প্রণয়ের_দহন
পর্ব_১৮
#তাসনিম_জাহান_রিয়া
কী রে কী ব্যাপার? এমনে তো কেউ জুর কে ঘাড় ধরেও তোকে শাড়ী পড়াতে পারে না। আর আজকে নিজে থেকেই পড়লি। কারো প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছো?
কী যে বলো না ভাবি? ( খানিক লজ্জা পেয়ে)
ননদিনি দেখা যায় লজ্জা পাচ্ছে। কী ব্যাপার? সে কে যে আমার ছোট্ট আনহার মনটা কেঁড়ে নিয়েছে? সেই সৌভাগ্যবান পুরুষটা কে শুনি? যে আনহা বাবুর মতো একটা মিষ্টি মেয়েকে প্রেমিকা হিসেবে পেয়েছে? বল?
উফ ভাবি তুমি কী শুরু করলে?
আনহাকে জ্বালাতে জ্বালাতে বাসায় চলে এলাম। গাড়ি থেকে আমরা তিন জন নামলাম। কলিংবেল বাঁজানোর আগেই দরজা খুলে দিলো আম্মু। যেনো আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। আরিয়ান আমার হাত ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আম্মু আমাদের হাতের দিকে তাকিয়ে আলতো হাসলো। আমি আরিয়ানের কাছ থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে আম্মুকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরলাম। আমার চোখ ছলছল করছে। আমি কাঁদো কাঁদো গলায় আম্মুকে জিঙ্গেস করলাম,
কেমন আছো আম্মু? তোমরা আমাকে কীভাবে ভুলে যেতে পারলে? হুম?একটা বারও কী তোমাদের আমার কথা মনে পড়েনি? আমি তোমাদের এতোটা পর হয়ে গেলাম? বিয়ে হয়ে গেলে যে মেয়েরা বাবা মায়ের কাছে পর হয়ে যায় সেটা তোমরা প্রমাণ করে দিলে। ভাইয়া বিয়ের পর আমার সাথে একটু দেখা করে নিজের ফরজ কাজ আদায় করে ফেলছে। আব্বু, ভাইয়া, তুমি কেউই ফোন করে আমার একটু খোঁজ নেওনি। আমি বেঁচে আছি নাকি মরে গেছি সেটাও জানতে চাওনি। আমি ফোন দিলেও তোমরা ধরনি।
আমরা ভালো আছি। আগে ভিতরে আয় পড়ে সব কথা হবে।
আগে আমার প্রশ্নের উত্তরগুলো দাও।
আম্মু আমতা আমতা করে কিছু বলতে গিয়েও আরিয়ানের দিতে তাকিয়ে থেমে যায়। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে আরিয়ানের দিকে তাকাই। কিন্তু আরিয়ান বেশ সাবলীল ভঙ্গিতেই দাঁড়িয়ে আছে। আরিয়ান আম্মুকে উদ্দেশ্য করে বলে,
আন্টি কেমন আছো তুমি?
ভালো বাবা। তুই কেমন আছিস?
তোমার মেয়ে যেমন রেখেছে।
উনার কথা শুনেই আমি তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠলাম,
আমি যেমন রেখেছি মানে কী? আমি তোমাকে খারাপ রেখেছি? নাকি তোমাকে ভাত দেই না?
আজব আমি আবার এসব কখন বললাম। আমি তো শুধু বলেছি, তোমার মেয়ে যেমন রেখেছে। এর সাথে খারাপ রাখার সম্পর্ক কী? সব সময় নেগেটিভ ভাবো কেনো? একটু পজেটিভ ভাবার চেষ্টা করো।
তোমার পজেটিভ নিয়ে তুমি বসে থাক। আমার ভাবার দরকার নেই।
তোরা থাম এবার। তোরা দুইজন একাই এসেছিস? আনহার না আসার কথা ছিল। আনহা আসেনি?
এইযে আন্টি আমি এখানে। এই দুই জামাই বউয়ের জন্য তো আমাকে দেখাই যাচ্ছে না। দুই ঝগড়ুটে।
ওমা শাড়ি পড়ছিস দেখা যায়। এদিকে আয়। মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর লাগছে। চোখের পলকেই মেয়েটা কতো বড় হয়ে গেছে। দুই দিন পর বিয়ে হবে শ্বশুরবাড়ি চলে যাবে।
উফ আন্টি সব কথা কী বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখেই বলবে? ভিতরে ঢুকতে দিবে না নাকি?
আমি ভুলেই গেছিলাম। আয় ভিতরে আয়।
আম্মু আব্বু আর ভাইয়া কই?
রুমে আছে। তোর ভাই আর তোর আব্বু জানে না যে তোরা আজকে আসবি। তোদের দেখে সারপ্রাইজড হয়ে যাবে এখন। তাই আগে বলিনি।
আমি দেখা করে আসি।
পরে দেখা করতে যাস আগে রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। কতটা জার্নি করে আসলি। আরিয়ান যাও রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি খাবার নিয়ে আসছি।
আরিয়ান মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানিয়ে আমার রুমের দিকে পা বাড়ায়। আরিয়ান বহুবার আমাদের বাসায় আসছে ইনফ্যাক্ট আমার রুমে গেছে। তাই আরিয়ানকে নতুন করে কিছু চিনিয়ে দেওয়ার নাই। আমিও আরিয়ানের পিছু পিছু রুমে চলে আসলাম। আগে আরিয়ান ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। আরিয়ান ফ্রেশ হয়ে বের হতেই আমি ঢুকে পড়লাম।
আমি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ বের হয়ে আরিয়ানকে রুমে পেলাম না। হয়তো বেলকনিতে আছে। আমাদের বাসায় আরিয়ানের সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হচ্ছে আমার বেলকনি। ভাইয়ার সাথে আড্ডা দিলেও আমার বেলকনিতে বসে। আরিয়ান আগে আমাদের বাসায় যতটুকু সময় থাকতো বেশির ভাগ সময় আমার রুমের বেলকনিতে কাটাত।
আমি রুম থেকে বের হয়ে এলাম। আব্বু আম্মুর রুমের দিকে পা বাড়ালাম। উদ্দেশ্য আব্বুর সাথে দেখা করা, কথা বলে সবকিছু মিটিয়ে নেওয়া। আব্বুর রুমে গিয়ে দেখি আব্বু বেডের সাথে হেলান দিয়ে বই পড়ছে। সম্ভবত কাজি নজরুল ইসলামের উপন্যাস। আব্বু বই প্রেমী। সুযোগ পেলেই বই পড়া শুরু করে দেয়। আজকে হয়তো আব্বু অফিসে যায়নি। মনে হয় আম্মু যেতে দেয়নি।
আব্বু এখনো আমাকে দেখেনি। আব্বু একবার বই পড়া শুরু করলে বইয়ের মাঝেই ডুবে যায়। তখন আব্বুর দুনিয়ার কোনো খেয়ালই থাকে না। আমি আব্বুর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমি আব্বুর হাত থেকে বইটা নিয়ে নিলাম। আব্বু প্রথমে হকচকিয়ে গেলোও পরে আমাকে দেখে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
আব্বু চোখ থেকে চশমাটা খুলে পরিষ্কার করে নিয়ে চশমাটা চোখে পড়ে নিল আবার আমার দিকে তাকাল। মনে হয় আব্বুর বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমি এসেছি। আমি আব্বুর দিকে তাকিয়ে আছি। চোখে পানি টলমল করছে। কত দিন পর আব্বুকে এতোটা কাছ থেকে দেখছি। আব্বু আগের থেকে অনেকটা শুকিয়ে গেছে।
কেমন আছো আব্বু?
আমি ভালো আছি মা তুই কেমন আছিস?
তোমাদের ছাড়া কী করে ভালো থাকি? তোমরা তো আমার একটা খবর নাওনি।
আমার মামুনিটা বুঝি আমার ওপর রাগ করেছে? তা মামুনির রাগ কীভাবে ভাঙানো যায়? চকলেট খাইয়ে নাকি আইসক্রিম খাইয়ে? হুম?
আমি আব্বুর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে ডুকরে কেঁদে ওঠলাম। এতোদিন যেনো কান্নাগুলো গলায় দলা পাকিয়ে ছিল। আজকে সব কান্না বেরিয়ে আসছে। আব্বুর সাথে আরো কিছুটা সময় কাটালাম। কিন্তু আব্বু একবারের জন্যও নিহানের বিষয় বা ঐ দিনের বিষয়ে কোনো কথা তুলেনি। আমি এক স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম। এতোদিন একটা দম বন্ধকর পরিস্থিতিতে ছিলাম। মনে হয়েছিল আব্বু হয়তো আমার ওপর অনেক রেগে আছে। কিন্তু তেমন কিছু না।
আব্বুর সাথে কথা বলে রুমের দিকে আসতে লাগলাম। ভাইয়ার রুমের দরজা বন্ধ তাই ডাক দিলাম না। কারণ ভাইয়া বাসায় থাকলে এই সময়টাতে ঘুমায়। আনহার রুমের সামনে দিয়ে আসার সময় দেখলাম আনহা ফোন স্ক্রল করছে। রুমে ঢুকার সাথে সাথেই আরিয়ান রুমের দরজা লক করে দিয়ে ধাক্কা দিয়ে আমাকে বেডে ফেলে দেয়। আমার ওপর ওঠে আমার হাত দুটো বেডের সাথে চেপে ধরে। তারপর মিহি কন্ঠে বলে,
সারাদিন বাবার সাথে থাকলেই হবে? তোমার যে একটা হ্যান্ডসাম বর আছে। তাকে কে সময় দিবে? হুম?
আমি সত্যিই বুঝতে পারি না যে তোমার কয় রূপ? এই ভালো তো এই খারাপ। এই রোমান্টিক এই ডেবিল।
আমাকে বুঝা তোমার মতো পিচ্চি মেয়ের কাজ না। একদিন বলেছিলাম না তোমার লাইফে হিরোও আমি ভিলেনও আমি। আমাকে বুঝতে হলে তোমাকে আরো ১০ বার জন্ম নিতে হবে।
আমি তোমাকে বুঝতে পারি না?
একদমি না। আমি তোমাকে যতটুকু বুঝাতে চাই তুমি আমাকে ততটুকুই বুঝতে পার এর বেশি না।
তুমি বললেই হলো না। আমি তোমাকে বুঝতে পারি। তোমার সম্পর্কে সব জানি।
আমার কথা শুনেই আরিয়ান অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। হাসতে হাসতে আমার হাত দুটো ছেড়ে দেয়। আমার ওপর থেকে সরে গিয়ে আমার পাশে শুয়ে পড়ে। হাসতে হাসতেই বলে,
তুমি সত্যিই বোকা। তুমি আমার সম্পর্কে ততটুকু জানতে পার যতটুকু আমি জানাতে চাই। এর বাইরে তুমি আমার সম্পর্কে কিছুই জানো না।
আমি তোমার সম্পর্কে কী জানিনা সেটা বলেন?
তুমি আমার সম্পর্কে কী জানো সেটা বল।
বললামই তো আমি তোমার সম্পর্কে সব জানি।
ওহ রিয়েলি। তুমি কী এটা জানো আমি ৭ মাস মেন্টাল হসপিটালে ছিলাম?
হুট করে আরিয়ানের এমন কথায় আমি থমকে যায়। আরিয়ান কী বললো এটা? আরিয়ান ৭ মাস মেন্টাল হসপিটালে ছিল? সেটা কীভাবে সম্ভব? যদি থাকত তাহলে আমি জানতে পারতাম না। সব আমার মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। আরিয়ান কী আমার সাথে মজা করছে? কিন্তু উনার মুখ দেখে তো তা মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে উনি সিরিয়াসলি বলছেন।
চলবে…….