আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন পর্ব ৫

0
360

আরাধনায় বিহঙ্গ জীবন
.
৫ম পর্ব
.
রোজকার মতো আজও পড়তে এসেছে সায়মা। আসার আগে নিজের সমস্ত সৌন্দর্য ফুটিয়ে তোলার সর্বোচ্চ চেষ্টাও করা হয়েছে।
পড়ানোর একপর্যায়ে জিসানের মনে পড়ে গেল ভোরের কোরআন তেলাওয়াতের কথা।
– ‘সায়মা তোমাদের বাসায় তো আর কোনো মেয়ে নাই। সকালে কার কোরআন তেলাওয়াত শুনলাম?’

– ‘আছে তো, অন্তরা।’

– ‘তাই না-কি। আগে কখনও দেখিনি তো। কে সে?’

– ‘আমাদের বাসার কাজের মেয়ে।’

– ‘বাহ, মেয়েটি খুব সুন্দর তেলাওয়াত করে।’
সায়মার মন মুহূর্তেই খারাপ হয়ে গেল। ছোটবেলা থেকে বাসায় যেইই এসেছে শুধু অন্তরার প্রশংসা।
ভাবনায় ছেদ করে জিসান বলল,
– ‘বাই দ্যা ওয়ে। তুমি এখন পুরোপুরি শুদ্ধ করে কথা বলতে পারছো দেখছি।’

এতটুকু প্রশংসাতে সায়মা লজ্জায় মাথা নীচু করে ফেলল। মন খারাপ ভাবটাও পুরোপুরি কেটে গেল।
জিসান খানিক ভেবে আবার বলল,
– ‘আচ্ছা একটা ব্যাপার বল তো। আমি জানি তোমার মা অসুস্থ৷ এর আগে কাজের মেয়ে আছে বলেও জানতাম না। ভেবেছিলাম এতো সুস্বাদু রান্নাটা তুমিই করো। তবুও তোমাকে যতটুকু জেনেছি বিশ্বাস হতো না তুমি এতো ভালো রান্না করতে পারবে। এখন বুঝলাম অই কাজের মেয়েটিই রাধুনি। তাকে দেখি না কেন? কোরআন তেলাওয়াত আর রান্না সব মিলিয়ে একদিন দেখতে ইচ্ছে করছে৷’

সায়মার ভীষণ অস্বস্তি লাগছে। অই কুলক্ষী অপেয়া মেয়েটি তাদের মাঝখানে ঢুকে যাচ্ছে না তো? তবুও সে ভদ্রতার জন্য বলল,
-‘আচ্ছা একদিন দেখা করিয়ে দেব।’

– ‘ঠিকাছে। এখন আমরা পড়ায় আসি। শোন আমাদের দেশের শিক্ষকরা কিন্তু পরীক্ষার পেপার দেখায় মোটেও সৎ না। তাই একটা স্টুডেন্টের হাতের লেখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইংলিশ যেমনই হোক৷ বাংলা লেখা কিন্তু মাস্ট সুন্দর এবং গতিময় হতে হবে৷ পরীক্ষায় যা পারো তা আগে লিখে সময় থাকলে সব আনসার করে আসতেই হবে। কারণ আগেই বলেছি পেপার দেখায় সৎ না। হাবিজাবি খাতায় সুন্দর করে লিখে আসলেই মার্ক…।’

সায়মা মনযোগ দিতে পারছে না৷ স্যারের চুলের দিকে তাকিয়ে আছে। কালো সিল্কি চুল। ইচ্ছা করছে ছুঁয়ে দিতে। কেমন ঘোর লাগানো ঘ্রাণও আসছে। স্যারের সবকিছু এমন কেন? কেমন যেন অন্যরকম। কথাও বলেন অনেক সুন্দর৷
এই মানুষটির জন্য সে সব করতে পারে। আচ্ছা সে কি রান্না করা শিখবে? অন্তরার মতন রাঁধবে। স্যার তখন তারও প্রশংসা করবেন। সে কি কোরআন তেলাওয়াতও শিখে নেবে? অবিকল অন্তরার মতন।
– ‘সায়মা অন্যমনস্ক কেন? মনযোগ দিয়ে শোন।’
—-
রাত এগারোটায় বক্কর আলী জানালায় নক দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-‘জমিলা হজাগ আছোনি?’

জমিলা প্রথমে শুনলো না। কয়েকবার নক দেবার পর জমিলা জানালার খিল খুলে বিস্মিত হয়ে বলল
– ‘বক্কর ভাই তুমি অতো রাইত!’

–‘তাড়াতাড়ি আগে দরজাটা খোলে দেও জমিলা সব বলিব।’

জমিলা চুপিচুপি দরজা খুলে দিল। বক্কর আলী ঘরে ঢুকেই বলল,
– ‘শহর থাকি আইলাম জমিলা। ব্যাংকের চাকরি খইরা লাভ নাই। যে বেতালা মেয়ে মানুষ। শহরের মেয়েরা তোমার মতো ভালা নায় জমিলা।’

– ‘কিতা খও ফুরিন্তে কিতা খরছে।’

– ‘শহরে মাইয়ালোক ল্যাংটা থাখে জমিলা।’

– ‘ধুর মিচা খতা খও।’

– ‘মিচা খতা নায় জমিলা। ফরমান দেখতায়নি? দেখতে চাইলে বও দেখাই।’

বক্কর আলী বুদ্ধি করে হারিকেনের আলো কমিয়ে মেঘাচ্ছন্ন করে দেয়। জমিলাকে টেনে আনে কোলে। পাঞ্জাবীর পকেট থেকে অনেকগুলো উলঙ্গ ছেলে-মেয়েদের ছবি বের করে। প্রাপ্ত বয়স্ক ম্যাগাজিনের অধিক উষ্ণ ছবিগুলো সে ব্লেড দিয়ে কেটে কেটে সংগ্রহ করে এনেছে।
জমিলা ছবি দেখে বিস্মিত হয়ে বলল,
–‘ইয়াল্লা ইতা কিতা। ইতার হায়া শরম নাইনি।’

বক্কর আলী সুর মিলিয়ে বলল,
–‘ইতা মেয়েরার এখেবারে লজ্জা-শরম নাই জমিলা। ওউ যে দেখরায় এক মাইয়া ওগুই তো আমার লগে ব্যাংকও চাকরি খরতো। আমারেনো এখদিন খয় আইলাবু বক্কর।’
কথাটি বলে খিকখিক করে হাসে বক্কর। জমিলা আরও অবাক হয়ে বলে,
– ‘ইয়াল্লা হাচানি?’

– ‘অয় জমিলা আল্ল পাকের কসম। খালি আইলাবু নায়। আরো কিতা খরতো চাইছে দেখাইতামনি?’

– ‘কিতা?’
চতুর বক্কর আলী এবার হারিকেন নিভিয়ে প্র‍্যাক্টিকালি দেখানোর প্রস্তুতি নেয়।
—-

ইমরাজ উল্লাহ মেয়ের কোনো আবদার ফেলতে পারেন না। তাই হাজার রকম ব্যস্ততাকে উপেক্ষা করে সায়মাকে নিয়ে গিয়েছিলেন ওর খালার বাসায়৷ খালাতো বোন নিপাকে নিয়ে সায়মা অনেক কেনাকাটা করেছে। পোশাক, কসমেটিক মেয়েদের নানান প্রসাধনী ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেছে। গতবার বেড়াতে গিয়ে বাবাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে বেশ কিছুদিন থেকেছিল৷ এবার কি এক টানে পরেরদিনই বাবাকে নিয়ে ফিরে এসেছে।
মেয়ের এসব অস্থিরতার কারণ চেয়ারম্যান প্রথম থেকেই বুঝতে পারছেন। মৌন সম্মতিও দিয়ে যাচ্ছেন। মাস্টারকে তাঁর বেশ পছন্দ হয়েছে।

সায়মা স্কুল থেকে ফিরেই সবকিছু বিছানায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে হুলস্থুল কান্ড।
রাজ্যের কাজকর্ম ফেলে অন্তরারও সঙ্গ দিতে হচ্ছে।
– ‘আপু সত্য করে বল তো কোন ড্রেস পরব?’

– ‘শাড়ী ফিন্দো। ওউ যে খচুপাতার লাখান রং।’

– ‘আপু শুদ্ধ করে কথা বলা শিখ তো। খুব সহজ। খালি শরম না পেয়ে একটু চেষ্টা করলেই পারবে। ‘

– ‘আচ্ছা।’

– ‘কচুপাতা রঙের শাড়ী নিপা আপু পছন্দ করে দিছে। আমার পছন্দ হয়নি। তাছাড়া এই শাড়ী পরে স্যারের সামনে যেতে লজ্জা লাগবে।’

– ‘খেনে শরম লাগতো৷ সুন্দর আছে শাড়ি। ফিন্দিলাউ।’

– ‘আপু আবার অশুদ্ধ করে কথা বলছো।’

– ‘আচ্ছা একন থেকে শুদ্ধ মাতমু।’

– ‘আচ্ছা তুমি সাজিয়ে পরিয়ে দাও। কোনোদিন শাড়ি পরিনি। কেমন লাগবে জানি না।’

অন্তরার কচুপাতা রঙের শাড়িটি ভীষণ পছন্দ হয়েছে। এই কারণে কি-না কে জানে। সে খুব আয়েশ করে সায়মাকে শাড়ি পরাল। অসম্ভব সুন্দর করে সাজিয়ে দিল। এক অভিনব কায়দায় চুলও আঁচড়ে দিল। অন্তরার ভেতরে যেন চুপটি করে এক শিল্পীর বসবাস। সেই শিল্পীর রংতুলিতে সায়মার ভেতরে থাকা নারী সৌন্দর্যের সবটুকু আজ প্রকাশ পেয়েছে। অন্তরা খুব যত্ন করে ভুরু পর্যন্ত আঙুল দিয়ে ঠিক করে দেয়। বিছানা থেকে সবকিছু নিজেই প্রয়োজন মাফিক ব্যবহার করে। সায়মার কিছুই বলে দিতে হল না। সব শেষে যখন সায়মা নিজেকে আয়নার সামনে দেখল নিজেকে ভিন্ন এক নারী মনে হল। এতো সৌন্দর্য বুঝি নিজের মধ্যে লুকিয়ে আছে?
বই হাতে বিব্রত ভঙ্গিতে জিসানের রুমের দরজাটি খুলে সালাম দিল সায়মা।

জিসান চমকে উঠলো শোয়া থেকে। অচেনা যেন লাগছে সায়মাকে।
– ‘ওয়াও প্রেমে পড়ে গেলাম, চেনাই যাচ্ছে না তোমাকে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে।

উত্তুরের একফালি শীতল হাওয়া যেন ছুঁয়ে দিল সায়মার শরীর, মন। সঙ্গে সঙ্গে হৃদয়টা কিসের ছোঁয়ায় যেন পবিত্র হয়ে গেল। জিসানের সামান্য প্রশংসার স্পর্শে মনের সকল হিংসা-বিদ্ধেষ ভেসে গেল শহরের নর্দমায়৷ এখন এই মন দিয়ে কেবল মানুষকে ভালোবাসা যায়।

– ‘কিন্তু এভাবে সাজাল কে? তোমাদের এখানে তো পার্লার আছে বলেও মনে হয় না।’

– ‘অন্তরা আপু সাজিয়েছে।’

– ‘বাবা। অনেক যত্ন করে সাজিয়েছে। মেয়েটির হাতে জাদু আছে বলতে হয়। রান্নার স্বাদ জিভে থেকে যায়। অইদিনের কোরআন তেলাওয়াতও কানে লেগে আছে। এখন তোমার চেহারাও চোখে ভেসে না থাকলেই হলো৷ হা হা হা।’

মুচকি হাসল সায়মাও৷ এবার একটুও হিংসা হল না। উল্টো অন্তরার জন্য ভালোবাসায় মনটা যেন কানায় কানায় ভরে গেল। নিচে গেলেই অন্তরাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে সে।
– ‘গুণবতী কাজের মেয়েটিকে দেখাবে বলছিলে।’

– ‘আচ্ছা এখনই নিয়ে আসছি।’

সায়মা যেন আজ নিষ্পাপ এক শিশু।
তার মনে হল একমাত্র অন্তরার জন্যই ইতোমধ্যে জিসানকে নিজের করে পেয়ে গেছে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে অন্তরাকে আনতে সিঁড়ির দিকে পা বাড়াল।
–চলবে–
লেখা: জবরুল ইসলাম

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here