মন_গহীনের_গল্প পর্ব-২০ রূবাইবা_মেহউইশ

মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-২০
রূবাইবা_মেহউইশ
💞

ঘরে মৃদু আলো জ্বলছে। নির্জনের জন্যই ঘর পুরোপুরি অন্ধকার করে ঘুমানো হয় না রিশাদের। মেহউইশেরও অভ্যাস হয়ে গেছে এখন এমন মৃদু আলো জ্বালিয়ে ঘুমানোর। কোমরে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে মেহউইশ সামনে তাকায়। রিশাদ, নির্জন দুজনেই গভীর ঘুমে। নিজের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলো আজ তারা তিনজনই একই কম্বলের নিচে। একটুখানি কম্বল উঠিয়েই বুঝতে পারলো ঘুমের ঘোরেই রিশাদ হাত তার গায়ে ফেলেছে। ভেবে পায় না সে এই মধ্যরাতেও কম্বলের নিচে লোকটার হাত এত ঠান্ডা কেন! যা তার জামার উপর দিয়েই অনুভব হচ্ছে । গায়ের উপর লোকটা হাত জেনেই অস্বস্তি হচ্ছে৷ তাই নিজেই কম্বলের তলা দিয়ে রিশাদের হাত সরিয়ে দিলো। কিছুক্ষণ একনাগাড়ে চেয়ে রইলো ঘুমন্ত রিশাদের মুখে। হালাল বিয়ের নাকি অসীম শক্তি অপরিচিত দুটো মানুষকে একসাথে আজীবন বেঁধে রাখার৷ কিন্তু এই লোকটা যেভাবে বিয়ে করেছে সেটাকে কি হালাল বিয়ে বলে!

সকালে আজ কারোই তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙেনি। ঘুম ভাঙলো গেইটের দারোয়ানের ডাকে।রেহনুমাই প্রথমে বেরিয়ে এলেন দরজা খুলে তারপর রিশাদ। মেহউইশ কিংবা রাইমা দুজনের কেউই ঘুম থেকে উঠেনি। রিশাদ ঘর ছেড়ে করিডোরে আসতে আসতে রেহনুমা বাইরেই এসে দাঁড়িয়েছে৷ দারোয়ানকে ডাকার কারণ জিজ্ঞেস করার আগেই চোখে পড়লো গেইটের সামনে দাঁড়ানো জেবুন্নেসাকে। গোলাপি রঙের একটা সিল্ক শাড়ি পরনে, এক হাতে তার ফোন অন্য হাতে সানগ্লাস । মুখের ভাবে মনে হচ্ছে শীতের সকাল তার গায়ে নিজের তীব্রতার বাহাদুরি একদমই করতে পারেনি।কাচরঙা রোদ্দুরে জেবুন্নেসাকে এই মধ্যবয়সেও তরুণীর মত প্রখর সৌন্দর্যে ঝলসানো সুন্দরী বলে মনে হচ্ছে রেহনুমার৷ যেই সৌন্দর্য বুকের ভেতর খচ্ করে কাঁটার মত বিঁধছে। নিজেও সে কম সুন্দরী নয় বরং রুপ তো জেবুন্নেসার চেয়ে তারই বেশি। কিন্তু তাতে কি আসে যায় যেই সৌন্দর্য তার মনপুরুষকে তার প্রতি আকর্ষিতই না করে! জেবুন্নেসাকে দেখতেই রেহনুমার দুনিয়ায় সব থমকে গিয়ে অতীতের একজনকেই মনে করিয়ে দিচ্ছে । চোখ দুটো ক্রমাগত ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে তার। শরীরটাও টলছে কি! রিশাদ এগিয়ে গেইটের কাছে যেতেই জেবু এসে তাকে জাপটে ধরলো। চোখে তার পানির ঢল সেই সাথে গলা কাঁপছে । কাঁপা কাঁপা স্বরে কত কি বলেও চলছে৷ রিশাদ প্রথমে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেও পরে ধীরে ধীরে হাত উঠিয়ে জেবুন্নেসাকে জড়িয়ে ধরলো৷ কত বছর! ঠিক কত বছর পর তা মনে নেই রিশাদের শুধু মনে হচ্ছে বহুবছর পর সে খালাকে এত কাছে পেয়েছে। মা মা গন্ধটা যেন আজই তার নাকে লাগলো প্রথমবার। মায়ের স্মৃতি ঠিকঠাক কিছুই মনে আসে না তার কিন্তু খালার আদর এখনও মনে আছে। ঠিক সেইদিন পর্যন্ত খালার আদর পেয়েছে যেদিন খালা শুধু খালা ছিলো। বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী হওয়ার পরই খালা বদলে গেছে। কাঁদতে কাঁদতে হিঁচকি উঠে গেছে জেবুন্নেসার তা দেখে রেহনুমা রিশাদকে ডেকে বলল, ‘ঘরে নিয়ে আয় রিশাদ।’ কথাটা জেবুন্নেসার কানেও গেছে সে রিশাদকে গালে,মুখে হাত বুলিয়ে কত কি বলতে লাগলেন তার মধ্যে রিশাদ শুধু নির্জনের নামটাই বুঝলো।জেবুন্নেসাকে ধরে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলে রেহনুমা এক গ্লাস পানি এনে এগিয়ে দিলো রিশাদের হাতে। রিশাদ পানিটুকু খেতে ইশারা করে জেবুন্নেসাকে ডাইনিংয়ের একটা চেয়ার এনে বসতে দিলো। রাইমা ততক্ষণে ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছে।মাকে দেখে চমকপ্রদ মুখ করে রিশাদের দিকে তাকালো। রিশাদ ইশারা করলো যার অর্থ সে কিছুই জানে না জেবুন্নেসার আগমন সম্পর্কে। জেবুন্নেসা নিজেই দুজনের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অত ইশারা ইঙ্গিত করার কিছুই নেই৷ কাল থেকে তোদের কারো সাথেই যোগাযোগ করতে পারিনি বলে হোটেলের ম্যানেজারকে বলে গাড়ি ব্যবস্থা করে চলে এসেছি। আমার উপস্থিতিতে কি কারো কোন প্রকার সমস্যা আছে?’ শেষে করা প্রশ্নটা বোধহয় জেবুন্নেসা না চাইতেও রেহনুমাকেই উদ্দেশ্য করে বলেছে। রেহনুমাও যেন জানতো এমন কোন প্রশ্ন তাকে শুনতে হবে তাই সে প্রস্তুতি নিয়েই রেখেছিলো।

‘কোন সমস্যাকেই সমস্যা বলে ভাবার মত উপলব্ধি আল্লাহ আমাকে এ জনমে কখনো দেয়নি আর দেবেন বলেও মনে করি না।’

রিশাদ তেমন কিছু মনে না করলেও রাইমা অবাকের চরমে পৌঁছে গেছে। মা আর ফুপুর এই কথাবার্তা তার কাছে কোন তর্ক বিতর্ক শো বলে মনে হচ্ছে। মেহউইশ আধখোলা চোখে নির্জনকে কোলে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়েছে মাত্রই। তার হয়তো ঘুমটা এখনো পূর্ণ হয়নি শুধুমাত্র নির্জন উঠে শব্দ করেছে বলেই তাকে নিয়ে বিছানা ছেড়েছে। রিশাদ খেয়াল করলো সে এলোমেলো পা ফেলে হাটছে আর তার খেয়ালও নেই করিডোরে কেউ আছে কিনা!

‘আমার দাদুভাই উঠে গেছে?’ চেয়ার ছেড়ে জেবুন্নেসা হাত বাড়ালেন নির্জনের দিকে। মেহউইশ কোন কিছু বুঝে উঠার আগেই নির্জনকে তার কোল থেকে নিয়ে নিয়েছে জেবুন্নেসা।এমন আকষ্মিক আচরণে হতভম্ব মেহউইশের ঘুম আপনাআপনি উবে গেছে। সে জেবুন্নেসাকে খেয়াল করতেই সালাম দিলো। সালামের জবাব নিলো কি নিলো না তা বোঝা গেল না। রিশাদের মনে হলো আপাতত বলার মত কোন কথা বাকি নেই তাদের তাই সে ঘরে গেল এবং যেতেই জোরে ডাকলো, ‘মেবিশ।’

সকাল সকাল একেকজনের আচরণে মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে উঠছে মেহউইশের কিন্তু তা প্রকাশ করার সুযোগটাও যেন নেই তার৷ রোদ ঝলমলে সকালে নির্জনকে নিয়ে উঠোনের শেষে চলে গেল জেবুন্নেসা। এখান থেকে যে পাহাড়টা সামনে আছে সেটা খুব উঁচু । রিশাদের এই বাড়ির চেয়েও শ’খানেক ফুট উঁচু হবে হয়তো। কিন্তু দক্ষিণ দিকটা ভয়ংকর খাঁদ । বাড়িটা এত পিছিয়ে কেন করেছে? যদি কোন বিপদ হয়! গায়ের লোম শিউরে উঠেছে জেবুন্নেসার। এসব কি ভাবছে সে, আর কেন? এই বাড়িতে রেহনুমা থাকে বলে! স্নেহমাখা পরশে বুকের মধ্যে চেপে রেখেছে সে নির্জনকে৷ সব অতীত আজই কেন কুঁড়ে কুঁড়ে তাজা হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে ভেবে পায় না সে৷ কি দরকার পুরনো স্মৃতিদের আজ আবার জ্বালাতন করার, নতুন করে ঘা গুলোকে তাজা করার! বেশতো কাটলো একুশ বছর৷

সকালের নাস্তা তৈরি হতে দেরি আর আজ এমনিতেই দেরি হওয়ায় নাস্তা না করেই চলে গেল রিশাদ। ফোন চালু করতেই দেখলো হোটেলের ম্যানেজার অনেকবার ফোন করেছিলো। আজ সে এতোটাই ঘুমে বিভোর ছিলো যার ফলে ফোনকল কান পর্যন্ত আসেনি৷ আবার কোন এক ফাঁকে ফোনটা চার্জের অভাবে বন্ধও হয়ে গিয়েছিলো। রিশাদ চলে যেতেই মেহউইশের মনে হলো আজ লোকটা কিছু ভুলে গেছে৷ কি ভুলে গেছে তা বুঝতে পারছে না। তবে জরুরি কিছু ভুলেছে বলেও মনে হচ্ছে না। একসময় জীবনে বেঁচে থাকার প্রতি যে আসক্তি ছিলো সেই আসক্তিতে লুকিয়ে থাকা যে বিতৃষ্ণা জমা আছে তা যেন ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে মেহউইশের জীবন থেকে। এ জীবনে সে কিংবা তার আশেপাশের মানুষ যাই ভুলে যাক তাতে এতো ভাবনার কি হলো বুঝে পায় না সে! তবুও ভাবনা আসছেই কি ভুলে গেল আজ লোকটা! নাস্তার টেবিলে মুখোমুখি চার নারী৷ সেখানে দুজন নারী, দুজন মধ্য বয়স্ক নারী তাদের আচরণে লুকোচুরি প্রকাশ করছে না চাইতেও। রাইমা কতটুকু খেয়াল করলো কে জানে! মেহউইশ খুব ভালো করেই খেয়াল করেছে ওই দুজন মধ্যবয়স্ক নারীর মধ্যে একজনের কথাবার্তায় ক্ষোভ,অহংকার এবং চিমটিখানিক তিরস্কারও মিশ্রিত ছিলো৷ আর দ্বিতীয় নারীটি বেশ অসহায়তা লুকিয়ে নিজেকে প্রচণ্ডরকম সুখী আর স্বাভাবিক দেখাতে আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। নাস্তার পরপরই আবার জেবুন্নেসা নির্জনকে নিয়ে খেলতে শুরু করেছে। রাইমা জেদ ধরে বসেছিলো সে পাহাড় ঘুরে ঘুরে দেখবে আর তার সঙ্গী হতে হবে মেহউইশকে। কিন্তু রেহনুমা তাদের একা ছাড়ার সাহস পাচ্ছে না আবার রিশাদকে না জানিয়েও অনুমতি দিতে ভয় পাচ্ছে। ফোন কয়েকবার রিশাদকে কল করেও নেটওয়ার্ক সমস্যায় কথা বলা গেল না। রাইমা জেদ ধরে বসে আছে। প্রথমবার ফুপুর কাছে আবদার করে তা পূরন হবে না ভাবতেই রেহনুমার মন খারাপ হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত উপায় ভেবে আনতুংকে সঙ্গে পাঠালো তাদের। বাড়ি থেকে বের হতেই আনতুং আরো কয়েকজন তার পরিচিত মেয়েকেও জুটিয়ে নিলো। একদল মেয়ে বেরিয়ে পড়লো পাহাড় ভ্রমণে। মেহউইশ আর রাইমা দুজনেই চরম উত্তেজিত এই হঠাৎ বের হওয়া ভ্রমণে। পাহাড়,সবুজবীথি, জানা অজানা হাজারো জংলী ফুল, পাখি, ফল আরো কত কি এই পাহাড়ের গায়ে। এত এত সৌন্দর্যে হারিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে মেহউইশের খুব করে মনে পড়ছে হাসপাতালের বাগানে বসে ইভানের সাথো বোনা কিছু স্বপ্ন। এই স্বপ্ন যখন মেহউইশের দৃষ্টি ঘোলাটে করে কিছুটা সময় পিছিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো ঠিক তখনই সে তার গ্রীবাদেশে কারো আলতো স্পর্শ পেল। পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা বুনোফুলের লতায় দুলে দুলে যাচ্ছে মাতাল হাওয়া। এ স্পর্শ মেহউইশের খুব চেনা,খুব আপন।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here