#উমা [কপি করা নিষেধ]
#৩৫তম_পর্ব
শাশ্বত চিন্তা ছেড়ে খাদি খামটি হাতে নিলো। খামটি খুলতেই তার চোখ কুচকে আসলো, বেশ কিছু পেপার কাটিং। কাটিং গুলো মনোযোগ দিয়ে দেখলো শাশ্বত। তাতে লেখা,
“দারোগা উত্তম চ্যাটার্জির কাটা দেহ পাওয়া গেলো রেললাইনের ধারে”
শিরোনামটি দেখতে হতচকিত হয় শাশ্বত। উত্তম চ্যাটার্জি তার বাবার নাম, শাশ্বত তখন খুব ছোট যখন তার বাবাকে হত্যা করা হয়। স্মৃতিগুলো ঝাপসা, কিন্তু জীবন্ত। এই ছোট ছোট হাতে মুখাগ্নি করেছিলো সে। প্রায় ত্রিশ বছর কেটে গেছে সেই ঘটনার। উত্তম বাবুর মৃত্যুকে প্রতিশোধ বলেই ফাইল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। একজন ন্যায়পরায়ন মানুষের শত্রুর অভাব নেই—– এই কথাটি ছিলো পুলিশের মুখ বক্তব্য। সে সময় টেকনলজি, কিংবা সংবাদমাধ্যমের প্রসার ততোটা ছিলো না, তাই এই কেসটা বেশি ঘাটানো ও হয় নি। উপরন্তু মালিনীর মতো ভীতু নারীর কাছে স্বামীর খুনীকে শাস্তি দেবার থেকে নিজের বাচ্চাকে সুরক্ষিত রাখাটাই বেশি প্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। শাশ্বত পেপার কাটিং গুলোর দিকে তাকিয়ে রইলো। বুকের বা পাশে এক অসহ্য চিনচিনে ব্যাথা অনুভূত হলো তার। বাবার স্মৃতিটুকুর মাঝে একটাই মনের গহীনে গেঁথে আছে শাশ্বতের, পাঁচ বছরের জন্মদিনে বাবা তাকে একটি কলম দিয়েছিলো, মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন,
“পৃথিবীর সর্বশক্তিশালী অস্ত্র দিচ্ছি, এই অস্ত্রের শক্তি সবচেয়ে বেশি। এখন তোর সিদ্ধান্ত, এটাকে অন্যায়ের জন্য ব্যাবহার করবি নাকি এর বিরুদ্ধে।“
বাবার কথাগুলো বোধগম্য হয় নি শাশ্বতের। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে কথাগুলোর ভার বুঝতে পারে। কলমটা কোথায় যেনো হারিয়ে ফেলেছে। এতো বছরের জমা মোটা ধুলোর পরদ মূহুর্তেই সরে গেলো। শাশ্বতের চোখ ঝাপসা হয়ে এলো সেই ধুলোর জন্য, শাশ্বত চোখ মুছে নিলো। শাশ্বত মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো বাবার কেসতা পুনরায় ওপেন করবে সে। দেখা যাক এবার কোনো কূল বের হয় কি না!
উমা পৌছালো সংগঠনের অফিসে। শরীরটা ভালো লাগছিলো না, মিনু মানাও করছিলো। কিন্তু নিজেকে আটকাতে পারলো না। শিল্পীর কথাটা শোনার পরো শান্তিতে বাসায় কিভাবে থাকবে সে, রুদ্র জানতে পারলে চোটপাট করবে। কিন্তু উমা নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। অফিসঘরের একটা চেয়ারে বসে আসে শিল্পী। শিউলি তার সামনে বসে আছে। মুখ ফুলে আছে, ঠোঁট ফেটে রক জমে কালো হয়ে আছে। হাতের জায়গায় জায়গায় কালো কালো ছোপ স্পষ্ট। গলায় আঙ্গুলের দাগ বোঝা যাচ্ছে। হাতের কিছু কিছু স্থানে মাংস দেখা যাচ্ছে। ভয়ার্ত চোখগুলো শুকিয়ে এসেছে। শিউলী তাকে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললো, সে অপেক্ষারত উমার জন্য। তখন ই উমা প্রবেশ করে রুমে। সে শিল্পীর কাছে গিয়ে বসে। শিল্পীর গায়ে হাত দিতেই কেঁপে উঠে সে, উমা তার হাতখানা চেপে ধরে ধীর কন্ঠে বলে,
“শিল্পী আপা আমি, উমা”
উমাকে দেখে শিল্পীর চোখ ভিজে এলো। হুমড়ি খেয়ে জড়িয়ে ধরলো তাকে। চাপা আর্তনাদ করে উঠলো মেয়েটি। শিল্পীর পিঠে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিলো উমা, তাকে খুব কষ্টে শান্ত করলো সে। শিল্পী শান্ত হলে তাকে অন্য মেয়েদের কাছে রেখে শিউলী এবং উমা আলাদা ঘরে যায়। শিউলী ধীর স্বরে বলে,
“তোর শরীর ঠিক আছে?”
“কেনো বলতো?”
“কেমন যেনো শুকনো, অসুস্থ লাগছে তোকে।“
“আমি ঠিক আছি, আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। আচ্ছা এবার শিল্পী আপার উপর অত্যাচারের কারণ কি? কিছুদিন পুর্বে তো সব ঠিক ছিলো। মকবুল মিয়া নাকি ভালো হয়েছে। আপার প্রতি তার ভালোবাসা নাকি উপসে উঠছিলো।“
“সব নাটক, ওই জানোয়ার কোনো ভালো হয় নি। কুকুরের লেজ কি সোজা হয়? মকবুল মিয়ার চাকরি চলে গিয়েছিলো, স্বাভাবিক ঘরের আয়ের উৎস শুধুমাত্র আমাদের শিল্পী। তাই এতোদিন তার জন্য ভালোবাসা উথলে উঠেছিলো। এখন আবার কাজ পেয়েছে। দাপট বেড়েছে। জুয়ার নেশা মাথা চারা দিলো। নিজের টাকা ডোবালো, শিল্পীর কাছে টাকা চাইলো। শিল্পী মানা করতে গিয়েছে তাই মেরেছে। এই পুরুষগুলো কবে মানুষ হবে তার ঠিক নেই। শিল্পীকে মেরে কি অবস্থা করেছে দেখেছিস। আমিতো বলে দিয়েছি আমার কাছেই থাকবে শিল্পী। ও বাড়ি যাওয়া লাগবে না।“
“শিল্পী আপার মেয়েটা কোথায় গো?”
“বাইরে খেলছে?”
“মকবুল ভাই এসেছিলো?”
“এসেছিলো আমি খেদিয়ে দিয়েছি, এখানে আহসান ভাই, করিম ভাই আছে। তারা তো মারতে গিয়েছিলো।“
উমা কিছুক্ষন চুপ করে থাকলো। তারপর ধীর স্বরে বললো,
“এভাবে হবে না আপা, এবার একটা নারী অত্যাচারের মামলা করতেই হবে। এভাবে চলতে থাকলে তো ওরা মাথা চারা দিয়ে উঠবে। শাস্তি পাবে না। যদি ছাড়াছাড়ি হয় ভালোভাবে হবে। দেনমোহর দিবে, অন্তত মেয়েটির খরচ দিবে। এরকম চলতে পারে না। নারীর দেহে শক্তি নেই বলে তাদের দূর্বল ভাবা বন্ধ করতে হবে। যারা জীবের সঞ্চা্র করে তারা দূর্বল নয়।“
শিউলী মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। তখন ই মানুষের গোল শুনতে পেলো তারা। অফিসের বাহিরে চেচামেচি করছে কিছু মানুষ। কৌতুহলের বসে শিউলী এবং উমা বেড়িয়ে এলো। মকবুল মিয়া, দশ বারোজন পুরুষ নিয়ে জড়ো হয়েছে। মকবুল মিয়া উমাকে দেখতে পেয়ে বাজখাই কন্ঠে বললো,
“দেখো, এই ভন্ড নারীবাদিরা আমার ঘর ভাঙ্গতে উদ্ধত হয়েছে। জোর করে আমার মেয়ে বউ কে আটকে রেখেছে। শুধু তাই নয় এরা চায় আমি যেনো আমার বউ তালাক দেই। এসব নষ্টামি নয়, এরা আমার ঘর ভাঙ্গতে চায়। কার না ঘরে ঝগড়া হয়, আমাদের ঝগড়ার মধ্যে এরা কেনো আসবে? আমার বিচার চাই“
মকবুলের কথায় কান ঝা ঝা করে উঠলো উমার। চোখজোড়া ঘৃণায় ঢেকে আসে। তীব্র কন্ঠে বলে উঠে,
“মকবুল ভাই, স্বামী স্ত্রীর ঝগড়া হলে আমরা কখনোই এর ভেতরে আসতাম না। কিন্তু তুমি যেভাবে জানোয়ারের মতো শিল্পী আপাকে মেরেছো সেটাকে কিভাবে এড়িয়ে যাই বলো। আপা তোমার সাথে যাবে না। এখানেই থাকবে সে। তুমি যদি কিছু মানুষের সাথে জড়ো করে আমাদের ভয় দেখাতে চাও, তবে বলবো ফিরে যাও।“
“আমার বউ আমি মারবো, তোরা বলার কে?”
“তুমি কি মানুষ? একটুর জন্য জানে বেঁচে গেছে শিল্পী আপা”
“ও আমার কথার অমান্য করেছে, স্বামী আমি ওর। ওকে শাসন করার অধিকার আমার আছে।“
“ভুলে যেও না সেও মানুষ, দেশে আইন আছে তুমিও ভুলে যেও না। শিউলি আপা পুলিশে ফোন দাও”
মকবুলের আতে ঘা লাগে, ছোট একটি মেয়ে তাকে দমিয়ে দিচ্ছে নিজের কড়া বক্তব্যে। মকবুলের সহ্য হলো না, রোষাগ্নি কন্ঠে বলে উঠো,
“নষ্টতামি দেখেছো? এরা আমাদের মেয়ে-বউদের নষ্ট করে দিবে। এই অফিস ই ভেঙ্গে দাও। না থাকবে সংগঠন না থাকবে নষ্টামি।“
তার লোকজন নিয়ে ভাঙ্গচুর করার জন্য উৎসুক হয়ে উঠে। শিউলি উমার হাত চেপে ধরে। আহসান, করিম ঠেকাতে পারে না হিংস্র মানুষদের। টেবিল, চেয়ার ভাঙ্গচুর করে তারা। জানালার কাঁচগুলোও ভেঙ্গে দেয় রোষের প্রকটে। মকবুল এক পর্যায়ে উমার উপর আক্রমণ করার জন্য তেড়ে আসলে উমা নিজের হাতজোড়া সম্মুখে নিয়ে তাকে প্রতিরোধ করতে চায়। কিন্তু মকবুলের জোরের কাছে সে একজন দূর্বল নারী। মকবুলের হাতে অবস্থিত লাঠির প্রবল আঘাতে ধপ করে বসে পড়ে উমা। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেড়িয়ে আসে হাত থেকে। বা হাত দিয়ে ডান হাত চেপে ধরে উমা। তখনই…………
চলবে
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে পোস্ট করবো ইনশাআল্লাহ]
মুশফিকা রহমান মৈথি
৩৪তম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/436516664736778/