কেন এমন হয় পর্ব -১৯

#কেন এমন হয়

পর্ব – ১৯

এক বছর পরে নিরা মায়ের কাছে আসলো।মা-মেয়ের এত দিন দুরে থাকার দুঃখ সেই সাথে এত দিন পরে মিলনের যে আনন্দ উভয় অনুভূতির প্রকাশের সেই দৃশ্য দেখলে পাথরের চোখেও পানি আসবে।
এক সময়, এই পরিবারের নতুন সদস্য এবং এই পৃথিবীর নতুন অতিথি তীব্র চিৎকারে জানান দিল তার অস্তিত্ব।নিরা খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লো মেয়েকে নিয়ে।মেয়েকে দুধ খাইয়ে মায়াকে বলল-
—মা বাবুর একটা সুন্দর নাম রাখ?
—তোরা কোন নাম ঠিক করিসনি এখনো?সালেহ তুমি একটা নাম ঠিক কর ।
সালেহ কিছু বলার আগেই নিরা বলল-
—আমার মেয়ের নাম তুমি রাখবে মা।
সালেহ সাথে সাথে বলল-
—জি আম্মা আপনিই রাখুন।
—তাহলে আমার এই ফুটফুটে নাতনির নাম রাখলাম
-রেহনুমা বুশরা। রেহনুমা অর্থ-পথ প্রদর্শক আর বুশবা অর্থ-সুসংবাদ।
নিরা বলল –
—খুব সুন্দর নাম। আমার বুশরা , আমার কাছে এসেছে এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সুসংবাদ।তাই না মা?
—অবশ্যই।
সালেহ বলল-
—খুব সুন্দর নাম আম্মা ।

সালেহ নিজেই নিরাকে নিয়ে এসেছে। মায়া ভাবছেন সালেহ এমন সোজা হয়ে গেল কিভাবে?সব কিছুতে আবার একটু তেল দেয়া দেয়া ভাব!
সালেহকে টেবিলে খাবার দিয়ে নিরাকে নিজ হাতে খাওয়াতে লাগলেন মায়া,নিরা খাচ্ছে আর দু’জনের চোখই ভিজে ভিজে উঠছে। আবার দু’জনেই সেটা গোপন করার চেষ্টায় ব্যস্ত।
খাওয়া শেষে নিরা বলল-
—আমি একটু ঘুমাই ,কত দিন যে ভালো করে একটু ঘুমাতে পারি না, তার হিসাব নেই।বাবুকে কেউ একটু ধরেও দেখে না ওখানে।দেখে মনে হয় বাবু ওদের কেউ হয় না,আমি বিরাট এক পাপ করেছি মেয়ে জন্ম দিয়ে।
মায়া চুপ করিয়ে দিলেন নিরাকে।
—এখন আর এই সব চিন্তা করতে হবে না, এখন তোর মায়ের কাছে চলে এসেছিস।চুপ করে ঘুমিয়ে পড়।

সালেহ বলল-
—আমি এখানে থাকতে পারবো না আম্মা,কাল ভোরেই চলে যাবো। অফিসে একটু ঝামেলা আছে। কিছুদিন পরে আবার আসবো।
—কোন সমস্যা নেই, তোমার কাজ আছে যেতে তো হবেই।আর যদি কোন দিন নাও আস তবুও সমস্যা নেই বাবা।
—এটা কি বলেন আম্মা আমি আসবো না এই কথা কি বলেছি?নিরা যত দিন থাকতে চায় থাকুক,যখন যেতে চায় আমাকে জানালে এসে নিয়ে যাবো।
—সেটা পরে দেখা যাবে।এখন রেস্ট নাও।

মায়া খুব শান্ত ভঙ্গিতে কথাগুলো বললেন। সালেহ খুব অবাক হলো।সে ভেবেছিল তার শাশুড়ি তাকে অন্যান্যবারের মতো থাকতে অনুরোধ করবে।বিয়ের পর যে কয়বার এসেছে ,নিরাকে সাথে নিয়ে দুই দিন থেকে আবার নিরাকে সাথে নিয়েই চলে গেছে।মায়া খুব অনুনয় করতেন আর একটা দিন থাকার জন্য। কখনো সালেহ সেই অনুনয় শোনেনি।এখন মায়ার এমন ব্যবহারে সে চিন্তিত।নিপা অসুস্থ , হসপিটালে ভর্তি, এই কথা শুনে সালেহ দেখতে যেতে চাইলে মায়া সেটাও মানা করে দিলেন।

মায়া কথা শেষ করে নিজের বেডরুমে এসে দেখেন নিরা গভীর ঘুমে।মনে মনে বললেন -আহ্ আমার মেয়ে , সন্তান জন্ম দিয়ে এখন বুঝতে পারছে , সন্তান গর্ভধারণ থেকে শুরু করে লালন-পালন করা কত কষ্টের ।

সন্তান যত বড়ই হোক যত অন্যায় করুক মায়ের মন সন্তানের জন্য সব সময় ভালোবাসায় পূর্ণ থাকে।এটা এমন এক ভালোবাসা যা কখনো একচুলও শেষ হয় না। সাময়িক অভিমান হতে পারে, মায়ারও হয়েছিল।নিরা যখন সালেহকে বিয়ে করবে বলল-মায়া কথা বললেন সালেহের মা-বাবার সাথে।ওরা কেমন মানুষ তখন বুঝতে পেরে অনেক বুঝিয়েছিলেন নিরাকে। তখন নিরা প্রেমে অন্ধ ছিল।যাক সে সব আর মায়া মনে করতে চান না।
আর এটাও ভাবেন মায়ার বিয়ে তো মায়ার আব্বা এত দেখে শুনে দিয়েছিলেন।কই তাঁর কপালে তো সুখ হলো না । এখন মায়া ভাবেন সুখ জিনিসটা যার যার নসিবের ব্যপার।
এই সব অতীতের চিন্তা একদম বাদ, কিভাবে নিরার জীবনটা মসৃণ হয় সেটাই ভাবতে হবে।

সাইকিয়াট্রিস্ট এনামুল হক দেখছেন নিপার সাথে কথা বলার সময় একটা পর্যায়ে এসে নিপা কোন না কোন কারণ দেখিয়ে কথা বলা বন্ধ করে দেয়। সেই পর্যায়টা হলো আদনানের পরে রিয়ার কথা।রিয়ার কাছাকাছি আসলেই নিপা কখনো বলে , ঘুম পাচ্ছে, কখনো বা ওয়াশরুমে যাবো ইত্যাদি।আজ এনামুল হক ভাবছেন কি কারণে এমন করে নিপা বের করতেই হবে।তবে কি নিপা কোন সাংঘাতিক কিছু ঘটিয়েছে।
—নিপা আজ আমাকে বল রিয়া কেমন ছিল।
—ভালো।
—দেখতে কেমন ছিল?
—মোটামুটি।
এই কথাটা সে মিথ্যা বলল।
—যে দিন রিয়া মারা গেল সে দিন তার সাথে তোমার দেখা হয়েছিল?
—কেন আপনাকে বলবো?কেন বলবো?বলবো না কিছুই বলবো না।
নিপা বসা থেকে দাঁড়িয়ে নিজের চেয়ারটা টেনে ফেলে দিল। চিৎকার করতে লাগলো, নিজের চুল নিজেই টানতে লাগল।দুইজন সিস্টার তাকে ধরে রাখতে পারছেনা কিছুতেই।ডাক্তার একটা ইনজেকশন পুশ করলেন নিপাকে।

ঝুম বৃষ্টির মধ্যে হিয়া আর সিমি ভিজতে লাগল। আহনাফ শাপলার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখছে । শাপলা বলতে লাগল ভাবি এইবার আইসা পড়,আর ভিজা লাগবো না। আদনান তারাতাড়ি অফিস থেকে এসে মফিজের কাছে শুনলো ওরা ছাদে গেছে। এখনই সন্ধ্যা নামবে। আদনান গিয়ে দাঁড়াতেই , আহনাফ দৌড়ে বৃষ্টিতে নেমে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ভিজে গেল সে। আদনানকে দেখে হিয়ার খুব লজ্জা লাগছে।

এবার হিয়াকে আসতেই হলো। আদনান বলল, জ্বর আসলে বুঝবে মজা।এর মধ্যে আহনাফ হাঁচি দিতে লাগলো।

আহনাফ হওয়ার আগে একবার এভাবে ভিজেছিল রিয়া। আদনানকেও টেনে নামিয়ে ছিল বৃষ্টিতে। দুজনে মিলে অনেকটা সময় ভিজেছিল,মনে হয়েছিল সময় থেমে আছে, শুধু বৃষ্টি ঝরছে।এত প্রবল বর্ষণে আশেপাশের লোকজনকে দেখা যাচ্ছিল না। দু’জন দু’জনকে জরিয়ে ছিল।কি মধুর ছিল সেই সময়। দুজন দুজনকে পাওয়ার, কাছে আসার কি যে আকর্ষণ কাজ করতো।

এই সব ভাবতে ভাবতে দরজার কাছে এসেও আবার নিচে নেমে যাচ্ছিল আদনান। আহনাফ বলল-
—বাবা কোথায় যাও?
—কোথাও না বাবা,ভুলে নেমে যাচ্ছিলাম। কারেন্ট নেই দেখে লিফট বন্ধ তাই সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভুল হয়ে গেল।
হিয়া আহনাফকে মুছিয়ে কাপড় চেঞ্জ করে নিজেও গোসল করে বের হলো।হিয়ার ভেজা ভেজা এলোমেলো চুলের দিক থেকে আদনানের চোখ কিছুতেই সরাতে পারছে না।
এক সময় বারান্দায় চলে গেল আদনান। বৃষ্টি কমে গেছে। একটু আগে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরে আকাশ এখন পরিষ্কার। গাছগুলোর পাতা চকচক করছে। আকাশ লাল হয়ে উঠেছে একটু পরেই সূর্য ডুবে যাবে।
হিয়া কফি আর পাকোড়া নিয়ে এলো। হিয়া হলুদ-ঘিয়ে টাইপ সালোয়ার কামিজ পড়েছে , গায়ের রং কাপড়ের রং এক মনে হচ্ছে। আদনান বলল-
—সিমি কোথায়,সবাই একসঙ্গে খাই।
—ও এখনো গোসল করছে,ডেকেছিলাম ,বলল পরে খাবে।
—হিয়া একটু বস পাশে। কিছু কথা আছে। তোমার কাছ থেকে লুকানো ঠিক হবে না।
পাশের চেয়ারটাতে হিয়া বসলো।
—কি ব্যপার বলেন তো।
—সেই দিন আমি আর রফিক চাচা আরজুদের বাসায় গিয়েছিলাম।
—মানে?
যা কিছু ওখানে হয়েছে সব কিছু বলল হিয়াকে।
হিয়া খুব বেশি অবাক হলো না।

আরজু ছিল হিয়ার কম বয়সের আবেগ।এখন মনে হয় সে আদনানকে পছন্দ করে ফেলেছে। আদনানের আচার,আচরণ,সংযম হিয়াকে গভীরভাবে টানে। আদনানের এই গুণ হিয়ার কম বয়সের আবেগ আরজুকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে দুর বহু দুর অজানায়।

হিয়া বলল-
—কয়েকটা মেসেজ এ আমার ও সন্দেহ হয়েছিল ঐটা আরজু ভাই নাও হতে পারে কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না কে এমন করবে? কাক্কু জানলেন কিভাবে? নিশ্চয়ই সিমি বলেছে?
—না।সিমির সাথে তুমি কথা বলার সময় চাচী শুনে চাচাকে বলেছে।
—এটাই ছিল কাক্কুর বিশেষ কাজ?
—হু । তোমাকে সবাই অনেক বেশি ভালোবাসে।সবাই তোমাকে সুখী দেখতে চায়।

হিয়া তাকিয়ে রইল আদনানের দিকে। আদনানের চোখজোড়া খুব সুন্দর।এই চোখের দিকে তাকিয়ে বহু যুগকে মনে হতে পারে এক মুহুর্ত। খুব জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো,’আপনি ভালোবাসেন না আমাকে?আপুকে ভুলতে বলছি না ,আপু আপুর জায়গায় থাকবে ,আমাকে আমার জায়গায় রেখে ভালোবাসতে পারবেন?’বলতে পারলো না। মানুষ যা চিন্তা করে সব মুখে প্রকাশ করতে পারে না।

আদনান ভাবছিলো-‘ আরজুকে, হিয়া ভালোবাসাতো আমাকে বিয়ে করেছে পরিস্থিতিতে পরে,ও কি আমাকে মন থেকে ভালোবাসতে পারবে?আমাকে তো বলেছেই আহনাফের মা হয়েই শুধু থাকবে তাহলে কেন দূর্বল হয়ে পড়ছি।নিজেকে আরো সংযত রাখতে হবে।’
আহনাফ এসে আদনানের কোলে বসলো।হিয়া বলল-
—মাগরিবের নামাজ পড়তে হবে,উঠুন।
আহনাফ বলল-
—মামনি আমিও নামাজ পড়বো।
—অবশ্যই বাবাটা নামাজ পড়বে ,উঠ উঠ তারাতাড়ি।সবাই নামাজ পড়বো।

জীবনের অনেক কষ্ট চোখের পানি দিয়ে ধুয়ে যায় না। হৃদয়ের গভীরে কাঁটার মতো সবসময় বিঁধতে থাকে।আরজু আটকে গিয়েছে জীবনের চোরা বালিতে। কোথায় যাবে কোন গন্তব্য নেই,কোন ঠিকানা নেই।
এত কাছে থেকেও কেন তোমাকে হয়নি পাওয়া ….এমন কথার একটা গান বাজছে বাসে। খুব ভালো লাগছে শুনতে।এই বাস যেখানে গিয়ে থামবে সেখানেই নামবে আরজু।ঠিকানাহীন পথ চলা শুরু হলো।

চলবে…

ফাহমিদা লাইজু

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here