আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন পর্ব ৩

0
473

আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
৩য় পর্ব
.
ছাদের চারপাশে আকাশ ছোঁয়ার প্রতিযোগিতায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য সুপারি আর নারিকেল গাছ। জিসানের মনে হচ্ছে সে এখন দাঁড়িয়ে আছে জঙ্গলের মধ্যখানে। চিলেকোঠার পাশে ছোট্ট একটি পাকা ঘর। উপরে টিনের চাল। সৌর বিদ্যুতের বাতি আছে। ইলাশ পুর গ্রামটিতে এখনও কারেন্ট আসেনি। কেবল অতি ধনবান দু-চারটি বাড়িতে সৌর বিদ্যুত এসেছে।

– ‘মাস্টার সাব হাগা-মুতার লাগি ফুস্কোন্ডির পারও টয়লেট আছে।’

বক্কর আলীর পরিচয় ইতোমধ্যে জিসানের বোধগম্য হয়েছে।
সে ভুরু কুঁচকে বলল,

-‘ফুস্কোন্ডি মানে?’

– ‘ফুকুর মাস্টার সাব। ওউ ফুকুরো গোসলও খরবা আফনে।’

– ‘আচ্ছা ঠিকাছে। তোমাদের গ্রামের নামটা কি যেন?’

– ‘ইলাশপুর।’

– ‘তুমি কি শুদ্ধ করে কথা বলতে পার?

– ‘তোরা তোরা ফারি।’

– ‘তাহলে এই ‘তোরা তোরা’ শুদ্ধ করেই আমার সঙ্গে কথা বলবেন। ঠিকাছে বক্কর ভাই?’

– ‘আইচ্ছা এক্কন থাইক্কা সেষ্টা করিব।’
বক্কর আলীর শুদ্ধ কথার ধরন দেখে জিসানের হাসি পাচ্ছিল। তবুও মুখে সেটা প্রকাশ পেতে দিল না।

পরের এক সপ্তাহ নতুন জায়গায় বেশ ভালোভাবেই কেটে গেল। দশটা থেকে সাড়ে তিনটা অবধি মাদ্রাসায় থাকে। বিকেলে বক্কর আলীর সঙ্গে এলাকা ঘুরে দেখে।
সন্ধ্যায় পড়তে আসে সায়মা। মেয়েটিকে পড়াতে তার ভালোই লাগে। তবে এখানকার মানুষজনের কথাবার্তা বুঝতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে। গতকাল বক্কর আলীর মতো সায়মাকেও বলে দিয়েছে তার সঙ্গে শুদ্ধ করে কথা বলার চেষ্টা করতে। দিনরাত এখন সেই চেষ্টাই অব্যাহত রাখে সায়মা। বক্কর আলী পুরোপুরি আয়ত্ত্ব করতে না পারলেও সায়মা ভালোই আয়ত্ত্ব করেছে। বাড়ির সবার সঙ্গে এখন শুদ্ধ করে কথা বলে সে। সায়মার মেজাজও আজকাল বেশ ফুরফুরে থাকে।
তবে সামান্য খারাপ হয় সন্ধ্যা বেলায়। এক ঘন্টা আগে থেকেই অন্তরার জীবন অতিষ্ঠ করে ছাড়ে সে। নানান ড্রেস পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অতি জরুরী ভঙ্গিতে ডাকবে,
– ‘অন্তরা আফা এদিকে আসো ত এখটু।’

অন্তরা রান্নাঘরে রাজ্যের কাজে ব্যস্ত থাকে। তবুও কাজ ফেলে সামনে এসে দাঁড়ায়।
– ‘আপা দেখতো কেমন লাগছে আমায়।’

অন্তরা খানিক তাকিয়ে বলে,
-‘ভালা অউ লাগের।’

– ‘সত্য বলিছো? না আরখটা ড্রেস ফিন্তাম।’

– ‘ফিন্দো।’ (কাপড় পরা)

সায়মা আবার আরেকটা ড্রেস পরে। এটাও ভালো লাগে না তার। ঠোঁটে আরেকটু লিপস্টিক দেয়। আচঁড়ানো চুল আরেকটু আচঁড়ে নেয়। আয়নার সামনে বসে ভাবে কালই বাবাকে বলবে সিলেট খালার বাসায় নিয়ে যেতে৷ তারপর নিপা আপুকে নিয়ে পুরো শহর ঘুরে শপিং করে আসবে৷

জিসানের সঙ্গে ইমরাজ সাহেবেরও বেশ ভালো সম্পর্ক হয়েছে। তিনি প্রতিদিন এশার বাদে জিসানের রুমে গিয়ে গল্পগুজব করেন। নানান বিষয়ে গল্প হয়। ভূতের গল্প থেকে শুরু করে রাজনৈতিক। মাস্টারকে ইমরাজ সাহেবের ভীষণ পছন্দ হয়েছে৷

বক্কর আলী দুপুরে জিসানের রুমে গিয়ে প্রথমে হাত-পা ছড়িয়ে আরাম করে খানিক্ষণ শুয়ে রইল। এখানে শুতে তার বেশ আরামই লাগে। সায়মা বাবাকে বলে স্যারের জন্য জাজিম এবং নতুন বিছানা চাদরের ব্যবস্থা করিয়েছে।
বক্কার আলী জাজিম বিছানায় আরাম পর্ব চুকিয়ে উঠে দাঁড়াল। টেবিল থেকে হাত বাড়িয়ে পারফিউম নিয়ে কায়দা করে বগলে দিল। তারপর সতর্কভাবে চারদিকে উঁকি দিয়ে তাকায়৷ পারফিউমটি আলগোছে ঢুকিয়ে নেয় নিজের পাঞ্জাবীর পকেটে। বিছানার নিচ এবং সমস্ত প্যান্টের পকেট খুঁজে দু’টা একশো টাকার নোট পাওয়া গেছে। একটা নোট যথাস্থানে রেখে একটি চকচকে একশো টাকার নোট নিজের পকেটে পুরে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে।
সামান্য হেঁটে মজনু মিয়ার টং দোকানে যায়।

-‘এখটা চা দেউ।’
(সবার সঙ্গে শুদ্ধ করে কথা বলার চেষ্টা চলছে।)

মজনু মিয়ার এখানে আয়েশ করে চা খেয়ে একটা পান আর সিগারেট নিয়ে পনেরো টাকা দিয়ে হাঁটা ধরে। আকাশে ঝকঝকে রোদ। তার গায়ে ছাই রঙা পাঞ্জাবী সাদা পায়জামা আর মাথার মাঝখানে টুপি। আয়েশ করে পান চিবুচ্ছে আর সিগারেট টেনে টেনে হাঁটছে। নিজেকে কেমন এ দেশের বাদশা বাদশা লাগছে বক্কর আলীর। সামনের আহমদ পুর বাজার থেকে দশ টাকায় দশটা বরই আচার আর একটা মজা বিস্কুট নিল। হাঁটতে হাঁটতে এলো লঞ্চঘাট। তারপর নদীর পাড় দিয়ে ঘন্টা খানেক হেঁটে একটা বাড়ির সামনে গিয়ে চারদিকে সতর্ক চোখে তাকায়। বাড়ির উঠোনে উঁকি দিয়ে প্রথমে দেখে নিচু স্বরে ডাকল,
–‘জমিলা আছোনি বাড়িত?’

জমিলা দরজা খুলে বক্কর আলীকে দেখে বলল,
–‘বক্কর ভাইনি। আও ভিতরে আও।’

–‘তোমার আম্মা কুয়াই?’

– ‘আম্মা গেছইন গরু ডুলানিত মাঠও।’

– ‘ও আচ্ছা ভালা।’

– ‘তুমি ইলাখান মাতো কিতা বক্কর ভাই। ডাখ হুইন্না আমি চিনছি না। ( তুমি এরকম কথা বলছো কেন বক্কর ভাই। প্রথম দরজায় ডাক শুনেও বুঝিনি কে আসছে)

–‘শুদ্ধ খইরা কথা বলিবার সিকরাম জমিলা। খারণ আছে। সুসংবাদ দেওয়ার লাগি অউ আইলাম। আমি তো ব্যাংকও ম্যানেজারির চাকুরী ফাইলাইছি শহরও। এরলাগি শুদ্ধ কথা সিকরাম।’

-‘হাচা? কিলা ফাইলায়? সিক্কিত লোক ছাড়া ব্যাংকও চাকরি ফাওয়া যায়নি?’

– ‘কিতা খইলায় জমিলা। আমি সিক্কিত নায়নি? আমি ডিগ্রি পাস। আমার সালটিফেক্ট হারিয়ে ফেলেছিলাম খরি এতদিন চাকরি ফাইনি।’

– ‘হাচা খইরায়নি?’

বক্কর আলী এবার একটু রোমান্টিক হয়ে জমিলার হাত ধরে খানিকটা কাছে গেল। তারপর আধো শুদ্ধ বাংলায় আবার বলল,
–‘জমিলা তোমার খতা সব সময় আমার বড় বেশি মনে ফড়ে। ফ্রতিদিন সফনে তোমারে দেখি। ব্যাংকও চাকরিত গেলেগি তোমার লগে খতদিন দেখা অইত নায়। একমাস চাকরির ফরে আমারে সরকারি বাসা দিলাইব আমি তোমারে তকন কিন্তুক বিয়া খইরা শহরো নিমুগি।’

জমিলা লজ্জায় মাথা নীচু করে বলল, –‘জানরাম মিচা খতা খইরায়। শহরো গেলেগি বুলিযাইবায় আমারে।’

বক্কর আলী এবার সুযোগ পেয়ে জমিলাকে বুকের সঙ্গে শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
–‘খখনো না জমিলা। আমি খখনো তোমারে বুলতাম নায়। আর শোন। আজকে রাইত আমি তোমার লগে থাখমু। খাইল ওউ শহরে চলে যাব। আর যকন আসব এখেবারে বিয়া খইরা তোমারে লইয়া শহরও যাইমুগি।’

কথাটি শেষে রহস্য করে পাঞ্জাবীর পকেটে হাত ঢুকিয়ে বলল,
–‘আমার ফগেটে কিতা আছে বল তো জমিলা।’

– ‘কিতা ফগেটো দেকি?’

– ‘ফগেটো গরান আছে জমিলা, গরান। তোমার লাগি শহর থাকি গরান আইনচি।’

কথাটি বলে জমিলার গায়ে পারফিউম দিয়ে বলল,
–‘দেখছোনি কিজাত গরান জমিলা। অউ নেউ বিস্কুট আর বরই আচারও তোমার লাগি আইনচি।’

জমিলা খুশিতে আত্মহারা। আজ বক্কর আলীকে থাকতে দেবে সে। মানুষটাকে তার খারাপ লাগে না। বক্কর আলী তাকে বড়ই ভালোবাসে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে জমিলার চোখ পানিতে ভরে এলো।
–চলবে–
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here