#উমা [কপি করা নিষেধ]
৩৯তম_পর্ব
এর মাঝেই তার ফোনটা বেজে উঠলো উমার। অচেনা নম্বরটি দেখে কৌতুহল জাগলো উমার। ফোন ধরতেই অপাশ থেকে একখানা তীক্ষ্ণ বৃদ্ধ কন্ঠে কানে এলো,
“উমা রায় বলছেন?”
“জ্বী, আপনি কে বলছেন?”
“আমি মহানগর ডায়াগনস্টিক থেকে বলছি। আপনার রিপোর্ট খানা নিয়ে যাবেন।”
রিপোর্টের কথাটা শুনেই অনুভূতিশুন্য হয়ে গেলো উমা। বিগত সপ্তাহেই রক্ত এবং প্রসাব পরীক্ষা করতে দিয়েছিলো উমা। সেই রিপোর্টটাই হয়তো এসেছে। বুকটা ধরফর করছে উমার। কৌতুহল হচ্ছে ফলাফলের আসায়। উমা ধীর স্বরে বললো,
“রিপোর্টে কি এসেছে জানতে পারি?”
মহিলা কিছুক্ষন থেমে বললো,
“রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে। আপনি মা হতে চলেছেন। রিপোর্টটা নিয়ে যাবার সময় ডা. শারমিনের সাথে দেখা করে যাবেন।”
মহিলাটির কথাটা কর্নকুহরে ঝংকার তুললো উমার। সে স্তদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। অপাশ থেকে নীরবতা মহিলাটিকে চিন্তায় ফেলে দিলো। প্রশ্ন করে উঠলো সে,
“হ্যালো, শুনতে কি পাচ্ছেন?”
“জ্বী।”
“রিপোর্টটা নিয়ে যাবেন।”
বলেই মহিলাটি ফোন রেখে দিলো। উমা চোখ বুঝে নিলো। ক্ষুদ্র জীবনের হাসি কান্নার অজস্র মূহুর্তগুলো জড়ো হতে লাগলো। মনের আঙ্গিনার মেঘের আড়ালের এক চিলতে কুসুমপ্রভা তার ঠোঁটের কোনায় ঠায় নিলো। চোখের ভেতরে এক অজানা ভবিষ্যতের আগাম প্রশান্তির ঢেউ উঁকি দিলো৷ উমার আবেগ জলে রুপান্তরিত হলো। বান্ধবী শিপ্রা কাঁধে হাত রেখে বললো,
“কাঁদছিস কেনো?”
“কিছু না”
নিজেকে নিপুন ভাবে সামলে উত্তরটি দিলো উমা। বাড়ি যাবার তাড়া হচ্ছে। এক অদ্ভুত কৌতুহল জাগছে, রুদ্রের মনোস্থিতি জানার এক অদ্ভুত কৌতুহল।
পার্টির সভাপতির অফিসে বসে রয়েছে অভিনব সিংহ। চার বছরে তার বয়স যেনো এক দিন ও বাড়ে নি। মুখশ্রীতে সেই দাপট, সেই অহমিকা। শুধু চুলের পাকটা বেড়েছে। চোখে এখন সোনালী বর্ডারের চশমা পরিধান করেন তিনি। শালটা সেই ভাবে ইস্ত্রী করে ভাজ করে দেওয়া। কে বলবে লোকটির উপরে এই চারবছরে ঝড় ঝাপটা গিয়েছে। তাকে বাড়ে বাড়ে দুদকের কাছে প্রশ্নোত্তরের খেলা খেলতে হয়েছে। সামনে বসে থাকা পার্টির সাতক্ষীরা জেলার সভাপতি শিকদার সাহেব বসে আছেন। তার পুরোনাম এস.এম.শিকদার। তিনি সিগারেটে সুখটান দিয়ে কড়া চায়ের কাপে চুমুক দিলেন। শ্লেষ্মাজরিত কন্ঠে বললো,
“অভিনব, এই পৌরমেয়র হবার জিদটা ছেড়ে দাও। পার্টির যা অবস্থা, পরাজিত হবার চান্স বেশি। আর এই চারবছরে কম ঝড় তো গেলো না। ব্রীজের টাকা, বেআইনি অস্ত্র পাচার, সরকারের বাজেট টাকা মেরে দেওয়া, বৈদ্যুতিক খাম্বা চুরি কম কেস তো হয় নি তোমার উপর। পনেরো বছর ধরে তুমি চেয়ারম্যান ছিলে, এই পনেরো বছরে তোমার উপর ১৯ টা কেস দিয়েছে। তোমার মনে হয় তুমি জিততে পারবে এই নির্বাচন? তাও আবার রুদ্রের বিরুদ্ধে! তাই বলছি, এবার ভোটে দাঁড়িও না।”
শিকদারের কথাটা কানে তুললেন না অভিনব বাবু। তিনি গোঁফে তা দিয়ে বললেন,
“ও ছোকরা রাজনীতির কি বুঝে? আমি পনেরো বছর ধরে এই রাজনীতিতে। গতবছর তো পৌরমেয়রের পদে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম। আপনারা দেন নি। এখন আমাকে বাধা দিচ্ছেন কেনো? আর কেস হয়েছে প্রমাণ তো হয়নি। আরে এ দেশের দাগী বেতারা জেল খেটেছে সেখানে আমি তো সামান্য অভিনব সিংহ। আমার হাটুতে হোচট লেগেছে, খোড়া আমি হই নি। আমার দূর্বলতার সুযোগ নিতে চাইলে তো হবে শিকদার মশাই”
“তুমি ভুল বুঝছো অভিনব। আচ্ছা দেখো এক সাথে উনিশখানা কেস হয় নি। এক এক করে হয়েছে। তাও আবার তোমার ভগিনী পুত্র শাশ্বত ই পত্রিকার হেডলাইন বানিয়েছে। একটা ধামাচাপা দেই আর পরেই আরেকটা। এখন নির্বাচনের সময়। সামনের বছর পৌরমেয়রের নির্বাচন। এতোদিনে কখন কি হয় তার ঠিক নেই। আমাদের পার্টির এখন অবস্থা খুব সূচনীয়। রুদ্রের এখন ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা বাড়ছে। মানুষ ওকে ভরসা করতে শুরু করছে। তুমি ব্যাপারটা ভেবে দেখো।”
শিকদারের যৌক্তিক যুক্তিতে খানিকটা দমে অভিনব সিংহ। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলে,
” তাহলে কি করা উচিত?”
” শত্রুকে যদি হারাতেই চাও। তাহলে নিজের ক্ষমতা বাড়ানোর সাথে সাথে শত্রুর ক্ষমতা কমানোর কথাও চিন্তা করো। যদিও তোমার পুত্র সে। তবুও, শত্রু তো শত্রু। ক্ষমতা যার, হুকুম তার। তুমি মানুষটি বুদ্ধিমান। চিন্তা করো।”
অভিনব সিংহ সামনে টেবিলে থাকা দাবার গুটিগুলোর দিকে মনোযোগ দেয়। রুদ্রের দূর্বলতা উমা। কিন্তু উমাকে দিয়ে রুদ্রকে পরাজিত করবার কোনো বুদ্ধি মাথায় খেলছে না অভিনব সিংহের। তার চিন্তিত মুখখানা দেখে শিকদার ধীর স্বরে বলে,
“অদেখা শত্রুর থেকে চেনা শত্রু কম ভয়ংকর। তোমার অজানা শত্রুটি কে।আগে খুজে বের কর। যে তোমার সকল খবর দুদকের কাছে দিচ্ছে। আমার ভেতরে সিপাহী না থাকলে প্রমাণ কিন্তু হাতে নাতে পেয়ে যেতো সবাই। তাই আগে অগোচরের শত্রুটিকে খুজে বের করো।”
শিকদারের ইঙ্গিত বুঝতে বাকি রইলো না অভিনব সিংহের। সত্যি কেউ পেছন থেকে কল কাঠি নাড়াচ্ছে। যে যে খবর দুদকের কানে যাওয়া অসম্ভব সেই খবর গুলো দুদক পর্যন্ত যাচ্ছে। কেউ তো আছে সে পেছন থেকে তার হাটু ভাঙ্গার প্রচেষ্টায় আছে। মানুষটি কে! অভিনব সিংহের সন্দেহ দুজনের উপর স্থির রুদ্র এবং শাশ্বত। শাশ্বত সবার প্রথম তাকে নিয়ে পত্রিকায় লিখে। যাতে তার রাজনৈতিক কর্মজীবনে আঘাত এসেছে। অন্যদিকে তার ব্যাবসার উপর ফন তুলেছে রুদ্র। সেদিন থেকে তার ব্যাবসা থেকে পৃথক হয়েছে রুদ্র। সেদিন থেকে রুদ্র তার সকল কার্যে বাধা দিচ্ছে। তাই অভিনব সিংহের দৃঢ় বিশ্বাস এই দুজনের একজন ই তার জীবনে ঝড় তুলছে। অভিনব বাবুর কপাল কুচকে আসলো। চোখে আগুন জ্বললো। এই আগুন যে সে আগুন নয়, প্রতিহিংসার লিকলিকে গাঢ় অগ্নি।
২১.
রুদ্রের বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বাজলো। গাড়ি থেকে থেমে হাত পায় টান টান করলো সে। বেশ ধকল গয়েছে আজ। মংলার ওদিক যাওয়া আসাতে পাঁচঘন্টা লেগে গিয়েছে। রুদ্র মংলাতে জমি খরিদ করেছে কিছু। যদিও সেগুলো এখন কেবল ই পানি তে ডুবন্ত ডোবার ন্যায় জমি। তবুও খরিদ করেছে রুদ্র। খুলনার অদিকে চলে যাবার ইচ্ছে আছে তার। যদি মন মতো সরকার আসে তবে এই দক্ষিণাঞ্চলের উন্নতি নিশ্চিত। রুদ্রের ইচ্ছে ওখানে মৎস ফার্ম করা। তাই তিনবিঘা জমি খরিদ করেছে সে। বিশ্বস্ত লোকের নিয়োগ হলেই বেশ লাভবান হয়ে পারবে। এই চার বছরে মৎস ব্যাবসায় বেশ মন দিয়েছে সে। লাভ ও হচ্ছে। একারণে রুদ্রের মনটা আজ বেজায় ভালো। আসার সময় উমার জন্য একখানা বেলীফুলের মালাও কিনে নিয়েছে। মেয়েটিকে বেলীফুল খুব ভালো লাগে। আর উমার হাস্যোজ্জ্বল মুখখানা তার প্রচন্ড ভালো লাগে। রুদ্র হাসি মনেই ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলো। কিন্তু প্রবেশ করতেই মনে হলো সে কোনো অন্ধকার নগরীতে চলে এসেছে। হয়তো বিদ্যুৎ গিয়েছে এই ভেবে মিনুকে ডাক দিলো রুদ্র। একটা ছোট হারিকেন নিয়ে মিনু উপস্থিত হলো, তারপর বললো,
“দাদা এসেছেন?”
“হু, উমা কোথায়? আর ঘরে অন্ধকার কেনো?”
“কারেন্ট নাই, সেই সন্ধ্যায় গেছে। মোম ফুরায় গেছে তাই আন্ধার। দিদিমনি আমারে এই হারিকেন দিছে পড়ার জন্য। উনি আন্ধআরে বারান্দায় বইয়ে আছে। কইলাম দোকানে যাইয়া মোম নিয়ে আছি। মানা করে দিলো”
“আচ্ছা আমি দেখছি”
“অন্ধকারে উপরে যাইতে পারবেন?”
“পারবো সমস্যা নেই।”
বলে উপরের দিকে হাটা দিলো রুদ্র। কোনোমতে রেলিং ধরে নিজের ঘরের কাছে আসলো। অন্ধকারে নিজের গায়ের পশম ও দেখা যাচ্ছে না। ঘরে প্রবেশ করতেই বারান্দায় অবয়বের দেখা মিললো রুদ্রের। পূর্ণ চন্দ্রমায় অবয়ব খানা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। অন্ধকার ঘরে বাহিরের চন্দ্রের আলো গলিয়ে পড়ছে। হাতের ব্যাগখানা রেখে ধীর পায়ে এগিয়ে যায় রুদ্র। উমা তখন চোখ বুঝে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। রুদ্রের উপস্থিতি টের পেয়েও সে নড়লো না। রুদ্র তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,
“আঁধারে ডুবে থাকতে বুঝি ভালো লাগে?”
“মাঝে মাঝে মন্দ লাগে না”
“কি ভাবছো?”
“সময়ের গতিকে নিয়ে চিন্তা করছি”
“তোমার হেয়ালি বোঝার সাধ্য আমার নেই।”
উমা স্মিত হাসলো। তারপর ধীর স্বরে বললো,
“একখানা বলার আছে”
“তোমার কথা শোনার জন্যই তো আমি কান পেতে আছি। বলো”
উমা রুদ্রের পানে ফিরলো। আধার আলোর মায়ায় রুদ্রের মুখোভঙ্গি আবছা হয়ে আছে। তবুও উমার ইচ্ছে হলো এই মূহুর্তে কথাটা বলতে। রুদ্রের হাতখানা নিয়ে নিজের উদর ছুলো সে। ধীর স্বরে বললো,
“আমাদের ছোট পরিবারে একজনের আবির্ভাব হতে চলেছে……..
চলবে
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব আজ রাতে পোস্ট করবো ইনশাআল্লাহ]
মুশফিকা রহমান মৈথি
৩৮তম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/440194984368946/