মাস্টারমশাই
পর্ব ২৬
___________________
রাত্রির কালো পর্দা সরিয়ে একটি রৌদ্রদীপ্ত দিনকে উপহারস্বরুপ শ্যামা ধরিত্রীর হাতে তুলে দেয় যে, সে উষা-তপনের দ্রুতি, অরুণ রমণী। ঊষার আবির্ভাব রাত্রি বিদায় ও দিনের শুভসূচনা সন্ধিক্ষণ। তার পিছনে পিছনে চলে সূর্য দেবের আবির্ভাব,আবির্ভূত হন উদয়াচলে। সূচিত হয় প্রভাত। প্রবাদে আছে শব্দ জাগরণের স্নিগ্ধ প্রশান্তি। আছে শুভ্র শুচিতা, আছে অরুণের সোনা হাসিতে উজ্জ্বল কর্মচঞ্চল প্রাণের অবলীলা। সকালের হিম শীতল বায়ু আঘাত এনেছে গ্রাম অঞ্চলে। সকালে ঘুম ভাঙতে অনেক দেরি হয়ে গেল কাবেরীর। মাস্টারমশাইয়ের কথা মতো, সারারাত ধরে বইটি দ্বিতীয় বার পড়েছে। একটা লাইনও বাদ দেয়নি। মনের মধ্যে একটা আশা ছিল, কিশলয় এমন কোনো লাইন হয়তো লিখেছে যেখানে মাস্টারমশাইকে সম্পূর্ণ নির্দোষ বলা হয়েছে। কিন্তু সে হতাশা হয়েছে। কোথাও এমন লাইন খুঁজে পায়নি। মাস্টারমশাই বইটি কেন দ্বিতীয় বার পড়তে বললেন, জানে না সে। উনার বলা কথার মানে উদ্ধার করতে পারেনি। বই পড়া শেষ হওয়ার পর, নীরব হয়ে বসেছিল।হতাশাগ্রস্ত কাবেরী রাতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল ঠিক মনে নেই। ঘুম ভাঙতেই বুঝতে পারে বেলা অনেক হয়েছে। ইতিমধ্যে ঘড়ির কাঁটা দশটা পূর্ণ করে ফেলেছে। বাড়ির মধ্যে শীতল ভাব একটু বেশি। বাইরের রোদে নিজেকে একটু স্নিগ্ধ করতে চাইল। গায়ে সাদা রঙের শাল জড়িয়ে রাস্তার মাঝখানে এসে দাঁড়ালো। চারিদিকে থমথমে পরিবেশ। একটা গাঢ় নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। নিস্তব্ধতার বুক ছিঁড়ে কয়েকজন শিশুর কৌতুহল গ্রস্থ কথাবার্তা ভেসে আসছে কাবেরীর কানের গোড়ায়। কাবেরী আগ্রহের সাথে কথাগুলো শুনতে চাইলো। বাচ্চা শিশু গুলো কাউকে নিয়ে ঠাট্টা করছে। ভীষণ ভয় পেয়ে আছে ওই মানুষটাকে। কাবেরী আরও ভালো করে লক্ষ্য করে, কয়েকজন শিশু স্কুলের পথে রওনা দিচ্ছে। তারা কোনো এক ঘটনা নিয়ে ভীষণ রকমের কৌতুহলী হয়ে আছে। বাচ্চাগুলো কাছে আসতেই কাবেরী তাদের কাছে সম্পূর্ণ ঘটনাটি জানতে চাইলো। সামান্য কথায় কাবেরী বুঝতে পেরে যায়, শিশু গুলো ঠিক কি বলতে চাইছে। কাবেরী স্প্রিংয়ের মতো ছিটকে উঠলো।স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো।মুখের ভাষা আজ বিবর্ণ। কোনো শব্দ বেরিয়ে আসতে চাইছে না। পুরো শরীর জুড়ে ভয়ঙ্কর রকমের কাঁপুনি শুরু হয়েছে। দাঁড়ানোর শক্তি টুকু নেই।গতকাল রাতে মাস্টারমশাই মারা গেছেন। ঘুমের মধ্যে তিনি পৃথিবীর ছেড়েছেন। রাতের মধ্যেই মাস্টারমশাই মৃত্যুর খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। শীতকে নিজের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে দেবে না, তাই বাড়ির দরজা-জানালা ভালো করে বন্ধ করে নিজেকে রুমের মধ্যে বন্দি রেখেছিল। রুমের মধ্যে শীত ততটা প্রবেশ করতে পারেনি সঙ্গে সঙ্গে মাস্টারমশাইয়ের মৃত্যুর খবরটাও। কাবেরী আরও একটা জিনিস খেয়াল করে। বাচ্চা শিশুরা বিপরীত রাস্তা দিয়ে স্কুল যাচ্ছে। পনেরো মিনিটের রাস্তা তিরিশ মিনিট ধরে ঘুরে যাওয়ার কারন কি? কাবেরী তার সঠিক কারণ খুঁজে বার করতে পারল না। এই ভাবে ঘুরে ঘুরে স্কুল যাওয়ার কোনো মানে হয় না। উপস্থিত শিশুদের প্রশ্ন করল। প্রশ্নের উত্তর কাবেরীর মধ্যে একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করল। মাস্টারমশাই খারাপ মানুষ। বেঁচে থাকাকালীন তিনি কখনো কারোর ভালো চাননি। সবার অমঙ্গল চাইতেন। তাই তিনি সবার কাছে অবহেলার শিকার হয়েছেন। ঠাট্টার মানুষ হয়ে উঠেছিলেন। সবাই হাসি ঠাট্টা করতো। মৃত্যুর পর তিনি অবশ্যই তার প্রতিশোধ নেবেন। ভূত হয়ে তাদের ঘাড়ে চাপবে। তাদেরকে ভয় দেখাবে।বাচ্চাদের মুখে এমন কুসংস্কার গ্রস্থ কথা শুনে কাবেরী হাসবে না কান্না করবে বুঝতে পারছে না। শিশুদের উদ্দেশ্যে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয়।
‘এইসব কথা কে বলেছে তোদের?’
উপস্থিত শিশুদের মধ্যে একজন শিশু কাবেরী দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অন্যান্য শিশুর মধ্যে ভয় থাকলেও তার মধ্যে ভয় জিনিসটা নেই। সে জোর গলায় বলল,’এগুলো আমার মা বলেছে। আমাদের মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির সামনে দিয়ে যেতে বারণ করেছেন। তিনি ভূত হয়ে আমাদের ঘাড়ে চাপতে পারেন।খুব ধূত মানুষ। তাছাড়া মৃত মানুষকে দেখলে রাতে ভয় পাবো।তাই আমরা মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির সামনের রাস্তায় না গিয়ে এই পথ দিয়ে স্কুলে যাচ্ছি।’
কাবেরী আর এক মুহূর্তও সেখানে অপেক্ষা করল না। বন্দুকের নল থেকে বেরিয়ে আসা গুলির মতো স্থান ত্যাগ করল। শিশুদের কথা গুলো বারবার মনে দাগ কাটছে। তাদের মুখে এমন কথা প্রত্যাশার মধ্যে ছিল না। এর জন্য কি আদৌ শিশুটা দায়ী? তাদের মায়েরা তো এমন সব কথা শিখিয়েছে। সেখানে তারা নিরুপায়। মাস্টারমশাই মারা গেছেন,এই কথা শোনে সে যতটা না কষ্ট পাচ্ছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে মাস্টারমশায়ের শেষ জীবনের কথা মনে করে। এক মুহূর্তও শান্তি পাননি। যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গেছেন। শেষ জীবনে কারোর স্নেহ-মমতা-ভালবাসা পাননি।শুধু পেয়েছেন অবহেলা আর কটুক্তি কথাবার্তা। মাস্টারমশাইয়ের মৃত্যু মাস্টারমশাইকে মুক্তি দিয়েছেন। শেষ জীবনে যদি একটু শান্তি পেতেন, তাহলে তাঁর মৃত্যুটা সার্থক হতো।তিনি দিনের পর দিন যেভাবে যন্ত্রণা সহ্য করেছিলেন, তার চাইতে মৃত্যুটাই শ্রেয় ছিল।মৃত্যুর পরেও শান্তি পাচ্ছেন কই? এখনো মানুষটাকে সবাই ভুল বুঝছে। অন্যায় না করেও, তিনি অন্যায়ের শাস্তি পিয়েছেন, তার সত্যতা তিনি কখনও প্রমাণ করতে পারলেন না। সারা জীবন দোষটা নিজের ঘাড়ে বয়ে বেড়ালেন। সবকিছুর সত্যতা কেউ হয়তো কোনদিন প্রমাণ করতে পারবে না। মাস্টারমশাইয়ের একটা নিয়ম ছিল, মানুষের জীবনে যা কিছু ভালোমন্দ ঘটে, অধিকাংশই ক্ষেত্রে তার জন্য সে নিজেই দায়ী থাকে। মানুষ সবসময় প্রশ্ন করতে ভালোবাসে। কিন্তু কখনো সে নিজেকে প্রশ্ন করে না। প্রশ্ন করলেও খুব অল্প। নিজেকে প্রশ্ন করলে, নিজেকে পিছনে নিয়ে যেতে হবে।পেছনের কিছু ঘটনা তাকে লজ্জিত কিংবা বিব্রত করে তোলে। তাই মানুষ নিজেকে প্রশ্ন করা থেকে সবসময় বিরত থাকে। নিজের কাজের সত্য মিথ্যা নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। অন্য কেউ কখনো করে দেবে না। যদি কেউ করে থাকে,তাহলে সে তার স্বার্থের জন্য করবে। আজ মাস্টারমশাই নির্দোষ হয়েও প্রমাণ করতে পারলেন না তিনি নির্দোষ। তার জন্য সম্পূর্ণ রুপে নিজেই দায়ী। নিজের তৈরি করা আইনে আজ নিজেই ব্যর্থ। এমন কেউ কি আছে যে তাকে নির্দোষ প্রমাণ করবেন? হয়তো,তিনি একদিন নির্দোষ প্রমাণিত হবেন। কিন্তু নির্দোষ প্রমাণ করে লাভ কী? মানুষটা তো আর নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ মারা গেলে তাকে পূর্ণ মর্যাদায় সম্মান করা হয়। বেঁচে থাকতে একজন মানুষের যতটুকু প্রাপ্য সম্মান ততটুকুই সে কখনো পায় না। মারা যাওয়ার পর তার প্রাপ্য সম্মান ফিরে পায়।কিন্তু মাস্টারমশাই মারা যাওয়ার পর, তাঁর প্রাপ্য সম্মান কি কোনদিন ফিরে পাবেন? শুধু প্রশ্ন চিহ্ন থেকে যায়। উত্তরটা অজানা কিংবা কাল্পনিক।
মাস্টারমশাইয়ের বাড়ির সামনে লোকে লোকারণ্য। চাপা একটা ক্রন্দন বাড়ির মধ্য থেকে বেরিয়ে আসছে। চারিদিকে নিস্তব্ধতার মধ্যে ক্রন্দনের শব্দ বেশ জোরালো। সবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সাদা কাফনে ঢাকা লাশের পাশে কেউ বসে আছে, আবার কেউ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে যাচ্ছে। কিছু মানুষকে দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, মাস্টারমশাইয়ের মৃত্যুতে তারা অনেক খুশি। মৃত্যুর আনন্দ উপভোগ করছে। কাবেরী ভিড় ঠেলে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করল। মৃতদেহের কাছে তেমন কেউ নেই। ইয়াসমিন বাবার মাথার কাছে বসে রয়েছে। পাশে রাকিব আর তাদের ছোট্ট মেয়ে মিষ্টি বসে আছে। তাদের ছাড়া আর তেমন কাউকে কান্না করতে দেখা যাচ্ছে না। কাবেরী ইয়াসমিন ছাড়া আর কাউকেই চিনতে পারল না। সেও মাস্টারমশাইয়ের মাথার কাছে গিয়ে বসলো। মৃত মানুষকে স্পর্শ করা যায় কিনা তার জানা নেই। কোন নিয়ম জানে না সে। তবুও স্পর্শ করল শেষবারের মতো। উনার শরীর ঠান্ডা হয়ে আছে। রক্তশূন্য ভাঙচুর দেহখানা….. ভাঁজ পড়া চামড়া যুক্ত কপালে আলতো করে মাস্টারমশাইকে চুম্বন করল। বারবার কেঁপে উঠছে সে। চোখ দুটো বন্ধ না করে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।খোলা দুটো চোখ শূন্যের দিকে তাকিয়ে আছে। কোনো বাচ্চা শিশু মৃতদেহ দেখে ভাবতে পারবে না, মানুষটি আর এই পৃথিবীতে নেই।শুধু রক্ত মাংসে গড়া দেহটি পড়ে আছে। কাবেরী গুমড়ে গুমড়ে কেঁদে ওঠে। চোখ থেকে অশ্রু ধারা বয়ে যায়। দু ফোঁটা চোখের জল মাস্টারমশাইয়ের কপালে এসে পড়ে। কাবেরী নিজের হাত দিয়ে তাঁর কপাল থেকে চোখের জল মুছে দেয়। মাস্টারমশাই গালগুলো কুঁচকে গেছে। হাতে পায়ের চামড়া গুলো গলে ঝুলে পড়েছে। এই মানুষটিকে সে একদিন ভীষণ রকমের ভয় পেত। আজ তাঁর একদম কাছে বসে আছে। একটা কথা বলছে না। তাকে বকছেও না।একটা আলাদা অনুভুতি হচ্ছে। বুক বার বার মোচড় খাচ্ছে। এই মানুষটার জন্য সে এতো কান্না করছে কেন?তা জানে না। তার মনে হচ্ছে, মানুষটা বেঁচে থাকতে একটা দিনও শান্তি পাননি। সারাজীবন কষ্ট পেয়ে গেলেন। এর চাইতে বড়ো আকাঙ্ক্ষা আর কি হতে পারে? মাস্টারমশাইয়ের বই আর ফেরত দেওয়া হল না। তাঁর জিনিস তিনি ফিরিয়ে না নিয়ে পৃথিবীত ত্যাগ করেছেন। কাল রাত পর্যন্ত মানুষটি ঠিক ছিল আর সকাল……
কাবেরী বেশ অনেকক্ষণ ধরে মাস্টারমশাইয়ের মাথার কাছে বসে থাকল। সামনের দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখল রঘু দাঁড়িয়ে আছে। তাঁর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে। কোনো শব্দ নেই। নিঃশব্দে বুকের যন্ত্রণা প্রকাশ করছে। গাল দুটো টগরের মতো ফুলে গেছে। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো। রুক্ষ শুষ্ক দেহখানা দেখে বোঝা যাচ্ছে সারারাত এক ফোঁটাও ঘুমায়নি সে। সারারাত কান্না করেছে। সে তার পিতাকে হারিয়েছে। রক্তের কোন সম্পর্ক নেই, তবুও মাস্টারমশাই তার পিতা ছিলেন। তাই তো অন্যের ফেলে যাওয়া বাবা-মাকে সে নিজের মতো করে রেখেছে। সমস্ত দায়িত্ব পালন করেছে। মাস্টারমশাইকে কখনো বলতে শোনা যায়নি, রঘু একটি খামখেয়ালি ছেলে। কোনো কাজে মনোযোগী নয়। সঠিকভাবে তাঁর দায়িত্ব নিতে পারে না। মাস্টারমশাই রঘুর কাছে অনেক ভালো ছিল। মাস্টারমশাইকে নিজের বাবা ভেবে সে তার সমস্ত দায়িত্ব কর্তব্য পালন করেছে। মাস্টারমশাইকে হারানোর ভয়ানক এক মুহুর্তের সাক্ষী আছে সে। তাই সে কাঁদছে।
বেলা বাড়তে শুরু করল। গ্রামের মানুষজন মাস্টারমশাইয়ের বাড়িতে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে বিবাদ শুরু হয়ে যায়। কিছু মানুষ দাবি করেন, মাস্টারমশাই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন , তাঁকে সম্মান জানাতে তার মৃতদেহ স্কুলে নিয়ে যাওয়া উচিত। আবার কিছু মানুষ তার পাল্টা যুক্তি দেয়, মাস্টারমশাই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, সঠিক। কিন্তু, তিনি স্কুল থেকে রিটায়ার্ড হননি। স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেওয়া একজন মানুষকে যথাযথ সম্মান দেওয়ার সার্থকতা খুঁজে পাচ্ছে না তারা। মাস্টারমশাই মৃতদেহ স্কুলে কিছুতেই নিয়ে যেতে দেবে না। উপস্থিত মানুষ দুটো দলে ভাগ হয়ে যায়। তাদের মধ্যে চলতে থাকে তর্কাতর্কি। একসময় কান্নার শব্দ কোথায় বিলীন হয়ে যায়। মানুষের হট্টগোল প্রাধান্য পেতে থাকে। আরও বেশি লোক জড়ো হতে থাকে। পাশের গ্রাম থেকে মানুষরাও আসতে শুরু করে। ইয়াসমিন বাবার মৃতদেহ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে সঙ্গে কাবেরীও। উপস্থিত মানুষ জনের মধ্যে কাবেরী দুজন ছাড়া কাউকে চিনতে পারল না। শহর থেকে গ্রামে আসার সময় তার পাশে একজন বৃদ্ধ বসে ছিলেন। সেই বৃদ্ধ সেখানে দাঁড়িয়ে আছেন। বৃদ্ধটি কে কাবেরী তা অনুমান করতে থাকলো। কিন্তু বৃদ্ধের আসল পরিচয় পাওয়া গেল না। বৃদ্ধের পাশেই কিরণ দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে বারবার জোর গলায় বলছে, একজন মানুষ মারা গেছে। আজ সেই মানুষটাকে নিয়ে সমালোচনা না করাই ভালো। মাস্টারমশাইয়ের মধ্যে অনেক কিছু খারাপ আছে, সেগুলো আজ বর্জন করাই শ্রেষ্ঠ। তিনি একজন শিক্ষক ছিলেন তাকে যথাযথ সম্মান প্রদান করাই আমাদের কর্তব্য। তিনি শুধু একজন শিক্ষক নন, তিনি আমাদের গ্রামের মাস্টারমশাই। তিনি আমাদের গ্রামের প্রথম শিক্ষক। একজন শিক্ষকের ঋণ কখনো শোধ করা সম্ভব নয়। আমরা শুধুমাত্র যোগ্য সন্মান দিতে পারি। কিন্তু বুদ্ধিজীবীদের কাছে কিরনের বক্তব্য নগণ্য। তাঁর কথা কেউ শোনল না। বৃদ্ধ মানুষটিও মাস্টারমশাইয়ের মৃতদেহ স্কুলে নিয়ে যেতে বললেন। কিন্তু তাদের কথা বেশিরভাগ মানুষই মানতে চাইলো না। শেষমেষ বৃদ্ধ মানুষটি রেগে তানভীর স্যারের মৃত দেহের দিকে এগিয়ে গেল। এগিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, সব জায়গায় রাজনীতি না করাটাই ভালো।কাবেরী এমন দৃশ্য দেখতে ভালো লাগছে না। বড্ড বিরক্ত হচ্ছে সে। এত মানুষের ভিড়ে কিশলয়কে খুঁজলো সে। তার দেখা সাক্ষাৎ নেই। সে ব্যস্ত মানুষ। মাস্টারমশাইয়ের মতো একজন সামান্য মানুষের মৃত্যু তাকে প্রভাবিত করতে পারেনি। তাই সে শেষবারের মতো মাস্টারমশাইকে দেখতে আসেনি।
মাস্টারমশাই কি করে মারা গেল তা জানার ইচ্ছা কাবেরীর মধ্যে বাড়তে থাকে। সে রঘুকে নিজের কাছে ডেকে সমস্ত মানুষের আড়াল হয়ে গেল। তারপর একটার পর একটা প্রশ্ন করতে থাকে।কাবেরী প্রশ্ন শোনে রঘু আবার একবার কেঁদে উঠলো। তার বুক চিন চিন করছে। সে সমস্ত ঘটনা আর মনে করতে চায় না। কালকের রাতটা তার কাছে যেন একটা ভয়ঙ্কর রাত। সব কিছু কল্পনা লাগছে। বিশ্বাস করতে পারছে না, মাস্টারমশাই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তবুও সে কাঁদো কাঁদো গলায় কাবেরীকে সব কিছু বলল। প্রতিদিনের মতো কালকেও,সে মাষ্টারমশাইকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। তারপর নিজের রুমের দিকে যায়। কিন্তু গতকাল মাস্টারমশাই এক অদ্ভুত আচরণ করেন। সে রঘুকে যেতে দিলো না। তাঁর ছেলেমেয়েকে একবার ফোন করতে বলেন। তাদেরকে দেখতে বড্ড ইচ্ছে করছে।রঘু বিরক্ত বোধ করে। সারাদিন কাজ করার পর আবার মাস্টারমশায়ের কাছে বসে থাকতে তার ভালো লাগে না। একটু বিশ্রাম চায় সে। মাস্টারমশাই এখন ফোন ধরলে কিছুতেই ছাড়বে না। সে মিছামিছি ফোন নিয়ে টিপতে থাকে। একবারের জন্যও ছেলেমেয়েরকে ফোন না করে বলে, তারা কেউই ফোন তুলছে না। সম্ভবত ঘুমিয়ে পড়েছে বা অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত। মাস্টারমশাই নিরাশ হয়ে রঘুকে ছেড়ে দিতে বলেন। রঘু হাসি মুখে রুম থেকে বেরিয়ে আসে। সামান্য কিছু কাজ শেষ করে নিজের বিছানায় গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। চোখ সবেমাত্র বন্ধ করেছিল,তখনই মাস্টারমশাইয়ের মুখে কিছু অস্পষ্ট শব্দ শুনতে পায়। তিনি বারবার মুখে মাহবুবের নাম নিচ্ছেন। রঘু অবাক হয়। মাস্টারমশাই কখনো এমন করেন না। সে বিছানা ছেড়ে মাস্টারমশায়ের রুমে যায়। উনার দুটো চোখ জলে ভিজে গেছে। চোখ থেকে জল বেয়ে পড়ছে। তিনি কান্না করছেন। তিনি মরতে চান না আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতে চান। কিন্তু তিনি তো মৃত্যুর দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছেন। সেখান থেকে ফিরবার উপায় নাই। তড়িঘড়ি করে রঘু মাস্টারমশায়ের কাছে এসে উনার হাত শক্ত করে ধরে ফেলে। মাস্টারমশাই তখন হা হা করে হেসে ওঠেন। রঘুর হাত ধরে জোর গলায় বললেন, তুইও শেষ পর্যন্ত আমাকে মিথ্যা কথা বললি। বুড়ো হয়ে গেছি বলে আমাকে ফাঁকি দিবি;এত সহজ! তানভীর আলমকে কেউ কখনো ফাঁকি দিতে পারেনি। অনেকেই আমাকে ব্যবহার করে অনেক বড়ো হয়ে গেছে, কিন্তু সবাই আমার সরলতার সুযোগ নিয়ে। তারা কেউ ফাঁকি দিতে পারেনি বরং তারা নিজেকে নিজেই ফাঁকি দিয়েছে। জানিস রঘু, আমার ছেলেটা বড্ড ভালো। কিন্তু টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেল। টাকার বিনিময়ে ভালোবাসা সংসার সুখ-শান্তি সব গুলোকে মাফতে চাইল। কিন্তু আদৌ কি টাকা দিয়ে ভালোবাসা আর সুখ-শান্তিকে মাপা যায়? মাপা যায় না। আর তুই মাহবুবের সমস্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করেছিস, কিন্তু মাহবুবের অভাব পূরণ করতে পারিসনি। আবার মাঝে মাঝে ভাবি আমার ছেলেটা ভীষণ খারাপ।বাবা-মা কথা না ভেবে বিদেশে পড়ে রয়েছে।কখনো কখনো আবার ভাবি আমার ছেলে-মেয়েই সঠিক।তারা নিজের বাবার দায়িত্ব নিতে পারেনি বলে, তোরা আরেক বাবাকে খুঁজে পেয়েছিস। তোরা তোদের পরিবারের দায়িত্ব নিতে পেরেছিস। একটা কাজ পেয়েছিস। এটাই পৃথিবীর নিয়ম। পাখি ফল খায় আবার পায়খানাও করে। সেই পায়খানার মধ্যে কখনো আবার ফলের বীজ লুকিয়ে থাকে। সেই বীজ থেকে একটা নতুন গাছের জন্ম হয়। যে গাছে পাখি নিজে বাসা বানায়। তার খাদ্যের একমাত্র উৎস সেই গাছ। পাখি আর গাছের মতো আমার পরিবারেরও একটা গভীর সম্পর্ক রয়েছে। আমার ছেলেমেয়েদেরও আমাকে আর প্রয়োজন নেই। আমাকে ফেলে দিয়ে বিদেশে চলে গেছে। আর তুই আমার সেবা সুস্থতা করে তোর সংসার চালাচ্ছিস। বাড্ড অদ্ভুত এই পৃথিবীর নিয়ম! মাস্টারমশাই আর কিছু বলতে পারেননি। তিনি আবার কেঁদে ওঠেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। রঘু কাবেরীকে সবকিছু বলে নিজেই কেঁদে ফেলল। বলল,’আমি যদি জানতাম তিনি মারা যাবেন, তাহলে কখনই মাস্টারমশাইকে মিথ্যা কথা বলতাম না। এই একটা মিথ্যা যে আমাকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। আমাকে তিলে তিলে শেষ করে দেবে এই একটা মিথ্যা।’
বাবার মৃত্যুর খবর পাওয়া মাত্র ল্যাপটপ হাতে নিয়ে বসে মাহবুব। সমস্ত মিটিং,ট্যুর ক্যানসিল করে দেশে ফিরে আসতে তড়িঘড়ি শুরু করে। প্রায় এক ঘন্টা ধরে টিকিট খুঁজে হতাশা হয়। পাঁচ দিনের মধ্যে নিজের দেশে ফিরে আসার জন্য কোন টিকিট নেই। আপাতত ভাবে নিজের দেশে ফিরে আসার সম্ভাবনাই নেই। কানাডায় পাঁচ দিন ধরে পড়ে থাকতে হবে। বাবাকে শেষ দেখা দেখতে পাবে না। মাহবুব জোরে জোরে কেঁদে ওঠে। তার কান্নার শব্দ শুনে দুপুর ছুটে আসে। তাকে আশ্বস্ত করে। শান্ত হতে বলে। কিন্তু মাহবুব কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না। কান্নার বেগ বেড়ে চলছে। নিজেকে অপরাধী মনে করছে। জীবনে অনেক টাকা রোজগার করেছে। গাড়ি, বাড়ি, সম্মান,খ্যাতি, সুন্দরী স্ত্রী সবকিছুই রয়েছে। কোনো কিছুর অভাব নেই। তবুও আজ তার কান্না পাচ্ছে। কিছু একটা অভাব তাকে জ্বলে-পুড়ে মারছে। সব কিছুর বিনিময় কি বাবা মাকে কখনো মাপা সম্ভব? বাবা মা; বাবা-মাই হয়। কারো সঙ্গে কখনো তুলনা করা সম্ভব নয়। সেই দুজন প্রিয় মানুষের জীবনের শেষ মুহূর্ত তো দূরের কথা;মৃত্যুর পরে একবারও দেখতে পেল না। মা মারা যাওয়ার দু’বছর পর সে দেশে ফিরল। মাকে শেষ কবে দেখে ছিল ঠিক মনে নেই।আর বাবা মারা যাওয়ার পর বাবাকেও দেখতে পেল না। এরপরেও সে কি করে শান্তিতে থাকতে পারবে? নিজেকে সান্ত্বনা দেবে।তার বুকটা যে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। জীবনে যখন কোনো কাজে ব্যর্থ হত, যখন কেউ গালি দিত, যখন কিছু ভালো লাগতো না, তখন তো একমাত্র শান্তির ঠিকানা ছিল বাবা মায়ের কোল। বাবা মায়ের সান্ত্বনা। আজ সে সেগুলো হারিয়ে ফেলেছে। চাইলেও কখনো ফিরে পাবে না। জীবনে এর পর আর কোনো ব্যর্থতা আসবে না, তার গ্যারান্টি কি আছে?নেই! এরপর জীবনে ব্যর্থতা এলে সে কার কোলে মাথা রেখে ঘুমাবে?কে বা তাকে সান্ত্বনা দেবে? বাবা মা ছাড়া এই পৃথিবীতে আদৌ কি কেউ আপন আছে? মাহবুবের ছোটবেলায়,তার বাবা-মা তার সমস্ত আবদার পূরণ করেছে। নিজের জন্য পোশাক না কিনে দিনের-পর-দিন ছেঁড়া পোশাক পরে ছেলেমেয়েদেরকে ভালো পোশাক এনে দিয়েছেন। নিজের সুখ শান্তি বিসর্জন দিয়ে ছেলেমেয়েদেরকে বড় করেছেন। আর সে বড় হয়ে কি করলো? বাবা-মার শেষ ইচ্ছাটাই পূরণ করতে পরলো না। শেষ দেখাটাও হলো না।সে এতটা নিকৃষ্ট যে নিজের বাবা-মায়ের লাশ নিজের কাঁধে বয়ে বেড়াতে পারল না। অন্য কাউকে টাকার বিনিময় দায়িত্ব দিতে হলো। মাস্টারমশাই ঠিক কথাই বলতেন, তার ছেলে মেয়ের কাছে বৃদ্ধ বাবা-মা নয় টাকাটা বড়।
সূর্য পশ্চিম দিগন্তে। রঘু বাড়ির বারান্দায় মাস্টারমশাই যে চেয়ারে বসতেন সেটা ভালো করে পরিষ্কার করছে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসলে মনে হয়, সেখানে কোনো একজন মানুষ বসে আছে। এটা দীর্ঘ দিনের অভ্যাস। চেয়ার পরিষ্কার করতে করতে সে কান্না করে ফেলল। বড্ড কষ্ট হচ্ছে মানুষটাকে হারিয়ে ফেলে। কিন্তু মৃত্যুর পরেও মানুষটা তার যোগ্য সম্মান পেলেন না। হারিয়ে গেলেন নিজের সততার কাছে। তিনি যে সত্যিকারের একজন সৎ নিষ্ঠা মানুষ ছিলেন,সেটা কেউই বিশ্বাস করল না। তার মৃতদেহ সম্মান জানানোর জন্য স্কুলে নিয়ে যেতে দেয়নি। অনেক বাধা আসতে শুরু করে। আসলে,নিজের মানুষ গুলো তো বেইমান।নিজের কাছের মানুষগুলো যদি রুখে না দাঁড়ায়, তাহলে অন্য মানুষ রুখে দাঁড়িয়ে লাভ কি? মাস্টারমশাইয়ের ছেলে যদি আজ এখানে থাকতো,সে যদি সবার সামনে বুক উঁচু করে বলতো, তার বাবার মৃতদেহ স্কুলে নিয়ে যাওয়া হবে। তাহলে কেউ কি তার মুখের উপর কথা বলতে পারতো? সে যদি নিজের বাবাকে সব সময় আগলে রাখতো, সব সময় বাবার কাছে থাকতো, অন্যের বলা কটুক্তি কথার প্রতিবাদ করতো,তাহলে তারা কি কখনো সাহস পেত মাস্টারমশাইকে অসম্মান করার! কখনোই পেত না। যেখানে নিজের ছেলে-মেয়ে পর, সেখানে অন্যের দোষ দেওয়াটা নিতান্তই বৃথা।কোন বাচ্চা ছেলে অন্য কারোর সঙ্গে মারপিট করলে কিংবা ঝামেলা করলে প্রথমে তার বাবা-মা বাধা দেয়। দুজনকে বুঝিয়ে সুজিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে। প্রয়োজন হলে বিপরীত ছেলেটিকে ধমকায় তার বাবা-মাকে সবকিছু বলে দেবে বলে। তাইতো তারা দ্বিতীয়বার ঝামেলা করার সাহস পায় না। তেমনি একজন ছেলেরও কর্তব্য তার বাবা মা যখন বৃদ্ধ হবে। তাদেরকে কেউ গালি দিলে, তাদের ঘাড়ে মিথ্যা দোষ চাপিয়ে দিলে,ওই সমস্ত মানুষের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই একজন ছেলের কর্তব্য।সেটা মাহবুব কি কখনো করেছে? যদি করতো, তাহলে মাস্টারমশাই কখনো এতটা অসম্মানীতো হতেন না।
মাহবুবের পাঁচ দিনের মধ্যে দেশে ফেরা সম্ভব নয় এটা জানার পর গ্রামবাসীরা মিলে মাস্টারমশাইয়ের দাফন কাজ সম্পন্ন করেন। কাজের ব্যস্ততার জন্য ইয়াসমিন বিকেলে নিজের বাড়ি ফিরে যায়। রঘুকে কয়েকদিনের জন্য ওই বাড়িতে থাকতে বলে। তার ভীষণ ভয় করলেও সে মানিয়ে নেয়। এই বাড়ির সঙ্গে তার একটা সম্পর্ক রয়েছে।সেই সম্পর্কের নাম কি সে জানে না। এটাও জানে না, এই বাড়িতে হয়তো তার আজ শেষ দিন।এরপর এই বাড়ির দায়িত্ব অন্য কারোর হয়ে উঠবে। তাকে কাজ খুঁজতে হবে। তবুও শেষবারের মতো এই বাড়িতে থাকার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইল না।রাত বাড়তে শুরু করে। মাস্টারমশাই যে চেয়ারে বসতেন,তার পাশে একটা চেয়ার নিয়ে এসে বসলো রঘু। বারবার মাস্টারমশাইয়ের চেয়ারের দিকে খেয়াল করলো। মনে হচ্ছে সেই মানুষটা এখনো সেখানে বসে আছেন। বকবক করে কাকে যেন বকে যাচ্ছেন। দূর থেকে শিয়ালের ডাক কানে ভেসে আসছে। ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক তীব্র নিস্তব্ধতার বুক চিরে ভেসে আসছে। রাত যতই বাড়তে থাকে, নিস্তব্ধতার গভীরতা ততই বাড়তে থাকে। ভরা সংসারে আজ একটাও মানুষ নেই।এত বড় একটা ঘরে শুধুমাত্র একজন বসে রয়েছে। সে আবার পরের ঘরের ছেলে। পরের দিন তার ঠিকানা কোথায় হবে সে নিজেও জানে না। চারিদিকে শুধু শূন্য শূন্য লাগছে।
পর্ব ২৭ আসছে