মন_গহীনের_গল্প পর্ব-২৪ রূবাইবা_মেহউইশ

মন_গহীনের_গল্প
পর্ব-২৪
রূবাইবা_মেহউইশ
💞

সুইমিংপুলের সাথের বাগানের প্রতিটি ফুলগাছে ছোট ছোট আধুনিক রঙবেরঙের বাতি লাগানো হয়েছে। সেই সাথে সুইমিংপুলের পানিতে ঠিক গত বছরের মতোই প্রদীপ জ্বালানোর ব্যবস্থাও করা হয়েছে। গত বছর সব হয়েছে নীলিমার ইচ্ছেতে এবার হয়েছে মডেল কন্যা তিশমার ইচ্ছেতে। রিশাদ যখন নিজের কেবিনে বসে ম্যানেজারের উপর রাগ ঝাড়ছিলো কাপল স্যুইট ডেকোরেশন দেখা নিয়ে তখনই আবির্ভাব ঘটে তিশমার। সে রিশাদ বলে ডাকতেই সুচতুর রিশাদ নিজের অগোছালো অবস্থার পরিবর্তন করার চেষ্টা করে। শার্টের কলার,ইন ঠিক করে টাইটাকে সোজা করে। হাত বুলিয়ে চুল ঠিক করতে করতেই কেবিনের ভেতর প্রবেশ করে তিশমা। রিশাদের অমন অগ্নি থেকে জল হওয়া দেখেই চরম বিষ্ময়ে বিষ্মিত হয় ম্যানেজার।রিশাদকে তিনি চেনে অনেক বছর হলো। বয়সেও রিশাদের চেয়ে জুনিয়র হলেও পড়াশোনায় রিশাদের ব্যাচমেট ছিলো। পরিচয় ছিলো বলেই লোকটার চরিত্র এবং কাজের প্রতি আগ্রহ দেখেই রিশাদ তাকে নিজের করা প্রথম কাজে তাকে জবের অফার করেছিলো। মধ্যবিত্ত পরিবারের এই ছেলেটির জন্য তখন চাকুরিটা ছিলো সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতন। বিনাবাক্যে চাকরিতে জয়েন করে আর তারপর থেকেই একসাথে অনেক সময় দুজন এখানে কাটিয়েছিলো। সেই সুবাদেই রিশাদের কঠোরতা,গম্ভীরতা এবং নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে সে অবগত৷ আর সেই ধারনা আজ আমূল বদলে গেলো মেয়েটিকে কেবিনে ঢুকতে দেখেই। রিশাদের মত লোক কিনা কোন এক মেয়ের জন্য এভাবে নিজেকে অপ্রস্তুত ভাবছে! তিশমা বর্তমানে আমাদের দেশের একজন উঠতি তারকা। কিছু কিছু বিজ্ঞাপনে কাজ করেই এ পর্যন্ত অনেক সাড়া পেয়েছে বড় বড় কাজের। রিশাদের সাথে তার পরিচয় অস্ট্রেলিয়ার যাত্রাপথে বিমানে। পাশাপাশি সিট হওয়ায় টুকিটাকি গল্প এবং দুজন সুন্দর মানুষের টুকটাক পরিচয় থেকেই ফোন নাম্বার আর সোশ্যাল সংযোগ আদান প্রদানে পরিচয় গভীর হয়। বয়সের পার্থক্য অনেক থাকা সত্ত্বেও দুজনের বন্ধুত্ব হয় দারুণ। বলতে নেই মেয়েটা মনে মনে রিশাদকে নিয়ে ভাবেও অনেকদূর কিন্তু সেই ভাবনায় ছেদ ঘটে বছর দেড়েক আগে রিশাদের বিয়ের নিউজ পেয়ে। তারপরও একটু আধটু কথাবার্তা সবসময়ই চলতো। নীলিমার পালিয়ে যাওয়া আর নির্জনের জন্মের কথাটাও সে জানে, শুধুই অজানা মেহউইশ নামের রিশাদের জীবনের নতুন অধ্যায়।

ছোট ছোট হাত চালিয়ে মেহউইশের গাল বার বার খামচে ধরছে নির্জন। আজকাল জাপটে ধরে, থাবা বসায় নির্জন সামনে কিছু পেলেই । মেহউইশের প্রথম প্রথম নির্জনকে দেখলেই মনে হতো ইভান হারিয়ে গেছে,তার জীবন তছনছ হয়ে গেছে শুধু মাত্র এই বাচ্চাটার কারণে। কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি এখন আর তেমন লাগে না। মধ্যরাতের নিঃস্তব্ধতায় ইভানের শূন্যতা বুকের ভেতর সুঁচের মত বিঁধলেও সেই কষ্টের দায় এখন আর নির্জনের ওপর দেয় না সে।ভাগ্য বলেও মেনে নেয় না। সবকিছুর জন্য দ্বায়ী সে রিশাদকেই ভাবে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে পেটের উপর বসিয়ে দেয় নির্জনকে। ঘাড় এখনও হেলেদুলে বাঁকিয়ে পড়ে এদিক, ওদিক আর মেহউইশ খুব সতর্কভাবে তার ঘাড়ের পেছন হাত রেখেছে। যেন বেকায়দায় পড়ে ঘাড় না ভাঙে,বাচ্চাটা ব্যথা না পায়! দুপুরের খাওয়া একটু আগেই শেষ হয়েছে তার আর রেহনুমার। কিন্তু নির্জন জেগে থাকায় তার আর ভাতঘুম দেওয়া হয়নি। বিছানায় শুয়েই খেলা করছে সে আর অমনি মেহউইশের ফোনটা বাজলো। উপর থেকে নির্জনকে বিছানায় শুইয়ে ড্রেসিংটেবিল এর ওপর থাকা ফোনটা নিতেই চমকালো ভীষণ, স্ক্রীণে ভেসে থাকা নামটা দেখে৷ এত দিনের মাঝে রিশাদ তাকে মাত্র দু দিন ফোন করেছিলো। প্রথমবার চেক করেছিলো মেহউইশ ফোনটা ধরে কিনা আর দ্বিতীয়দিন জিজ্ঞেস খোঁজ নেওয়ার ছিলো সে নির্জনের টিকার কার্ড সাথে এনেছিলো কিনা ভুলে গেছে। মেহউইশ যেন একটিবার আলমারিতে চেক করে। তখন সে মনে মনে রেগেছিলো খুব অলৌকিকভাবেই আজকে তার রাগ হলো না। ফোনটা তুলতেই ওপাশ থেকে রিশাদের গলা পাওয়া গেল, ‘নেট পাওয়া গেলে একটু হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল দাও তো। আমার এক ফ্রেন্ড নির্জনকে দেখবে।’ নিজের কথা শেষ করেই কল কেটে দিলো রিশাদ। মেহউইশ বোকা বনে গেল, কি হলো এটা? ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ আছে কিনা, নেট আছে কিনা এখানে ডাটা নেট কানেক্ট হবে কিনা কিছু না খবর নিয়েই অর্ডার করলো শুধু । নবাবজাদা ভাব সবসময় হুহ! নিজের মনেই বলতে বলতেই ফোনে দেখলো মেসেজ এসেছে রিশাদের নাম্বার থেকে।

‘ফোনে হোয়াটসঅ্যাপ, এমবি সবই আছে। তুমি শুধু ডাটা কানেক্ট করে নির্জনকে নিয়ে বাগানের দিকে যাও।’

মেসেজ পড়তেই ভয় লাগলো মেহউইশের। ভূতে দিলো নাকি এই মেসেজ! সে তো মনে মনে বলেছে এসব কথা এরই জবাব ওই লোকটা কি করে পাঠালো! লা হাওলা ওয়ালা কুয়াতা,,,,৷ পড়তে পড়তেই মেহউইশ ফোনের ডাটা কানেক্ট করলো। সিম নেটওয়ার্ক একবার দেখা যাচ্ছে তো আরেকবার ভ্যানিশ। ভয় তো বেড়েই চলছে, লোকটার ওপর কি জ্বীন, ভূতের আছর আছে?

শীতের আকাশে সূর্য একটু জলদিই লুকিয়ে পড়ে গৌধূলিবেলায়। এখন গৌধূলির শুরু আকাশ কালচে হয়ে কুয়াশার চাদর নেমে আসছে এখনই পাহাড়ে। মেহউইশ নির্জনকে কোলে রেখে চেয়ারে বসেছিলো কিন্তু ফোন ধরায় সমস্যা হচ্ছে । বাধ্য হয়ে রেহনুমাকে ডেকে চেয়ারে বসিয়ে নির্জনকে তার কোলে দিলো। নিজে ফোনটা ধরে ভিডিও কল দিতেই ক্যামেরায় ভেসে উঠলো একজোড়া মুখ৷ রেহনুমা কিছু বলতে যাবে তার আগেই তিশমা বলল, ‘ইনি কে?’ ক্যামেরার পেছন থেকে সচকিত মেহউইশ নারী কন্ঠ শুনে কৌতূহলী হলো বেশ তবুও দেখার চেষ্টা করলো না। এবার রিশাদের গলা পাওয়া গেল, ‘আমার ফুপি আর আমার ছেলে৷’

‘ওহ, স্লামালিকুম আন্টি।’ বেশ উৎফুল্ল গলায় জানতে চাইলো তিশমা। ততক্ষণে রিশাদের নজর স্ক্রীণে আরো একটি মুখ দেখার প্রতীক্ষায়। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মুখটি দেখা গেল না৷ রেহনুমা সালামের জবাব দিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ক্যামেরায়। এদিকে ছোট্ট হাতে বার বার ফোনটা খাবলে তুলে নিতে চাইছে নির্জন সাথে বাবার মুখ দেখেও উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বিভিন্নরকম শব্দ করছে।

‘ফুপি এ হলো তিশমা।আমার বান্ধবী।’ মেহউইশের কানে বাক্যটা প্রবেশ করা মাত্রই সে ফোন ঘুরিয়ে নিজের মুখের সামনে ধরলো৷এপাশে রিশাদ,তিশমা দুজনেই হকচকিয়ে গেল আচানক মেহউইশকে দেখে ওপাশে মেহউইশ হতভম্ব অপরুপ সুন্দরী মডেল কন্যা তিশমাকে দেখে। দ্রুত আবার ফোন ঘুরিয়ে সে রেহনুমার দিকে তাক করলো। কয়েক সেকেন্ড পর তিশমার গলা পাওয়া গেল, ‘ওটা কে ছিলো রিশাদ?’

‘বেবিসিটার।’

‘বেবিসিটার!’ কথাটা কানে বাজলো মেহউইশের সাথে রেহনুময়ারও। রিশাদ তার ফ্রেন্ডের সামনে মেহউইশের পরিচয় লুকালো! কলিজায় লাগলো যেন রিশাদের বলা কথাটা। লোকটার মতলব কি? জোরজবরদস্তি বিয়ে করে এনে এখনও লোকের সামনে বলছে আমি তার ছেলের কাজের লোক। অসভ্য, হারামি বেবিসিটারের সাথে রাত কাটাতে আসিস তুই! শালা বজ্জাত। মনে মনে গালির ফোয়ারা ছুটলো মেহউইশের কিন্তু মুখে বলার সাহস নেই রেহনুমার সামনে। শত হলেও রেহনুমা তো রিশাদেরই ফুপু৷ ফোনকল কেটে দিয়েছে রিশাদ অনেক আগেই তবুও চেয়ারে থম মেরে বসে আছে রেহনুমা৷ রিশাদের আচরণ তার নিজেরও ভালো লাগেনি। রিশাদকে সে দূর থেকেই জানে তবুও এতখানি জানে রিশাদ কখনো কোন মেয়েকে পটাতে তার স্ত্রী’র পরিচয় লুকাবে না। নাকি ওই মেয়েটা তার বন্ধুর চেয়েও বেশি কিছু! রেহনুমা মনে প্রাণে চাইছে তার মনের ভাবনাগুলো ভুল হোক। রিশাদের জীবনে নীলিমাকে নিয়ে যে তামাশা হয়ে গেছে তা আবার নতুন করে তার আর মেহউইশের সম্পর্কেও হোক৷ এমনিতেও রিশাদের বন্ধুটি দেখে অনেক বেশিই সুন্দরী মনে হলো। অন্তত নীলিমা,মেহউইশের তুলনায় তো অনেক বেশিই। বয়সেও মেহউইশের সমানই হবে হয়তো।

রাশেদ খানের তর্জনে গর্জনে খান বাড়ি আজ তুঙ্গে। থমথমে মুখে বসে আছে রাইমা আর রিহান তাদের মায়ের ঘরে। তাদেরই সামনে বসে আছে জেবুন্নেসা আর দরজামুখে দাঁড়িয়ে চিৎকার করছে রাশেদ খান। তার এক কথা, মেয়ে তার কাছেই থাকবে। আর এই কথাটা রিহানের কান ভেদ করে অন্তরের ভেতরে গেঁথে গেল৷ বাবা- মা ডিভোর্স চায় আর সেই ডিভোর্সে তার মেয়েকেও চায় নিজের সঙ্গে৷ আর মা বলছে মেয়েকে সে কিছুতেই এ বাড়িতে রেখে যাবেন না। আজই চলে যাবে সে বাপের বাড়ি সাথে রাইমাও যাবে৷ রিহানের দুঃখটা এখান থেকেই শুরু, মাও তাকে চায় না, বাবাও৷ সে কি তবে ফেলনা! রিহানের কিশোর মনে বড়সড় আঘাতটা এখান থেকেই লাগা যা তার খুব কাছের আর আপন কেউ জানতেই পারলো না। রাইমা বিমর্ষ মুখে বসে আছে। বাবাকে সে অসম্ভব ভালোবাসে সাথে মাকেও, যদিও মায়ের সাথে তার মিষ্টি মুহূর্ত কখনো ছিলো বলে মনে পড়ে না। আজ মা বাবার লড়াই তার সকল প্রাণশক্তি কেড়ে নিচ্ছে। সত্যিই কি মা-বাবা ডিভোর্স নেবে! তাদের বিচ্ছেদে কি তাকে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে? নাহ, কিছুতেই সে এমনটা হতে দেবে না। ছোট থেকেই তো মা বাবার কখনো বনিবনা দেখেনি তাই বলে এভাবে বিচ্ছেদ তার কল্পনার বাইরে।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here