মন_বাড়িয়ে_ছুঁই লিখা~ফারজানা ফাইরুজ তানিশা পর্ব-১৯

মন_বাড়িয়ে_ছুঁই
লিখা~ফারজানা ফাইরুজ তানিশা
পর্ব-১৯
.
আঞ্জুমান ধপ করে সোফায় বসে পড়লেন। অভ্র ধীরপায়ে আঞ্জুমানের সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে ফ্লোরে বসল। মাথা নিচু করে বলল,
“আমি সবটাই জানতাম আম্মু। পৃথুলাকে যেদিন দেখতে গিয়েছিলাম সেদিনই ও আমাকে সবটা বলেছে। জানিয়েছে ওর ভয়ংকর অতীত সম্পর্কে। বছর চারেক আগে ও রেপড হয়েছিল। আ’ম শিওর, ওর জায়গায় অন্য কোনো মেয়ে থাকলে কখনোই এসব বলতো না, লুকিয়ে রাখত ব্যাপার টা। কিন্তু পৃথুলা লুকায়নি। কারণ ও সবার চেয়ে আলাদা। ও আর দশটা মেয়ের মত না। ওর সরলতায় মুগ্ধ হয়েই আমি ওকে বিয়ে করেছি। আমি জানি না তুমি এখন ব্যাপারটা কিভাবে নেবে। এই ঘটনার পর তুমি পৃথুলাকে মেনে নেবে কীনা! কিন্তু আম্মু, এতে পৃথুলার কি দোষ বলো? পৃথুলা এতদিন অনেক কষ্ট পেয়েছে আম্মু। ওকে আর কষ্ট দিও না প্লিজ। আমি পৃথুলাকে কথা দিয়েছিলাম কখনো ওর হাত ছাড়ব না। আমি আমার কথা ফেলতে পারব না আম্মু। প্লিজ ওকে মেনে নাও।”
দিলারা বেগম বললেন,
“মাইন্না নিবো না তয় কি করবো? এইহানে মাইয়াডার কি দোষ? যারা আকাম কুকাম করে হেগোই লজ্জা শরমের বালাই নাই। আর ওই মাইয়ার তো কোনো দোষই নাই।”
মনামীর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে কথাটা বললেন দিলারা বেগম।

আঞ্জুমানের ভাবান্তর হলো না। তাকে নির্বিকার দেখে অভ্র বলল,
“আম্মু প্লিজ কিছু বলো।”
আঞ্জুমান ছেলের কথায় জবাব দিলেন না। সোফা ছেড়ে আনিসুল ইসলামের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। অনুতাপের সুরে বললেন,
“দুঃখিত ভাই। মনামীর ব্যবহারে আপনারা কষ্ট পেয়েছেন জানি। আমি ওর হয়ে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি।”

আনিসুল ইসলাম অবাক চোখে তাকালেন আঞ্জুমানের দিকে। তিনি ভেবেই নিয়েছেন পৃথুলা ধর্ষিতা জানার পর আঞ্জুমান কখনোই তার পুত্রবধূ হিসেবে মেনে নেবেন না পৃথুলাকে। তার হতভাগ্য মেয়েটার সংসার শুরু না হতেই ভেঙে যাবে, এই আশংকায় বুক কাঁপছিল তার। কিন্তু আঞ্জুমানের কথায় তার মনের মধ্যে নিভে যাওয়া প্রদীপটা যেন আবারও জ্বলতে চাইছে।

মাহিমা বেগম কান্নাবিজড়ির কণ্ঠে বললেন,
“আপনি ক্ষমা চাইছেন কেন আপা? উনি তো মিথ্যে কিছু বলেননি। আসলে আমার পৃথুলাটার কপালটাই খারাপ। এত বছর পরেও অতীত ওর পিছু ছাড়ল না। ভেবেছিলাম এতদিন পর আমার মেয়েটা সুখের মুখ দেখবে। কিন্তু সেটাও হলো না৷ আল্লাহ ওর ভাগ্যে সুখ লিখে রাখেননি। আমার মেয়েটা বিনা দোষে শাস্তি পেয়েছে এতদিন। এখনো পাচ্ছে। সারাজীবন শাস্তিই পেয়ে যেতে হবে। ভুলটা আমাদেরই হয়েছে। বিয়ের আগেই আপনাদেরকে সব জানানো উচিত ছিল। বুঝিনি এভাবে সত্যিটা সামনে চলে আসবে। বুঝলে আগেই জানিয়ে দিতাম। তাহলে আমার মেয়ের সংসারটা ভাঙতে বসতো না।”
আঞ্জুমান আঁৎকে উঠে বললেন,
“আপা, কি বলছেন আপনি! সংসার ভাঙবে কেন?”
“তাহলে কি হবে? সব জেনেও কি আমার মেয়েকে মেনে নেবেন আপনার ছেলের বউ হিসেবে?”
আঞ্জুমান ঠাণ্ডা গলায় বললেন,
“আমি অতোটা মনুষ্যত্বহীন নই আপা। তবে মিথ্যে বলব না, মনামীর মুখে প্রথমে কথাটা শুনে একটু ধাক্কা খেয়েছিলাম। ধাক্কাটা সামলাতে আমার খানিকটা সময় লেগেছে, এই যাহ। কিন্তু পৃথুলার সাথে যা হয়েছে তাতে তো ওর কোনো দোষ নেই। তাহলে ওকে মেনে না নেওয়ার কথা আসছে কেন! ঘটনাটা যদি আমার অর্থির সাথে ঘটত তাহলে আমি কি পারতাম মা হয়ে অর্থির দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে? তাহলে পৃথুলার সাথে এমন করব কেন! পৃথুলাও তো আমার আরেকটা মেয়ে।”
মাহিমা বেগম কাঁদতে ভুলে গেলেন। পলকহীন তাকিয়ে রইলেন আঞ্জুমানের দিকে আর ভাবতে লাগলেন, এমন মানুষও দুনিয়ায় হয়!

আঞ্জুমান পৃথুলার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। পৃথুলা ফুঁপিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। আঞ্জুমান পৃথুলার মুখটা দুহাতে তুলে ওর চোখ দুটো মুছে দিলেন। পরম যত্নে পৃথুলাকে বুকে টেনে বললেন,
“কাঁদছো কেন মেয়ে? মেয়ে কাঁদলে মায়ের কি ভালো লাগে? একদম কাঁদবে না।”
পৃথুলা দু হাতে জাপটে ধরল আঞ্জুমানকে।

আনিসুল ইসলামের চোখের কোণের জমে থাকা জলের ফোঁটা টুপ করে গাল বেয়ে পড়ল। কষ্ট হয়ে জমা অশ্রু আনন্দ হয়ে ঝড়ে পড়ল। কি অদ্ভুত!
এতদিন তিনি নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে হতভাগ্য বাবা ভাবতেন। আজ নিজেকে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান বাবা মনে হচ্ছে।

পুরো ব্যাপারটায় সবচেয়ে হতভম্ব হয়েছেন মনামী। তিনি ভেবেছিলেন সবাই মেনে নিলেও আঞ্জুমান কিছুতেই মেনে নেবে না এই ধর্ষিতা মেয়েটাকে। কিন্তু হলো তার উল্টো। তিনি বিষ্মিত গলায় বললেন,
“তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে আঞ্জু? তুই মেনে নিলি এই মেয়েটাকে?”
আঞ্জুমান মনামীর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বললেন,
“তুই কি খেয়েছিস?”
“ফাজলামি করছিস? আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে তুই জিজ্ঞেস করছিস আমি খেয়েছি কীনা! আমি কি তোর এখানে খেতে এসেছি?”
আঞ্জুমান সোজাসাপ্টা উত্তর দিলেন,
“না খেয়ে থাকলে খেয়ে বিদায় হ।”
মনামীর চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। আঞ্জুমান বললেন,
“অবশ্য তুই না খেতে চাইলে খাস না। এখন যেতে পারিস। তোকে এখানে কোনো প্রয়োজন নেই।”

মনামী বিষ্মিত, হতবাক। তার বান্ধবী তার সাথে এভাবে কথা বলছে! কয়েক সেকেণ্ড পলকহীনভাবে আঞ্জুমানের দিকে তাকিয়ে রইলেন মনামী৷ তার আর বলার মত কিছু নেই। তার শব্দভাণ্ডারে ব্যবহার করার মতো আপাতত কোনো শব্দ মজুদ নেই। কয়েক সেকেণ্ড পর যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেন। অর্থি পেছন থেকে ডেকে বলল,
“এইযে কূটনী আন্টি, বড় ভাইয়ার কথাটা মাথায় রাখবেন। অন্যের দিকে আঙুল তোলার আগে নিজের দিকে তাকাবেন, ওকে?”
এখানে এসে যথেষ্ট অপমানিত হয়েছেন মনামী। আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না তিনি। দ্রুত পায়ে হলরুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
.
নিয়মানুযায়ী অভ্র-পৃথুলাকে সঙ্গে নিয়ে নিজের বাড়িতে ফিরলেন আনিসুল ইসলাম। পুরো সময়টা জুড়ে পৃথুলা ভাবলেশহীনভাবে ছিল৷ একটা কথাও বলেনি৷ অভ্রও আর ঘাঁটায়নি পৃথুলাকে।

ডিনার সেরেই পৃথুলা রুমে চলে যায়। সারাদিনের ধকলে শরীরটা ক্লান্ত লাগছে খুব। অভ্র আনিসুল ইসলামের সাথে টুকটাক কথা শেষ করে নিজেও ঘুমাতে চলে যায়। অভ্র রুমে এসে দেখে পৃথুলা ঘুমায়নি। চোখ মেলে তাকিয়ে আছে শূণ্যে। তার দৃষ্টি সিলিং এ নিবদ্ধ। অভ্র দরজা লক করে ধীরপায়ে এগিয়ে আসে বিছানার দিকে।

গলা খাঁকাড়ি দিয়ে বলল,
“ঘুমাওনি পৃথা?”
পৃথুলা অভ্রর দিকে তাকিয়ে একটু নড়েচড়ে বসল৷ অভ্র হাতঘড়িটা খুলে বেডসাইড টেবিলের উপর রেখে পৃথুলার সামনে বসল। অসহায় গলায় বলল,
“স্যরি পৃথা।”
“কেন?”
“আজ তোমাকে অনেক আজেবাজে কথা শুনতে হয়েছে। যদি জানতাম এমনটা হবে ওই মহিলাকে ওখানে ঢুকতেই দিতাম না।”
পৃথুলা কিছু বলল না। হাসল কেবল।

অভ্র ভ্রু কুঁচকে বলল,
“হাসছো কেন?”
“একটা কথা বলব?”
“নিশ্চয়ই?”
“আজ মনামী আন্টি যে কথাগুলো বলেছে সেগুলো এর আগে আমাকে অসংখ্যবার শুনতে হয়েছে। বরং এরচেয়েও খারাপ কথা শুনতে হয়েছে। আমার রেপ হওয়ার পর ‘নষ্টা’ শব্দটা যে কতবার শুনতে হয়েছে তা হিসেবহীন। এছাড়া আরো কত নোংরা নামে সম্বোধন করতো লোকে! ইজ্জ্বত হারিয়ে যতটা কষ্ট পেয়েছি তারচেয়ে বেশি কষ্ট পেয়েছি মানুষের মুখের কথায়। অনেক ছেলেরা তো বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আমার রেটও জানতে চেয়েছে। তখন মনে হতো, রাফসান আমাকে শুধু রেপ করেই ছেড়ে দিয়েছে কেন? মেরে ফেলল না কেন? ধর্ষনের পর মেরে ফেলার ঘটনা তো অহরহ ঘটছে এ দেশে। আমার সাথে তেমনটা হলো না কেন? অতিষ্ট হয়ে আগের বাড়ি পাল্টে এ বাড়িতে চলে আসি আমরা। এ বাড়িতে আসার পর লোকের নোংরা কথা শুনতে হয়নি এমনটা না। তবে সংখ্যাটা কমে গেছে। প্রথম প্রথম কষ্ট পেতাম খুব। ইচ্ছে হতো মরে যাই। প্রথম প্রথম কয়েকমাস অনেক কেঁদেছি। কিন্তু এরপর শুনতে শুনতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। যে যাই বলতো চুপচাপ শুনে যেতাম। কষ্ট পেতাম তবে কাঁদতাম না। কিন্তু আজ কেন যেন চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি। মনামী আন্টি আজ যা বলেছে তারচেয়েও অনেক খারাপ কথা শুনতে হয়েছে এতদিন৷ তারপরেও কাঁদতাম না৷ আজ কেঁদেছি। কারণ, এতদিন আমার হয়ে প্রতিবাদ করার মত আমার পাশে কেউ ছিল না। কিন্তু এখন আপনি আছেন আমার পাশে। জানেন অভ্র, এতদিন নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হতো। কিন্তু এখন মনে হয় না। বাবা, মা, বোন ছাড়াও আপনার মত একজন স্বামী পেয়েছি, মায়ের মতো শাশুড়ি আর ভাই-বোনের মত দেবর ননদ। জীবনের পূর্ণতার জন্য আর কি লাগে, বলুন?”
.
চলবে___

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here