মাস্টারমশাই পর্ব ২৩

0
386

মাস্টারমশাই
পর্ব ২৩
___________________
(এই পর্বটি অনেক জটিল। গল্পের মূল অংশ এই অংশে লুকিয়ে রয়েছে। সবাইকে ধৈর্য সহকারে এবং বুঝে বুঝে পড়ার অনুরোধ রইল। তারপরেও যদি কেউ বুঝতে না পারেন কমেন্ট করে জানাবেন অবশ্যই বোঝানোর চেষ্টা করব।)

শহরের বেশিরভাগ মানুষের ঘুম ভাঙ্গে এলামের শব্দে। কিন্তু গ্রামে সম্পূর্ণ ভিন্ন। মানুষের ঘুম ভাঙ্গে মোরগের ডাকে। জর্জরিত শীতে মোরগরা হয় না ক্লান্ত। ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তারা ডাক দিতে শুরু করে। রাতে কাবেরী কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল মনে নেই‌। তবে এটুকু মনে করতে পারছে, ‘মাস্টারমশাই’ উপন্যাসটি শেষ করে ঘুমিয়ে ছিল।সে পুরোপুরি গল্পের মধ্যে ঢুকে গেছিল।কখন তার ক্লান্ত চোখ বন্ধ হয়ে গেছে জানে না। মোরগের ডাকে তার ঘুম ভাঙ্গে। আলসেমি ভাবে লম্বা একটা হাই তুলল। মনে পড়ল মাস্টারমশাইয়ের কথা। গল্পটা কেমন যেন অদ্ভুত! কত জনপ্রিয় উপন্যাস সে হাতে পেয়েও পড়েনি। কেন সে এই উপন্যাসটি পড়ল? উপন্যাসটি না পড়লে ভালোই হতো। এই উপন্যাসটি তার আবার কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে কিশলয়ের প্রশংসা করতে হবে। তার শব্দ চয়ন, লেখার ধৈর্যতা, লেখার মাধুর্যতা, নতুন নতুন বাক্য তৈরি, নতুন নতুন ডায়লগ, গল্পে প্রচুর উপমা ব্যবহার তাকে অনন্য করেছে। তাকে সম্পূর্ণভাবে লেখক নির্বাচিত করেছে।সে সত্যি ‘সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার’ পাওয়ার যোগ্য।গুগল সার্চ করলে হয়তো দেখা যাবে এত অল্প বয়সে কেউ ‘সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার’ পায়নি। সেখানে কিশলয় পেতে চলেছে। এটা একটা বিস্ময়কর ঘটনা। ময়ূরগঞ্জের গর্বের বিষয়। কিন্তু গল্পের কাহিনী….। গল্পের কাহিনীও পুরোপুরি নতুন। বাংলা পাঠকেরা একটা নতুন গল্পের স্বাদ পেয়েছে। বাংলা সাহিত্যে আজ পর্যন্ত কি কোনো স্কুল টিচারকে নিয়ে দীর্ঘ উপন্যাস লেখা হয়েছে? অবশ্যই লেখা হয়েছে। কিন্তু খুব কম। আবার সেই সমস্ত উপন্যাসে বেশিরভাগ অংশেই গল্পের নায়ক থাকে ওই স্কুল টিচার।তার চিন্তা ধারা এবং নিষ্ঠাতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়।কিন্তু এই উপন্যাস সম্পূর্ণ ভিন্ন, এখানে গল্পের ভিলেন হচ্ছে ওই স্কুল টিচার। তিরিশটি পর্ব জুড়ে এই দীর্ঘ উপন্যাস। উপন্যাসের প্রত্যেকটি পর্ব যথেষ্ট বড় এবং গুচ্ছিত লেখনী। প্রত্যেকটা পর্বে এক-একটা করে ঘটনা বর্ণনা। মাস্টারমশাইয়ের স্কুল জীবন, তাঁর পরিবার এবং সমাজের সঙ্গে তাঁর মানিয়ে চলা। প্রতিটা পর্বে মাস্টারমশাইয়ের ভালো দিকগুলো তুলে ধরেছে। এবং প্রত্যেকটা পর্বের শেষে মাস্টারমশাইয়ের সিদ্ধান্ত গুলো সমাজের পক্ষে কতটা ক্ষতিকর হতে পারে সেগুলো উদাহরণ স্বরূপ বর্ণনা করা হয়েছে। এই উপন্যাস কোনো বাচ্চা ছেলে/মেয়ে পড়লে তার মনে হবে এটা একটি স্বাভাবিক উপন্যাস। কিন্তু কোনো শিক্ষিত মানুষ এই উপন্যাস বুঝিয়ে বুঝিয়ে পড়লে তার এমনটা মনে হবে না।তার চোখে তানভীর স্যার হয়ে উঠবে একজন ভিলেন, সমাজে লুকিয়ে থাকা এক কীট। তার মনে হবে তানভীর স্যার আসলে সমাজে একটা ক্ষতিকর মানুষ। সমাজে ভালো মানুষের আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটা ছোট্ট ভাইরাস।যদি ভাইরাসটি কোনোক্রমে একজনের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে সমাজকে বাঁচানো বড্ড মুশকিল। গল্পের লেখক কিশলয় বিভিন্ন অংশে উদাহরণ স্বরূপ বর্ণনা করেছে। উদাহরণ গুলো দুর্দান্ত। উপন্যাসে বর্ণনার সংক্ষিপ্ত………
মাস্টারমশাই মদ পান করে স্কুলে আসতেন। তাইতো ছাত্র-ছাত্রীদের উপর অকথ্য অত্যাচার করতেন, নিজের বিবেকে প্রশ্ন করতেন না।মদ খাওয়ার পর তিনি নিজের মধ্যে থাকবেন না উন্মাদ পাগল হয়ে উঠতেন। গাধাকে পিটিয়ে কখনো কি ঘোড়া তৈরি করা যায়? যায় না। কিন্তু তিনি সব সময় সেটা করতে চাইতেন। তিনি শুধু ছাত্র-ছাত্রী নয় তিনি নিজের ছেলেমেয়েদের ওপর অকথ্য অত্যাচার করেছেন। অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তার ছেলে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। মেয়ে বাবার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখে না। নিজের স্ত্রীও তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন। দীর্ঘ দিন ধরে চিন্তা করতে করতে তিনি একসময় পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। সহকর্মীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক মোটেও ভালো ছিল না।

মাস্টারমশাইকে আদর্শ শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রশ্ন করা যায়? তিনি কখনো একজন আদর্শ শিক্ষক হতে পারেন না। তিনি সবসময় প্রয়োজনের তুলনায় নিজের ছেলে মেয়েদেরকে বেশি নাম্বার দিয়েছেন। বাড়িতে ছেলেমেয়েদেরকে প্রশ্নপত্র তুলে দিয়েছেন। তার প্রমাণ কিন্তু স্কুলেই রয়েছে। উনার দুই ছেলেমেয়ে ক্লাস ফাইভ থেকে টুয়েলভ পর্যন্ত প্রথম হয়েছে।স্কুলে এত ভাল ছাত্র-ছাত্রী থাকার সত্বেও তারা দুজন কি করে প্রত্যেক বছর প্রথম হল? তারা যদি সত্যিকারে নিজের নিষ্ঠা দিয়ে প্রথম হয়ে থাকে, তাহলে কেন তারা বোর্ডের এক্সামে স্কুলের মধ্যে প্রথম হতে পারল না? কারণ, বোর্ডের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র স্কুল থেকে করা হয় না।তাই মাস্টারমশাই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ছেলেমেয়ের হাতে তুলে দিতে পারেননি।

মাস্টারমশাইকে নিজের চরিত্রের দিক দিয়েও প্রশ্ন করা যায়! তিনি সত্তিকারের পুরুষ না কাপুরুষ! তাঁর চোখের দৃষ্টি মোটেও ভালো ছিল না।চোখের মধ্যে সব সময় একটা লালসা লুকিয়ে থাকতো। তিনি ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েদেরকেও বাইরে নীলডাউন করিয়ে দিতে লজ্জা বোধ করতেন না। তিনি কোনো মেয়েকে বাইরে বার করে দেওয়ার পর সে-ই মেয়েটাকে বারবার লক্ষ করতেন। আসলে তাঁর দৃষ্টি ছিল মেয়েদের যৌবনের দিকে। ছাত্রীদের অস্বস্তিকর পরিবেশে ফেলে দিয়ে অগোছালো ভঙ্গিতে গভীর লালসা মেতে উঠেছেন বারবার। মেয়েদের দিকে সবসময় নজর লালসা দিয়ে দেখেছেন। নিজের ভোগের স্বীকার করতে চেয়ে ছিলেন। শিক্ষক ও ছাত্র ছাত্রীদের মধ্যে সম্পর্ক থাকা উচিত পিতা আর সন্তানদের মতো। কিন্তু তিনি কখনো নিজের ছাত্র-ছাত্রীদেরকে সন্তান ভাবতেন না। যদি সত্যি তিনি ছাত্র ছাত্রীদের নিজের সন্তান ভাবতেন, তাহলে কখনো তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার করতেন না। সবসময় অত্যাচার করে গেছেন কখনো কাউকে ভালোবাসেননি। মানুষটা ভালোবাসতেই জানে না। মাস্টারমশাইয়ের অভিধানে ভালোবাসা শব্দটাই নেই। তিনি শাসন ছাড়া কখনো কোনো কিছু বোঝেননি। শাসন ছিল তার কাছে স্বর্গ। তিনি কাউকে আঘাত করে মনের আনন্দ পেতেন। অন্যের কান্না দেখে তিনি মজা পেতেন। এক তৃপ্ত সুখ অনুভব করতেন।

মাস্টারমশাই সরকারি এবং স্কুলের কোনো গাইড লাইনস মানতেন না। সরকারের তৈরি করা নির্দিষ্ট সিলেবাসের চাইতে নিজের তৈরি করা সিলেবাসে বেশি গুরুত্ব দিতেন।তিনি কখনো সম্পূর্ণভাবে সিলেবাস শেষ করতে পারতেন না। যার ফলে স্টুডেন্টদের বড্ড সমস্যা হতো। স্টুডেন্টরা টিউশনের প্রতি আসক্ত হয়ে ওঠে। এর প্রভাব তীব্রভাবে পড়ে গরীব স্টুডেন্ট দের ওপর। যার ফলে তারা খুব সহজে বছরের-পর-বছর ফেল করতে‌ থাকে।

তিনি কখনো গরিবদের সাহায্য করতে চাইতেন না। নিজের রোজগারের টাকার নিচে ভোগ করেছেন। চোখের সামনে অনেক দুর্দশা মানুষ থাকার সত্বেও তাদের দিকে হাত বাড়ায়নি।

মাস্টারমশাই কখনো কারোর ভালো চাননি। অন্যের সুখ সহ্য করতে পারেননি। তিনি যেটা মনে করতেন সেটাই সঠিক। কখনো কারোর কথাকে গুরুত্ব দেননি। ভীষন অহংকারী আর জেদি মানুষ। তিনি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পছন্দ করতেন না। তাই তো স্কুলের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের সময় আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলেন। সমস্ত দরকারি কাগজপত্র পুড়িয়ে ফেলে ছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, এই অন্যায়ের শাস্তি তাঁকে পেতে হবে। তাই তো কাউকে কোনো কিছু না জানিয়ে বাড়িতে গিয়ে লুকিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু পাপের শাস্তি এক জন্মে পেতে হবে। তিনিও তাঁর পাপের শাস্তি পেয়েছেন। স্কুল থেকে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। বৃদ্ধ অবস্থায় যন্ত্রনায় ভুগছেন। এটাই বিধাতার নিয়ম। অন্যায় করলে প্রত্যক্ষ ভাবে শাস্তি না পেলেও পরোক্ষভাবে শাস্তি পেতেই হবে। তিনিও তার পাপের শাস্তি পেয়েছেন।তিনি সবার সামনে সব সময় ভালো হওয়ার চেষ্টা করেছেন। অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে নিজেই অন্যায় করেছেন। অন্যায়কে সমর্থন করেছেন ……।’
(কিশলয় এই সমস্ত কথাগুলো উপন্যাসে একটা অংশে লেখেনি। বিভিন্ন অংশে বিভিন্ন ঘটনা বর্ণনা করতে এই অংশগুলো বর্ণনা করেছে।)
উপন্যাসের কাহিনী মনে পড়তেই কাবেরীর চোখ ভিজে উঠলো। শুধু কি এখানেই কাহিনী শেষ? তা কিন্তু নয়। কিশলয় মাস্টারমশাইয়ের সম্বন্ধে আরও অনেক তথ্য দিয়েছে। কিশলয়ের দেওয়া তথ্যগুলো কাবেরীর যেমন অনেক গুলো পছন্দ হয়েছে,তেমন অনেকগুলো তথ্য পছন্দ হয়নি। মনে হয়েছে,ওই সব তথ্য গুলো আসলেই মাস্টারমশাইকে অপমান করার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়েছে।মাস্টারমশাইয়ের জীবনে ঘটে যাওয়া আরও অনেক ঘটনা,ঠিক বিপরীত ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। মাস্টারমশাইকে সম্মান দেওয়ার জন্য এই উপন্যাস রচনা করা হয়নি। বরং,অপমান করার জন্য রচনা করা হয়েছে। কিশলয়ের প্রতি ঘৃণা আর আক্রোশ বাড়তে থাকে। এতদিন ছেলেটাকে অনেক ভালো মনে হতো। অনেক বুদ্ধিমান মনে হতো। অনেক শান্ত শিষ্ট সাদাসিধে লাগতো। কিন্তু সে আসলেই………। কাবেরী ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে ওঠল। তবে উপন্যাসের মধ্যে সে একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে, পুরো উপন্যাসের মধ্যে কোথাও তানভীর স্যারের নাম উল্লেখ(সূচনা কথা বাদে) করা নেই। পুরো গল্প জুড়ে ‘মাস্টারমশাই’ এই নামটি ব্যবহার করেছে। এবং আরও যে সমস্ত চরিত্র রয়েছে সেগুলোও কাল্পনিক।মাস্টারমশাইয়ের ছেলে, মেয়ে,স্ত্রী এবং আরও অনেক জন রয়েছে তবে নামগুলো সব কাল্পনিক। এই উপন্যাস বাইরের(তানভীর স্যারকে চেনে না এমন মানুষ) কোনো মানুষ পড়লে,তার মধ্যে প্রথম ধারণা আসবে আসলেই মাস্টারমশাই একটা কাল্পনিক চরিত্র কিংবা লেখক কোনো একজন মানুষকে দেখেছিল, কিংবা মানুষটার সম্বন্ধে শোনেছিল, এবং তাঁর মধ্যেই ওই সমস্ত গুণ গুলো ছিল, সেখান থেকে কাহিনী নিয়ে নিজের মতো সাজিয়েছে। লেখকেরা সাধারণত এমন ভাবেই গল্প লেখে। তারা কোনো ঘটনা নিজের চোখের সামনে দেখে, কখনো নিজের অভিজ্ঞতা, আবার কখনো নিজের কল্পনাকে জ্বলন্ত চরিত্র আকারে ভাষায় বর্ণনা করেন। এই উপন্যাসের ক্ষেত্রে অবশ্যই তাই ঘটেছে। লেখকের দেখা কিংবা কল্পনার মানুষটাকে কেন্দ্র করে এই উপন্যাস। এই উপন্যাসটি যে ব্যক্তি শেষ করবে তার অবশ্যই উল্লেখিত চরিত্র মানে মাস্টারমশাইয়ের প্রতি ঘৃণা আসবে। ঘৃণা আসতে বাধ্য। কারণ, মাস্টারমশাই চরিত্রটাই এমন ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। মাস্টারমশাই চরিত্রটি তাদের জীবনে আজীবন এক ঘৃণ্য চরিত্র হিসেবে থেকে যাবে। কিন্তু যারা কিশলয় এবং তানভীর স্যার উভয়কে কিংবা শুধু মাএ তানভীর স্যারকে চেনে, তাদের ক্ষেত্রে কি ঘটবে?তারা উপন্যাসে উল্লেখিত ঘটনা আর তানভীর স্যারের জীবনী পুরোপুরি মিলিয়ে নিতে পারবে। তারা কি উপন্যাসে উল্লেখিত মাস্টারমশাই চরিত্রটিকে কাল্পনিক ভাববে? না ভাববে এই চরিত্রটি বাস্তব!
কাবেরী হয়তো ভাবছে মাস্টারমশাই ভালো মানুষ। তিনি সম্পূর্ণ নির্দোষ। কিন্তু অন্য কোন ব্যক্তি কি ভাববে মাস্টারমশাই নির্দোষ? তিনি সত্যিকারের ভালো মানুষ! আজকে বাচ্চারা যখন কয়েকবছর পর বড় হবে, তারাও নিশ্চয়ই এই উপন্যাস পড়বে। উপন্যাস পড়ে কি তারা কখনো ভাববে মাস্টারমশাই ভালো মানুষ ছিলেন? কখনই নয়। কারণ উপন্যাসে শুধু ঘটনা নয়, ঘটনার সত্যতার প্রমাণও দেওয়া হয়েছে। মাস্টারমশাই সবার কাছে সারা জীবন অমর হয়ে থাকবে, তবে ঘৃণ্য এক চরিত্র হিসেবে; ভালো মানুষ হিসাবে নয়। মাস্টারমশাই ঠিক কথাই বলেছিলেন, তার ছাত্র তাকে অমর করে দিয়েছে। সত্যিই মাস্টারমশাই অমর হয়ে থাকবেন তাঁর ছাত্রের উপন্যাসে। যত মানুষ এই উপন্যাস পড়বে, তত মানুষ একবার হলেও মাস্টারমশাইকে গালি দেবে।কাবেরী আর কিছু কল্পনা করতে পারছে না। মাথায় দুমদুম করে আওয়াজ হচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণা অনুভব করছে। কিছু ভালো লাগছে না তার। উপন্যাস পড়ে তার এতটা কষ্ট হচ্ছে, যা সে সহ্য করতে পারছে না। তাহলে তানভীর স্যার কি করে সহ্য করছেন? হয়তো, সবাই একদিন মেনে নেবে ‘মাস্টারমশাই’ উপন্যাসে মাস্টারমশাই চরিত্রটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক। কিন্তু তানভীর স্যার কি কখনো মেনে নেবে ওই চরিত্রটা কাল্পনিক?

‘এই রঘু! কোথায় গেলি? আমি সকাল সকাল চা পান করি ভুলে গেলি! চা নিয়ে আয় তাড়াতাড়ি।’
‘আনছি মাস্টারমশাই। একটু অপেক্ষা করুন। আপনি একদম বাইরে বের হবেন না। বাইরে প্রচণ্ড কুয়াশা।’ রান্নাঘর থেকে রঘুর কথা ভেসে আসলো।মাস্টারমশাই জানালার পর্দা সরিয়ে দেখলেন বাইরে ভীষণ কুয়াশা।বেলা আটটা হতে যায় তবুও সূর্যিমামার দেখা নেই। ভীষণ ঠান্ডা করছে। তিনি রঘুর কথা শুনলেন। রুমের মধ্যে বসে থাকলেন। কি করবেন কিছু বুঝতে পারছেন না। সব সময় কি আর বই পড়তে ভালো লাগে? কারোর সঙ্গে বসে যে গল্প করবেন তারও উপায় নেই। বাড়ি থেকে বেরিয়ে একটু ঘুরতে যাবে,তাও সম্ভব নয়। সবাই এই বুড়ো মানুষটাকে নিয়ে খিল্লি করবে। একদিন তিনি সবাইকে বলতেন, লোকে কি বলল,এই কথা ভেবে নিজের ভাললাগা যেন না হারিয়ে ফেলে। আজকে নিজেই,লোকে কি বলবে; তার ভয়ে বাড়ি থেকে বের হতে পারেন না। বড্ড অদ্ভুত এই সমাজের নিয়ম! আমরা যে সমস্ত সমাজের নিয়ম অন্যকে শেখাই, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আমরা সেই সমস্ত নিয়ম পালন করতে পারি না। আমরা নিজেরা যদি সেই নিয়ম পালন করতে না পারি,তাহলে অন্যরা সেই নিয়ম কি করে পালন করবে? রঘু দু’কাপ চা নিয়ে আসলো। এক কাপ নিজে নিল আর এক কাপ মাস্টারমশাইকে দিল।মাস্টারমশাইয়ের চায়ের সঙ্গে আবার দশটা বিস্কুট চাই। তিনি বাচ্চাদের মতো চায়ের সঙ্গে অনেকগুলো বিস্কুট খান। ডাক্তার বারণ করেছেন। কিন্তু তিনি শোনেন না। বুড়ো বয়সে যাই ভালো লাগে তাই খান। পেটের খিদেকে কি জোর করে আটকানো যায়? মুখের স্বাদ অতৃপ্ততা রেখে তিনি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে চান না। সমস্ত স্বাদ পূর্ণ করে বিদায় নেবেন। মাস্টারমশাই চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,’মাহবুবকে একটা ফোন লাগিয়ে দে তো। একটু কথা বলি।’ মাস্টারমশাইয়ের কথা শোনে রঘুর একটা খটকা লাগলো। মাস্টারমশাই সবসময় নিজে থেকে টেলিফোন করেন। কখনো কাউকে ফোন লাগিয়ে দিতে বলেন না।সে টেলিফোনে মাহবুবের নাম্বার ডায়াল করার আগেই, মাস্টারমশাই বাধা দিলেন। তিনি মাহবুবকে ভিডিও কল করতে বলেন। মাহাবুব বাবার জন্য একটা বড়ো ট্যাপ কিনে দিয়েছেন। সময় পেলে তারা একই সঙ্গে ভিডিও কলে আসে। অনেক গল্প করে। তবে মাস্টারমশাই ভিডিও কল করতে জানেন না। যদিও তিনি আদৌ ট্যাপ চালাতে পারেন না। বেশিরভাগ সময় রঘু ট্যাপ নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করে। মাস্টারমশাই ছেলে-মেয়ের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলতে চাইলে, রঘুই ফোন লাগিয়ে দেয়।সে জোরে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে ট্যাপ আনতে গেল। তারপর মাহবুবকে ফোন লাগিয়ে মাস্টারমশাইকে দিল। মাস্টারমশাই ফোনের মধ্যে নিজের ছেলেকে দেখে আপ্লুত হয়ে উঠলেন। ছেলে আর বৌমার সঙ্গে গল্প করতে লাগলেন। বেশ অনেকক্ষণ ধরে গল্প করলেন।এদিকে চা ঠান্ডা হয়ে গেছে, সেটা তিনি খেয়াল করলেন না। কথার মাঝখানে তিনি বললেন,’কিরে তোরা দেশে ফিরবি কবে?’
‘ঈদের সময় ফিরব।’ হাসিমুখে বলল।
‘মাহবুবসে কি রে…. ঈদ এখনো ঢের বাকি।কয়েকদিন আগে তো বললি জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির মধ্যে আসবি। তাছাড়া ওই সব কান্ট্রিতে এই সময় বেশি ছুটি থাকে। এই সময় একবার নিজের দেশ থেকে ঘুরে যা।’
‘আব্বু,আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি একটা ঝামেলার মধ্যে পড়ে গেছি। তোমার ছোট বাবু কবে থেকে জেদ ধরে বসে আছে নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখবে বলে।তাছাড়া ছোট বাবুকে এই দেশ ঘুরেও দেখানো হয়নি। এবারে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই মরশুমে আমরা পুরো কানাডা ঘুরে দেখব। এবার আর দেশে ফেরা হচ্ছে না।’
ছোট বাবুর কথা শুনে তানভীর স্যার আরও বেশি প্রফুল্ল হয়ে উঠলেন। দুপুর আর মাহবুবের সাত বছরের সন্তান হলো ছোট বাবু। ছোট বাবু নামটা তানভীর স্যারের দেওয়া। তিনি সব সময় বাচ্চাটিকে ছোট বাবু বলে ডাকেন। আর তার নাম ছোট বাবু হয়ে গেছে। যদিও এই নামটি কারোর পছন্দ নয়।
‘আচ্ছা ঠিক আছে। তোরা যা ভালো বুঝিস ওটাই কর। কিন্তু আমার ছোট বাবু কই? ওকে ফোনের সামনে নিয়ে আয়।’ কথাগুলো বলতে গিয়ে তানভীর স্যারের চোখ দুটো ছল ছল করে উঠলো। তিনি যে অসীম ব্যথায় ভুগছেন। সেই ব্যথা কি বুঝতে পারবে মাহবুব? হয়তো, কখনো বুঝতে পারবে না। যদি বুঝতে পারত,তাহলে সে কখনো নিজের ছেলেকে নিয়ে কানাডায় থাকতো না। নিজের দেশে চলে আসতো। ছোট বাচ্চাটি ল্যাপটপের সামনে এসে হাত নাড়িয়ে ‘দাদুভাই’ বলে ডাকলো।অজান্তেই তানভীর স্যারের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। তিনি কেন কান্না করছেন? চোখের জল মুছে ফেললেন। কণ্ঠস্বর ধীর করে বললেন,’কেমন আছো ছোট বাবু?’
‘আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?’
‘আমিও অনেক ভালো আছি। এখন কি করছো?’
‘এইতো ফোনে গেম খেলছি।’
‘তুমি গেম খেলছো, আবার জোর গলায় বলছো? তোমার বয়স অল্প। এই বয়সে তোমার হাতে ফোন কে দিয়েছি?’ গম্ভীর গলায় বললেন।
‘এইজন্য তোমাকে ভালো লাগে না দাদুভাই। সব সময় পচা পচা কথা বল।’
মাস্টারমশাই আর কিছু বললেন না। মাহবুব আর দুপুরের বয়স নিতান্ত নয়। তাদের বোঝার ক্ষমতা হয়েছে। তারা যদি ছেলের হাতে ফোন ধরে দেয়, তাহলে মাস্টারমশাইয়ের কি করার আছে! তিনি প্রসঙ্গ পাল্টে বললেন,’আচ্ছা ছোট বাবু, তুমি কবে দেশে ফিরবে?’
‘আমি কখনোই ওই দেশে যাব না। সেখানে প্রচুর গরম আর কাদা।’
‘ছোট বাবু,এমন কথা বলতে নেই। এটা তোমার নিজের দেশ। নিজের জিনিসকে কখনো অপমান করতে নেই। সব সময় তার পাশে থাকতে হয়।’
‘তুমিও তো আমার নিজের দাদু। কই তুমি তো কখনো আমাদের সঙ্গে থাকো নি! সব সময় আলাদা থাকো।বাবা কতবার বলেছে তোমাকে আমাদের কাছে চলে আসতে। কই তুমি তো আমাদের কাছে আসোনি।’
মাস্টারমশাইয়ের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লো। তিনি কি একা থাকতে চেয়েছিলেন? তাঁকে তো একা থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। আর নিজের দেশ ছেড়ে অন্য দেশে গিয়ে থাকতে মন চায় না।তারপর, তিনি আরও কিছুক্ষণ মাহবুবের সঙ্গে কথা বলেন। ছেলেকে আগলে রাখতে বলেন। ছেলেকে সঠিক শিক্ষা দিতে বলেন। কিন্তু মাস্টারমশাই কেন যেন মনে হল, মাহবুব একটা কথাও মন দিয়ে শোনেনি। বরং উল্টো বলল, ছোট বাবু এখন অনেক ছোট। তাই এমন করছে। বড় হলে বুঝতে পারলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ট্যাপ রেখে মাস্টারমশাই চুপচাপ বসে থাকলেন। দু চোখ থেকে অশ্রু ধারা ঝরে পড়ছে। মাহবুব যেদিন থেকে এই বাড়ি ছেড়েছে সেদিন থেকেই এই বাড়িতে মাংস হয়নি। একা মাংস খেতে মাস্টারমশাই পছন্দ করেন না। তিনি অপেক্ষায় আছেন, একদিন তার ছেলে-বৌমা, মেয়ে-জামাই,ছোট বাবু, মিষ্টি সবাই বাড়িতে আসবে। একসঙ্গে মিলে মাংস রান্না হবে। পিঠে হবে। একসঙ্গে গোল হয়ে বসে খাবেন।দুদিন হলেও তাদের পরিবারে সেই অতীতের মুহূর্ত ফিরে আসবে। জীবনের সব চাইতে বিশেষ মুহূর্ত তৈরি হয়ে থাকবে। মাহবুব মাংস খেতে ভীষণ পছন্দ করতো। মাহবুবকে না খাইয়ে তিনি একা মাংস খেতে পারেন না। তাই এই বাড়িতে মাংস আর রান্না হয় না। কিন্তু মাহবুব কি বাবার অপেক্ষায় আছে? বাবার পছন্দের খাবারগুলো না খেয়ে আছে? একসঙ্গে বাবা ছেলে মিলে তাদের পছন্দের খাবার খাবে। তেমনটা ভাবাও যেন স্বার্থপরতা।

মাস্টারমশাইয়ের কথা ভাবতে ভাবতে কাবেরী আবার কখন ঘুমিয়ে পড়েছে সে ঠিক বুঝতে পারেনি। বেশ অনেকক্ষণ ধরে ঘুমালো। হঠাৎ দরজায় টোকা শব্দে তার ঘুম ভাঙলো। একটা লম্বা হাই তুলল। এত সকালে আবার কে আসলো? বিছানা থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুলল। তিনজন সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষ। তিনজনই পুরুষ মানুষ। তাদের দেখে কাবেরী একটু ঘাবড়ে গেল। এত সকালে তাদের এই বাড়িতে কি চাই?

পর্ব ২৪ আসছে।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here