উমা [কপি করা নিষেধ] ২৮তম_পর্ব

উমা [কপি করা নিষেধ]
২৮তম_পর্ব

রুদ্র উমার মাঝে এই পরিবর্তন মেনে নিতে পারলো না। ভাবলো গ্রাম থেকে দূরে থাকলে হয়তো মেয়েটি স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তাই আজ কালীগঞ্জ যাবার কথা বলবে সে। উমা তখন কাপড় গুছাচ্ছিলো।
“আমাদের ও বাড়ি যেতে হবে। কাল উপজেলার দিকে যাবো যে। অনেক গোছানো বাকি”
“বেশ, আমি রাজশ্বী আর মাকেও গোছাতে বলে দেই।”

উমার স্বাভাবিক বক্তব্যে অবাক হয় রুদ্র। চোখ কুচিয়ে বলে,
“উনারা কি গোছাবেন?”
“ওহ, আপনাকে বলা হয় নি মা রা এখন থেকে আমার সাথেই থাকবে“
“তোমার সাথে থাকবে মানে? একটু খোলসা করে বলবে?”
“অবশ্যই, আমি মায়েরা আমার সাথে কালীগঞ্জে যাবেন। আমি তাদের একা ফেলে কালীগঞ্জে যাবো না। রাজশ্বী, গোপালের ভবিষ্যতটাও দেখতে হবে। মা একা তাদের কিভাবে পালবে? তাই এই সিদ্ধান্ত”

নির্লিপ্ত চিত্তে কথা গুলো বললো উমা। রুদ্র উমার এরুপ আচারণে শুধু অবাক ই হলো না, খানিকটা বিরক্ত ও হলো। উমার নিজের মা হলে হয়তো রাজীও হয়ে যেত সে, কিন্তু রতী উমার সৎ মা, শুধু তাই নয় রতীর চেয়ে স্বার্থপর খুজে পাওয়া ভার। সেই লোভী নির্দয় নারীকে তার বাড়িতে নিয়ে যাবার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে হলো না। রুদ্র ঈষৎ বিরক্তি মাখা গলায় বললো,
“যদি পালতে সমস্যা হয়, আমি না হয় মাসে মাসে তাদের কিছু টাকা দিয়ে দিবো। রাজশ্বী এবং গোপালের পড়াশোনা, রাজশ্বীর বিয়ের সব খরচ না হয় আমি ই দিবো। কিন্তু তাদের আমাদের সাথে কালীগঞ্জে নেবার কোনো মানেই হয় না। মা-বাবাকে কি উত্তর দিবো? একেই তোমার পড়াশোনার জন্য কম যুদ্ধ তো আমাকে করতে হচ্ছে না। তাদের মতের বিরুদ্ধে আমরা কালীগঞ্জ যাচ্ছি। সেখানে এই উটকো ঝামেলার কোনো মানে নেই। আর লোকে কি বলবে? কখনো দেখেছো মেয়ের বাবা-মাকে শ্বশুর বাড়ি থাকতে? অহেতুক মানুষ কথা রটাবে। সাহায্য অন্য ভাবেও করা যায়”

রুদ্র এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললো, উমা হাতের কাজ থামিয়ে শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রুদ্রের দিকে। কিছুক্ষন চুপ থেকে বরফ শীতল কন্ঠে বললো,
“আচ্ছা, এই লোক কি বলবে বা ভাববে কথাটা না বললে কি নয়? শ্বশুরের মৃত্যুতে মাল খেয়ে যখন টাল হয়ে পড়ে ছিলেন তখন কি পরোয়া করেছিলেন? তবে এখন কেনো? আর মেয়েদের জন্য আলাদা নিয়ম কেনো? কেনো ছেলেরা তার মা-বাবার পাশে না থাকলে সমাজ বলে কি পাষন্ড ছেলেটি, বৃদ্ধ বিধবা মা এবং ভাই বোনকে ছেড়ে আলাদা থাকে। আর মেয়ে যদি সন্তানের দায়িত্ব ও পালন করতে চায় তখন বলে উঠে লোকে কি ভাববে? টাকা দিয়ে দিলেও তো হয়। বিয়ের পর বাবা-মার প্রতি দায়িত্ব পালন করলে লোকে কি ভাববে! কন্যা সম্প্রদান করে দিলে কি সত্যি মেয়ের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়? কনকাঞ্জলীর পর মেয়ের কোনো ঋণ থাকে না? সে মেয়ে বলে তার ভাই বোনের প্রতি কি আদৌও কোনো দায়িত্ব পালন করতে পারবে না? ব্যাপারগুলো কি হাস্যকর না!”

উমার কথা শুনে থমকে যায় রুদ্র। উমার শান্ত চাহনীতে নিজের ষোড়শীকে যেনো কোথাও হারিয়ে ফেলেছে। সেই ভীত, সঙ্কিত উমাটি আজ নেই। আজ এক নির্জীব শক্ত পাথর দাঁড়িয়ে আছে রুদ্রের সামনে। এবার খানিকটা দমে রুদ্র। কিঞ্চিত বিনয়ী স্বরে বললো,
“তুমি ভুল বুঝছো উমা, আমি কিন্তু বলি নি দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। আমি বলছি দায়িত্ব বিভিন্নভাবেও পালন করা যায়। আর তোমার মায়ের গুনের তো শেষ নেই, মা হবার মতো যোগ্যতাও তার নেই। তোমার উপর কম অত্যাচার তো সে করে নি। আস্ত একজন লোভী মহিলা। তাকে নিয়ে এতো মাতামাতির কি খুব দরকার?”
“বাবাও তো অনেক কিছুই করেছেন, তাই বলে কি বাবাকে ছেড়ে দিতে পারবেন আপনি? পারবেন না তো? তাহলে আমাকে এই প্রশ্নটি করার কি মানে? আপন মায়ের মুখখানাও আমার মনে নেই, মা বলতে আমি এই না্রীকেই চিনে এসেছি। আজ তাদের এখানে ছেড়ে এতো দূরে কিভাবে যাই বলুন তো? আপনার মত না থাকলে আমি জোর করবো না। আমি তো জোর করার কেউ নই ও, বাড়ি আপনার, টাকা আপনার; সুতরাং সিদ্ধান্ত ও আপনার। পরজীবি মানুষের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে হবে এমনটা বাধ্যবাধকতা নেই। আমি আসছি, দেখে আসি গোপালটা খেয়েছে কি না”

বলেই ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো উমা। রুদ্র খানিকটা আহত হলো, উমার ভালোর জন্য ই সে রতীকে তার থেকে দূরে রাখতে চাচ্ছে। কিন্তু উমা সেটা বুঝতেই চাচ্ছে না। উপরন্তু তাকেই ভুল বুঝছে। সে তো একটিবারের জন্য গোপাল কিংবা রাজশ্বীর ব্যাপারে অমত জানায় নি। উমার বোন হিসেবে সকল দায়িত্বের পালন সে করতে রাজী। তবে কেনো উমা তাকে বুঝে না, কেনো বারে বারে তাকেই পৃথক করে দেয় নিজের থেকে।

নিজ রুমে একা একা বসেছিলো রতী। নিখিলের সকল জামাকাপড় গুলো গুছিয়ে স্টিলের ট্রাংকে রেখে দিয়েছে সে। ট্রাংকটির চাবিখানা নিজের বালিশের তলে রাখলো সে। মানুষটা নেই, অথচ দিনগুলো কেটেই যাচ্ছে। কিছুই আটকে থাকে না কারোর জন্য। শুধু মানুষটির জায়গাতাই ফাঁকা। এমন সময় উমার আগমন ঘটে সেই রুমে। শান্ত গলায় বলে,
“আসবো মা?”

রতী চোখ মুখে নেয় আচলে। ভাঙ্গা গলায় বলে,
“আয়”

উমা ভেতরে এসে তার পাশে বসে। রতী ধীর কন্ঠে বলে,
“কিছু বলবি?”
“তুমি তো জানো আমি কলেজে ভর্তি হয়েছি। সেজন্য কালীগঞ্জ যেতে হবে। আমি চাচ্ছিলাম, তোমরা যেনো আমার সাথে যাও।“
“এ ভিটে ছেড়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না।“

স্পষ্ট কন্ঠ রতী কথাটা বলে দেয়। উমা অবাক কন্ঠে বলে,
“আমার সাথে যেতে আপত্তি আছে তোমার?”
“আমাদের এখানে মেয়ের বাড়ির পানিটুকু খাওয়া বর্জিত সেখানে তোর বাড়ি কেনো থাকবো বলতো?”
“ছেলে হলেও এভাবে ফিরিয়ে দিতে?”
“হয়তো না, কারণ সে ছেলে। এটাই নিয়ম উমা। আর তোর বাড়ি কি ভরসায় থাকবো বলতো? জামাই এর খোটা শুনে এই বয়সে থাকার ইচ্ছে আমার নেই। গতবারের ভুলখানা আবার করতে চাই না। আর আমি চাই না আমার গোপাল সারাটাজীবন রুদ্রের টাকায় বড় হোক। তুই যদি কামাই করতি হয়তো আপত্তি হতো না। আগের অবস্থা আর এখন তো এক নয় উমা। তখন তোর বাবা জীবিত ছিলেন, এখন সে বট গাছ টুকু নেই। সামনে রাজশ্বীর বিয়ের ব্যাপার ও আছে।“
“আমি কিন্তু গোপাল এবং রাজশ্বীর সুন্দর ভবিষ্যতটা ভেবেই বলেছিলাম। কালীগঞ্জের ভালো স্কুলে গোপাল পরতো। রাজশ্বীর পড়াশোনাটাও হতো।“
“জানি, তুই ওদের নিয়ে অনেক ভাবিস। কিন্তু আমি পরজীবি হয়ে থাকতে পারবো না। তুই চিন্তা করিস না, তোর বাপের দোকান টা ভাড়া দিয়ে দিবো। পশ্চিমের জমিগুলো বেঁচে দিবো। তাতে যা পয়সা পাবো, আমাদের তিনজনের চলে যাবে। আমার ভাইরাও তো আছে। ঠিক চলে যাবে। আমাদের নিয়ে এতটা ভাবিস না। যদি সমস্যা হয় তখন না হয় তোর থেকে চাবোক্ষনে। কিন্তু এই ব্যাপারটা নিয়ে জিদ করিস না। তোর শ্বশুর-শাশুড়ির কাছে তোর কোনো সম্মান থাকবে না। অহেতুক কথা শুনতে হবে।“
“তুমি সত্যি কি এসব নিয়ে ভাবো?”
“নাহ, ভাবি না। কিন্তু এখন ভাবতে ইচ্ছে হয়। তোর বাপটা তো উপর থেকে দেখছে। লোকটা অহেতুক কষ্ট পাবে। মানুষটা তো গোবেচারা। এসব ছলছাতুরি বুঝে না। তাই তাকে কষ্ট দিতে চাই না।“

উমা চুপ করে থাকলো। বুকের কোনে ব্যাথা করছে। এক চিনচিনে ব্যাথা। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“তাহলে তুমি যাবে না? আচ্ছা আলাদা বাড়ি নিলেও যাবে না?”
“যেদিন নিজে কামাই করবি, আমি সেদিন যাবো। তখন লোভ করলেও সেটা তোর পয়সা হবে।“

ম্লান হাসি হেসে রতী কথাটা বলে। একজন মানুষের মৃত্যু সবাই কে কোনো না কোনো ভাবে বদলায়। বদলেছে উমা, বদলেছে রতীও। সময় ই সবকিছুর মলম, সময়ের সাথে সাথে সবকিছুই বদলায়। উমা আর বসে রইলো না। ধির কন্ঠে বললো,
“ঘুমিয়ে পড়ো। কাল ও বাড়ি চলে যাবো। সকালে উঠতে হবে। আসি”
“আয়”

উমা আর অপেক্ষা করলো না। রতীর ঘর থেকে বেড়িয়ে উঠোনে গিয়ে দাঁড়ালো। কালচে আকাশের বুকে হাজারো তারার মেলা বসেছে। তারা দেখতে ভালোই ঠেকছে। ছোট বেলায় ঠাম্মা বলতো,
“মরলে তারা হয়ে যায় মাইনশ্যে”

উমার মনে হলো তার পিতাও হয়তো আকাশের এক কোনে লুকিয়ে আছে। উমা ধীর স্বরে বললো,
“আমি একদিন নিজ পায়ে দাঁড়াব বাবা, তুমি চিন্তা করো না। এই তিনজনকে আমি দেখে রাখবো।“

১৬.
কালীগঞ্জে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে গিয়েছে উমা এবং রুদ্র। ভ্যান এসেছে, কাপড়ের ট্রাংক গুলো তোলা হয়েছে। উমা সকলকে গড় করে প্রনাম করলো। লক্ষী দেবী না চাইতেও বললেন,
“দীর্ঘায়ু হও, সুখী হও”

রুদ্র লক্ষী দেবীকে জড়িয়ে বললো,
“আসি মা, আমি একখান মোবাইল ফোন কিনে পাঠিয়ে দিব। তারপর যোগাযোগ করবো প্রতিদিন”
“না গেলে হয় না?”
“না মা, সম্ভব না”

লক্ষী দেবী দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। অভিনব সিংহ কিছু বললেন না। রুদ্র এবং উমা বেড়িয়ে গেলো। লক্ষী দেবী ধীর স্বরে বললো,
“দূগগা, দূগগা”

রুদ্ররা চলে গেলো, সেই মূহুর্তে দীপঙ্কর ছুটে এলো। হাফতে হাফতে বললো,
“জ্যেঠু, ফোন এসেছে গুদামে……………

চলবে

[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব ইনশাআল্লাহ আগামীকাল রাতে দিবো।]

মুশফিকা রহমান মৈথি

২৭তম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/431762305212214/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here