||কৈশোরে প্রেম|| ||অংশ: ১২||
কপালে কারো শীতল হাতের স্পর্শে চোখ মেলে তাকায় প্রহেলি। দিয়ানকে সামনে দেখে আবার চোখ বন্ধ করে নেয়। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে তার। সামনে একটা বাটিতে জল রাখা। নিজ হাতে জলপট্টি দিতে লাগে সে। চোখের জল উলটো হাতে মুছছে। নিজেকে আজ অনেক অসহায় লাগছে তার। প্রিয় মানুষটাকে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখার থেকে বড় কষ্ট বোধহয় আর কোনো কিছুতেই নেই। নিজেদের দশটা অসুস্থতা স্বাভাবিকভাবে নেওয়া যায় কিন্তু প্রিয় মানুষের একটা অসুস্থতাও কলিজায় আঘাত দেয়।
“এই ছেলে কেন আমার স্বপ্নে এসেছে! আমি তো স্বপ্নে এখন আমার সেই হাসিখুশি জীবনে ফিরে গিয়েছিলাম।”, বিড়বিড় করে বলল প্রহেলি।
তার ঠোঁটজোড়া কেবল নড়ছে। জ্বরের ঘোরে আবোলতাবোল বকছে। কথার খৈ হারিয়ে ফেলছে। সত্যিটাকেও সে স্বপ্ন ভেবে ধরে নিচ্ছে।
প্রহেলি পাঁচ মিনিটের মাথায় আবার চোখ পিটপিট করে তাকায়। দিয়ানকে আগের জায়গায় বসে থাকতে দেখে ক্ষুদ্র চোখে চেয়ে রয়।
অপ্রস্তুত গলায় বলল, “এই ছেলে তুমি এখানে কীভাবে আসলে?”
এবার প্রহেলি স্বাভাবিকভাবেই কথা বলছে। ব্যথায় উঠে বসতে কষ্ট হচ্ছে তার। দিয়ান আলতো করে ধরে তাকে বসতে সাহায্য করে। বালিশে হেলান দিয়ে বসে বলল, “তুমি এখানে কীভাবে এসেছ? প্রান্ত ভাইয়া দেখলে সমস্যা হবে। প্লিজ চলে যাও।”
“এভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকলে বুঝি আমি না এসে পারি?”
“এসব কথার মানে কী? আর তুমি বাচ্চাদের মতো কাঁদছো কেন? কী সমস্যা তোমার? রুমা…রুমা…”, কাজের মেয়েকে ডাকতে লাগে প্রহেলি।
দিয়ান তার মুখের উপর হাত চেপে ধরে। চোখ বড় বড় করে তাকায় সে। তৎক্ষনাৎ সে হাত সরিয়ে নিয়ে বলে, “স্যরি, স্যরি। আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি ভুল করে ফেলেছি। আর এমন হবে না।”
একটা মেয়ে যতই নির্বোধ হোক না কেন কোন ছেলে তাকে পছন্দ করে তা অন্য কেউ বোঝার আগে সে নিজেই বুঝতে পারে। প্রহেলির বেলায় দেরি হলেও সে এখন বুঝে যায়৷ আর বোঝার কিছু বাকি নেই।
মাথাটা ঈষৎ হেলিয়ে বলল, “দেখ দিয়ান তুমি ভুল পথে হাঁটছো। এসব উদ্ভট চিন্তা ভাবনা ছেড়ে দাও। অল্প বয়সে ভুল করেছি আমি। তুমি অন্তত করো না। তোমার এখনো অনেক সুন্দর ভবিষ্যৎ পড়ে আছে।”
“তোমাকে ভালোবাসা কী আমার শাস্তিযোগ্য কোনো অপরাধ?”
“মানে!”
“তাহলে কেন এত বছর ধরে শাস্তি দিয়ে যাচ্ছ? অনেক তো অপেক্ষা করালে।”
দিয়ানের চোখ লাল হয়ে আছে। চশমা খুলে সাইড টেবিলের উপর রেখে দেয়। প্রহেলির থেকে কিছুটা দূরে সরে বলল, “আমাকে তো তুমি কথা দিয়েছিলে রে, ভুলে গেলে কীভাবে সবকিছু?”
“কথা দিয়েছিলাম মানে?”, ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে।
দিয়ান ছলছল চোখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “আমাকে বিয়ে করবা না প্রহু আপু? এখন আর তোমাকে কীভাবে খাওয়াবো তার চিন্তা করতে হবে না। মাস শেষে মোটা অংকের টাকা পায় তোমার ক্ষুদে শিল্পী।”
“শিল্পী তুই!”
এবার কেঁদে দেয় দিয়ান। চোখের জল আর আটকে রাখতে পারে না। প্রহেলির মাথা ঝিম ধরে আছে। চোখ জ্বালা করছে। হাঁটুর উপর ভর দিয়ে দিয়ানের গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সে। এই সুযোগে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে সে। প্রহেলির কাঁধ ভিজিয়ে দিচ্ছে। সকল অনুভূতি যেন বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। এই দিয়ান যে দিব্য কখনো ভাবতেই পারেনি সে। সেই ছোট্ট দিব্য আজ কত বড় হয়ে গেছে! এ জন্যেই তো প্রহেলি তার সাথে এত মিল খুঁজে পাচ্ছিল! আজ সে জানতে পারে দিয়ানের পুরো নাম দিয়ান রহমান দিব্য।
“তুই তো অনেক বড় হয়ে গেছিস রে আমার ক্ষুদে শিল্পী! জানিস আমি তো তোর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম! তবে যখন তুই স্কুল ছেড়ে চলে গেলি অনেক খুঁজেছিলাম তোকে। কেন সেদিন ওভাবেই চলে গেলি?”, দিয়ানকে ছেড়ে একদম সম্মুখে বসে পড়ে।
কিছুক্ষণ আগেও যে মেয়ে গায়ের ব্যথায় নড়তে পারছিল না এখন সে সোজা হয়ে বসে আছে। হাত বাড়িয়ে দিয়ানের চোখের জল মুছে দেয়। সেদিন যখন দিয়ান পড়ালেখা তাড়াতাড়ি শেষ করে চাকরি ধরে প্রহেলিকে বিয়ে করার কথা তার বাবা সোহেল রহমানকে বলে তখন সবাই তার কথায় হাসলেও তার বাবা তাকে বুঝিয়েছিলেন। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে তবেই সে তার ভালোবাসাকে বিয়ে করতে পারবে৷ সোহেল রহমান তার বেকারত্বের কারণে নিজের প্রেমিকাকে চোখের সামনে দিয়ে অন্য ছেলের সাথে বিয়ে হতে দেখেছেন। কিন্তু ছেলের সেদিনের নিতান্তই পাগলামোর কথাকে গভীরভাবে নিয়ে নেন তিনি। যতটা না নিজের ভালোবাসাকে দিব্য আগলে রেখেছে তার থেকে বেশি যত্ন করেছেন তার বাবা সোহেল রহমান। দিব্যকে পড়ালেখার পাশাপাশি ক্রিকেট খেলার জন্য একটা স্বনামধন্য ক্রিকেট ক্লাবে ভর্তি করে দেন তার বাবা। ভালোবাসাকে বুকে লালন করতে হবে এই কথা শিখিয়ে হুট করেই তখন তাকে প্রহেলিকার চোখের আড়ালে নিয়ে গিয়েছিলেন। যখন সে নিজের পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে পেরেছে তখন তিনি তাকে অনুমতি দিয়েছেন ভালোবাসাকে সফল করে পেতে। এমন বাবা ভাগ্যক্রমেই পাওয়া যায়। দিয়ান তার বাবার কথামতো প্রহেলিকাকে নিজের করে পেতে আবারো তার দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছে।
দিব্যের মুখে সবকথা শুনে বাকহারা হয়ে পড়ে প্রহেলি। চোখের সামনে কাকে দেখছে সে! সে কী মানুষ নাকি ভালোবাসার কোনো প্রতিমা! যাকে মানুষ স্মরণ রাখবে যুগের পর যুগ। নিজের প্রতি লজ্জা হচ্ছে আজ প্রহেলির৷ চাইলেও আজ সে আগের মতো কোনো কিছু করে দিতে পারবে না৷
প্রহেলি তার একটা হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, “তুই তো একটা পাগল রে! এখনো সেই ছোটবেলার কথা মনে রেখে বসে আছিস! ওসব কী আর হয় বল!”
“কেন হয় না? কী জন্যে হয় না? তুমি না আমাকে কথা দিয়েছিলে? আমায় ছুঁয়ে কথা দিয়েছিলে।”
“তোর আর আমার মাঝে এসব কোনোদিন সম্ভব না। তখন তো মজার ছলে বলে দিয়েছিলাম।”
“মজার ছলে! সিরিয়াসলি! আমার ভালোবাসা তো মজার ছলে ছিল না। আমার চাওয়াটা তো মজার ছলে ছিল না। তোমাকে পাওয়ার জন্য নিজের সব সুখ বিসর্জন দিয়েছি আমি। একটা লক্ষ্য রেখে এগিয়ে গিয়েছি আর কোনো কিছু নিয়ে ভাবিনি। ভেবেছি কেবল একবার তোমাকে পেয়ে গেলে সব সুখ হয়ে যাবে। আর এখন সেই তুমি আমাকে বঞ্চিত করতে চাচ্ছ! আমার ভালোবাসাকে গুরুত্ব দিচ্ছ না!”
“আরে তুই আমার ছোট ভাইয়ের বয়সী রে পাগল। আমি সেদিন নিতান্তই মজা করে কথাগুলো বলেছিলাম। এর তুই এখনো সেসব ধরে বসে আছিস!”
“আচ্ছা! আমায় ছুঁয়ে বলা যে কথাগুলো তোমার কাছে মজা ছিল, সে কথাগুলো আমার কাছে দলিলে লিখিত সত্য ছিল। যা কেউ চাইলেও খণ্ডাতে পারবে না। আর বয়সটাই জরুরি হয়ে দাঁড়ালো তোমার কাছে? আমার ভালোবাসা কোনো ফ্যাক্ট না? আমার আরো দু’বছর আগে জন্ম হয়নি তাতে কি আমার দোষ? কই আমি তো ছোট ভাইদের মতো কথা বলছি না তাহলে তুমি কেন বড় বোনের মতো কথা বলছো?”
আশ্চর্য ধরে রাখতে পারছে না সে। এই ছেলে কীসব উলটা পালটা কথা বলছে! প্রহেলির ভাবনার বাইরে তার চিন্তাভাবনা! লোকে সাধারণত পান থেকে চুন খসলেই কথা শোনায় আর বয়সে ছোট-বড় বিয়ে শুনলে তো কথা তাদের মুখে তুলে দেওয়া হয়।
দিব্য শান্ত গলায় আবার বলল, “আমি ভালোবাসি তোমায়, পাগলের মতো ভালোবাসি। আমার ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। সত্য, সুন্দর স্বচ্ছ ভালোবাসা। তুমি আমাকে ভালোবাসতেই হবে। তোমাকে ভালোবাসিয়েই ছাড়ব আমি।”
নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে আছে প্রহেলি। যাকে সে গতকালও একজন পরিণত বয়সের পরিপক্ব মানুষ ভেবেছে আজ সে বাচ্চা ছেলেদের মতো জেদ ধরে বসে আছে। জ্বর ধরেছে তাকে আর ঘোর হয়েছে দিব্যের। প্রহেলি কিছু বলতে যাবে সেই মুহূর্তে আচমকা দিব্য তার কোলে মাথা রেখে শক্ত করে কোমর জড়িয়ে ধরে। নিঃশব্দে চোখের জল ফেলছে সে। কেন জানি বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠে প্রহেলির। এভাবে কোনো ছেলেকে সে কাঁদতে দেখেনি। ধীরেধীরে নিজের হাতটা নিয়ে তার মাথায় রাখে। মাথাভর্তি নরম চুলের ভেতর তার হাতটা হারিয়ে যায়৷ একটা মানুষ তাকে পাগলের মতো ভালোবেসে গেছে আর সে জানতেও পারেনি। কিন্তু সে তো তাকে ভালোবাসতে পারবে না। তার কলঙ্কিত জীবনের সাথে এই নিষ্পাপ মানুষটাকে জড়িয়ে তার জীবনকে নষ্ট করতে পারবে না। নিজের বলতে তো আর কিছুই নেই। ইজ্জতটাকেও হারিয়ে বসেছে। মানুষটাকে কিছুই দেওয়ার আর নেই তার কাছে। কাউকে সে ঠকাতে পারবে না। আজ জীবনের প্রথম নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে হচ্ছে তার। কেবল অপরাধী নয় ঘৃণ্যতম এক পাপী। যে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করার সুযোগ হয়তো সে পাবে না। শাস্তি ভোগ করে যেতে হবে আজীবন। ভালোবাসার মানুষগুলো থেকে দূরে চলে গেলেই ভালো হবে। অন্তত এই মানুষগুলো ভালো থাকবে। নিজের কথা তো অনেক ভাবলো এবার না হয় কাছের মানুষদের কথা একবার ভাবা যাক।
প্রহেলি দিব্যের থেকে সরে যায়। মাথা নিচু করে বলে, “আমি অশুদ্ধ হয়ে গেছি দিব্য৷ কলঙ্কিত এই দেহটাতে অবশিষ্ট কিছুই নেই যা তোকে দান করবো। এই আমি তোর মতো কারো জন্য না। আমি তো কাউকেই বিয়েই করতে পারব না। কেউ একজন আমার সাজানো গোছানো ফুলের বাগান নষ্ট করে দিয়ে গেছে। এই বাগানে আর কোনোদিন ফুল ফুটবে না। চলে যা তুই এখান থেকে, আর কোনোদিন আসিস না। ভালো থাকবি তুই।”
প্রহেলির মনের কথাগুলো জানা হয় না দিব্যের৷ আর প্রহেলি জানতে পারে না দিব্যের সিদ্ধান্ত। তার মাথায় হাত রেখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মৃদু হেসে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে দিব্য৷ সেই রহস্য ঘেরা হাসি। পূজা এসে বসেছে প্রহেলির পাশে। তার চোখে জল। সুখ জিনিসটা কেন চিরস্থায়ী হয় না! একটাই তো জীবন, এই জীবনে মানুষের সব চাওয়া পূরণ হয়ে গেলে খুব একটা মন্দ হয়ে যেত না। পূজা মন থেকে চাচ্ছে প্রহেলি তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করুক। কিন্তু সে জানে না শেষ পর্যন্ত কী সিদ্ধান্ত নেবে সে।
চলবে…
লিখা: বর্ণালি সোহানা
[বিঃদ্রঃ দিনগুলো খুব ব্যস্ততায় যাচ্ছে। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন এবং মন্তব্য করে জানিয়ে দিবেন। নিয়মিত গল্প দেওয়ার চেষ্টায় আছি। লাইক, কমেন্ট শেয়ার করে অথবা গল্পটার কথা আপনার আশেপাশের পাঠকদের মেনশন করে জানিয়ে দিন৷ আপনাদের একটা মন্তব্য লিখে যাওয়ার একটা শক্তি। অনেক ভালোবাসা রইল প্রিয় পাঠক।]