কেন এমন হয় পর্ব-৬

কেন এমন হয়

পর্ব – ৬

দরজা পার করে ভেতরে ঢুকার সময় আদনানের পা টলে উঠলো,কোন দিন শ্বাসকষ্ট না হলেও মনে হচ্ছে এখন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে।এই বাসা বাসার মতোই আছে , শুধু রিয়া নেই ,বাবু নেই।এই বাসার প্রতিটি কোনায় রিয়ার ছোঁয়া। বাবুর ওয়াকারটা এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে।আর সহ্য হচ্ছিল না, আদনান প্রায় দৌড়ে ওয়াসরুমে ঢুকে গেল।

হিয়া এসে কলিং বেল বাজালেই রিয়া একটা হাসি দিয়ে দরজা খুলে দাঁড়াতো।বুকটা হু হু করে উঠল।আর কোন দিন আপু হাসি দিয়ে দরজা খুলে দাঁড়াবে না, হিয়া ঘরে পা দিল অশ্রু ভেজা চোখ নিয়ে।

শাপলা কাজে লেগে গেল। মফিজ বৌকে সাহায্য করতে লাগলো।
আহনাফ বারান্দার দোলনায় চুপ করে বসে রইল।ওর ছোট্ট মনে ভাবনা আসল ,’মা তুমি কেন আকাশের তাঁরা হলে ? শুধু বোনকে নিয়ে গেলে আমাকে নিলে না।আমি জানি তো তুমি আমার চাইতে বোনকেই বেশি ভালোবাস,তাই শুধু ওকেই নিয়ে গেছ।’

হিয়া সব রুম খুঁজে , বারান্দায় আহনাফকে দেখতে পেলো , এক মনে কি যেন চিন্তা করছে , দোলনায় বসে।হিয়া কাছে গিয়ে আহনাফকে বলল-
—বাবু সোনা, এখানে বসে কি করছ?
ফ্রেশ হয়ে খেতে হবে,আস তো।
—আচ্ছা খামমনি,মা শুধু বোনকেই ভালোবাসে তাই না?
—তা কেন হবে? তোমাকেও অনেক ভালোবাসে।
—তাহলে শুধু বোনকে নিয়ে চলে গেল,আমাকে নেয়নি কেন?
হিয়া বুঝে উঠতে পারছে না এই প্রশ্নের কি উত্তর দিবে। নিজের মনেই তো আজ হাজারো প্রশ্নের কোন উত্তর নেই।
—তুমি ও যদি মায়ের সঙ্গে চলে যেতে তাহলে তোমার বাবা কাঁদতো।বাবা তো তোমাকে অনেক ভালোবাসে।
—তাই তো।বাবা বসে বসে কাঁদতো আহনাফ কোথায় এই বলে বলে?বাবাও যদি আমাকে রেখে চলে যায়?
—কখনো যাবে না।বাবা যে তোমাকে অনেক ভালোবাসে।
—আচ্ছা খামমনি তুমি কি চলে যাবে?
—না,আমি তোমাকে রেখে কোথাও যাবো না।
—প্রমিস কর।
আহনাফের ছোট্ট হাত নিজের হাতের ভেতর ঢুকিয়ে হিয়া বলল-
—প্রমিস করছি এই ছোট্ট বাবাকে ছেড়ে কোথায় যাবো না আমি।
আহনাফ কে কোলে তুলে নিতে চাইলে, আহনাফ বলল-
—খামমনি তুমি আমাকে কোলে নিতে পারবে না,আমি এখন অনেক বড় হয়ে গেছি, না?
—তাই তো ,বাবাটা অনেক বড় হয়ে গেছে রে।চল চল তাড়াতাড়ি খেয়ে , আরো তারাতাড়ি বড় হতে হবে।

হিয়া আহনাফকে খাইয়ে দিতে লাগলো। আদনান এখনো ওয়াসরুম থেকে বের হয়নি।দরজায় নক করবে কিনা ভেবেও নক করলো না,একটু চিন্তা হতে লাগলো।

শাপলা আর মফিজ গেস্ট রুমে।হয়তো রেস্ট করছে।শাপলা মুহূর্তের মধ্যে সব কিছু পরিষ্কার করে খাবার গরম করে টেবিলে দিয়ে দিয়েছে।আসার সময় নূরজাহান আর হিয়ার মা দুজনেই রান্না করে অনেক খাবার দিয়ে দিয়েছেন।

হিয়া দরজার কাছে থাকাতে কলিং বেলের শব্দ হতেই সে দরজা খুলল।নিপা,হিয়াকে দেখেই যেন দমে গেল।নিপার হাতে একটা ট্রে, মিনমিনে গলায় বলল-
—কেমন আছ হিয়া? আহনাফ কোথায়?আহনাফকে দেখতে পেয়েও নিপার চোখ এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলো। হাতের ট্রে ডাইনিং টেবিলের উপর রেখে বলল-
—মা পাঠিয়েছে। বাটিগুলো খালি করে দিয়ে দাও।
—আমরা আসবো সেটা তোমরা জানতে নিপা?
—মনু ভাই বলেছে।
—আন্টি শুধু শুধু কষ্ট করতে গেলেন।
এর মাঝে শাপলা এলো।

আহনাফকে , নিপা আদর করার জন্য ধরতে গেলে আহনাফ সরে গিয়ে হিয়াকে জড়িয়ে ধরলো।হিয়ার হাতে মাখানো ভাত তাই সে বলল-
—বাটি পরে দিব,তুমি বস, আমাদের সাথে ভাত খাও।
নিপা শুধু না সূচক মাথা নাড়ালো।
শাপলা কে দেখেও যেন দেখলো না নিপা।আর একটা কথাও না বলে হনহন করে চলে গেল।
আহনাফের এমন আচরণ দেখে রাগে মনে মনে গজগজ করতে লাগল।নিপা খেয়াল করেছে,আহনাফ কখনো ওর কাছে আসতে চায় না। অথচ ,আহনাফ তাদের বাসায় গেলে মায়াকে নানু নানু ডেকে ডেকে যেভাবে কথা বলে,খেলা করে ,ওর সাথে সে সব করে না।মনে মনে বলতে লাগল সেই দিন ওর মায়ের সাথে ওটাও মরে গেল না কেন?

নিপার এমন আচরণ হিয়া স্বাভাবিক মনে করলেও শাপলা ভাবতে লাগল,’এ কেমন মেয়ে রে বাবা?’

হিয়া ঢাকনা সরিয়ে দেখলো দুইটা হাঁফ প্লেটে নুডুলস,দুইটা বাটিতে পায়েস। তার মানে সবার আসার কথা নিপা জানতো না। আদনান ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে কে এসেছিল জানতে চাইলে ,এই প্রথম হিয়া সরাসরি কথা বলল-
—নিপা এসেছিল খাবার নিয়ে।
বিয়ের পর এই প্রথম হিয়া আদনানের সঙ্গে কথা বলল।এখন কথা না বলে উপায় ও ছিল না।শাপলা কি উত্তর দিবে ,সে তো চিনেই না।

হিয়া কথা বলতে গিয়ে আদনানের চোখে ,চোখ পরাতে দেখলো , আদনানের চোখ লাল হয়ে আছে। বাথরুমে বসে হয়তো কেঁদেছে, পুরুষ মানুষ,সবার সামনে কাঁদলে তো লজ্জা! একজন শিশু নিজের মা’কে ভুলতে পারছে না,একজন বোন বড় বোনকে মনে করে কষ্ট পাচ্ছে,একজন স্বামীর মন মৃত স্ত্রী-সন্তানের জন্য হাহাকার করছে।

সবাই খেতে বসলো,কেউ কোন কথা বলল না।

নূরজাহান,শাপলাকে সব কিছুই শিখিয়ে দিয়েছেন।যে চলে যায় তার স্মৃতি আঁকড়ে নিজেকে দুঃখ দেয়ার সাথে সাথে অন্যদের ও অশান্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তিনি ইচ্ছে করলে আদনানের তালে তাল মিলিয়ে ঢাকায় এসে থাকতে পারতেন,ওর আরো পরে বিয়ে করলেও হতো কিন্তু সেটা কোন স্থায়ী সমাধান হতো না,মাটি নরম থাকতে থাকতেই আকার দিতে হয়।ছেলে এবং বাবা উভয়ের জন্যই এই সময় থেকেই প্রয়োজন ছিল হিয়াকে।

বোনের বেড রুমে শুয়ে হিয়ার অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো।এই বেড রুমে,এই বেডে কত না সুখের অনুভূতিতে কেটেছে দুজনের,আজ একজন নেই , অন্য জন কি সে সব কিছু ভুলতে পারবে?ভাইয়া ভাইয়া বলে কত মজা করেছে,কত আবদার করেছে, নিজের বোনের সাথে কত রোমান্টিকতা দেখেছে সেই মানুষটাকে কিভাবে স্বামী হিসেবে মেনে স্বাভাবিক হতে পারবে? নিজেকেই নিজে বোঝায় হিয়া-এ সব ভাবার কোন দরকার নেই,আহনাফের জন্য যা প্রয়োজন শুধু সেটাই করবে।

পাশে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত আহনাফের গালে চুমু দিয়ে ,আম্মার কথা মনে পড়ল হিয়ার ।আম্মা সবসময় বলেন,’বাচ্চারা ঘুমাইয়া গেলে আদর করতে হয় না, তাহলে বাচ্চারা দুষ্টু হয়।’ঘুমিয়ে গেলে বাবু সোনাটাকে আরো বেশি কিউট লাগে।হিয়া আবার একটা চুমু দিল গালে , তখন আহনাফ ঘুমের ঘোরে মা মা ডেকে কি যেন বলতে লাগল।হিয়া জরিয়ে ধরলো আহনাফকে।

চলবে…

ফাহমিদা লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here