উমা [কপি করা নিষেধ]
৪১তম_পর্ব
রাজশ্বী মাথা নাড়িয়ে বেড়িয়ে গেলো। শাশ্বতের মাথায় আগুন জ্বলছে। কাজের প্রতি অনীহা তার মোটেই ভালো লাগে না। এদিকে হতাশা তাকে জর্জরিত করে রেখেছে। কোনোভাবেই উত্তম বাবুর কেসের গতি হচ্ছে না। সব রাস্তা যেনো বন্ধ। কোনো কুল কিনারা পাচ্ছে না সে। এর মাঝেই মন্সুর মিয়া চায়ের ট্রে নিয়ে হাজির হয়। দরজা কড়া নাড়লেই শাশ্বতের চোখ যায় তার দিকে। খিটখিটে মেজাজে বলে,
“কি হলো, এতো দেরী হলো যে?”
“স্যার, একখানা খাম আইসে।”
খামের কথা শুনতেই বেশ নড়েচড়ে বসে শাশ্বত। হাত বাড়ায় মন্সুর মিয়ার দিকে। মন্সুর মিয়া বদলে করে আনা খামটা দেয় শাশ্বতের হাতে। ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে খামটি খুলে শাশ্বত। খাম খুলতেই কিছু পত্রিকার কাটিং বেড়িয়ে আসে৷ তার সাথে বেড়িয়ে আসে কিছু লেখা, খসরা এবং কিছু কাগজপত্র। তার সাথে তখনকার তদন্তের কিছু প্রমাণ ও ছিলো। উত্তমবাবুর কেসটি যে পুলিশ অফিসারটির আন্ডারে ছিলো তার নাম শফিকুল ইসলাম, সে এখন খুব বড় পোস্টে রয়েছে। সে জানিয়েছিলো, সে এই তদন্তে মূখ্য কোনো প্রমাণ পায় নি। কিন্তু এখানে খুব পুরোনো কিছু কাগজ, জবানবন্দি রয়েছে যা প্রমাণ হিসেবে খুব সহজে পেশ করা যেতো। শাশ্বত বেশ মনোযোগ দিয়ে কাগজগুলো সাজাতে থাকে। তারপর উত্তমবাবুর সেই ফাইলটি খুলে সামনে রাখে। ক্রমশ কপাল কুঞ্চিত হয়ে আসছে তার। ললাটের বাপাশের শিরাটা ধপধপ করে লাফাচ্ছে। উত্তম বাবু শেষ যে অপরাধীকে পাকরাও করেছিলেন সেই নামটি খুব পরিচিত লাগছে শাশ্বতের কাছে। এই নামটা কোথাও তো দেখেছেছিলো সে। শাশ্বত নিজের আলমারি থেকে একটা ফাইল বের করলো। ফাইলটি অভিনব সিংহের। কাগজগুলোর মধ্যে “কমলাপট ব্রীজ” এর কাগজগুলো বের করে শাশ্বত। “আর এ কন্সট্রাকশন” পেয়েছিলো এই ব্রীজের টেন্ডর। যার বর্তমান মালিক মাহমুদ সরদার। মাহমুদ সরদারকেই পাচারকারী চক্রের জন্য পাকরাও করেছিলেন উত্তমবাবু।
মাহমুদ সরদার বর্তমানে আঠারো মাইল থাকে। অনেকবড় মৎস ব্যাবসায়ী সে। বিঘার পর বিঘা তার মাছের ক্ষামার৷ তার খুব বড় মোটরসাইকেলের শোরুম রয়েছে, সাথে রড, বালি, সিমেন্টের আঠারো মাইলে খুব বড় দোকান রয়েছে। এই দিকের বেশ কিছু সরকারি টেন্ডন তার “আর এ কন্সট্রাকশন” পেয়ে থাকে। তার দাপট অঞ্চল জুড়ে বেশ ভালোই। শাশ্বতের মনে খটকা লাগলো। তার বাবা ঠিক কেনো মাহমুদ সরদারকে পাকরাও করেছিলেন! তার পরেই উত্তমবাবুর খুন হয়। অথচ এই কেসের দারোগা শফিকুল ইসলাম এই প্রমাণ গুলোই গায়েব করে ফেলেন। প্রশ্নের ধোয়া গাঢ় হচ্ছে শাশ্বতের মনে। তার চেয়েও গভীর প্রশ্ন এই লোকটি কে যে তাকে আড়ালে এতো ভয়ংকর সত্যের বীজ শিকড়ের সন্ধান দিচ্ছে!
লক্ষীদেবীর খুশি বাধ মানছে না। কারণ তার বংশের প্রদীপ আসতে চলেছে। উমা যখন তাকে এই সুসংবাদটি জানায় তার চোখজোড়া আকুল আবেগপ্রবণ হয়ে উঠে। তিনি উমাকে পরম আদরে জড়িয়ে ধরে। ফুলির মাকে তীব্র উল্লাসে বলে আজ তার বউ মার জন্য যত প্রকার পিঠে আসে সব তৈরি করবে। লক্ষী দেবীর প্রসন্ন চেহারাটি উমাকে খানিকটা আবেগপ্রবণ করে তুলে। এতো বছর পর আজ সে শাশুড়ীর মনে কড়া নাড়তে পেরেছে। এতোকাল কেবল একজন খড়কুটোর ন্যায় নির্জীব প্রাণী ছিলো সে শাশুড়ীর দৃষ্টিতে। লক্ষীরাণী রুদ্রের নিকট আবদার করে বসে যেনো তারা আজ রাত্রী এই বাড়ি থেকে যায়। প্রথমে আবদারটি রুদ্র নাকোচ করে দিলেও মায়ের আবেগঘন আবদার ফেরাতে পারে নি সে। রুদ্রের মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয় তার মাকে তার কাছে নয়ে রাখতে। কিন্তু পারে না, পতিভক্ত তার মা কখনোই রুদ্রকে তার পিতাকে ছেড়ে যাবে না। অবশেষে রুদ্র এই বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্তে রাজী হলো। দীপঙ্করের বিয়ে হয়েছে। তার স্ত্রী মৌমিতা এবং লক্ষী উমার দেখভালের কোনো ত্রুটি রাখছে না। রুদ্রের পুরোনো ঘরের তালা খুলে ঘরটি সুন্দর করে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। দীপঙ্করের ছোট মেয়েটি উমাকে খুব পছন্দ করে, যতবার আসে তার কোলে চেপে বসে থাকে। এবারো তাই হলো, এই উৎসবের মাঝে শুধু একজনের মুখখানা বেরাজ হয়ে রয়েছে। তা হলো দীপঙ্কর। রুদ্রের বাড়ি থেকে যাবার পর থেকে সে জ্যেঠুর নিকটতম মানুষ হবার সুযোগটি কাজে লাগিয়েছিলো। তার মনের সুপ্ত লালসা ফন তুলেছিলো বহু আগে, বাবা ছেলের অন্তঃদ্বন্দে নিজের খুটি মজবুত করার চেষ্টায় ছিলো সে। কিন্তু রুদ্রের সুসংবাদে এখন ভয় লাগছে তার যদি তাদের মধ্যের বিবাদের অন্ত হয় তবে ক্ষতিখানা তার ই হবে। আমে দুধে মিলে আটি হয়ে থেকে যাবে সে। তাই রুদ্রের সন্তান আগমনের খবরে খুশি হতে পারছে না সে। মৌমিতার আদিক্ষেতা দেখেও বেশ মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার। সুযোগ বুঝে তাকে টেনে আনে নিজ কক্ষে। হিনহিনে স্বরে বলে,
“এতো খুশির তো কিছু হয় নি, এতো লাফালাফি করছো কেনো? তোমার বর দুপুরে খায় নি কিছু সেদিকে খেয়াল আছে?”
“আপনি চটছেন কেনো? আর খুশি হবো না। দিদিভাই মা হতে চলেছে। নতুন সদস্যের আগমনে মুখ গোমড়া করে রাখবো নাকি?”
“আদিক্ষেতা দেখলে গা জ্বলে যায়। এতো খুশি হবার কি আছে শুনি? একবার ভেবে দেখেছো ওই বাচ্চা আসলে আমাদের মেয়েকে কি আর নাতনীর চোখে দেখবে জ্যেঠু জ্যেঠী? তখন ওই বাচ্চাকেই বেশি মাথায় করে নাচবে। আর যদি ছেলে হয় তাহলে তো কথাই নেই।”
“কি বলছেন আপনি? যে আসেই নি তার সাথে কিসের হিংসা?”
“তুমি বুঝলে তো হতোই”
এক রাশ বিরক্তি নিয়ে স্নানঘরে চলে গেলো দীপঙ্কর। মৌমিতার মনে ঈষৎ ভয় উঁকি দিছে। স্বামীর জটিল মনোস্থিতির পরিণাম কোনো অশুভ ঘটনার সূত্রপাত না করে।
খাবারের পর লক্ষী দেবী উমার রুমে আসেন। ধীর স্বরে বলেন,
“আসবো?”
উমা তখন অবহেলিত ঘরটিকে নির্লিপ্ত চিত্তে বিচরণ করছিলো। লক্ষী দেবীকে দেখে স্মিত হেসে বললো,
“ছেলের ঘরে আসবেন, অনুমতি নেবার কি আছে মা!”
লক্ষী দেবী ঘরে প্রবেশ করতে করতে বললেন,
“ভেবেছি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছো”
“না না, ঘুম আসছে না। বিছানা বদল হবার খারাপ দিক। আর দুপুরে ঘুমাই না। তাই ঘুরে দেখছিলাম ঘরটা।”
লক্ষী দেবী বিছানাতে বসলেন। তার হাতে বেশ কিছু কাপড়। তিনি বসতে বসতে বললেন,
“এই কাপড়গুলো রুদ্রের। কাথা, টুপি, সোয়েটার। এই কাথাটা ওর শরীরে প্রথম জড়ানো হয়েছিলো। এইন্যে টুপিটা দেখছো আমি নিজ হাতে বুনেছিলাম। প্রচুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। পুরোনো অনেক। কিন্তু মূল্যবান এই স্মৃতি। খুব যত্নে আগলে রেখেছিলাম। আমার নাতী এই পৃথিবীতে আসলে তুমি তাকে প্রথম এই কাপড়গুলো পড়াবে। তাই তোমাকে দিতে এসেছি।”
নাতী শব্দটি শুনতেই খানিকটা নড়ে উঠলো উমা। অবাক কন্ঠে বললো,
“সে তো নাতনীও হতে পারে মা। নাতী ই যে হবে এমনটা তো নিশ্চিত নয়।”
উমার কথা শুনে চোখ কুচকে আসে লক্ষীর। সে কথাটি শুনে প্রসন্ন হয় নি তা বুঝতে বাকি রইলো না উমার। খানিকটা বিরক্তিভরা কন্ঠে বললো,
“এ বাড়ির প্রথম সন্তান সর্বদা ছেলেই হয়েছে। এবার তার ব্যাতিক্রম হবে কেনো?”
“এতো আমাদের হাতে নেই। আর আমাদের প্রার্থনা করা উচিত ছেলে কিংবা মেয়ে যাই হোক, সে যেনো সুস্থ হয়।”
“তর্ক করো না তো, কাপড় গুলো সামলে রাখো”
মনোক্ষুণ্ণ হলো উমা। প্রগতিশীল দেশে আজ ও কন্যা আর পুত্রের মাঝে এতোটা তফাত। উমা মন থেকে চায় তার যেনো একটা কন্যাসন্তান হয়। কিন্তু শ্বাশুড়ির এরুপ প্রতিক্রিয়ায় সে আহত হয়। লক্ষী দেবী চলে গেলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উমা। কন্যা হয়েও লক্ষী দেবীর মনে কন্যার অভিলাষা নেই। ভাবতেও বিরক্ত লাগছে উমার। মানুষের মনোভাবের এরুপ বিরুপ অবস্থা দেখে হতাশায় বুক ভরাক্রান্ত হয়ে উঠে তার।
বিকেল ৪.৩০,
অভিনব সিংহের পাশে দাঁড়িয়ে আছে রুদ্র। বাবা ছেলে পাশাপাশি দাঁড়ানোর পর ও তাদের মাঝে যেনো কথা বলার কিছুই নেই। অভিনব সিংহ শাল জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ঠান্ডা বেড়েছে এই প্রান্তে। বয়সটাও বেড়েছে, সেকারণেই হয়তো এখন তার ঠান্ডা সহ্য হয় না এখন। রুদ্র প্যান্টের পকেটে হাত গুজে দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি সামনের বিলানটির দিকে। গ্রাম ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। মানুষ শহরে কর্মের জন্য ছুটছে। নিস্তব্ধতা চিরে রুদ্রই কথার সূচনা করলো। নির্লিপ্ত কন্ঠে বললো,
“শুনলাম, এবার নাকি মেয়রের পদে দাঁড়াচ্ছেন, কখনো ভাবি নি আপনার বিরুদ্ধে দাঁড়াবো”
“আমার বিরুদ্ধে তো এই প্রথম দাঁড়াও নি তুমি”
“আমি তো শুধু মুক্তি চেয়েছি, আপনি আমাকে জোর করে নিজের মুঠোতে রেখেছেন।”
“আমি তোমার বাবা, তোমার ভালো চাই।”
অভিনব সিংহের কথায় বিদ্রুপের হাসি হাসে রুদ্র। তার হাসির ঝংকার অভিনব সিংহের মুখোভাব বদলে দেয়। রুদ্র তখন ধীর স্বরে বলে,
“কোন বাবা নিজের ছেলের প্রগতিতে অখুশি হয় বলুন তো? কোন বাবা শুধু নিজের ছেলেকে নিজের মুঠোয় রাখার জন্য তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে?”
রুদ্রের প্রশ্নে থমকে যায় অভিনব সিংহ। পরমূহুর্তে……..
চলবে
[ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। পরবর্তী পর্ব আগামীকাল রাতে পোস্ট করবো ইনশাআল্লাহ]
মুশফিকা রহমান মৈথি
৪০তম পর্বের লিংক
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/441549100900201/