্রিকা আহানা
পর্বঃ৬
পরেদিন দুপুর বেলা ইউনিভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরতেই দারোয়ান জানালো আমার আপুর শ্বাশুড়ি মারা গেছে। আপু যেহেতু দেশে নেই। বাবা মা দুজনকেই চিটাগাং যেতে হলো। আমি ইউনিভার্সিটিতে ছিলাম বিধায় বাসার চাবি আন্টির কাছে দিয়ে গেছেন। দারোয়ান আমাকে ধ্রুবদের বাসা থেকে চাবি নিয়ে নিতে বললো।
আমি চাবি নেওয়ার জন্য ধ্রুবদের বাসায় গেলাম। দরজা খুললো ধ্রুব। ভেতরে ঢোকার পর জানতে পারলাম আন্টি মার্কেটে গেছেন। ফিরতে সময় লাগবে। ধ্রুব আমাকে বসতে বললো। কিন্তু আমি বেরিয়ে যাবো ভাবছিলাম। একা বাসায় ধ্রুবর সাথে থাকতে আমার সংকোচ বোধ হচ্ছিলো। এদিকে বাসায় তালা বন্ধ! গিয়ে বসবো কোথায়? দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছিলাম।
তাই দাঁড়িয়েই রইলাম। ধ্রুব সদর দরজা খুলে সোফায় বসে টিভি অন করলো। ওর হাতে ফোন, টিভি সে দেখছে না। ফোন নিয়েই ব্যস্ত! আমি দ্বিধাগ্রস্তভাবে ওর অপজিট সোফায় বসলাম। ও আমার দিকে রিমোট বাড়িয়ে দিয়ে বললো,”বোর হলে টিভি দেখতে পারো।” আমি রিমোট নিলাম। টিভিতে আমার মন নেই। আমি আড়চোখে ধ্রুবকে লক্ষ্য করছিলাম। দেখতে দেখতে হিপনোটাইজড হয়ে যাচ্ছিলাম! ওর মায়াভরা মুখটা আমার ভেতরে হাহাকারের বন্যা বইয়ে দিলো। একদিন যেই মানুষটার সমগ্র এটেশনের কারণ ছিলাম আমি আজ সেই মানুষটাই আমার প্রতি সবচেয়ে বেশি অনাসক্ত ! কি করি সহ্য করবো আমি! চোখের পানি নিঃশব্দে গাল গড়িয়ে নিচে পড়লো।
চোখ মুছে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। ধ্রুব মনোযোগ দিয়ে ফোন স্ক্রল করছিলো। আমাকে ভূতগ্রস্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো, “কি?”
ওর চোখে চোখ পড়তেই ফের কান্না চলে এলো। ঝরঝর করে কেঁদে ফেললাম। ধ্রুব সোজা হয়ে বসলো। অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে থেকে বললো,”কাঁদছো কেন?” আমি কান্নারত কন্ঠে বললাম, “আমার ভুল হয়ে গেছে ধ্রুব। আই এম সরি! ”
ধ্রুবর বিস্ময়ভাব কেটে গেলো। চেহারায় কষ্টের ছাপ দেখা দিলো। বোধকরি, আমার কান্নার হেতু সে বুঝতে পেরেছে। তবুও নিরবে চেয়ে রইলো কেবল। আমার কান্নার বেগ তাতে আরো বেড়ে গেলো। আমি অসহায় ভাবে কেঁদে চললাম। কাঁদতে কাঁদতেই বললাম,”আমি তোমাকে ভালোবাসি ধ্রুব। আমি তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবো না।”
আমার কান্না, আমার আকুলতা কোনটাই মিথ্যে নয়। সেইজন্যই বোধহয় ধ্রুবর চোখে কোন অবিশ্বাস নেই। ও আমাকে বিশ্বাস করছে। আশার আলো খুঁজে পেলাম। কিন্তু মুহূর্তেই সেই ক্ষীণ আলো নিভে আমার সমস্ত পৃথিবীটাকে অন্ধকার হয়ে গেলো তখন ধ্রুব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
—“আই এম সরি নিশাত! আমার পক্ষে তরুকে ঠকানো সম্ভব নয়। আমি ওকে ভালোবাসি।”
আমার কান্না থেমে গেলো। স্তব্ধ হয়ে ধ্রুবর দিকে চেয়ে রইলাম। ধ্রুব নরম গলায় বললো,”তরু খুব ভালো মেয়ে। আমি ওকে মাঝপথে ছেড়ে দিতে পারি না।”
লজ্জায়, অপমানে বিবর্ণ হয়ে গেলাম। জর্জরিত হয়ে গেলাম প্রত্যাখানের আঘাতে! এরপর আর কিছু বলার থাকে না। ফর দ্যা লাস্ট টাইম আমি পুরোপুরিভাবে উপলব্ধি করলাম ধ্রুবকে আমি সত্যিই হারিয়েছি। ওকে পাওয়ার অধিকার আমার চিরদিনের জন্য শেষ হয়ে গিয়েছে। সেই অধিকার এখন তরুর! অনুতপ্ত কন্ঠে বললাম,”ইট’স ওকে। ভুল আমারই। আমার বোঝা উচিৎ ছিল এখন এসব বলে কোন লাভ নেই। তোমার আমার সম্পর্কতো অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে।”
ধ্রুব মায়াভরা কোমল কন্ঠে বললো,” আমি তো ভেবেছিলাম তুমি সত্যিই নতুন করে শুরু করতে চাইছিলে। তোমাকে হার্ট করার কোন ইন্টেশন আমার ছিলো না।”
যথার্থই এখন আর এসব বলে কোন লাভ নেই সেটা বুঝতে আমার কোন অসুবিধে হলো না। ধ্রুব তার অতীতটাকে মেমোরি কার্ডের মতনই পুরোপুরি ফরমেট করে সবকিছু আবার নতুন করে শুরু করেছে। সুতরাং আমার সেখানে প্রবেশ অশোভন। চাপা কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিলো তথাপি প্রসঙ্গ বদলাবার চেষ্টা করে বললাম,”আন্টি কখন আসবেন?”
তাতে অবশ্য কাজ হলো। ধ্রুব স্থিরদৃষ্টিতে কিছুক্ষন আমার দিকে চেয়ে থেকে আন্টির নাম্বারে ডায়াল করলো। আমি ভেতরে চলে গেলাম।
আন্টি আসা পর্যন্ত আমি ভেতরের রুমেই বসে রইলাম। একটু আগে যা ঘটেছে তারপর আর ধ্রুব মুখোমুখি বসে থাকা চলে না। লজ্জায়, অপমানে সমস্ত শরীর নুইয়ে আসছে। যুক্তিহীন, ভিত্তিহীন, কথাবার্তা মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। মনে হচ্ছে ধ্রুব হয়ত ভেতরে ভেতরে আমাকে নিয়ে পরিহাস করছে! মজা নিচ্ছে! ওয়াশরুমে ঢুকে অনেকক্ষণ কাঁদলাম। নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলাম। ঘন্টাখানেক বাদে আন্টি আসলেন।
ধ্রুবকে দরজা খোলা রেখে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে বললেন,”কি রে তুই বাসার দরজা হাঁ করে বসে আছিস কেন?”
ধ্রুব আন্টিকে জানালো বাসায় আমি আছি। আন্টির ভেতরে ঢুকে আমার চোখমুখের অবস্থা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। চিন্তিত মুখে বললেন,” তোর চেহারার এই অবস্থা কেন? কি হয়েছে?”
ধ্রুব আন্টির পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। ওর চোখে সহানুভূতি। লজ্জা, গ্লানি আমার ভেতরটাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কয়লা বানিয়ে দিচ্ছিলো। ওর চোখের সামনে থেকে ছুটে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিলো। ওর প্রত্যাখ্যান আমি সইতে পারলেও সিমপ্যাথি পারছিলাম না। কারণ ঐ জিনিসটা বারবার আমাকে নিজের কাছে ছোট করে দিচ্ছিলো। আমি আন্টিকে বললাম, আমার শরীর খারাপ লাগছে আমি বাসায় যেতে চাই। কিন্তু আন্টি আমাকে কিছুতেই উপরে যেতে দিলেন না। জোর করে আটকে রাখলেন। নিজের হাতে খাবার খাওয়ালেন। মাথা ব্যথার ওষুধ লাগিয়ে দিলেন। সবশেষে উনার ঘরে আমাকে নিরিবিলি শোওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। ঐমুহূর্তে যেটা আমার জন্য খুব দরকারি ছিলো। ধ্রুবকে হারানোর দমবন্ধ অনুভূতি সামলে নিতে একা থাকার বিকল্প কিছু নেই। আমি বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে চুপচাপ শুয়ে রইলাম! সেদিন মা,বাবা ফিরলেন না। আমি ধ্রুবদের বাসায় রয়ে গেলাম।
সেই ঘটনার পর আমি খেয়াল করলাম ধ্রুব আমার সাথে কথা বলতে চাইতো। আমার সাথে সহজ হওয়ার চেষ্টা করতো। কিন্তু আমি সুযোগ দিতাম না। দূরে দূরে সরে থাকতাম। পরেরদিন বাবা মা ফিরলে আমি বাসায় চলে গেলাম।
ওদের বাসা থেকে চলে আসার পর আমার একটাই উদ্দেশ্য হয়ে উঠলো। সেটা হলো ধ্রুবকে ভুলে যাওয়া। এবং আবারো ব্যর্থ হলাম! ধ্রুব আমার মনের আকাশে ধ্রুবতারার ন্যায়
জ্বলজ্বল করতে লাগলো। আমার আঁখিপল্লবে অশ্রু হয়ে দেখা দিতো ধ্রুবর স্মৃতি!
তবুও পারতপক্ষে আমি ধ্রুবর সামনে যেতাম না। কিন্তু আন্টির সাথে রোজই দেখা হত। কখনো কখনো আন্টি নিজে আসতেন আবার কখনো কখনো ধ্রুব বাসায় না থাকলে আমিই যেতাম।
তিনচারদিন বাদে একদিন আমি ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরছিলাম। বাসার গেটে ধ্রুবর সাথে দেখা হয়ে গেলো। না চাইতেও আমার দৃষ্টি ওর ওপর গিয়ে পড়লো। ওকে খুব টায়ার্ড আর অস্থির লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো খুব তাড়ায় আছে। আমি নির্লিপ্ত থাকতে পারলাম না। উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে? কোন সমস্যা?”
ধ্রুব আমার কথার জবাব না দিয়ে তরতর করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। আগের মত হলে অপমানিত বোধ করতাম কিন্তু এখন সব সয়ে গেছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধীরেসুস্থে উঠে বাসায় গেলাম। বাসায় ঢুকতেই সুলতানা জানালো আন্টি অসুস্থ, কন্ডিশন সিরিয়াস! মা ধ্রুবদের বাসায়। আমি ব্যাগ রেখে একছুটে ধ্রুবদের বাসায় চলে গেলাম।
নিচে অ্যাম্বুলেন্স এসেছে আন্টিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ধ্রুবর বোন এখনো এসে পৌঁছায় নি। তাঁর জন্য অপেক্ষা করার সময় নেই। অতএব ডিরেক্ট হস্পিটালে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলো তাঁকে। মা জানালো তিনি যাচ্ছেন আন্টির সাথে। আমি মায়ের জিনিসপত্র সব গুছিয়ে দিলাম। ধ্রুব আর মা মিলে আন্টিকে হস্পিটালে নিয়ে গেলো।
রাত আটটার দিকে মায়ের কাছে ফোন করে জানতে পারলাম আন্টির কন্ডিশন এখন আগের চাইতে ভালো। হার্টঅ্যাটাক ছিলো। বিপদ এখনো পুরোপুরি কাটে নি। তাই কিছুদিন অভজারবেশনে রাখতে হবে। আজকে রাতে মা আন্টির কাছেই থাকবেন। ধ্রুব আর ওর বোন বাসায় আসছে। আমাদের বাসায় খাবে। আমি যেন ওদের জন্য রান্না করে রাখি। খাওয়ার পর ধ্রুব হস্পিটালে খাবার নিয়ে যাবে।
আমি আর সুলতানা মিলে সব রান্নাবান্না করে টিফিনে ভরে রাখলাম। ধ্রুব এলো সাড়ে নয়টার দিকে। ওদের ফ্ল্যাটে গিয়ে গোসল সেরে উপরে উঠলো। আমি আন্টির খোঁজখবর জিজ্ঞেস করে টেবিলে খাবার দিয়ে ভেতরে ঘরে গিয়ে বসে রইলাম। পরে মনে হলো কাউকে খেতে দিয়ে এভাবে চলে আসাটা খুবই অভদ্রোচিত হবে। তাই ডাইনিং টেবিলে ওর অপজিটে চেয়ার টেনে বসলাম। ও একটা কথাও বললো না। চুপচাপ খাওয়া শেষে টিফিন বক্স নিয়ে হস্পিটালে চলে গেলো।
আন্টিকে চারদিনের মত হস্পিটালে রাখা হয়েছিলো। ধ্রুবর বড় বোন প্রেগন্যান্ট! তাই বাসার সব কাজ, রান্নাবাড়া, এমনকি হস্পিটালে আন্টির জন্য নিয়ে যাওয়া কাপড়চোপড় সব আমিই ধুয়ে দিতাম। মা রোজ সকালে যেতো। সারাদিন হাসপাতালে আন্টির কাছে থেকে রাতে ধ্রুবর সাথে ফিরতো। খাবার নিয়ে ধ্রুব আবার হস্পিটালে চলে যেত। আমি ওর সামনে খুব একটা যেতাম না। সংকোচ বোধ হত। খাবার দাবার সব সুলতানাকে দিয়েই পাঠাতাম। তবে মাঝেমাঝে ও নিজেই এটা ওটা নিতে আসতো। কোনকিছুর প্রয়োজন হলে আমাকে খবর পাঠাতো।
চারদিন বাদে আন্টিকে রিলিজ করা হলো। আমি আর মা আন্টিকে দেখতে গেলাম। মা ভেতরে ঘরে বসে আন্টির সাথে গল্প করছিলো। আমি কিছুক্ষন থাকার পর আন্টির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমাদের বাসায় চলে আসছিলাম, সদর দরজা পেরোবার আগেই আচমকা হাতে টান অনুভব করলাম। ধ্রুব আমাকে টেনে ওর রুমে নিয়ে গেলো। এবং আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই হি কিসড মি ফর থার্টি সেকেন্ডস! ধ্রুব আচমকা এমন কাজ করতে পারে তা আমি স্বপ্নেও ভাবি নি! থর থর করে কাঁপতে শুরু করলাম আমি! বুকের ভেতর তখন অদ্ভুত রকমের ধুপধাপ শব্দ শুরু হলো। জীবনে এই প্রথমবার কেউ আমাকে চুমু খেয়েছে!
ধ্রুব যখন আমাকে ছাড়লো তখন আমি দুহাতের মুঠোয় ওড়নার কোনা চেপে ধরে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। লজ্জায় মাথা তুলতে পারছিলাম না। ধ্রুব আমার মাথাটা টেনে ওর বুকের সাথে চেপে ধরে বললো,”আই লাভ ইউ!”
কথাটা ধ্রুব একবারই বলেছিলো। কিন্তু আমার কানে হাজারবার, লক্ষবার হয়ে ইকো হলো। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম! কিংকর্তব্যবিমূঢ়! ঠিক সেইমুহূর্তেই ধ্রুব অসহায় কন্ঠে বললো,”আমার খুব হেল্পলেস লাগছে নিশাত। আমি কি তরুকে ঠকালাম?”
ধ্রুবকে বাস্তবিকই খুব উদ্ভ্রান্ত এবং দিশেহারা দেখাচ্ছিলো। দোটানায় ভুগছিলো সে। অসহায় বোধ করছে। আমি ধ্রুবকে ছেড়ে সরে দাঁড়ালাম। ওর ওপর আমার কোন রাগ হলো না। তরুর ওপরও হলো না। আমি জানি তরু খুব ভালো মেয়ে! ও ধ্রুবকে ভালোবাসে। আমিও বাসি!
আমি ধ্রুবকে শান্ত করে বসালাম। দরজা খুলে পানি নিয়ে এলাম ওর জন্য। হাত দিয়ে ওর কপালের চুলগুলো গুছিয়ে দিলাম। ও শূন্য দৃষ্টিতে আমার কাজকর্ম দেখে যাচ্ছিলো। আমি মিষ্টি হেসে বললাম,”তুমি খামোখা কষ্ট পাচ্ছো। তুমি তরুকে ঠকাতে যাবে কেন? তুমি তো ওকে ভালোবাসো।”
ধ্রুব গম্ভীর গলায় বললো,”আই নেভার কিসড হার!”
আজকের আগ পর্যন্ত আমি নিজেও জানতাম না ধ্রুবকে আমি এতটা ভালোবাসি। ভেবেছিলাম তরুর সাথে ওকে দেখে ঈর্ষাবোধ হচ্ছিলো, জেলাস ফিল করছিলাম, আমাকে ভুলে এত তাড়াতাড়ি ও নতুন রিলেশনে যেতে পারে ভেবে কিঞ্চিৎ অপমান বোধও হয়েছিলো সেই জন্যেই তরুর সাথে একটা কম্পারিজন চলে এসেছিলো মনের ভেতর। মনে মবে সন্দেহ ছিলো তরুর প্রতি জেলাসি থেকেই বোধহয় ধ্রুবকে ফিরে পাওয়ার আকাঙ্কা করছিলাম। কিন্তু আজ বুঝতে পারলাম আমি ধ্রুবকে ঠিক কতটা ভালোবাসি! ওর জন্য নিজের জায়গা কেন আমি আমার সমস্ত পৃথিবীটা ছেড়ে দিতে পারি। ওর অসহায় চেহারা আমার কাছে শূলবেদনার চেয়েও বেশি যন্ত্রণাদায়ক!
আমি স্মিত হেসে বললাম,”তাতে কি হয়েছে? ঝোঁকের বশে একটা চুমু খেয়ে ফেলেছো বলে তরুকে ঠকানো হয়ে গেলো? এটা কোন কথা?”
ধ্রুব বিমূঢ়, বিভ্রান্ত গলায় প্রশ্ন করলো,”ঝোঁকের বশে?” আমি বললাম,”হ্যাঁ। ঝোঁকের বশে।”
ধ্রুব যেন নিজেকেই প্রশ্ন করলো। বলল,”কিন্তু কেন?”
আমি খুব একটু হাসার ভান করে বললাম,”তার কারণ তুমি ইদানীং আমাকে নিয়ে খুব ভাবছিলে। আমার জন্য তোমার কষ্ট হচ্ছিলো।”
ধ্রুব চুপ করে রইলো। কথাটা যে সত্যি তা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। বললাম,”আমি সেদিন তোমাকে কথাগুলো বলেছিলাম বলেই তুমি এমন কান্ড করেছো।”
ধ্রুব অবিশ্বাসী কন্ঠে ফের প্রশ্ন করলো,”তুমি সিউর?” আমি দ্বিধাহীন ভাবে বললাম,”হান্ড্রেড পার্সেন্ট সিউর। তুমি তরুকেই ভালোবাসো।”
ধ্রুব ফ্যালফ্যাল করে আমার দিকে চেয়ে রইলো। আমি সেদিকে পাত্তা না দিয়ে বললাম,আচ্ছা, একটা কথা বলোতো সেদিন আমি কথাগুলো বলার আগ পর্যন্ত কি তোমার আমার কথা মনে হয়েছিলো?”
ধ্রুবর চোখমুখ করুণ হয়ে এলো। এর মানে আমার কথাটাই ঠিক। সেদিনের আগ পর্যন্ত ধ্রুবর আমার কথা মনে হয় নি। আমি এবার বেশ জোর দিয়েই বললাম, “তো? তুমি খামোখা এসব চিন্তা করছিলেন। আসল কথাটা হচ্ছে আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ায় আমার প্রতি একটা সিমপ্যাথি তৈরী হয়েছে তোমার। এবং তুমি সেটাকে ভালোবাসা ভেবে বসে আছো। তার অবশ্য কারণও আছে।আন্টির অসুস্থ অবস্থায় আমার সাথেই সবচেয়ে বেশি মেলামেশা হয়েছে তোমার। আমি তোমাদের বিপদে সহায়তা করেছি তাই আমাকে ফিরিয়ে দেওয়ার তোমার মনে খানিকটা অপরাধবোধ তৈরী হয়েছে। তুমি ভাবছো তুমি আমার সাথে অন্যায় করছো।”
—“তারমানে তুমি সিউর আমি তরুকে ভালোবাসি?”, দ্বিধাগ্রস্ত গলায় প্রশ্ন করলো ধ্রুব।
—“হ্যাঁ। তার কারণ তুমি আমার কাছে থাকা সত্ত্বেও তরুকে নিয়ে ভেবেছো।”
ধ্রুব আর কোন কথা বললো না। বেরিয়ে গেলো। আমি ভেতরের তরু নিজেকে নিয়ে রসিকতা করতে শুরু করলো। যাকে ফিরে পাবার জন্য এত আয়োজন ফের তাকে হারানোর আক্ষেপে গুমড়ে কেঁদে উঠলো। তবুও চাইছিলাম না ধ্রুব কোন দোটানায় থাকুক। আমার জন্য কোনরকম কষ্ট পাক! হ্যাঁ! আমি চাইলে এইমুহূর্তে হয়ত ধ্রুবর সুযোগ নিতে পারতাম। সেই সুযোগ আমার ছিলো কারণ এইমুহূর্তে আমি যা বলতাম ধ্রুব ঠিক তাই করতো। আমি যদি তরুকে ছেড়ে দিতে বলতাম ও তরুকে ছেড়ে দিতো। কারন ওর কাছে এইমুহূর্তে তরুকে ভালোবাসার চাইতে আমার প্রতি অপরাধবোধ বেশি প্রবল। ঠিক সেই কারনেই ধ্রুব আমার কাছে ছুটে এসেছে। কিন্তু আমি জানি এক সময় না একসময় ধ্রুব ঠিকই বুঝতো সে তরুর সাথে অন্যায় করেছে। ঐ একটা সত্যি আমাদের দুজনের সম্পর্কের মাঝে সীমাহীন দূরত্ব সৃষ্টি করে দিতো। ধ্রুব মুখে আমাকে মেনে নিলেও হয়ত সারাজীবন অপরাধবোধে ভুগতো। দুটো মানুষ পাশাপাশি থাকবে অথচ তাদের মনের মিল থাকবে না, এমন সম্পর্ক আমার চাই না। চাই না আমার এমন ধ্রুব যে আমার কাছে থাকা সত্ত্বেও অন্য কাউকে নিয়ে ভাববে। তাই আমি যা করেছি ঠিক করেছি।
.
.
.
চলবে